উঠোনের আড্ডাটা চরমভাবে জমে উঠেছে। গানের কলি খেলার পর প্রত্যেকেই তাদের ঈদকে ঘিরে মজার মজার স্মৃতিচারণ করলো। বড়দের মধ্যে এ নিয়ে একে অপরকে খোঁচাখোঁচি চললো। ছোটরা তাদের এ খুনসুটিগুলো ভীষণ উপভোগ করলো। এভাবেই আড্ডার মাঝে হঠাৎ কারেন্ট চলে এলো। অন্য সময় এভাবে কারেন্ট এলে সকলের মাঝেই ছোটখাটো একটা আনন্দের হৈ হৈ শুরু হয়ে যেতো। কিন্তু রাতের আঁধারে, দূরের নিভু নিভু মোমের আলোয় এ আড্ডাটা বেশ জমে উঠেছিলো। তাই কারেন্ট আসায় সকলেই হতাশ হলো। লিলি বেগম আশাহত হয়ে বললেন,
" ইশ! আরোও কিছুক্ষণ পর কারেন্ট আসতো। সব মজা নষ্ট করে দিলো। "
এরপর একে একে সবাই উঠে যেতে লাগলো। আড্ডা দেয়ার ইচ্ছে থাকলেও কারেন্ট চলে আসায় সকলের আনন্দে এক ভাঁটা পড়লো। তাই খানিক ইচ্ছে থাকা সত্ত্বেও প্রায় সকলেই বাড়ির ভেতর চলে গেলো। পিছে রইলো শুধু স্মরণ, নীলিমা ও রাফা। নীলিমা ও রাফা পাশাপাশি হাঁটছে। স্মরণ তাদের পিছনে। পরনের ট্রাউজারের পকেটে দু হাত ঢুকিয়ে বেশ খোশমেজাজে হেঁটে চলছে সে। তার সম্পূর্ণ মনযোগ নীলিমার চলনে। ওদিকে রাফা সুযোগ বুঝে নীলিমার কানের কাছে গিয়ে ফিসফিস করে জিজ্ঞেস করলো,
" সত্যি কথা বলতো নীলু, বাড়ির ভেতরে তোর আর স্মরণ ভাইয়ের মধ্যে কি হয়েছে? আজ গান গাওয়ার সময় দেখলাম স্মরণ ভাই আড়চোখে বারবার তোর দিকে তাকাচ্ছে। ব্যাপার কি বলতো।"
নীলিমা মুহূর্তেই গরম দৃষ্টিতে ইশারায় রাফাকে শাষালো। ওদিকে পিছন হতে স্মরণ গলা উঁচিয়ে বললো,
" আরেকটু ধীরে কথা বলতে পারতে রাফা। পিছন থেকে সব শুনে ফেললাম যে!"
এই বলতে বলতে স্মরণ তাদের পাশ কাটিয়ে সামনে চলে এলো। অতঃপর মনের আনন্দে শিষ বাজাতে বাজাতে বাড়ির ভেতর চলে গেলো।
এ কান্ডে রাফা মুহূর্তেই জিব কাটলো। ওদিকে নীলিমা লজ্জায় অপমানে চোখ বুজে ফেললো। স্মরণ তাদের দৃষ্টির অগোচরে যেতেই নীলিমা রাফার পিঠে দুম করে একটা কিল বসিয়ে বললো,
" উনার সামনে এমনই আমার মান সম্মানের ফালুদা হয়ে আছে। আর আজ তুই মান সম্মানের রায়তা বানিয়ে দিলি। আসলেই খারাপ মেয়ে তুই। ভীষণ খারাপ।"
বলেই সে রাফাকে ফেলে চলে গেলো। রাফাও তার কাছে মাফ চাইতে চাইতে তার পিছে দৌড়ে গেলো।
আজ ঈদ উপলক্ষে রাতের খাবারে পোলাও, গোশতের আয়োজন করা হয়েছে। সকালে আর দুপুরে খিচুড়ি হলেও রাতে সবার পাতে উঠে পড়লো পোলাও, ডিম ভুনা, ও গোশতের রেজালা। বহুদিন পর পোলাও পেয়ে রাফির পেটে যেনো এক ক্ষুধার্ত দৈত্য এসে ভর করলো। পরপর তিন প্লেট পোলাও সে একাই সাবাড় করলো। তার এই হাভাতের মতো অবস্থা দেখে স্মরণ বিস্মিত হয়ে জিজ্ঞেস করলো,
" কি রে রাফি! কত বছর ধরে পোলাও খাস না তুই? ফুপি? ওকে পোলাও-টোলাও খেতে দাও না বুঝি? নাকি তোমরা যেদিন পোলাও খাও সেদিন ওকে রাস্তায় রেখে আসো?"
স্মরণের কথায় রাফি মুখ পুরে পোলাও নিয়ে নাখোশ চাহনিতে চেয়ে বললো,
" পোলাও আর গোশতের রেজালাটা অনেক মজা হয়েছে। তাই এত খাচ্ছি। ডিস্টার্ব করো না ভাইয়া। খেতে দাও। "
লিলি বেগম ছেলের এহেন কান্ডে হেসে বললেন,
" বাসায় যখন পোলাও রান্না হয় সেদিন রাফিই পাতিলের অর্ধেক খাবার শেষ করে। এজন্য আজকে ওর কথা মাথায় রেখে বেশি করে পোলাও দিতে বলেছি ভাবীকে। "
স্মরণ লিলি বেগমের কথা শুনে রাফির দিকে হতাশাজনক চাহনিতে চাইলো। নিজে খেয়েদেয়ে উঠার সময় রাফির মাথায় ছোট্ট করে গাট্টা মেরে বললো,
" বেশি খাস না। পরে বেলুনের মতো উড়ে যাবি। পৃথিবীর যাবতীয় সুখ সৌন্দর্য সবকিছু হতে বঞ্চিত হবি।"
রাফি এসব শোনার পরও স্মরণের কথার তোয়াক্কা করলো না। বরং আরাম করে খেতে লাগলো।
-----------------
আজ পাশের বাড়ির আসিফের সুন্নাতে খৎনার অনুষ্ঠান। আসিফের দাদা ও স্মরণের দাদা বাহাদুর শেখ সম্পর্কে চাচাতো ভাই হোন। ঈদের তিনদিন পর মানতাসার বিয়ে বলে বাহাদুর শেখের অনুরোধে আসিফের দাদা ঈদের পরের দিনই নাতির সুন্নাতে খৎনার আয়োজন করেছেন। অনুষ্ঠান যে খুব বড়সড় করে আয়োজন করা হয়েছে তা নয়। আশপাশের বাড়ি, আত্মীয় স্বজন মিলিয়ে ১৫০জনকে দাওয়াত করা হয়েছে। যদিও গ্রামের বাড়ি ১৫০জন মানে আদতে ১৫০জন না। সবদিয়ে হিসেব করলো হয়তো ২০০ জনের বেশিই হয়ে যাবে। এ হিসেব করেই অবশ্য আয়োজন করা হয়েছে।
গ্রামের বাড়িতে সুন্নাতে খৎনার অনুষ্ঠান করার অর্থ নানান প্রকারের আয়োজন বা রীতিনীতি অনুসরণ করা। আসিফের দাদি পুরোনো সময়ের মানুষ বলে নাতির খৎনায় গোসল করানো নিয়েও নানাবিধ আয়োজন করলেন। সকাল ৯টায় আসিফকে গোসল করানোর জন্য তাদের ভেতরকার বাড়ির উঠোনে আয়োজন করা হলো। এই গোসল সারতে শেখ বাড়ির প্রতিটি মেয়ে থেকে মহিলা সকলকেই আসতে বলা হলো।
প্রথমে আসিফকে একটা লুঙ্গি ও সাদা গেঞ্জি পরিয়ে মধ্য উঠোনে বসানো হলো। এরপর দু বাড়ির মা, খালা, মামি, চাচিরা মিলে তার গালে একটু হলুদ ছোঁয়ালো। অতঃপর একটা ডালায় পান, সুপারি দিয়ে আসিফের মাথার উপরে দিয়ে বার কয়েক ঘোরালো। এরপর পানি দিয়ে আসিফকে গোসল করালো।
আসিফকে গোসল করানো শেষে গ্রামের মহিলারা, যারা সেখানে উপস্থিত ছিলো, সকলেই পানি খেলায় মেতে উঠলো। কে কাকে ভেজাতে পারে, কে শুকনো থাকতে পারে, এ নিয়ে যেনো প্রতিযোগিতা চললো। এভাবেই আসিফের গোসল করানো পর্ব শেষ হলে তাকে বাড়ির লম্বা বারান্দায় সাজানো কাঠের ছোট্ট চকির স্টেজে বসানো হলো। তার সামনে রাখা হলো সাজিয়ে রাখা ক্ষীর ও ফল। একে একে সবাই এসে ক্ষীর খাওয়ালো ও টাকা দিলো।
এরপর এলো শেখ বাড়ির লোকজন। যারা ক্ষীর খাওয়াবে তারা প্রায় একসাথেই এলো। এর মধ্যে বাহাদুর শেখ ও আসমানী বেগম ক্ষীর খাইয়ে আসিফকে দোয়া দিলেন। এরপর বড়রা ক্ষীর খাওয়ালো। তারপর পালা এলো বাড়ির ছোটদের। নীলিমা আসিফকে ক্ষীর খাওয়াতে খাওয়াতে পাশ থেকে গ্রামের এক মহিলা আসিফকে উদ্দেশ্য করে মজা নিয়ে বললেন,
" তোমার পাখি তো উইরা গেছে দাদুভাই। এই পাখি উড়ার খুশিত ক্ষীর খাইতেছোনি?"
৮ বছরের আসিফ বুড়ো মহিলার কথা ঠিক বুঝে উঠতে পারলো না। কিন্তু সে ঠিকই টের পেলো ঐ বুড়ো দাদির কথায় সকলেই হেসে কুটিকুটি হচ্ছে। সে অবুঝ চাহনিতে মায়ের দিকে চাইলে তার মা বুঝালো, পাখি অর্থ কি বুঝিয়েছে এই বুড়ো দাদি। এদিকে আসিফের সাথে সাথে রাফিও পাখি শব্দটার নতুন অর্থ খুঁজে পেলো। অতঃপর তার খুশি দেখে কে! এই নতুন শব্দ দিয়েই তার বোন পাখিকে ভীষণ জ্বালানো যাবে। আহা, কি আনন্দ!
পাখি আসিফের পাশেই বসে ছিলো। নীলিমা ও রাফা ক্ষীর খাইয়ে উঠে গেলে তাদের দুজনের সাথে সে-ও উঠে যাবে। কিন্তু এর মধ্যেই রাফি দুষ্টুমি ভরা চাহনি নিয়ে পাখির দিকে তাকিয়ে সেই বুড়ো দাদি ও আসিফকে উদ্দেশ্য করে বললো,
" কই পাখি উড়ে গিয়েছে? আসিফ এই দেখো, পাখি তো তোমার পাশেই বসে আছে।"
বলেই সে পৈশাচিক হাসিতে মাতোয়ারা হলো। তার সাথে হেসে ফেললো আশেপাশের বেশ ক'জনও। পাখির বুঝতে সময় লাগলো না যে রাফি তাকে উদ্দেশ্য করে মজা লুটে নিলো। এহেন পরিস্থিতিতে পড়ে পাখির ফর্সা মুখখানা অপমানে থমথমে হয়ে লাল হয়ে এলো। নীলিমা রাফির এ কাজে চোখ গরম করে তাকালো। কিন্তু কিছু বলার পূর্বেই স্মরণ এসে খপ করে পিছন থেকে রাফির কাঁধ চেপে ধরলো। গমগমে গলায় জিজ্ঞেস করলো,
" রাফি!! পাখিকে জ্বালাচ্ছিস তুই?"
স্মরণের কণ্ঠস্বর শোনামাত্রই রাফির হাসি হাসি মুখখানা পাংশুটে বর্ণ ধারণ করলো। সে ভয়ার্ত চাহনিতে পিছনে ফিরে তাকালো। স্মরণ তার বিশাল কাঁধের দেহখানা নিয়ে রাফিকে বললো,
" তোর মজা নেয়া বের করছি দাঁড়া। আগে তোর পাখিটাকে উড়িয়ে দেই চল।"
ভয়ের চোটে রাফি বেচারা স্মরণের বাঁধন হতে ছাড়া পেতে আকুতিপূর্ণ কণ্ঠে অনুরোধ করে বললো,
" এ ভাইয়া এ...... না.... আমার পাখি আগেই উড়া শেষ। আমার পাখি আগেই উড়ে গেছে। আমাকে ছেড়ে দাও। প্লিজ ভাইয়া।"
.
.
.
চলবে...........................................