স্মরণ আহত গলায় বললো,
" এখানে তোমাকে নিয়েই কথা হচ্ছে নীলিমা। তোমাকে ঘিরেই এসব ঘটনা ঘটেছে। তোমার ক্ষতিই আমাকে এ রূপ সামনে আনতে বাধ্য করেছে। তোমার কি মনে হয় যার-তার জন্য আমি এমন কাজ করবো? মোটেও না। আমি নিজেকে এতোটাও সহজলভ্য করিনি। কারণটা তুমি বলেই আমি আজকে এমন কাজ করেছি নীলি।"
থমকে গেলো নীলিমা। ক্ষণিকের জন্য বোধহয় তার নিঃশ্বাস আটকে এলো। স্মরণের কথার টান অন্য ধরণের। যেনো কিছু আকুতি, কিছু গভীর অনুভূতি মিশে আছে কথার সাথে। এ নিয়ে আর না ভেবেই ভ্রু কুঁচকালো নীলিমা। নিঃসংকোচ বিস্ময় নিয়ে বললো,
" আপনি সম্পূর্ণ দোষটা আমার ঘাড়ে চাপিয়ে দিচ্ছেন! আমি কি একবারো আপনাকে এমন করতে বলেছি? বলুন!"
নীলিমার কথায় স্মরণ মৃদু হাসলো৷ কিছু বলতে গিয়েও থেমে গেলো সে৷ কারণ বাড়ির ভেতর থেকে মিলি বেগমের কণ্ঠস্বর ভেসে আসছে। নীলিমাকে ডাকছেন তিনি। স্মরণ নীলিমার দিকে চেয়ে দু কদম পিছিয়ে এসে গাছে হেলান দিলো। দু হাত বুকের উপর আড়াআড়িভাবে রাখলো। অতঃপর ডান পাশে বিস্তৃত ঠোঁট বাঁকিয়ে হেসে বললো,
" এর জবাব বিশাল এক ফর্দের মতো হতে পারে। আবার ছোট্ট চিরকুট ওপর মতোও হতে পারে। তাই এটা পরে বলবো। এখন যাও। ফুপু ডাকছে তোমাকে। "
নীলিমার প্রত্যুত্তর করার পূর্বেই ভেতর থেকে তার নামের জরুরী তলব জারি করা হলো। তাই আর অপেক্ষা না করেই সে বাড়ির ভেতরে ছুট দিলো। পিছে স্মরণ ছোট্ট নিঃশ্বাস ফেললো। আপনমনে হেসে ফেললো নীলিমার কথাগুলো চিন্তা করে। অতঃপর বললো,
" একজন প্রেমে পড়লে অপর মানুষটা এত বোকা হয়ে যায় কি করে? ছয় বছর আগে আমি বোকা ছিলাম আর আজ নীলিমা। ইশ এই বোকা মেয়েকে মনের গোপন চিনাবো কি করে!"
এই বলে সে মৃদু নিঃশ্বাসে হাসলো।
-------------------------
সকালের খাবারের পর শেখ বাড়ির সকলে আনন্দে মেতে উঠেছে। মানতাসাকে এখন হলুদ গোসল করাবে গ্রামের পরিচিত মহিলারা। এ কারণে কাঁচা হলুদ রঙের সাধারণ একটা শাড়ি পরানো হয়েছে মানতাসাকে। সাথে তাজা গাঁদা ফুলের হাতে বানানো চুড়ি, কানের দুল, টিকলি পরানো হয়েছে। আর বাড়ির সকল মহিলা ও মেয়েগণও হলুদ শাড়ি পরেছে। নীলিমা, রাফা, পাখি, নওরীন দু হাতে তাজা গাঁদা ফুলের চুড়ি পরেছে। আর বাকি সাজটা সাধারণ রেখেছে। এ বাড়িতে বিয়ে, যারা যারা এ খবর জানে প্রায় সকলেই এসেছে মানতাসাকে হলুদ গোসল দিতে। এ অনুষ্ঠানে অবশ্য ছেলেদের কোনো জায়গা নেই। তাই নাস্তার পরপরই কেউ বাইরে চলে গিয়েছে বা কেউ বাড়ির ভেতরেই আছে।
উঠোনে মহিলা পার্টির তুমুল হৈচৈ, নাচগান হচ্ছে। মানতাসার গালে, কপালে, হাতে, গলায় কাঁচা হলুদ বাঁটায় মাখিয়ে দিচ্ছে সবাই। সেই হলুদ নিয়ে আবার অবিবাহিত মেয়েদের গালে ছুঁইয়ে দিচ্ছে গ্রামের কতিপয় মহিলা। এক পর্যায়ে আসমানী বেগম রাফা ও নীলিমাকে কাছে ডেকে তাদের দু গালে অল্প করে হলুদ ছুঁইয়ে দিলো। সে হাত দিয়ে মাথা বুলিয়ে বললো,
" আমার এই দুইডা নাতনিরও যেন তাত্তারি বিয়া হইয়া যায়। আর লাল টুকটুকে একখান বড় পায় যেন, এই দুয়া করি।"
নানির মুখে 'লাল টুকটুকে বর' শুনে হেসে উঠলো দুজনেই। নীলিমা বললো,
" লাল টুকটুকে আবার বর হয় নাকি। লাল টুকটুকে তো বউ হয়। বয়সের সাথে সাথে কথাবার্তাও সব উল্টাপাল্টা হচ্ছে নানি।"
আসমানী বেগম নীলিমার কথায় প্রাণখোলা হাসি দিলেন। নীলিমার বাহুতে আলতো চাপড় মেরে বললেন,
" হয় হয়। লাল টুকটুকে বরও হয়। তোর বাপে তো লাল টুকটুকে একখান পাঞ্জাবি পইরা বিয়া করতে আইছিলো। বিশ্বাস না হইলে জিজ্ঞাস করিস ইমাদরে। "
" আচ্ছা নানি। সময় সুযোগ পেলে জিজ্ঞেস করবো। আমি একটু ভেতর থেকে আসি। চুলের খোঁপা বারবার খুলে যাচ্ছে।"
বলেই সে খুলে যাওয়া চুলগুলো হাত খোঁপা করতে করতে সিঁড়ি পাড় হলো। সিঁড়িঘরে আসতেই আচমকা ভূত দেখার মতো চমকে উঠলো সে। সিঁড়িঘরের শেষে, ডাইনিং এ ঢোকার দরজায় হেলান দিয়ে দাঁড়িয়ে আছে স্মরণ। পরনে তার পাতলা একটা টিশার্ট ও কালো ট্রাউজার। চুলগুলো অগোছালো হয়ে পড়ে আছে কপালে। নীলিমাকে দেখা মাত্রই সে ঠাট্টার সুরে জিজ্ঞেস করলো,
" ওখানে কি কোনো ছেলেপেলে আছে? "
নীলিমা সন্দিহান চাহনিতে ভ্রু উঁচিয়ে তাকালো। তবে কয়েক সেকেন্ডের জন্য। অতঃপর স্বাভাবিক চাহনিতে চেয়ে স্মরণকে উল্টো খোঁচা মেরে বললো,
" কেনো? মারতে যাবেন নাকি?"
স্মরণ নীলিমার খোঁচাখানা আমলে নিলো না। উল্টো বেশ গর্বিত স্বরে বললো,
" এত যে সুন্দরী সুন্দরী মেয়ে আছে, তাদেরকে বাঁচাতে হবে তো নাকি!"
নীলিমা প্রশ্নসূচক চাহনিতে চেয়ে ভ্রু কুঁচকালো। মনে করার চেষ্টা করলো ওখানে এমন কম বয়সী কোনো সুন্দরী মেয়ে আছে নাকি। অতঃপর এক কদম পিছিয়ে এসে সিঁড়ি বরাবর সোজা উঠোনের দিকে তীক্ষ্ণ দৃষ্টি ফেললো। নাহ, স্মরণের কথানুযায়ী 'এত' মেয়েই নেই ওখানে।
নীলিমা এবার ঘাড় ঘুরিয়ে সোজা স্মরণের দিকে চাইলো। ঠোঁট উল্টিয়ে বললো,
" আপনার কথা মতো কোথায় 'এত' সুন্দরী মেয়ে আছে? আমি তো শুধু বুড়োদের চোখে দেখছি। "
স্মরণ এবার হো হো করে হেসে উঠলো। হাত দিয়ে নীলিমাকে আপাদমস্তক দেখিয়ে বললো,
" তুমি আসলেই চোখ থাকতে অন্ধ নীলিমা। নাহয় এই যুবতী বয়সেই নিজেকে বুড়ো ভেবে বসেছো। "
" আপনি কি বলতে চাচ্ছেন স্মরণ ভাই? আমাকে বুড়ো বলছেন?" নীলিমার কণ্ঠে মৃদু উত্তাপ। স্মরণ আবারও হাসলো তার কথায়। বললো,
" আমি না। তুমিই নিজেকে বুড়ো বলছো। কেনো? তোমাকে কি ওসব ছেলেদের হাত থেকে বাঁচাতে হবে না?"
নীলিমা ভেঙচি কেটে বললো,
" নিজেকে হিরো ভাবা বন্ধ করুন স্মরণ ভাই। আপনার এ হিরোগিরিতে আমি ঘাসও ঢালবো না।"
বলেই সে মানতাসার রুমের দিকে চলে গেলো। পিছনে স্মরণ তাকে উদ্দেশ্য করে বিরবির করে বললো,
" ঘাস না ঢাললেও চলবে। তুমি শুধু ভালোবাসা ঢালবে নীলিমা। "
নীলিমা একটা ক্লিপ নিয়ে বেরিয়ে এলো রুম থেকে। তার কোমড় অব্দি চুল আলগোছে পিঠে ছড়িয়ে আছে। সে স্মরণের সামনে দিয়ে খোলা চুল হাতে মুঠো করতে করতে চলে গেলো। পিছে স্মরণ বিমুগ্ধ নিষ্পলক চাহনিতে নীলিমার পানে চেয়ে রইলো। আজ সকাল থেকেই নীলিমাকে দেখছে সে। এই হলুদ শাড়ি পরা অবস্থায় নীলিমাকে কতবার দেখেছে তার হিসেব রাখেনি স্মরণ। আজ অগুনতি বার দেখেছে নীলিমাকে। নীলিমার রূপে এরুপ মুগ্ধ হয়েছে যেনো এমন রূপবতী সে প্রথম দেখেছে।
স্মরণ লক্ষ্য করেছে, নীলিমার পানে সে যতবার মুগ্ধ নয়নে চেয়েছে ততবার তার বুকের ভেতরে অদ্ভুত এক শান্তির শীতল হাওয়া বয়ে গিয়েছে। এ হাওয়া কেমন যেনো আলতো অনুভূতি দেয়। আবার শরীরে শিহরণও জাগিয়ে তোলে। আসলে স্মরণ প্রথম প্রেমের অনুভূতি বর্ণনা করতে ব্যর্থ। সে শুধু জানে ঐ মেয়েটিকে দেখলে তার অসম্ভব ভালো লাগে। অসম্ভব, অসম্ভব।
স্মরণ এগিয়ে গেলো সিঁড়ির কাছে। এখানে দাঁড়িয়ে নীলিমাকে স্পষ্টভাবে দেখা যাচ্ছে। নীলিমা এটা টেরও পেয়েছে বটে। আর সে যে টের পেয়েছে, স্মরণও এটা বুঝে নিয়েছে। এজন্য সে আরোও একগুঁয়েভাবে নীলিমাকে দেখে যাচ্ছে। নীলিমাও স্মরণের নজর হতে লুকানোর চেষ্টা করছে। কিন্তু এই ভিড়ভাট্টার মাঝেও লুকাতে পারছে না সে। স্মরণ ও নীলিমার এ লুকোচুরি খেলার সাক্ষী হলো মাহবুব। সে মাত্রই বাজার থেকে ফিরেছে। গেট দিয়ে বাড়ির ভেতর ঢুকতেই দেখলো স্মরণের এ কান্ড। স্মরণকে এভাবে দেখে মাহবুব আপনমনে হেসে বিড়বিড় করে বললো,
" ছেলে মস্ত বড় প্রেমিক হওয়ার যুদ্ধে নেমেছে বোধহয়। "
এদিকে নীলিমার লুকোচুরিপনা স্মরণকে ভারী বিনোদন দিচ্ছে। সে বিষয়টাকে উপভোগ করছে ভীষণ। এক পর্যায়ে সে নিজের মধ্যেই বিড়বিড় করে বললো,
" দুদিনের প্রেম অনুভূতি এমন পাগলাটে আকার ধারণ করবে কে জানতো! এই প্রেম বোধহয় এমনই হয়। কারো ক্ষেত্রে হুটহাট প্রেমজ্বর এসে গোটা শরীর কাঁপিয়ে দিয়ে যায়। তো কারো ক্ষেত্রে ধীরগতিতে এসে প্রেমরোগ ধরিয়ে দিয়ে যায়। আমার হলো প্রেম জ্বর। একদম হুটহাট প্রেম জ্বর। কি আশ্চর্যভাবে এই বোকা মেয়েটার প্রেমে পড়লাম আমি! যাকে 'প' বললে 'প্রেম' বুঝে নেয়ার কথা। তাকে 'প' বললে 'পালিয়ে যাওয়ার' বাহানা খুঁজে বেড়ায়। "
.
.
.
চলবে...........................................