প্রেমান্বেষা - পর্ব ২০ - সারা মেহেক - ধারাবাহিক গল্প


চরম নৃশংসতায় মেতে উঠেছে স্মরণ। সমস্ত ক্রোধ নিয়ে ছেলেটাকে বেধড়ক মারছে সে। মারতে মারতে দাঁতে দাঁত পিষে বললো,
" ওর ভিডিও করার সাহস হয় কি করে জা*** বাচ্চা! তুই জানিস ও কে? এত বড় স্পর্ধা দেখালি কি করে!"

ছেলেটির নাক-মুখ ফেটে রক্ত বেরিয়ে পড়ছে। এ পর্যায়ে বাড়ির ভেতর থেকে প্রায় দৌড়ের উপর আসিফের বাবা এসে স্মরণকে ধরলো। ওদিকে আনিস সাহেবও ইতোমধ্যে চলে এসেছে। তাঁর চোখেমুখে আতঙ্ক। ছেলে হঠাৎ এমন কাজ করে বসবে কল্পনাও করেননি তিনি। পাছে ভয় হচ্ছে, এতগুলো মানুষের সামনো যদি ঐ ছেলেটাকে স্মরণ মেরে ফেলে তবে! আতঙ্কে তিনি এসেই এক ধাক্কায় স্মরণকে মাটিতে ফেলে দিলেন। স্মরণ বেসামাল হয়ে মাটিতে শুয়ে পড়লো। কিন্তু আবারো উঠে গিয়ে ছেলেটাকে মারতে উদ্যত হলো। এ পর্যায়ে আসিফের বাবা ও আনিস সাহেব মিলে তাকে আটকে রাখলো৷ আহত ছেলেটিও এ সুযোগে নিজের প্রাণ হাত নিয়ে পালালো। স্মরণ তখন রক্ত গরম করা ক্রোধ নিয়ে ঝাঁপিয়ে পড়তে উদ্যত হতে চেয়েছিলো। তবে আনিস সাহেব মুহূর্তেই থামিয়ে দিলেন স্মরণকে। ছেলের এ হিংস্র রূপ দেখে গগন কাঁপিয়ে ধমক দিলেন তিনি। মুহূর্তেই স্তব্ধ হয়ে গেলো চারপাশ। অনুষ্ঠান বাড়ির লোকজনের কানাঘুষা বন্ধ হয়ে গেলো ক্ষণেই। ইতোমধ্যে শেখ পরিবারের সকলে এই উঠোনে চলে এসেছে। 
এদিকে বাবার ধমকে শান্ত ও স্মরণ। নিজেকে বাঁধনছাড়া করে বন্ধ চোখে লম্বা লম্বা নিঃশ্বাস নিলো সে। আনিস সাহেব ছেলের দু বাহু চেপে শঙ্কিত গলায় শুধালেন,
" এসব কি করছিলি স্মরণ! আরেকটু হলেই ছেলেটা মারা যেতো!'"

স্মরণ মুহূর্তেই দৃষ্টি তুলে তাকালো। তার চোখজোড়া রক্তিমাভাব রঙ ধারণ করেছে। চোখেমুখে যেনো জ্বলন্ত আগ্নেয়গিরির উত্তাপ। ঔদ্ধত্যপূর্ণ গলায় বললো,
" তুমি না থামালে ওকে মেরেই ফেলতাম আব্বু। ওর কত বড় স্পর্ধা!"

" কিন্তু ও করেছে কি? কি কারণে ওকে অমানুষের মতো মারছিলি তুই?"

" ও নীলিমার ভিডিও করছিলো আব্বু! আর ওর ফোনে দুনিয়ার যত নোংরা ভিডিও। এখন নিশ্চয়ই এসব খুলে বলতে হবে না তোমাকে।"

আনিস সাহেব বিস্মিত হলেন। বিস্মিত হলেন ওখানে উপস্থিত সকলে৷ মিলি বেগম প্রায় দৌড়ের উপর চলে গেলেন নীলিমার কাছে। রাফা তখনও নীলিমার পাশে দাঁড়িয়ে আছে। নীলিমা রুদ্ধশ্বাসে দাঁড়িয়ে আছে। এরূপ অকল্পনীয় ঘটনা তাকে আপাদমস্তক এলেমেলো করে দিয়েছে। মস্তিষ্কে ঘটনাটি প্রক্রিয়া হতেও সময় নিচ্ছে বেশ। 

আনিস সাহেব বিস্মিত হয়ে ক্রোধাগ্নি গলায় বললেন,
" তো নীলিমার কারণে কি তুই খুনি হবি স্মরণ!?"

স্মরণ আনিস সাহেবের বিপরীতে ঠিক নীলিমার সোজাসুজি দাঁড়িয়ে আছে। এখানে দাঁড়িয়ে নীলিমাকে স্পষ্টরূপে দেখা যাচ্ছে। সে এবার সরাসরি নীলিমার পানে চাইলো। নীলিমার ঐ হতভম্ব চাহনিতে চেয়ে আনিস সাহেবের উদ্দেশ্যে বললো,
" নীলিমার জন্য আমি খুনি হতেও রাজি আছি আব্বু। কিন্তু ওর কোনো ক্ষতি হতে দিবো না। "

নীলিমার আরোও একবার হতভম্ব হলো। স্তম্ভিত হলো স্মরণের ঐ চাহনিতে, স্তম্ভিত হলো স্মরণের কথায়। বুকের ভেতরে হৃদপিণ্ডটা অসম্ভব গতিতে ছুটে চলছে। মস্তিষ্ক এলেমেলো হয়ে আছে।
 মিলি বেগম এবার আর দেরি করলেন না। নীলিমাকে নিয়ে বাড়ির ভেতর চলে গেলেন। অগোছালো, ক্লান্ত চাহনিতে স্মরণ নীলিমার যাবার পানে চেয়ে রইলো।

---------------------

আজ শেখ বাড়িতে থমথমে পরিস্থিতি বিরাজ করছে। স্মরণ যে আজ বাড়ির সামনে মারপিট করে এসেছে এ ব্যাপারটা এখনও কেউ মেনে নিতে পারছেন না। নাজমা বেগম এখনও বিস্ময়ে হতভম্ব। তিনি কিছুতেই বিশ্বাস করতে পারছেন না, তাঁর আদরের ছেলে আজ গ্রামের লোকের সামনে মারপিট করে এসেছে। 
বিকেলের পর থেকে এ ব্যাপারে স্মরণের সাথে কেউ কোনোরূপ কথা বাড়ায়নি। একই বাড়ির মধ্যে কেউ স্মরণের এই কাজকে সমর্থন জানাচ্ছে তো কেউ বা ভুল বুঝছে। বড়দের মতে স্মরণ পরিস্থিতি অনুযায়ী মাত্রাতিরিক্ত প্রতিক্রিয়া দেখিয়ে ফেলেছে। কিন্তু মাহবুব, নওরীন, সাদ, সাজিদের কথা হলো, স্মরণ পরিস্থিতি অনুযায়ী একদম সঠিক কাজটা করেছে। কেননা তথ্য প্রযুক্তির এ যুগে সামান্য ছবি বা ভিডিও নিয়ে যে কত ধরনের সম্মানহানী কাজ করা যায় তা একমাত্র এ যুগের মানুষরাই বুঝতে পারবে। বাবা দাদাদের এ নিয়ে ব্যাখা করে বুঝিয়ে বললেও তারা ভুল ভেবে বসে। 

কাল মানতাসার গায়ে হলুদ ও ক্ষীর খাওয়ানো। পরশু মেহেদি এবং তরশু বিয়ে। মানতাসার অনুরোধেই মেহেদির জন্য আলাদাভাবে ছোট অনুষ্ঠানের আয়োজন করা হয়েছে। এ উপলক্ষেই বাড়ির উঠোনে ছোট্ট স্টেজের ব্যবস্থা করা হয়েছে। সেই স্টেজ সাজিয়ে মাত্রই বেরিয়ে গেলো লোকবল। স্মরণ ও মাহবুব দাঁড়িয়ে কাজের তদারকি করছিলো। স্মরণ দাঁড়িয়ে আছে একটা গাছের পাশে হেলান দিয়ে। তার মুখশ্রীতে শান্ত ভাব বিরাজ করছে। তবে চাহনিতে তার গভীর চিন্তার খেলা। সে কি চিন্তা করছে মাহবুব জানে না। তবে অনুমানের ভিত্তিতে স্মরণকে শুধালো,
" আজকের ঘটনা নিয়ে ভাবছিস?"

স্মরণ ছোট্ট করে জবাব দিলো, 
" হুম।"

মাহবুব এবার একটা দীর্ঘশ্বাস ফেলে বললো,
" গ্রামের অনুষ্টানে এমন কিছু ছেলেপেলে থাকে। যারা মেয়েদের দিকে খারাপ চোখে তাকায়, লুকিয়ে ছবি তুলে, ভিডিও করে। কিন্তু তাই বলে কেউ এতোটাও রিয়েক্ট করে না স্মরণ, যেমনটা তুই করেছিস। "

স্মরণ এবার সোজা হয়ে দাঁড়ালো। কণ্ঠে মৃদু চাপা ক্রোধ ও বিস্ময় নিয়ে বললো,
" তোর কি মনে হয় আমি বেশি রিয়েক্ট করে ফেলেছি! আমার জায়গায় তুই থাকলে এমন কিছু করতি না মাহবুব? "

মাহবুব ছোট্ট শ্বাস ফেলে হাসলো। বললো,
" তোর সামনেই দাঁড়িয়ে আছি স্মরণ, তখনও ছিলাম। দেখেছিস কিছু করেছি কি না। তাই আমাকে দিয়ে নিজের কাজকে জাস্টিফাই করার দরকার নেই। এ ঘটনার মাধ্যমে আমি এবার শতভাগ নিশ্চিত হলাম, তুই নীলিমাকে ভালোবাসিস। এতে কোনো সন্দেহ নেই। '

স্মরণ গা ছেড়ে দাঁড়ালো। ধীরে নিঃশ্বাস ছেড়ে কিছু বলতে যাবে এর পূর্বেই সে দেখলো নীলিমা সিঁড়িঘরে দাঁড়িয়ে আছে। মাহবুবের দৃষ্টিও সেদিকে গেলো। সে নীলিমাকে দেখেই চলে যাওয়ার সিদ্ধান্ত নিলো। যাওয়ার পূর্বে স্মরণের কাঁধে আলতো হাত চাপড়ে বললো,
" নীলিমার সাথে কথা বল। আমি ভেতরে যাই।"
বলেই সে ক্র্যাচে ভর দিয়ে চলে এলো। বাড়িতে ঢোকার পূর্বে নীলিমার দিকে সামান্য মুচকি হাসি দিয়ে বললো,
" আমি শুধু এটুকুই বলবো, স্মরণকে ভুল বুঝো না নীলিমা। "
নীলিমা প্রত্যুত্তর করলো না। শুধু ফিরতি হাসি দিয়ে সিঁড়ি দিয়ে নেমে পড়লো। মাহবুব চলে গেলো বাড়ির ভেতরে। আর নীলিমা চলে এলো উঠোনে। ধীর পায়ে এগিয়ে সে স্মরণের ঠিক পাশে গিয়ে দাঁড়ালো। স্মরণ খানিক নড়েচড়ে বুকের উপর দু হাত আড়াআড়িভাবে রেখে দাঁড়ালো।

উঠোনের ঐ কোনার ঝোপ হতে ঝিঁঝিঁ পোকার আওয়াজ শোনা যাচ্ছে।এ ঝিঁঝিঁ পোকার ডাক যেনো রাতের গভীরতা বাড়িয়ে দিচ্ছে। অথচ ঘড়িতে মাত্র ন'টা বাজে। স্মরণ ও নীলিমা উভয়ই নিশ্চুপ দাঁড়িয়ে আছে। ঝিঁঝিঁ ডাক না হলে বোধহয় দুজন দুজনার নিঃশ্বাসের শব্দ টের পেতো। এভাবে বেশ কিছুক্ষণ অতিবাহিত হওয়ার পর স্মরণ ধীর স্বরে শুধালো,
" কিছু বলতে এসেছিলে?"

নীলিমা বুকভরে শ্বাস টেনে বললো,
" বলতে এসেছিলাম অনেক কিছুই। কিন্তু হঠাৎ করেই কেনো যেনো শব্দহারা হয়ে বসে আছি।"

" আজকের ঘটনা নিয়ে কি মনে হয় তোমার? আমি বেশি রিয়েক্ট করে ফেলেছি?"

" আপনার কি মনে হয়? নিজের এই কাজটাকে আপনি কিভাবে নিচ্ছেন?"

" উমমম.. নরমালি নিচ্ছি। আমার দিক থেকে মনে হয় আমি ঠিক কাজটাই করেছি। "

নীলিমা এবার পাশ ফিরে তাকালো। কিঞ্চিত বিস্ময়ে শুধালো,
" এমন নৃশংস ভাবে মারপিটকে আপনি ঠিক কাজ মনে করছেন স্মরণ ভাই?"

স্মরণ ঘাড় ঘুরিয়ে নীলিমার পানে তাকালো। বললো,
" অবশ্যই! বেঠিক কাজ করিনি আমি। অপরাধী তার উপযুক্ত শাস্তি পেয়েছে। "

" অপরাধী! সামান্য ভিডিও করাকে আপনি এত বড় করে দেখছেন! "

" তোমার বুঝি ঐ জা*** উপর মায়া হচ্ছে? ওর কাজকে তুমি জাস্টিফাই করতে চাচ্ছো?" স্মরণের কণ্ঠস্বর স্বাভাবিক। নেই কোনো ক্রোধ, নেই কোনো বিস্ময়। কিন্তু নীলিমার চাহনিতে বিস্ময়। সে শুধালো,
" আমি কাউকে জাস্টিফাই করছি না স্মরণ ভাই। আমি আপনার কাজে অবাক হয়েছি। আপনার ঐ রাগ, ঐ হিংস্রতা আমাকে কাঁপিয়ে দিয়েছে। আগে কখনো আপনার এ রূপ আমার চোখে পড়েনি। "

স্মরণ আহত হলো খানিক। বললো,
" পড়লে বুঝি আমায় ভালোবাসতে না নীলিমা?"

নীলিমা এবার চাপা ক্রোধ ও বিরক্তি নিয়ে বললো,
" আপনি বারবার পুরোনো কথাগুলোকে কেনো টেনে আনেন? এখানে আমার কথা কোথ থেকে এলো?"

স্মরণ আহত গলায় বললো,
" এখানে তোমাকে নিয়েই কথা হচ্ছে নীলিমা। তোমাকে ঘিরেই এসব ঘটনা ঘটেছে। তোমার ক্ষতিই আমাকে এ রূপ সামনে আনতে বাধ্য করেছে। তোমার কি মনে হয় যার-তার জন্য আমি এমন কাজ করবো? মোটেও না। আমি নিজেকে এতোটাও সহজলভ্য করিনি। কারণটা তুমি বলেই আমি আজকে এমন কাজ করেছি নীলি।"
.
.
.
চলবে............................................

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন