প্রেমান্বেষা - পর্ব ১৯ - সারা মেহেক - ধারাবাহিক গল্প


ভয়ের চোটে রাফি বেচারা স্মরণের বাঁধন হতে ছাড়া পেতে আকুতিপূর্ণ কণ্ঠে অনুরোধ করে বললো,
" এ ভাইয়া এ...... না.... আমার পাখি আগেই উড়া শেষ। আমার পাখি আগেই উড়ে গেছে। আমাকে ছেড়ে দাও। প্লিজ ভাইয়া।"
বলেই জোর খাটিয়ে স্মরণের বাঁন আলগা করে এক ভৌ-দৌড় দিয়ে পালালো সে। এদিকে তার ও স্মরণের এহেন কান্ডে মহলে হাসির রোল পড়ে গেলো।

রাফি চলে যেতেই স্মরণ এগিয়ে গেলো পাখির কাছে। পাখির মাথায় হাত বুলিয়ে বললো,
" রাফি আর একবার জ্বালালে বলবি আমাকে। ওকে গাছের সাথে উল্টো করে যদি না লটকিয়েছি তো আমার নাম স্মরণ না। "

পাখি বিস্তৃত হাসি দিয়ে বললো,
" আচ্ছা ভাইয়া। আমি সবার আগে তোমার কাছেই আসবো। "

স্মরণ ও পাখির এ কথোপকথনটুকু নীলিমা মনোযোগ দিয়ে দেখলো, শুনলো। আবেগের তাড়নায় অকস্মাৎ চট করে সে বলে বসলো,
" পাখির এত খেয়াল রাখেন, রাফির কাছ থেকে ওকে সবসময় প্রটেক্ট করেন। আর কারোর তো এভাবে খেয়াল রাখেন না। এ অন্যায় কেনো স্মরণ ভাই?"

স্মরণ হাসলো। নীলিমার এ প্রশ্নে সে মোটেও বিচলিত হলো না। উল্টো ক্ষণেই ভ্রু নাচিয়ে নিমগ্ন গলায় শুধালো,
" তোমার খেয়াল রাখতে বলছো? ওকে, আজ থেকে তোমারও এভাবে খেয়াল রাখবো। কেউ ডিস্টার্ব করলে তাকে জেলের ভাত খাওয়াবো। খুশি এবার?"

স্মরণের কথা বলার ভঙ্গিমায় হকচকালো নীলিমা। বিভ্রান্ত হয়ে এলো। ক্ষণেই দৃষ্টি হটিয়ে চলে এলো বাড়ির উঠোনে। নীলিমার এ কান্ডে আনমনেই হেসে ফেললো স্মরণ। ক্ষীণ ভালোলাগায় ছেয়ে উঠলো সদ্য প্রেমে পিছলে পড়া হৃদয়খানা। তবে তৎক্ষনাৎ ভালোলাগার হাসিটুকু মিইয়ে দিয়ে আশপাশে লক্ষ্য করলো। ভাগ্যিস এ মুহূর্তে আশেপাশে এমন কেউ নেই যে তাদের এরূপ কথোপকথনকে আশ্রয় করে পরবর্তীতে বিশাল ক্যাচাল বাঁধিয়ে ফেলবে। এ নিয়ে বোঝার মতো আছে একমাত্র রাফা। সে-ও যা বুঝার বুঝে নিয়েছে। স্মরণের মনে নচেৎ মস্তিষ্কে নীলিমাকে নিয়ে যে কিছু একটা চলছে এ বিষয়ে সম্পূর্ণ নিশ্চিত সে। এবার শুধু স্মরণের জবান হতে শোনা বাকি। 

আসিফদের বাড়ির বাইরের বিশাল জায়গা জুড়ে খাবারের প্যান্ডেল বাঁধানো হয়েছে। দ্বিতীয়বারে শেখ পরিবারের সকলে তিনটা টেবিল চেয়ার দখল করে বসলো। কোনার দিকের টেবিলে স্মরণ, মাহবুব, নীলিমা, রাফা, রাফি, পাখি ও সাদ বসেছে। স্মরণ ও নীলিমা বসেছে ঠিক মুখোমুখি। দুজনের একজনও অবশ্য ইচ্ছে করে এভাবে বসেনি। সবার বসার পর যেখানে জায়গা পেয়েছে সেখানেই স্মরণ বসে পড়েছে। নীলিমার মুখোমুখি বসায় অবশ্য সে খুশিও হয়েছে বটে। কিন্তু সে বসার কিছুক্ষণের মধ্যেই দেখলো নীলিমা বা হাত দিয়ে আড়ালে মুখ ঢাকার চেষ্টা করছে। বিষয়টা প্রথমবারেই তার দৃষ্টিগোচর হলো। তবে পরিস্থিতি ও কারণ নিশ্চিত হতে সে কয়েক মুহূর্ত সময় নিলো। অতঃপর নীলিমার ইতস্তত চাহনি অনুসরণ করে সে ঘাড় ঘুরিয়ে পিছনে তাকালো। তাকিয়ে দেখলো, তাদের এক টেবিল পরেই কয়েকটা ছেলে বসেছে। যারা কুরুচিপূর্ণ দৃষ্টিতে বারংবার এদিকটায় তাকাচ্ছে। স্মরণ বেশ বুঝতে পেরেছে ছেলেগুলোর নজর এই টেবিলের দিকেই আছে এবং তারা নীলিমাকে নিয়ে আলোচনা করছে। এই বোধ হওয়া মাত্র স্মরণ উঠে দাঁড়ালো। সাদকে তার চেয়ারে বসিয়ে সে সাদ এর চেয়ারে বসলো। ফলস্বরূপ তার প্রশস্ত কাঁধের আড়ালে ঢাকা পড়লো নীলিমা। এখন আর ঐ টেবিল হতে নীলিমাকে দেখতে পারছে না ছেলেগুলো। এটা নিশ্চিত করে তবেই ক্ষান্ত হলো স্মরণ। ছেলেগুলোও এ নীরব সতর্কবার্তায় নড়েচড়ে বসলো। 
এদিকে স্মরণের আচমকা এ জায়গা পরিবর্তন করায় সকলেই প্রশ্নসূচক চাহনিতে চেয়ে রইলো তার দিকে। ব্যতিত নীলিমা। সে স্মরণের এ কাজের কারণ ঠিকই উদঘাটন করতে পেরেছে। কেননা এখন সে নিজে এখন স্বস্তি নিয়ে বসতে পেরেছে। অথচ এতক্ষণ তীব্র অস্বস্তিতে গা গুলিয়ে আসছিলো তার। 

স্মরণ তার সাধ্যমতো চেষ্টা করলো যেনো নীলিমা কোনোপ্রকার অস্বস্তিকর পরিস্থিতিতে না পড়ে। এজন্য খাবার শুরু থেকে শেষ অব্দি তার সতর্ক দৃষ্টি নিবদ্ধ ছিলো নীলিমার উপর।

খাবার শেষে যে যার মতো অনুষ্ঠান বাড়িতে ব্যস্ত হলো। কেউ বাড়ি ফিরে গেলো, কেউ বা সেখানেই থেকে গল্পগুজবে মেতে উঠলো। নীলিমা ও রাফা প্যান্ডেল থেকে একটু দূরে গাছের তলায় দাঁড়িয়ে গল্প করছে। অনুষ্ঠান বাড়ির ভেতরে মানুষের ভীড়ে ভীষণ গরম লাগছে। এদিকটায় বাগানের মতো থাকায় জায়গাটা অনেকটাই শীতল অনুভূত হচ্ছে। উপরন্তু মৃদু হাওয়া বইছে। ফলে গাছের তলায় খানিক স্বস্তি মিলছে। নীলিমা গাছে বাহু ঠেকিয়ে দিয়ে গল্প করছে। গল্পের মাঝে হঠাৎ তার দৃষ্টি আটকে গেলো আসিফদের বাড়ির গেটের দিকে। রাফার কাঁধ ছাপিয়ে সে দেখলো সেই ছেলেগুলো হাতে মোবাইল নিয়ে দাঁড়িয়ে আছে। মুহূর্তেই নীলিমার মুখখানা পাংশুটে বর্ণ ধারণ করলো। বুকের ভেতরটা আতঙ্কে কেঁপে উঠলো। মুহূর্তেই সে রাফার হাত ধরে পিছনের দিকে ফিরে হাঁটতে লাগলো। অকস্মাৎ তার এ কাজে রাফা বিস্মিত হয়ে জিজ্ঞেস করলো,
" কি রে! কি হয়েছে নীলু? এভাবে টেনে নিয়ে কোথায় যাচ্ছিস?"

নীলিমার কণ্ঠে আতঙ্ক। ভয়ে তার হাত দুটো ঘেমে আসছে। সে অগোছালো ভঙ্গিতে বললো,
" ঐ ছেলেগুলো ছবি তুলছে আমাদের। দ্রুত বাড়িতে চল। "

রাফাও ভয়ে সংকুচিত হয়ে এলো। নীলিমার কথার প্রত্যুত্তরে কিছু বলতে যাবে এর পূর্বেই পিছন হতে স্মরণের গলার স্বর ভেসে এলো। দুজনেই চট করে পিছনে ফিরে তাকিয়ে দেখলো স্মরণ ঐ ছেলেগুলোকে জেরা করছে। পাশেই মাহবুব দাঁড়িয়ে। 

স্মরণ তন্মধ্যের একটি ছেলের মোবাইল নিয়ে আগুন রাঙা চাহনিতে চেয়ে জিজ্ঞেস করলো,
" কোন সাহসে ওদের ছবি তুলছিলি তোরা?"

ছেলেগুলো এতক্ষণ মজা লুটলেও এখন ভয়ে জড়োসড়ো হয়ে দাঁড়িয়ে আছে। কারোর জবান হতে টু শব্দটুকু বের হচ্ছে না। সকলের দৃষ্টিই অবনমিত। ছেলেগুলোর নিকট হতে কোনো জবাব না পেয়ে স্মরণ এক রাম ধমক দিয়ে ফোনটা সজোরে ছুঁড়ে মারলো। তার এ ধমকে কেঁপে উঠলো ছেলেগুলো। এমনকি মাহবুবসহ খানিক দূরে দাঁড়িয়ে থাকা নীলিমা ও রাফাও কেঁপে উঠলো। এদিকে বাইরের এ ঘটনার আঁচ বাড়ির ভেতর অব্দি চলে গেলো। বাড়ির ভেতর হতে অনেকেই বেরিয়ে আসলো কাহিনি জানতে। 

স্মরণ এবার নীরবে অপর ছেলেটির ফোন হাতে নিলো, এক প্রকার জোর করে। ছেলেটির কাছ থেকে ফোনের লক খুলে সর্বপ্রথম গ্যালারিতে ঢুকলো। সেখানে ছড়িয়ে আছে রাজ্যের সব নোংরা ভিডিও। এসব দেখা মাত্র স্মরণের রাগ যেনো চট করে মাথায় উঠে গেলো। রক্ত গরম চাহনিতে ছেলেটির দিকে কয়েক সেকেন্ড তাকিয়ে থেকে ফের মাটিতে ফোন আছড়ে ফেললো সে। এবারের ফোনটা ঠিক দু টুকরো হয়ে দু'দিকে ছড়িয়ে পড়লো। এরপর অকস্মাৎ স্মরণ ছেলেটির কলার চেপে ধরে মুহূর্তেই তাকে ধরাশায়ী করলো। অতঃপর শুরু হলো বেধড়ক মা' র। শরীরের সমস্ত শক্তি ও রক্ত গরম ক্রোধ নিয়ে পেটাতে লাগলো ছেলেটাকে। এ দেখে বাকি দুটো ছেলে নিজের প্রাণ নিয়ে ছুটে পালালো।
 মাহবুব স্মরণকে থামালো না। থামানোর চেষ্টাও করলো না। কারণ সে জানে, স্মরণকে থামাতে পারবে না সে। একে তো স্মরণের ভয়ংকর ক্রোধ সম্পর্কে সে পূর্ব হতেই অবগত, উপরন্তু ক্র্যাচ ভর দিয়ে তার পক্ষে পারতপক্ষে স্মরণকে থামানো সম্ভব নয়। 

এদিকে স্মরণের এ ভয়ংকর রূপ দেখে বিস্ময়ে বিমূঢ় হয়ে দাঁড়িয়ে আছে নীলিমা। সে স্মরণের এ রূপের সাথে অপরিচিত, অনবগত। সে কখনো স্মরণকে এতোটা হিংস্র হতে দেখেনি। নীলিমা এখান থেকে স্পষ্ট দেখতে পারছে স্মরণের হিংস্রতা। স্মরণ কিভাবে দাঁতে দাঁত চেপে মারছে, তা দেখছে। ক্রোধের চোটে ফর্সা মুখখানা কেমন লাল টকটকে হয়ে আছে তা পরিষ্কার রূপে নীলিমার চোখে ধরা পড়ছে। এতক্ষণ যে আতঙ্ক ও ভয়ে তার বুকের ভেতরে অস্থিরতা নেমে এসেছিলো, স্মরণের এ চেহারা দেখে পূর্বের চেয়েও দ্বিগুন ভয়ে তার আত্মা শুকিয়ে আসছে। হাত দুটো যেনো ধীরেধীরে বরফ শীতল হয়ে আসছে। সে না পারছে দু কদম এগুতে, না পারছে দু কদম পিছাতে। শুধু মস্তিষ্কে ঘুরপাক খাচ্ছে একটা প্রশ্ন,
" স্মরণ ভাই এতোটা ভয়ানক হলো কিভাবে?"
.
.
.
চলবে...............................................

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন