ভোরের আলো ফুটতে না ফুটতেই জাওয়াদ তার ঘর থেকে বেরিয়ে এল। মনের আকুলতা তাকে টেনে নিয়ে যাচ্ছিল রান্নাঘরের দিকে। গুলনূরকে খুঁজতে খুঁজতে সে শেষ পর্যন্ত এসে থমকে দাঁড়াল রান্নাঘরের দরজায়।
রান্নাঘরের মেঝেতে কয়েকজন দাসী মশলা বাটা আর তরকারি কোটার কাজে ব্যস্ত ছিল। জমিদার-পুত্রের হঠাৎ আগমনে তারা চমকে উঠে তাড়াহুড়ো করে দাঁড়িয়ে কুর্নিশ জানাল। জাওয়াদের চোখ তখন স্থির, নিবদ্ধ একটাই দৃশ্যের দিকে।
উনুনের সামনে দাঁড়িয়ে গুলনূর তন্ময় হয়ে রান্না করছিল। তার কপালে জমে উঠেছে ঘামের বিন্দু। সকালের নরম রোদ এসে পড়েছে চোখেমুখে। নিজের ভাবনায় এতটাই মগ্ন ছিল যে, জাওয়াদের উপস্থিতি টেরই পায়নি। একজন দাসী হালকা ধাক্কা দিয়ে তাকে সচেতন করে তুলল। চমকে উঠে তাকিয়ে জাওয়াদকে দেখে সে তাড়াতাড়ি কুর্নিশ করল।
জাওয়াদ দাঁড়িয়ে ছিল শহুরে ঢঙে, প্যান্টের পকেটে দুহাত ঢুকিয়ে। তার পরনে সাদা সিল্কের শার্ট। রান্নাঘরের বাতাস ভারী হয়ে উঠেছিল নানান মশলার মিশ্র গন্ধে।
হঠাৎ করেই অন্য দাসীদের উপস্থিতির কথা মনে পড়ে গেল জাওয়াদের। একজন জমিদার-পুত্রের পক্ষে রান্নাঘরে এভাবে দাঁড়িয়ে থাকা কতটা অশোভন, সে কথা মনে পড়তেই সে নিজেকে সামলে নিল। তার কণ্ঠস্বর পাল্টে গেল, ফুটে উঠল কর্তৃত্বের সুর। "গুলনূর, আমার খাবার নিয়ে এসো," বলে সে চলে গেল।
দরজায় মৃদু কড়া নাড়ার শব্দে জাওয়াদ ধীরে ধীরে দরজার দিকে এগিয়ে গেল। দরজা খুলতেই তার চোখে পড়ল গুলনূরের নম্র মূর্তি। মেয়েটি নত মাথায় কুর্নিশ করল। জাওয়াদের চোখ আটকে গেল তার কপালের পাশের লম্বা দাগটার দিকে। ক্ষতচিহ্নটি যেন নীরব আর্তনাদের মতো! এতটুকু একটা মেয়ের জীবনে এত অসহায়তা, এত যন্ত্রণা!
অন্ধকারে পুরুষের উপস্থিতি গুলনূর নিতে পারে না, সারা শরীর থরথর করে কাঁপতে শুরু করে - মনে পড়তেই কোনো কথা না বলে জাওয়াদ দ্রুত পায়ে এগিয়ে গেল জানালাগুলোর দিকে। একটার পর একটা জানালা খুলে দিতে লাগল! সকালের সোনালি আলো এসে ভরে দেয় ঘরের প্রতিটি কোণ।
গুলনূর নীরবে থালাটি নামিয়ে রাখল টেবিলে, তারপর আবার একটি কুর্নিশ করে ফিরে যাওয়ার জন্য পা বাড়াল।
জাওয়াদের কণ্ঠ থেকে বেরিয়ে এল মৃদু অনুরোধ, "গুলনূর, একটু বসো।"
গুলনূর মাথা নত করে ধীরে ধীরে ঘরের এক কোণে মাদুরে বসল।
নরম রোদ এসে পড়েছে পিতলের থালায়। রূপার রেকাবিতে গরম গরম লুচি, আলুর দম, ছোলার ডাল। পাশে ছোট্ট বাটিতে নবনীত। আরেক বাটিতে মিষ্টি দই, উপরে গোলাপজল ছিটানো। একটি পিতলের গ্লাসে দুধের সর।
গুলনূর নিঃশব্দে মাদুরের কোণে বসে আছে, মাথা নত করে। তার চোখ মেঝের দিকে। জাওয়াদ প্রথম লুচিটি তুলে নিল। লুচির পাতলা চামড়ায় ঘিয়ের ঝিলিক। মুখে দিতেই সে অনুভব করল, কী অসাধারণ হাল্কা আর মোলায়েম।
"এমন লুচি আমি অনেকদিন খাইনি," জাওয়াদ বলল উচ্ছ্বসিত কণ্ঠে। গুলনূর নীরবে বসে রইল, তার চোখের পাতা কাঁপল একবার।
জাওয়াদ আলুর দম থেকে একটু তুলে নিল লুচির সাথে। আলুর টুকরোগুলো এমন নরম যে ছুঁলেই যেন ভেঙে যাবে। "আলুর দমটা চমৎকার হয়েছে।"
নবনীত মাখানো লুচি মুখে দিতে দিতে জাওয়াদ আবার বলল, "তোমার রান্নার হাত অসাধারণ।
গুলনূর অনড়, নিস্পন্দ। শুধু বুকের ভেতর থেকে একটা দীর্ঘশ্বাস বের হলো। জাওয়াদ লক্ষ্য করল, তার চোখের কোণে জমে উঠেছে জলের ভার। জাওয়াদ খাওয়াদাওয়া শেষ করে হঠাৎ ডাকল,
“গুলনূর," সে নিজের মনের গভীরে তলিয়ে গিয়ে বলতে লাগল, "আমার ভেতরে পাহাড়সম এক কষ্ট আছে। দুই বছর ধরে এই বোঝা বয়ে বেড়াচ্ছি। কাউকে বলতে পারিনি, বোঝাতেও পারিনি। হয়তো কেউ বোঝার মতো ছিল না। মাঝে মাঝে মনে হয়, এই পৃথিবীতে আমার জন্য কিছুই অবশিষ্ট নেই।"
গুলনূর নীরবে শুনছে।
জাওয়াদ আবার শুরু করল, "প্রতি রাতে একা ঘরে শুয়ে ভাবতাম, কেউ যদি পাশে থাকত। কেউ যদি মাথায় হাত বুলিয়ে দিত, জড়িয়ে ধরে বলত - তুমি একা নও। কিন্তু সেই 'কেউ' কখনো এল না।
গুলনূরের চোখে নেমে এল বিষাদের ছায়া। তার নিজের জীবনেরও তো এমন কতশত রাত গেছে, যখন একাকিত্বের যন্ত্রণা বুকে নিয়ে ঘুমোতে হয়েছে। জাওয়াদের কথাগুলো তার নিজের মনেরই প্রতিধ্বনি।
জাওয়াদ প্রশ্ন করল, "তোমারও কি কখনো এমন মনে হয়, গুলনূর? কেউ একটু মাথায় হাত বুলিয়ে দিক? হাতটা ধরে রাখুক? দুঃখের সঙ্গী হোক?"
জাওয়াদের কথাগুলো গুলনূরের হৃদয়ের গভীরতম কোণে লুকিয়ে থাকা ব্যথাগুলোকে ছুঁয়ে গেল। সে নীরবে মাথা নিচু করে রইল। তার চোখের ভাষায় ফুটে উঠল সেই একই বেদনা, সেই একই একাকিত্বের যন্ত্রণা যা জাওয়াদকেও গ্রাস করে রেখেছে।
জাওয়াদ উঠে এসে গুলনূরের সামনের ছোট চৌকিতে বসল। গুলনূর নিজেকে আরও গুটিয়ে নিল। জাওয়াদের বুকের ভেতর করুণার ঢেউ উথলে উঠছে। কী নিদারুণ একাকী এই মেয়েটি! কত গভীর তার অন্তরের ক্ষত! কতটা না ভেঙে পড়েছে সে ভেতরে ভেতরে!
ধীরে ধীরে, অতি সন্তর্পণে জাওয়াদ তার হাত তুলল। গুলনূরের মাথায় আলতো করে রাখল সেই হাত। আঙুলগুলো আস্তে আস্তে বুলিয়ে দিতে লাগল তার চুলে। গুলনূরের মুখে ফুটে উঠল অবাক বিস্ময়। তার চোখে জমে থাকা অশ্রু এবার মুক্ত হলো। সে প্রথমবারের মতো সরাসরি তাকাল জাওয়াদের দিকে।
জাওয়াদ তার মাথায় হাত বুলাতে বুলাতে মৃদু স্বরে বলল, "তুমি একা নও, গুলনূর। আমি আছি তোমার পাশে।"
গুলনূরের চোখের কোণ বেয়ে টপ টপ করে ঝরে পড়তে লাগল অশ্রু। তার বোবা কান্নার সাক্ষী হয়ে জাওয়াদ নীরবে বসে রইল তার পাশে। কোনো কথা না বলে, শুধু মমতায় ভরা হাতটা রেখে দিল তার মাথায়। এই মুহূর্তে তার স্পর্শই গুলনূরের একমাত্র ভরসা। আর গুলনূরের অশ্রুই তার নিজের ব্যথার প্রতিচ্ছবি।
দাসীর কথায় রাইহার বুকের ভেতর থেকে একটা অজানা আশঙ্কা উঠে এল। বড় বেগম তো কখনোই ডাকেন না তাকে! আজ কেন ডাকলেন? সেই যে প্রথম দিন থেকেই তার দিকে তাকিয়ে থাকত কুটিল দৃষ্টিতে। যার চোখে চোখ পড়লেই রাইহা মাথা নিচু করে পালিয়ে যেত। সেই মানুষটা তাকে হঠাৎ কেন ডাকবে?
ললিতার ঘরের দরজায় দাঁড়িয়ে রাইহার হৃৎপিণ্ড থেমে গেল। বিশাল পালঙ্কের উপর ছড়ানো রঙিন শাড়িগুলো দেখে তার চোখ কপালে! গাঢ় বেগুনি রঙের শাড়িটি জামরুল পাতার মতো ঝকঝক করছে, পাশেই সবুজ পান্নার মতো একটি শাড়ি, আর সিঁদুরের মতো লাল শাড়ি আগুনের শিখা হয়ে জ্বলজ্বল করছে।
"এদিকে এসো।" ললিতার কণ্ঠস্বরে মায়া। "এই শাড়িগুলো তোমার জন্যই।"
রাইহা যেন স্বপ্ন দেখছে। "আ-আমার জন্য?" তার কণ্ঠে বিস্ময় আর অবিশ্বাস।
ললিতা মৃদু হেসে এগিয়ে এলেন। "হ্যাঁ, তোমার জন্যই। তোমাকে শাড়িতে কেমন লাগে দেখি।"
রাইহা তখনো ঘোরে৷ সে লজ্জায় রাঙা হয়ে গেল।
"আমি তো শাড়ি পরতে জানি না।"
"আমি শিখিয়ে দেব। চলো, আগে এই বেগুনি শাড়িটা দিয়ে শুরু করি।"
ধীরে ধীরে ললিতা রাইহাকে সাজাতে লাগলেন। প্রথমে পেটিকোট, তারপর নরম সিল্কের ব্লাউজ। শাড়ির প্রতিটি কুঁচি তার আঙুলের স্পর্শে জীবন্ত হয়ে উঠল। রাইহা অবাক বিস্ময়ে দেখছিল কীভাবে ললিতার হাতের যাদুতে সাধারণ কাপড়ের টুকরো অপরূপ শিল্পকর্মে পরিণত হচ্ছে।
"এই যে, আঁচলটা এভাবে কাঁধে তুলে দাও।" ললিতা বললেন।
আয়নার সামনে দাঁড়িয়ে রাইহা নিজেকে চিনতেই পারল না। বেগুনি রঙের শাড়িতে তার সাদা ফর্সা গায়ের রং আরও ফুটে উঠেছে। ললিতা মুগ্ধ দৃষ্টিতে তাকিয়ে রইলেন। সেই প্রথম দিনের কথা মনে পড়ে গেল তার। কী ঘৃণাই না করেছিলেন এই মেয়েটিকে। কতবার ভেবেছিলেন মহল থেকে বের করে দেবেন। কিন্তু আজ? আজ তিনি নিজের হাতে সাজিয়ে দিচ্ছেন তাকে।
"আরেকটা পরবে?" ললিতা লাল শাড়িটা তুলে ধরলেন। "এই লাল রঙটা তোমার গায়ে খুব মানাবে।"
রাইহার চোখে মুখে শিশুর মতো আনন্দ, "পরব।" সে উত্তর দিল।
ললিতা ধৈর্য্য ধরে শেখাল রাইহাকে কীভাবে শাড়ি পরতে হয়। কুঁচি করা থেকে শুরু করে আঁচল কাঁধে ফেলা সবই। শুধু তাই নয়, সেই সঙ্গে শেখাল বাঙালি মেয়েদের আদব-কায়দাও।
রাইহা মন দিয়ে শিখছিল। প্রতিটি ভঙ্গি, প্রতিটি আদব। তার মনে হচ্ছিল, সে নতুন করে জন্ম নিচ্ছে। তার চোখে জল এসে গেল। ললিতার দিকে তাকিয়ে বলল, "আপনি ভীষণ ভালো।"
রাইহা যখন ঘর থেকে বেরিয়ে যাচ্ছিল, তখন হঠাৎ সুফিয়ান সাহেবের সঙ্গে মুখোমুখি হলো। লাল শাড়িতে সেজেগুজে থাকা অবস্থায় রাইহা প্রথমে একটু থতমত খেয়ে গেল। তারপর সামলে নিয়ে দ্রুত কুর্নিশ করল। মাথা নিচু করে, ডান হাত বুকের কাছে রেখে, বাঁ পা পিছনে সরিয়ে। ঠিক যেভাবে ললিতা শিখিয়েছিল।
সুফিয়ান অবাক হয়ে তাকিয়ে রইলেন। বিলেত থেকে ফেরা এই মেয়েটি, যাকে তিনি প্রথম দেখেছিলেন ইংরেজি পোশাকে, আজ শাড়িতে অন্য কেউ। এমন সভ্য, শালীন ভঙ্গিতে কুর্নিশ করা - এ অন্য এক রাইহা।
রাইহা চলে যাওয়ার পর সুফিয়ান ললিতার ঘরে ঢুকলেন। দেখলেন, তার স্ত্রী আয়নার সামনে দাঁড়িয়ে নিজের কালো, ঘন চুলে চিরুনি বুলাচ্ছেন। স্বামীকে দেখে ললিতার ঠোঁটের কোণে একটি চতুর হাসি ফুটে উঠল।
"দেখলেন?" ললিতা মৃদু স্বরে জিজ্ঞেস করলেন। চিরুনি চালাতে চালাতেই বললেন, "কেমন মানিয়েছে শাড়িটা ওকে? আমার তো মনে হচ্ছিল, জন্ম থেকেই শাড়ি পরে আছে।"
সুফিয়ান ধীরে ধীরে মখমলের চেয়ারে বসলেন। তার মুখে চিন্তার ছায়া। "হুম," বললেন তিনি। একটু থেমে আবার বললেন, "তুমি ভালো কাজই করেছ ওকে শাড়ি পরিয়ে। এই বাড়িতে থাকতে হলে আমাদের রীতিনীতি মেনে চলতে হবে।"
ললিতা চিরুনি নামিয়ে রেখে স্বামীর দিকে ফিরলেন, "আমার মনে হয়, ও এখন অনেকটাই বদলেছে। আমাদের রীতিনীতি, আচার-ব্যবহার শিখছে। শাড়ি পরাটাও শিখে নিল অল্প সময়ে।"
ললিতা একটু থামলেন। সাহস সঞ্চয় করে শেষে বললেন, "জাওয়াদের সঙ্গে ওর বিয়ে দিলে কেমন হয়?"
সুফিয়ান চেয়ারে আরও গভীরভাবে হেলান দিয়ে বসলেন।
"আমি সেটাই ভাবছিলাম। একটা মেয়েকে এভাবে তো থাকতে দিতে পারি না।" ধীর, গম্ভীর কণ্ঠে বললেন। "একটা জমিদার বংশের উত্তরাধিকারীর বিয়েও সামান্য ব্যাপার নয়। তাই আমি খোঁজখবর নেওয়ার জন্য লোক পাঠিয়েছি।"
ললিতার বুক ধক করে উঠল। তিনি জানতেন না যে স্বামী এতদূর এগিয়েছেন।
সুফিয়ান বললেন, "যা যা শুনেছি, সব সত্যি হলে বিয়ের সিদ্ধান্ত নেয়া যায়। তবে তার আগে..." তিনি ললিতার দিকে তাকালেন। "তুমি আরও কিছুদিন ওকে দেখো। আমাদের সংস্কৃতি, সংস্কার - এসব শেখাতে পারো কিনা। এ বাড়ির বউ হওয়া সহজ নয়। শুধু রূপ আর শিক্ষা যথেষ্ট নয়, চাই আমাদের ঐতিহ্যের প্রতি শ্রদ্ধা, বোঝাপড়া।"
ললিতার চোখ করুণায় ভরে গেল। রাইহার সরলতা আর রূপ দুটোই তাকে মুগ্ধ করেছে। কিন্তু তার চেয়েও বেশি করেছে মেয়েটির শেখার আগ্রহ, নিজেকে বদলে নেওয়ার চেষ্টা।
"আমি শেখাব," ললিতা দৃঢ়তার সঙ্গে বললেন। "সব শিখিয়ে দেব।"
সুফিয়ান উঠে দাঁড়ালেন, "আপাতত এ নিয়ে আর কারও সঙ্গে কথা বলো না। সময় হলে আমি নিজেই জাওয়াদের সঙ্গে কথা বলব।"
রাতের নীরবতা ভেঙে হঠাৎ ঘোড়ার ক্ষুরের আওয়াজে চমকে উঠল দারোয়ান। বাড়ির প্রধান ফটকের সামনে দাঁড়িয়ে সে অন্ধকারের মধ্যে চোখ পাকিয়ে দেখার চেষ্টা করল।
"কে আসছে এত রাতে?"
ঘোড়ার গাড়ি থেমে যেতেই চিনতে পারল আগন্তুককে। "হুজুর! আপনি!" বিস্ময়ে তার চোখ বড় বড় হয়ে গেল। তড়িঘড়ি করে ফটক খুলে দিয়ে সম্মানের সঙ্গে কুর্নিশ করল।
দোতলার বারান্দায় তখন দাঁড়িয়েছিলেন সুফিয়ান আর তার স্ত্রী ললিতা। রাতের নিস্তব্ধতায় গাড়ির শব্দটা স্পষ্ট ভেসে এল ললিতার কানে। মৃদু স্বরে স্বামীর দিকে ফিরে বললেন, "শুনছেন? মনে হচ্ছে কেউ এসেছে।"
সুফিয়ান বারান্দার রেলিং ধরে ঝুঁকে দেখলেন। অন্ধকারেও চিনতে পারলেন - শব্দর!
সিঁড়ি বেয়ে উপরে উঠে আসতেই সুফিয়ান এগিয়ে গেলেন। "এ কী আশ্চর্য! তুমি তো বলেছিলে চার দিন পরে আসবে। হঠাৎ করে..."
কথা শেষ হওয়ার আগেই শব্দর সুফিয়ানকে জড়িয়ে ধরল। তার কণ্ঠে আবেগের ছোঁয়া, "ভাইজান! আর থাকতে পারলাম না। মন কেমন করছিল।"
সুফিয়ানের তীক্ষ্ণ দৃষ্টি শব্দরের মুখের উপর। "ব্যবসার খবর কী?"
"সব ঠিক আছে," - সংক্ষিপ্ত উত্তর।
ললিতা এগিয়ে এলেন, "এত রাতে এসেছ। হাত-মুখ ধুয়ে এসো, খাবার দিতে বলি।"
"না ভাবি, এখন না।" শব্দরের গলায় অস্থিরতা।
সুফিয়ান লক্ষ্য করলেন শব্দরের বাহ্যিক পরিবর্তন। তার কানের পাশে, কপালের ধারে কয়েকটা রূপালি চুল ছিল! আজ সেই চুলগুলো কালো। পোশাক-আশাকে অস্বাভাবিক পরিপাটি ভাব।
ঘটনাটি বুঝতে অসুবিধা হলো না তার। তিনি কর্তৃত্বের সুরে বললেন, "যাও, এখন বিশ্রাম নাও। কাল সকালে আমার সঙ্গে দেখা করবে।"
শব্দরের চোখে জ্বলে উঠল কৃতজ্ঞতার আলো। এতক্ষণ এই কথাটাই শোনার জন্য অপেক্ষা করছিল সে। আর কোনো কথা না বলে, প্রায় দৌড়ে সিঁড়ি বেয়ে উপরে উঠে গেল।
সুফিয়ান দাঁড়িয়ে রইলেন। তার ঠোঁটের কোণে স্নেহমাখা হাসি। জীবনের এই প্রান্তে এসে শব্দর খুঁজে পেয়েছে তার হৃদয়ের উষ্ণতা। যে মানুষটা শুধু টাকা-পয়সা, ব্যবসা-বাণিজ্য নিয়েই মেতে থাকত, আজ তার চোখে-মুখে প্রেমের আভা।
মানুষের জীবনে প্রেম আসে নানা বয়সে। কেউ খুঁজে পায় যৌবনের উন্মাদনায়, কেউ বা প্রৌঢ়ত্বের প্রজ্ঞায়। কিন্তু যখনই আসুক, প্রেম মানুষকে করে তোলে নতুন। নতুন করে বাঁচার স্বপ্ন দেখায়। আজ শব্দরের মধ্যেও সেই নবজন্মের স্পর্শ। তার প্রতিটি পদক্ষেপে যৌবনের চাঞ্চল্য, প্রতিটি কথায় প্রেমের অধীরতা।
শব্দর দ্রুত পায়ে এগিয়ে চলল জুলফার ঘরের দিকে। তার পা নিজের থেকেই চলছে, মনের টানে। বুকের ভেতর ধুকপুক করছে। এতদিন পর জুলফার সঙ্গে দেখা হবে! মনের ভেতর হাজারো কথা ভিড় করে আসছে, কিন্তু কোনটা যে প্রথমে বলবে, কী করবে, কিছুই ঠিক করতে পারছে না। শুধু অন্তরের অদম্য টানে ছুটে এসেছে।
জুলফার ঘরের দরজার সামনে এসে থমকে দাঁড়াল। একবার নিজের পোশাক ঠিক করল। আয়নার সামনে দাঁড়িয়ে যেভাবে কেউ নিজেকে সাজায়, তেমনি করে জামার ভাঁজ ঠিক করল। তারপর আস্তে করে, ভীরু কিশোরের মতো, দরজায় টোকা দিল।
"কে?" - ভেতর থেকে জুলফার সেই চেনা কণ্ঠস্বর ভেসে এল।
সেই স্বর শুনে শব্দরের বুকের ভেতর ঝড় উঠল। কত দিন এই স্বরের জন্য তার বুক হাহাকার করেছে! "আমি..."
দরজা খুলতেই শব্দর আর নিজেকে সামলাতে পারল না। বহুদিনের বিরহ-ব্যথা এক মুহূর্তে উথলে উঠল। জুলফাকে জড়িয়ে ধরল। তার মুখে, গালে, কপালে, চুলে পাগলের মতো চুমু দিতে লাগল।
"জুলফা, আমার জুলফা!" কণ্ঠে প্রেমাতুর আবেগ। "তোমাকে খুব মনে পড়েছে। দূরে গেলে তবেই বোঝা যায়, প্রতিদিন কীভাবে তোমার প্রেমে আমি আরও গভীরভাবে ডুবে যাচ্ছি!"
জুলফা প্রথমে বিরক্তিতে শব্দরকে সরিয়ে দিতে চাইল। "কী করছেন? ছাড়ুন আমাকে!" কিন্তু পরক্ষণেই তার হাত থমকে গেল। চোখ পড়ল শব্দরের দিকে।
শব্দরের এলোমেলো চুল কপালে ছড়িয়ে পড়েছে। সেই চুল আজ আর রূপালি নয়, কালো, ঝকঝকে। বয়সের ছাপ তার চেহারায় একটা পরিণত পুরুষের আকর্ষণ এনেছে। চোখে-মুখে কিশোর সুলভ প্রেমাতুরতা।
"আপনি... আপনার চুল..." জুলফার কথা আটকে গেল।
"পছন্দ হয়নি?" শব্দর জুলফার চোখের দিকে তাকিয়ে জিজ্ঞেস করল। "তোমার জন্যই তো সব! তুমিই তো বলেছিলে, আমার রূপালি চুল দেখলে মনে হয় আমি বুড়ো হয়ে যাচ্ছি? দেখো, আজ আমি তোমার জন্য আবার যৌবনে ফিরে এসেছি।"
জুলফা বিস্ময়ে হতবাক হয়ে তাকিয়ে রইল। কোনোমতে বলল, "আপনি পাগল!"
শব্দর জুলফার চুল আলতো করে কানের পেছনে গুঁজে দিয়ে মৃদু স্বরে জিজ্ঞেস করল, "আমার অনুপস্থিতি কি তোমাকে কষ্ট দিয়েছে?"
জুলফা মুখ তুলে তাকাল। একটা অপরাধবোধ তার মনে চিড় কাটল। সত্যি বলতে, সে তো শব্দরকে তেমন মনেই করেনি। বরং নাভেদের সান্নিধ্যে সে বেশ সুখেই ছিল।
"জানো জুলফা," শব্দর আবেগে বলে চলল, "শহরে থাকার প্রতিটি মুহূর্তে শুধু তোমার কথাই ভেবেছি। রাতে ঘুম আসেনি। খাবার টেবিলে বসে তোমার হাতের রান্নার স্বাদ মনে পড়েছে। রাস্তায় হাঁটতে গিয়ে মনে হয়েছে, তুমি পাশে থাকলে কত ভালো হত!"
বাইরে থেকে পায়ের শব্দ ভেসে এল। শব্দর তৎক্ষণাৎ জুলফার কাছ থেকে সরে দাঁড়াল। মনির এসেছে, হাতে ব্যাগপত্র।
মনির চলে যাওয়ার পর শব্দর দ্রুত ব্যাগের জিপার খুলল। তার হাত কাঁপছে উত্তেজনায়। মনে হচ্ছিল যেন কোনো ছোট ছেলে তার প্রিয় মানুষটির জন্য আনা উপহার দেখাতে উদগ্রীব।
"জুলফা, দেখো!" - তার কণ্ঠে আনন্দের ঢেউ। "তোমার জন্য কী এনেছি!" প্রথমে বের করল একটি রেশমি শাড়ি। গাঢ় নীল রঙের উপর রূপালি জরির কাজ। আলোয় ঝিলিক দিচ্ছে।
"এটা কিনেছি যখন প্রথম শহরে গিয়েছিলাম। দোকানে ঢুকেই এটা চোখে পড়ল। ভাবলাম, এই নীল রঙটা তোমার গায়ের রঙের সঙ্গে কী সুন্দর মানাবে!" শব্দর শাড়িটা জুলফার সামনে মেলে ধরল।
তারপর একে একে বের করতে লাগল আরও উপহার। একটি চাঁদবালি এগিয়ে দিয়ে বলল, "এটা দেখলাম আর ভাবলাম, তোমার কানে এটা দুলবে যখন, মনে হবে আকাশের চাঁদ নেমে এসেছে।"
সবশেষে বের করল একটি ছোট্ট প্যাকেট।
"এটা কিন্তু সবচেয়ে বিশেষ!" তার চোখে উজ্জ্বল হাসি। প্যাকেট খুলতেই বেরিয়ে এল একটি সূক্ষ্ম হার। মাঝখানে একটি নীলা পাথর।
"জানো, এটা কেনার দিন সারাটা রাত ঘুমাইনি। ভাবছিলাম, তুমি এটা পরলে কেমন লাগবে। তোমার গলায় এই হার, আর চাঁদের আলোয় এই নীলা পাথর... মনে হবে আকাশের তারা এসে তোমার গলায় ঝুলে পড়েছে।"
জুলফা নির্বাক হয়ে দেখছিল।
"এসো, হারটা তোমার গলায় পরিয়ে দিই।"
শব্দর আবেগভরে এগিয়ে এল। জুলফা মাথা নিচু করে দাঁড়াল। হারের চেইনটা খুলতে গিয়ে শব্দরের দৃষ্টি আটকে গেল জুলফার কানে।
প্লাটিনামের তৈরি নতুন একজোড়া দুল। হীরের কুচি বসানো। আলোয় ঝিকমিক করছে। শব্দরের হাত থমকে গেল। বুকের ভেতর কী একটা খচ করে উঠল। এত দামি দুল! সে তো কেনেনি। এ বাড়িতে এ ধরনের দামি গহনা ছিল না! তাছাড়া জমিদার বাড়ির অন্য কেউ তো জুলফাকে এমন দামি উপহার দিবে না।
"এই দুল..." শব্দরের গলা কেঁপে উঠল। "কোথায় পেলে?"
জুলফার মুখ সাদা হয়ে গেল। হঠাৎ করে যেন ঘরের তাপমাত্রা কমে গেল। সে তড়িঘড়ি হাত দিয়ে কানের দুল ঢেকে ফেলল।
"ও... ও কিছু না।"
"কিছু না মানে? এত দামি দুল! কে দিয়েছে তোমাকে?"
.
.
.
চলবে............................................