ব্যাপারটায় স্পষ্ট কিছু জড়িয়ে আছে। যা ফাঁকা চোখে ধরা দিতে চাচ্ছে না। বারবার বুঝতে গিয়ে শত পা পিছিয়ে যাচ্ছে শোয়েব, অথচ কোনোকিছুই তার স্বাভাবিক মনে হচ্ছে না। একটা ভ্রমণপিপাসু দল, যারা প্রকৃতি নির্যাসে মগ্ন; অথচ তাদের উপরই কিনা মারাত্মক পর্যায়ে অঘটনটা ঘটল! এটা বাস্তবিক অর্থে হবারই কথা নয়। এরকমটা কেন হবে? কী কারণ? শত শত পর্যটক তার চোখের সম্মুখে অবাধ মনে ঘুরে বেড়াচ্ছে। তাদের নিরাপত্তা নিয়ে সর্বোচ্চ সতর্ক অবস্থানেও রয়েছে। প্রতিটি চেকপোস্টে বিভিন্ন বাহিনী সহ বনবিভাগের কিছু আউট সেক্টরও সক্রিয়ভাবে ব্যস্ত। তবে এমন ধরণের ঘটনা কীভাবে ঘটে? এরা কী কোনোভাবে ছদ্ম পরিচয় ধারণ করে আছে? সবচেয়ে আশ্চর্যজনক ব্যাপার হচ্ছে, ওই সাধারণ দলটার ভেতর সন্দেহজনক কিছুই পায়নি রাফানরা। সবকিছু পর্যবেক্ষণ করে একটা পজিটিভ রিপোর্টই দিয়েছে ওরা। তবে রাফানের ভাষ্যমতে কিছু ছেঁড়া ছেঁড়া সংযোগ খুঁজে পেলেও সেটি খতিয়ে দেখার জন্য জানিয়ে দিয়েছে শোয়েব। এরপরও তার এলাকায় যদি বীভৎস কিছুর আর্বিভাব ঘটে, তবে সেটি গোঁড়া থেকে উপড়ে ফেলতে সদা তৎপর। স্টিলের গোল চকচকে থালায় ধপ করে তিন ইঞ্চি পুরু বিফ স্টেকটি রাখল শোয়েব। একবুক ভারি শ্বাস ফেলে নিজের ভরাট, প্রস্তর, অনুভূতিহীন গলায় ডেকে উঠল,
- রেঞ্জার, স্কিডলাই এটা বিস্ত্রো। ব্যাকইয়ার্ড!
তার নির্ভার নিঃশঙ্ক কণ্ঠের শেষ বর্ণটুকু মাটিতে পরতে পারেনি। তার আগেই অনতিদূরে প্রবল সচকিত শব্দে ঝোঁপঝাড় কেঁপে উঠল! ভয়াল আগ্রাসী রূপে প্রচণ্ড ব্যগ্রগতিতে ছুটে আসছে কিছু। সমস্ত গা রোমশ বাদামি, পায়ে হিংস্রসুলভ বাঘের গতি, নিঃস্তব্ধ বাতাসের তাল কেটে শাঁই শাঁই শব্দে ভয়ংকরভাবে হুংকার ছুঁড়ছে! চারপাশ হিংস্র দানবীয় হুংকারে গমগম করে উঠলে অকস্মাৎ ঝাঁপিয়ে পরল ওটা! অসম্ভব ভারি ওই জানোয়ারকে দুহাতে বাহুবদ্ধ করল শোয়েব। কালো বুটের রিফ্লেক্সে পিছনে উলটে পড়া থেকে নিজেকে চতুরভাবে সামলে নিল। জান্তব ওই হিংস্র জানোয়ার মালিকের বুকে এইটুকু কুকুরের মতো আবদ্ধ হয়ে রইল। যেমনটা সে ছোট্ট বয়সে ওস্তাদের কোলজুড়ে আবদ্ধ হয়ে থাকতো। মাথায়, কানে, সমস্ত রোমশ দেহে আদুরে স্পর্শ অনুভব করল সে। 'রেঞ্জার' খ্যাত অতি ধূর্ত প্রজাতির এক জার্মান শেফার্ড শোয়েবের আতিশয্যে কুঁই কুঁই করতে লাগল। গলায় বেঁধে দেওয়া বেল্টটা মুক্ত করে হাস্য স্নেহাত্মক কণ্ঠে বলল প্রভু,
- কেমন আছিস?
তখনো মনুষ্য গায়ে রোমশ দেহটা আবদ্ধ রেখেছে রেঞ্জার। যেন সে চার পেয়ে কুকুর নয়, একটি অনুভূতিসম্পণ্ণ জীব। ঘেঁউ ঘেঁউ করে দুবার কী যেন বোবা অর্থ বুঝিয়ে কিছুটা সুস্থির হলো। যেন মালিকের কাছে ঘোর মেজাজের সুরে বলছে, 'এখানে জঘণ্য ঘুম হচ্ছে! এক মুহুর্তও এখানে থাকতে রাজি নই। আমায় তুমি বাংলোয় নিয়ে চলো'। পরক্ষণে নিজের চিরচেনা থালায় সুস্বাদু স্টেক দেখে রাগটা বোধহয় পানি হয়ে গেল। একহাত জিভটা বের করে ঝটিতি সেটা খাওয়ার জন্য নেমে গেল রেঞ্জার। থালাটা ওর দিকে ঠেলে দিতেই রোমশ মাথায় হাত রাখল শোয়েব,
- আজ আমার সঙ্গে যাবি। এখানে আজ থাকতে হবে না। কর্ণেলকে ইনফর্ম করে এসেছি। বুঝতে পারছি তোর এখানে মন টিকছে না।
প্রত্যুত্তরে খাওয়া থামিয়ে মুখ তুলে তাকায় রেঞ্জার। কালো দুচোখে মালিকের চিন্তাগ্রস্ত মুখটা দেখে। মালিকের নীল চকচকে চোখদুটো আজ অন্যমনষ্ক, বিভ্রম। আপাতদৃষ্টিতে বুঝতে পারে তার দীর্ঘদিনের মানব-প্রভুটি সহজে চিন্তিত হয় না। বরং তার সহজাত ইন্দ্রিয় চরম খারাপ পরিস্থিতিতেও অসম্ভব রকম স্থির। তার সিদ্ধান্ত নেবার গুণটি অত্যন্ত চতুরাত্মক ক্ষিপ্র! সেকেণ্ডের ভেতর সিদ্ধান্ত যেন নেওয়া শেষ। তাহলে কিছু ঘটেছে নির্ঘাত! আবারো খাওয়ায় মনোযোগ ছুঁড়লে সবুজ ব্রকলির টুকরোগুলো স্টেকের পাশে দিল শোয়েব। সেই দুর্লভ চিন্তার গুণটি স্বতঃর্স্ফূত প্রকাশ করে বলল,
- রেঞ্জার, সমস্যাটা বেগতিক পর্যায়ে যাচ্ছে। আমার পক্ষে এটা বোঝা সম্ভব হচ্ছে না। ঘটনাটা নতুন এবং উদ্ভট। এরকম অভিজ্ঞতার মুখোমুখী এখনো হইনি। তোর কী মনে হয় ওই দলটা প্রচণ্ড ভয়ংকর?
কথাটা শেষ করার পূর্বেই আর্তকণ্ঠে কে যেন শিউরে উঠল,
- কী হয়েছে!
সেকেণ্ডের ভেতর অজানা কারোর উপস্থিতিতে সতর্ক হলো শোয়েব। মুখের অপ্রতিভ ভাব সঙ্গে সঙ্গে মুছে নিয়ে শান্ত চেহারা এঁটে পিছু ঘুরে চাইল। চোখ বিস্ফোরিত করে মুখ হাঁ করে দাঁড়িয়ে আছে ইলহাম। ওর পায়ে কাছে পড়ে গেছে কুড়িয়ে আনা কাঠগোলাপ ফুল। নিশ্চয়ই মেয়েটা আধা কথায় ভয় পেয়েছে। দ্রুত পরিস্থিতি স্বাভাবিক করতে শোয়েব কিছু বলবে, তার আগেই ফুলগুলোকে জুতোর নীচে মাড়িতে এগিয়ে আসে ইলহাম,
- কীসের কথা বলা হচ্ছে? আপনি রেঞ্জারকে কী নিয়ে বলছেন অফিসার?
হাঁটু গেড়ে বসা শোয়েব তেমনি স্থিরভাবে বসে রইল। ঘাসের উপর থেকে উঠল না। বরং মেজাজটা এখন খারাপ হচ্ছে এভাবে চুপিচুপি কথা শোনাটা দেখে। মেয়েটা তার বয়সের তুলনায় অতি ছোটো। তবে বোধ বিবেচনার বয়স তার হয়েছে। স্নাতক চতুর্থ বর্ষের পরীক্ষা দিয়ে এখন ফলাফলের জন্য প্রহর গুণছে। অথচ, কখন কোথায় সঠিক লেহাজটুকু রাখতে হয়, সে ব্যাপারে যেন ইচ্ছে করে বে-লাগাম। ইলহাম বুঝতে পেরেছে মানুষটা তার উপর ব্যাপক চটে আছে। কণ্ঠে কোমল একটা ভাব ফুটিয়ে আরো একবার প্রশ্ন ছুঁড়ে দিল,
- ওর সঙ্গে কাদের নিয়ে কথা বলছেন? কারা এখানে ভয়ংকর?
শোয়েব ঠিক জানে না কতটুকু শুনেছে এই মেয়ে। তবু চেহারার ভাবভঙ্গি লক্ষ করে বেশ সাবধানে উত্তরটা রাখল,
- মেবি ইয়্যু আর স্টেপিং আউট অফ ইয়্যুর সাবজেক্ট ইলহাম। এসব তোমার বিবেচনার বিষয় না। এখানে তুমি কী করছ জানতে পারি?
মুখের উপর সোজাসুজি প্রশ্ন আসতেই ভীষণভাবে ঘাবড়ে গেল ইলহাম। লোকটার কথা বলার আড়ালে কেমন হাড় হিম করা অদ্ভুত ব্যাপার আছে। হুমকি, ধামকি, হংকার না দিলেও ওই হিম-জমাট করা কণ্ঠই যেন ভয়াবহ। ইলহাম গড়পড়তা বাদ দিয়ে সংকোচ ঝেড়ে বলল,
- আপনি আজ এখানে ইনভাইটেড অফিসার। বাবা আপনাকে চায়ের জন্য ভেতরে যেতে বলেছে। কিন্তু আপনি ওর সাথে ওসব কী নিয়ে বলছেন? কাদের নিয়ে ঠিক কথাগুলো?
প্রশ্নের উপর প্রশ্ন দেখে ভীষণ রকম চুপ রইল শোয়েব। কথা বলার ক্ষেত্রে খুব সাবধানে শব্দ নির্বাচন করে বলল,
- বিশেষ কিছু নয়। আমার মনে হয় তুমি আমার পেশাগত কাজে কাউন্টার রাখছ। আমি এটা উপরমহল ব্যতিত আর কারো কাছে দেওয়াটা পছন্দ করি না। ইলহাম, তুমি আমাকে একটা উপকার করতে পারো। যদি তোমার সমস্যা ফিল না হয়। করবে?
ঠিক ক'হাত দূরত্বে বসে আছে ওই শান্ত চেহারার সুপুরুষটা। বসেও আছে নিজের হাঁটু গেঁড়ে ভীষণ অদ্ভুত সুন্দর ভঙ্গিতে। গলায় ঢোক গিলে মনে মনে ওই বসার ভঙ্গিটা কল্পনায় ভেবে নিতেই নিঃশ্বাস বন্ধ হয়ে এল ওর! যদি কোনো মেয়ের সমুখে ওভাবে বসে তিনি প্রস্তাব রাখেন, তবে কী সেই মেয়েটি সৌভাগ্যের চূড়ান্ত হবে না? ওই চোয়ালের দৃঢ়তায় হাত, চোখের নীল-সমুদ্রে চোখ, ঠোঁটের পুরুষ্টুতায় ওষ্ঠযুগল রেখে কী শীতোষ্ণতায় কাঁপবে না? হঠাৎ চিন্তার বুননে কাচি বসিয়ে ঘেঁউ করে উঠল রেঞ্জার। দাঁতে দাঁত পিষে ঘড়্ ঘড়্ হিংস্র আওয়াজে তাকিয়ে আছে সে, যেন ইলহামের ওই লাজহীন দৃষ্টির ধারাভাষ্য ভালোই বুঝতে পেরেছে। অবস্থা বেগতিক বুঝে চট করে রেঞ্জারের গলায় বেল্ট বাঁধল শোয়েব। ওর মুখটা নিজের দিকে ঘুরিয়ে খরদৃষ্টিতে বলে উঠল,
- স্টোই রেঞ্জার। আমাকে বাড়ি ফিরতে হবে। এরকম করলে তোকে ফেলে যাব! খাওয়া শেষ কর।
একপলক মাসুম দৃষ্টিতে তাকিয়ে পুনরায় থালার দিকে মুখ নামাল রেঞ্জার। নামানো পূর্বে ইলহামের দিকে দৃষ্টি বুলাতে সুযোগ ছাড়ল না সে। ওই কুকুরের চোখে চোখ রেখে শিউরে উঠল ইলহাম, কিন্তু পরক্ষণে শোয়েবের চাহনি বুঝে তড়িঘড়ি নিজেকে সামলে নিল। শুকনো খড়খড়ে গলায় সৌজন্যতা ঢেলে শান্তসুরে বলল,
- কী করতে হবে বলুন। আমি কাজটা করে দিচ্ছি অফিসার।
ইলহামের হাসি মাখামাখি মুখটা অন্ধকার বানিয়ে গাঢ়স্বরে বলে উঠল শোয়েব,
- আমি রেঞ্জারকে এখান থেকে নিয়ে যাচ্ছি। ও এখানে থাকতে চাচ্ছে না। তুমি গুলজার স্যারকে জানিয়ে দিয়ো আমি রাতে এসে নিমন্ত্রণ গ্রহণ করব।
কথাটা শোনার পর অমাবস্যার রাত্রির ঘোর কালো অন্ধকার ইরার মুখে জমল। হেলিপ্যাড থেকে ওদের এই বাড়ির পেছনদিক বেশ ভালোভাবে দেখা যায়, এখানেই মানুষটার প্রিয় কুকুর রেঞ্জারকে থাকতে দেওয়া হয়। পরিবেশ বিষয়ক সেমিনারে দু সপ্তাহের জন্য দেশের বাইরে যেতে হয় শোয়েবের। ফলে গুলজার আজিজের সৌজন্যতায় প্রিয় কুকুর রেঞ্জারকে এখানে রেখে যায় সে। যেদিন থেকে শুনেছে বন কর্মকর্তা তাদের বাড়িতে যাতায়াত করছে, সেদিন থেকেই সব গোছগাছ করে হোস্টেল থেকে চলে আসে ইরা। বলা বাহুল্য, ঢাকার স্বনামধন্য বি ইউ পি তথা বাংলাদেশ ইউনিভার্সিটি অফ প্রোফেশনালস্ থেকে স্নাতক পড়াটা শেষ করেছে। এখন অপেক্ষা করছে ফলাফল প্রকাশের জন্য। বাবা আর্মি থেকে রিটায়ার্ড নেবার পর একদিন আসে বাবার শেষ কর্মস্থলে। এখানে এসেই বুঝতে পারে জায়গাটা ঢাকার মতো সহজলভ্য নয়। ভীষণ কঠিন এখানকার জনজীবন, আরো কঠিন এখানকার দারিদ্রতার ছাপ। তবে প্রাকৃতিক সৌন্দর্য এখানে এমনভাবে জড়িয়ে আছে যে, একবার কোনো প্রকৃতিপ্রেমী, বন-মুগ্ধ ব্যক্তি, পাহাড়-পাগল কেউ এখানে এলে আর কক্ষনো নিজেকে শহরে ফেরাতে পারবে না। শহরের কৃত্রিম সৌন্দর্যে মন ভুলানোও যাবে না। বরঞ্চ, এখানে রয়েছে শান্তি . . শান্তি . . শান্তির ঘোর। সেই ঘোর লাগা এক কুয়াশার মাঝে হঠাৎই দেখা দেয় শোয়েব ফারশাদ। আজও মনে আছে সেই ঘোর লাগা দিনক্ষণ। শীতের কুয়াশায় বন বনানী মুড়ে আছে। আকাশে তখনো সূর্য উঠেনি। কুয়াশার ঠাণ্ডা কনকনে আবহাওয়ার ভেতর ঘুম ঘুম চোখে বাড়ির ড্রয়িংরুমে এসেছিল। হঠাৎই ড্রয়িং রুমের সোফায় অচেনা এক পুরুষকে দেখে চোখ কচলানো বন্ধ করে ইরা। ভালোভাবে তাকিয়ে দেখে একজন বিজনেসম্যান সুলভ ব্যক্তি ওদের ধবল সোফায় বসে টেবিলের উপর কিছু কাগজ সাইন করছে। অত্যন্ত দৃঢ়তা-গম্ভীর মুখ। চোয়াল যেন রেজারের মতো শার্প। পড়ণে থাকা ছাই বর্ণ শার্ট পাথরের মতো পরিশীলিত এক দেহকে জানান দিচ্ছে। সোফার বাঁদিক সংলগ্ন জানালা দিয়ে সদ্য ফোঁটা সূর্যের তেরছা আলো তার মাথার চুলে পড়ছে। সেই সঙ্গে দমকা শীতালু হাওয়া তার চুলে আঙুল বুলিয়ে উড়িয়ে দিচ্ছে। চোখের ওই চিকন রিমলেস চশমাটা যেন অর্থপূর্ণ এক কর্তৃত্বের বহিঃপ্রকাশ। গুরুত্বপূর্ণ জায়গাগুলোয় সাইন বসিয়ে ফাইলটা ফিরিয়ে দিল সে। অতঃপর তখনই বাবা গুলজার আজিজ মেয়েকে দেখতে পেয়ে কোমল হাসিতে বলে ওঠেন,
- ইলহাম মা! উঠেছ তুমি? ভালো হলো। আসো, বাবার কাছে আসো। ভয় নেই। ও ঘরেরই লোক। পরিচয় করিয়ে দিই। ও হচ্ছে এ অঞ্চলের বনবিভাগের কার্যনির্বাহী কর্মকর্তা। শোয়েব ফারশাদ।
এবার গুলজার আজিজ যেন দৃষ্টি ঘুরিয়ে শোয়েবের দিকে চাইলেন,
- ও হচ্ছে আমার মেয়ে। ইলহাম। ইলহাম আজিজ ইরা। এই প্রথম লম্বা দিনের ছুটি কাটাতে এই অঞ্চলে এলো।
কলমের মাথা ক্যাপে বন্ধ করতে করতে একনজর তাকাল সেই ব্যক্তি। সেই চাহনির ভেতর সম্পূর্ণ কর্তব্যপরায়ণ কঠোরতা। ঠোঁটে কোনোরূপ ঢিলে হাসি না রেখে মার্জিত এক হাসিতে সংক্ষিপ্ত স্বরে বলল,
- হ্যালো ইলহাম।
- হ্যালো।
সেদিনের সেই 'হ্যালোর' পর আর কোনো বাড়তি প্রশ্ন করেনি। বরং দেখা-সাক্ষাৎ হলে দাম্ভিক আচরণ না দেখিয়ে মার্জিতসুলভ এক ঠাণ্ডা ব্যবহার দেখিয়েছে। যেখানে উপেক্ষার ভাষা শীতল, অবজ্ঞার বাক্য নীরব, রাগের বিষয়ে পুরোপুরি নিয়ন্ত্রিত। কোনো বন্ধু নেই। সমবয়সি সঙ্গী নেই। স্বজন বলতে কাউকেই কখনো দেখেনি ও। হঠাৎ কানের কাছে 'ঘেঁউ ঘেঁউ' করে দুবার হুংকার ছুঁড়লে চকিতে চমকে উঠল ইরা। দেখতে পেল গলায় বেল্ট বেঁধে রেঞ্জারকে নিয়ে যেতে প্রস্তুত হয়েছে শোয়েব। বিদায় নেবার জন্য সেই সংক্ষিপ্ত স্বরেই বলে উঠল,
- আসি। স্যারকে সালাম জানাবে। রেঞ্জারকে দেখে রাখার জন্য থ্যাংকস ইলহাম।
কথাটা বলেই আর দাঁড়াল না শোয়েব। ছায়াসঙ্গী সেই কুকুরকে নিয়ে ইলহামের চক্ষু সীমানার সামনে দিয়ে চলে গেল। ব্যাপারটা নির্দয়, নিষ্ঠুর অথবা ভালো লাগল ওর। ঠোঁটে মুচকি হাসি ফুটল ইরার।
•
সন্ধ্যার পর থেকেই কিছু একটা ভালো লাগছে না। কিছু সুস্থির ঠেকছে না। মনের মধ্যে কেমন যেন কু ডেকে উঠছে! মনে হচ্ছে ভীষণ খারাপ কিছু ঘটবে। এমন দূর্বিসহ কিছু, যা হয়তো স্বপ্নেও ভাবা যায়নি। গভীর করে দম টেনে আস্তে আস্তে সেটা ছাড়ল শাওলিন। চোখদুটো বন্ধ করে খারাপ চিন্তাগুলো ঝেড়ে ফেলতে চাইল। হঠাৎ ডান কাঁধের উপর ভার অনুভূত হতেই চোখ মেলে তাকায় ও। ডানদিক বরাবর ধীরে ধীরে মুখ পিছু করে দেখল শ্রেষ্ঠা। চোখে বিভ্রান্তির ছাপ, গলায় উৎকণ্ঠা নিয়ে সে বলল,
- কী নিয়ে মুখ গম্ভীর করে আছিস? বিকেলের পর থেকে এই চেহারায় তোকে দেখছি! মনে মনে কী নিয়ে অতো ভাবছিস বল তো? ওইটুকু মাথায় রাজ্যের কোন চিন্তাটা অমন বীভৎস গম্ভীর করে তুলল?
প্রশ্নটার সদ্যুত্তর কী দেবে বুঝতে পারল না শাওলিন। চোখ তুলে বড় বড় গভীর সুন্দর চাহনি দুটোয় কী যেন বোঝাতে চাইল। যা ঠোঁটের ভাষায়, মনের কথায় অনেক সময়ই বলা যায় না; বলা যায় না ঠিক কেমন একটা অদ্ভুত উচাটন অনুভূতি ওর হচ্ছে। চিন্তা, শঙ্কা, বিপদ জড়ানো এক আশঙ্কিত অবস্থা মুহুর্মুহু ডঙ্কা বাজাচ্ছে। নরম কবোষ্ণ ঠোঁটের উপর মৃদু দাঁত দংশন করে শান্তভাবে বলে উঠল শাওলিন,
- আজ বিকেলের পর থেকে কেমন যেন অদ্ভুত অনুভূতি হচ্ছে। আমি ঠিক তোমাকে বুঝিয়ে বলতে পারব না। তুমি জানো শ্রেষ্ঠা, আমি আমার মনকে সবচেয়ে বেশি প্রাধান্য দিয়ে থাকি। ভালো মন্দ সবকিছুতে ভাবনা রাখি। আজ তোমাদের সঙ্গে হেলিপ্যাড থেকে নামার পরপরই প্রচণ্ড অস্থির অস্থির লাগছে। মনে হচ্ছে আমাদের খুব কাছ দিয়ে কিছু অপেক্ষা করছে, অথচ আমরা টের পাচ্ছি না। আমি জানি না তুমি আমার কথা বিশ্বাস করবে কিনা। কিন্তু ব্যাপারটা আমাকে স্বস্তি দিচ্ছে না।
এরকম করুণ, অপ্রস্তুত, হতবিহ্বল চেহারা আগে কখনো দেখেনি ওর। ঠিক মনেও পড়ছে না শেষ কবে এমন চিন্তিত মুখখানা দেখেছিল। নিজের ছোটোবোন নিপার বয়সি এই মেয়েটাকে ঠিক বোনের মতো দেখে এসেছে শ্রেষ্ঠা। একমাত্র ব্যক্তি হিসেবে শ্রেষ্ঠাই জানে এই মেয়েটার জীবনের অব্যক্ত গল্প। বাতাসে ওর এলোমেলো পাকানো চুলগুলো আঙুলে আঙুলে ঠিক করে দেয় শ্রেষ্ঠা। গভীর করে দম টেনে নিয়ে বলল,
- আমি তোর সব কথাই বিশ্বাস করি জানা। আর সবসময় সেটা করব। কিন্তু এই মুহুর্তে আমার কথাও তো তোকে বিশ্বাস করতে হবে, তাই না? এখানে আসার পর সেলিম আর জিদান পুরোটা জায়গা ছেঁকে দেখেছে। তেমন কোনো সমস্যা নেই যেটা দ্বারা ওরকম ভয় করবি। যদি কোনো বিপদের আশঙ্কা থাকতো, ওরা এখানে কেউই থাকতে দিতো না। এসব নিয়ে অতো ভাবিস না। নীচে চল, একটু গান বাজনা শোন, তারপর রাতের খাবার খেয়ে ঘুম। ঠিকআছে?
মনের ভেতর অস্থির বেসামাল অবস্থা নিয়ে সেভাবেই চুপ রইল শাওলিন। বুঝতে পারল শ্রেষ্ঠার মতো একজন বুঝশীল মানুষও ওর অন্দরের বিষয়টা ধরতে পারল না। বুঝতে পারল না। এই বুঝাতে গিয়েও ব্যর্থ হয়ে ফিরে আসাটা সবচেয়ে বেশি যন্ত্রণা দেয়। মাঝে মাঝে নিজের কাছেই নিজেকে ছোটো করে। তখন মনে হয় অন্তর্যামী ব্যতীত আর কেউই বোধহয় সবটুকু কথা বুঝতে পারে না। ঝাড়া এক বুক শ্বাস ছেড়ে সমবেত আড্ডায় যোগ দিল শাওলিন। ওরা কেউ ভাবতেও পারেনি কী ভয়াবহ ঘটনা ওঁত পেতে রয়েছে!
•
নিথর নিস্তব্ধ চাঁদভাসি আকাশ। বোবা আঁধারে ডুবে আছে চরাচর। জোৎস্নার রূপোলি আলোয় চকচক করা পরিবেশ বুকে শূন্যতা জাগাচ্ছে। হুঁ হুঁ করে অমোঘ শূন্যতা অনুভব হচ্ছে বুকে। দুধারে সারি সারি আকাশচুম্বী বৃক্ষ, মসৃণ পাকা পথ, মাথার উপর জোৎস্না বিকরিত আলোয় চারপাশটা অন্যরকম ঠেকছে আজ। মনে হচ্ছে এ যেন ঝড় আসার পূর্বাভাস। সেই প্রাচীন প্রচলিত কথাটার মতো, যেন ঝড়ের আগে এক অদ্ভুত নীরবতা থমথম করছে। আজ আর গায়ে শার্ট চাপায়নি শোয়েব। অন্যান্য দিনের নিয়মটা ভঙ্গ করে আজ বিকেলের সাদা টিশার্টটাই পরে এসেছে। যদিও টিশার্টটা ইদানিং তার বাহুর কাছে, বুকের উপর স্পষ্ট পুরুষ সৌন্দর্যকে জানান দিচ্ছে। হালকা কাশির শব্দে মুখ ঘুরিয়ে ডানে তাকাল শোয়েব। তির্যক চোখে হিম কণ্ঠে বলে উঠে,
- মনে হচ্ছে কিছু বলবে। বলো।
অকপটে এরকম কথা ধরে ফেলায় বিস্মিত আর হল না পার্থ। আরো একবার বুঝতে পারল উনি সদা সতর্ক। রাতের জোৎস্না মাখা রাস্তায় ল্যাণ্ড ক্রুজার গাড়িটি চালাতে চালাতে বলল,
- গুলজার স্যার আপনাকে আজ বিশেষ কারণে ডেকেছেন। বলতে পারেন এই নিমন্ত্রণ টিমন্ত্রণ স্রেফ একটা উছিলা।
- জানি। কিন্তু আমার কিছু করার নেই। ওরকম একটা মানুষকে মুখের উপর 'না' বলাটা শোভা দেখায় না। তবে দাওয়াতের নামে অন্যকিছু গ্রহণ করতে বললে সেটা মেনে নিতে পিছু হটবো।
স্টিয়ারিংয়ের উপর দক্ষতার বহিঃপ্রকাশ ঘটিয়ে রাতের এই নিশি নির্জনে বেরিয়েছে তারা। ড্রাইভটা প্রথমে রাফান করতে চাইলেও শোয়েবের চাহনি দেখে তৎক্ষণাৎ পিছিয়ে গেছে। ফলে ড্রাইভের গুরুভার আপনা আপনি পেয়ে গেছে পার্থ। তাই নিয়ে কপাল কোঁচকানো চেহারা নিয়ে ব্যাকসীটে বসেছে রাফান। চোখদুটো বাঁদিকের জানালা দিয়ে বাইরে স্থির। রিয়ার-ভিউ মিররে পেছনে বসা রাফানকে একপলক পরোখ করতেই কিছুটা ঢিলেঢালা স্বরে বলল শোয়েব,
- মেজাজ হারিয়ে ইলহামের গালে কিছু বসিয়ে দিয়ো না। তুমি যে কেমন এবং কী করার সামর্থ্যটুকু রাখো, আমি জানি। ওখানে অফিসার্স ক্লাবের অনেক সদস্যই থাকবে। কাজেই— আমাকে হেঁট করো না।
পেছন থেকে গম্ভীর ভারি স্বরে জবাব দিল রাফান,
- আপনি নিশ্চিন্ত থাকুন স্যার। আমি তেমন কিছু ঘটাব না। পরিস্থিতি খারাপ দেখলে বাড়ি থেকে বের হয়ে আসব।
- গুড। নিশ্চিন্তে থাকলাম।
সামনে একটা মোড় নিতেই রূপোলি আলোয় দুধারটা দেখে নিল পার্থ। সাবধানে ড্রাইভ করার মধ্য দিয়েই জায়গাটা চিনতে পেরে বলল,
- মনে হচ্ছে ওই অদ্ভুতূড়ে দলটার রেসোর্ট এরিয়া পরেছে। জায়গাটা খুব নীরব। এরা যে কেন নীরব স্পটে এই ধরণের ব্যয়বহুল রেসোর্টটা বুক করল, ঠিক বুঝতে পারছি না স্যার।
জোৎস্নার আলোটা ধবধবে বলেই রূপোলি আলোয় চারপাশটা পরিষ্কার দেখাচ্ছে। ফটফটে আলোয় জানালার বাইরেটা দেখে নিয়ে বলল শোয়েব,
- তোমরা দুজন কেন ওই দলটাকে 'অদ্ভূতূড়ে' নাম দিয়েছ এটা কিন্তু জিজ্ঞাসা করা হয়নি। যাই হোক, এদের দলটা ঢাকার উত্তরা বনানী থেকে এসেছে। তাদের কাছে এরকম রেসোর্ট ব্যয়বহুল লাগবে না। এরা এটাকে বিনোদনের অংশ হিসেবে দেখে।
হঠাৎ কী যেন একটা মনে পড়ার ভঙ্গিতে সামনে তাকাল রাফান। জানালায় মগ্ন থাকা দৃষ্টি দুটো এতোক্ষণে সামনে ফেলে বলল,
- স্যার।
সামনের রিয়ার-ভিউ মিররে আবার দৃষ্টি ফেলল শোয়েব,
- বলো।
- আপনাকে একটা গুরুত্বপূর্ণ তথ্য দিতে ভুলে গেছি!
- কী তথ্য?
- নাযীফ, জিদান, সেলিম এদের প্রত্যেকের ব্যাগ ক্যামেরা ছিল। সবাই ভ্লগ স্যূটের জন্য যার যার ক্যামেরা ক্যারি করছিল। সবচেয়ে দামি ক্যামেরাটা সেলিমের, এরপর জিদানের এবং সর্বশেষ নাযীফের ক্যামেরা। অথচ নাযীফের ক্যামেরাটাই হাসপাতালে থেকে গায়েব! এমনকি তাজ্জবের বিষয় হচ্ছে, ওই ক্যামেরার যাবতীয় জিনিসপত্র সোহানার ব্যাগে ছিল, যেটা সোহানার ব্যাগ-সহ লোপাট হয়ে গেছে। পুরো দলের ভেতর স্রেফ ওইদুটো ব্যাগই হারিয়েছে স্যার! যেখানে আসল জিনিসগুলো সব ঠিকঠাক।
কপালে ক্ষীণ ভাঁজ ফেলে রিয়ার ভিউ মিররে তাকায় শোয়েব। এবার সত্যিই বুঝতে পারছে কেন এই দলটাকে 'অদ্ভূতূড়ে' নাম দেওয়া হয়েছে। এই নাযীফ ছেলেটা আসলে করছে কী? এই অত্র এলাকায় এসে কী ঘটিয়েছে সে? ঘটনার আগাগোড়া ভালো কিছুর আভাস দিচ্ছে না। একের পর এক প্রশ্নের ভিড়ে হঠাৎ পকেটটা যেন মৃদু কেঁপে উঠল। ভাবনার চাকা স্থগিত রেখে পকেটে হাত ঢুকিয়ে ফোনটা বের করল। চিন্তিত, কপাল কোঁচকানো দৃষ্টিতে স্ক্রিনটা দেখল শোয়েব। কলার নেমে 'Tourist Nazeef' লেখা নামটা দেখে অবাক হয়েই ফোনটা কানে চাপে সে। ওপাশ থেকে চরম ভীতিস্বরে চিৎকার করে উঠল,
- হ্যালো! হ্যালো, শোয়েব স্যার! এখানে ওপেন ফায়ারিং হচ্ছে স্যার! তাড়াতাড়ি আসুন!!
কথাটা শেষ হবার পূর্বেই বুলেটের চাপা শব্দ যেন সাক্ষাৎই শুনতে পেল। ড্রাইভ করতে থাকা পার্থ চরম আশ্চর্য হয়ে গাড়ি থামিয়ে ফেলেছে। বিপুল আশ্চর্য নিয়ে পেছন থেকে রাফান বলে উঠল,
- এটা কী বুলেটের আওয়াজ না? এই এরিয়ায় বুলেট কোথা থেকে — . . .
.
.
.
চলবে........................................................