কুহুর কথা বুঝতে কয়েক সেকেন্ড সময় লাগলো রওনকের।ইতিমধ্যে আকাশে ঘটা করে সন্ধ্যার আয়োজন নেমেছে।চিন্তায় বক্ষস্থল ফাঁকা হলো তার।গম্ভীর গলায় বলল,
"এই মুহূর্তে তুমি ঠিক কি ধরনের ইয়ারকি করছো বুঝতে পারছো কুহু? আমাকে কষ্ট দিয়ে, দুশ্চিন্তায় ফেলে কি শান্তি পাও?
ফোনের ওপাশ নীরবতায় কাটলো।চলন্ত ট্রেনের শব্দ এবার স্পষ্ট কর্নকুহরে পৌঁছাল রওনকের।অত্যল্পকালে বক্ষস্থল ধ্বক করে উঠলো।কপাল জুড়ে ঘাম বিন্দু জমলো।তবে কি কুহু সত্যিই ট্রেনে করে কোথাও যাচ্ছে?
" আমি, আসলে সত্যিই বলছি আপনাকে।
কুহুর চিকণ স্বর আরো মোলায়েম হলো।প্রলম্বিত দম নিল মেয়েটা।সবটাই ফোনের ওপাশে অনুভব করলো রওনক।কিয়ৎক্ষণের জন্য নিশ্বাস আঁটকে রইল তার।মনে হলো কুহুকে সে হারিয়ে ফেলছে! অদ্ভুত এক অনুভূতি তাকে দিশেহারা করে দিল।এলোমেলো পা ফেলে গন্তব্যহীন হেঁটে চলল রওনক।কুহু কোথায় আছে বিচলিত হয়ে জানতে চাইল।কুহু আমতাআমতা করলো।অস্থিরতা বাড়লো রওনকের।
"এখন দিনাজপুরের দিকে যাচ্ছি।আমার সাথে একটা পাঁচ - ছয় বছর বয়সী মেয়ে আছে।সে নাকি হারিয়ে গেছে।পরিবারের সাথে ঢাকায় এসেছিল। মেয়েটা একবার বলছে তার বাড়ি রংপুর আরেকবার বলছে দিনাজপুর।কারো ফোন নাম্বার নাকি মনে নেই।রাস্তায় বসে খুব কাঁদছিল।আপাতত তাকে নিয়ে দিনাজপুর যাচ্ছি।
রওনকের চলন্ত পা দু'টো থেমে গেল।কপালে ভাজ পরলো তার।
" মানে? তুমি দিনাজপুর যাওয়ার আগে আমাকে জানালে না কেন? আর নিজেই এতবড়ো একটা দায়িত্ব নিয়ে নিয়েছো! থানায় যেতে পারতে তুমি। যদি মেয়েটির পরিবার থানায় যায়? আর পুলিশ খোঁজ করলে তোমার সঙ্গে মেয়েটিকে পায় তাহলে নির্ঘাত কিডন্যাপার ভাববে তোমাকে।
কুহু আচমকা স্তব্ধ হয়ে গেল।এই কথা তার মোটা মাথায় প্রবেশ করেনি।সত্যিই তো! থানায় না গিয়ে বোকার মতো দিনাজপুর কেন যাচ্ছে সে? আসলে বাচ্চাটার কান্নার জন্য সবকিছু তালগোল পাকিয়ে গেছে।কোনোরকম তুতলে বলল সে,
"আপনি তো মিটিংয়ে ছিলেন।ছুটির পর শাহিনূর মাহি ম্যামকে পৌঁছে দেওয়ার দায়িত্ব নিয়েছেন।আমার ভীষণ রাগ হয়েছিল আপনার উপর।তাই কল করিনি।রেগে থাকলে কি কেউ আগ বাড়িয়ে কথা বলে নাকি?
রওনক এই মুহূর্তে ঠিক কি উত্তর দিবে বুঝতে পারলো না।কুহুর প্রতি চরম ক্ষিপ্ত হলো সে।যে সরলতা দেখে প্রেমে পড়েছে সেই বোকামো তাকে নাকানিচুবানি খাইয়ে দিচ্ছে! বাসে করে আসছে জানিয়ে ফোন রেখে দিল রওনক। যতক্ষণ মেয়েটাকে চোখের সামনে না দেখছে মন কিছুতেই শান্ত হবে না।একবার সামনে পেলেই হলো।রওনক কতটা ভয়নক হতে পারে সেটা বুঝিয়ে দিবে।স্বাধীন ভাবে চলতে দিয়ে আশকারা দিয়ে ফেলেছে একেবারে।শার্টের টপ বোতামটা খুলে দিয়ে লম্বা শ্বাস নিল।হাত ঘড়িতে চোখ বুলিয়ে দ্রুত পা চালালো রওনক।এই মেয়ে আবার কোথায় ফেঁসে যায় ঠিক নেই।ফল তো তাকেই ভোগ করতে হবে।
◾
রিশা বাড়িতে ঠিকই পৌঁছেছে তবে মনটা পড়ে আছে রাতিমের কাছে।অদৃশ্য এক জালে যেন আঁটকে যাচ্ছে ক্রমেই! রিশার বিচক্ষণ মস্তিষ্ক সেটা টের পেল! রাতিমের চোখমুখ জুড়ে অসম্ভব এক মায়া ঠাসা যেন! ও চোখে নিজের জন্য সম্মনও দেখেছে সে।শুদ্ধ আর জ্ঞানী পুরুষ! রাত ভালোই হয়েছে।অনেকবার ফোন হাতে তুলে নিয়েও রেখে নিল রিশা।এই মুহূর্তে রাতিম ভাইকে কল করা কি ঠিক হবে? কেন তার এত জড়তা সংকোচ কাজ করছে? আগের মতো দ্বিধাহীন ভাবটা যেন আর নেই! ঈষৎ লজ্জাও যুক্ত হয়েছে সঙ্গে। রাতিমের থেকে সব কথা জানার পর তো কোনো উত্তর দেয়নি রিশা।ইচ্ছে করেই চলে এসেছিল।বেচারা এবারও নিশ্চয়ই চিন্তায় আছে।রিশার মন হঠাৎই বলে উঠল, এই অসুস্থ মানুষটাকে এভাবে জ্বালাতন করে কি সুখ পাচ্ছ তুমি? একদম উচিত হচ্ছে না। এক্ষুনি তাকে কল দিয়ে বলেই দিতে পারো আপনি মহান পুরুষ রাতিম ভাই! এমন মানুষের প্রতি রাগ করে থাকা যায় না।কেবল ভালবাসা যায়! কথাটুকু ভাবতেই চোখমুখ খিঁচিয়ে নিল রিশা।নিজের মাথায় চাটি মেরে বিরবির করে বলল, মনের কথা কখনো শুনতে নেই।সকল নষ্টের মূল এই 'মন'! হেঁটে জানালার কাছে এসে পর্দা সরিয়ে দিল রিশা। পৃথিবী আজ অন্যরকম রঙিন লাগছে।এই প্রথম তার মন আশফিক ভাই ব্যাতিত অন্য কাউকে নিয়ে ভাবতে বসলো! বন্ধুর উপকার করতে কয়জন নিজেকে এভাবে বিলিয়ে দেয়? এত বড়ো বদনামের বোজা ঘাড়ে নিয়ে! সত্যিই রাতিম ভাই একজন সুন্দর মনের পুরুষ।
"তোর ভাই কি শুরু করেছে এসব? বিয়ে করার পর তো সম্পূর্ণ বদলে গেছে! ভাবখানা দেখলে মনে হয় নিজে পছন্দ করে সেচ্ছায় বিয়ে করেছে।
মায়ের কথায় ভাবনার ঘোর কাটলো রিশার।ঘুরে তাকাল সে।খাটে বসে বললেন শারমিন বেগম,
" রওনক ফোন করেছিল।আজকে বাড়ি ফিরবে না।কুহুকে নিয়ে নাকি ঘুরতে বেরিয়েছে।
মায়ের কথা এতক্ষণে বোধগম্য হলো রিশার। পরশু যেহেতু বন্ধের দিন আর কালকে বোধহয় তেমন কাজ নেই রওনকের তাই হয়তো বউ নিয়ে একটু বেরিয়েছে সে।ব্যাপারটা খুব ভালো লাগলো রিশার।প্রিয় মানুষটাকে নিয়ে কতশত স্বপ্ন থাকে সবারই! তপ্ত শ্বাস ফেলে বলল সে,
"কালকেই তো এসে যাবে মা।তা ছাড়া ভাইয়া তো সবসময় ভার্সিটি,ক্লাস আর কোচিং নিয়ে ব্যস্ত থাকে। এখন তেমন চাপ নেই তাই হয়তো বেরিয়েছে একটু।
মেয়ের কথার প্রতিত্তোরে দীর্ঘশ্বাস ফেললেন শারমিন বেগম।
◾
দিনাজপুর পৌঁছাতে ভোর হয়ে এসেছে প্রায়।আকাশ এখনো ঘোলাটে হয়ে আছে।আশেপাশে মানুষ বলতে নেই বললেই চলে।মেয়েটির কথা অনুযায়ী বিন্যাকুড়ি গ্রাম অবধি এসেছে সে। মেয়েটির পরনে লাল রঙা ফ্রক।কুহুর হাত আষ্টেপৃষ্ট জড়িয়ে ধরে আছে সে।মাথায় হাত বুলিয়ে নিয়ে আবারও ভালো মতো ঠিকানা জানতে চাইলো কুহু।মেয়েটি জানাল এখানেই। রওনক এখনো আসেনি। সারা রাতে হাজার খানেক হবে কল করেছে লোকটা। কুহুর ভীষণ খারাপ লেগেছে রওনককে দুশ্চিন্তা দেওয়ার জন্য। তার মাঝেও অন্যরকম এক ভাল লাগা ছুঁয়ে দিয়েছে। রওনক ভাই কি তাকে সত্যিই ভালবাসে? ভাবতেই শিরদাঁড়া বেয়ে শীতল স্রোত নেমে গেল।মেয়েটিকে নিয়ে পায়ে হেঁটে বলল কুহু। কিছুদূর এগুতেই এক বৃদ্ধ বয়সী পুরুষকে দেখে দাদা বলে চেচিয়ে উঠলো মেয়েটি। কুহুর ধ্যান ভাঙ্গলো।ততক্ষণে বৃদ্ধ এগিয়ে এসে মেয়েটিকে জড়িয়ে নিল।লোকটির সন্দিহান দৃষ্টি কুহুর মাঝে নিবদ্ধ।ভাঙ্গা স্বরে বলতে লাগলেন তিনি,
" রাফিয়া দাদু কই চইলা গেছিলা তুমি? কেউ তোমারে ধইরা নিয়া গেছিল?
কুহু অপ্রস্তুত হলো। রাফিয়া তার দাদাকে ছেড়ে দিয়ে বলল, সবাই মিলে যখন শপিং করতে বের হয়েছিল তখন রাফিয়া বিচ্ছিন্ন হয়ে গিয়েছিল। আশেপাশে খুঁজেও আর পায়নি মা আর ফুপিদের। ভয়ে রাস্তায় বসে কাঁদছিল।কেউ তার দিকে তাকাচ্ছিলও না।কুহুকে ইশারায় দেখিয়ে বলল,
"এই আন্টি আমাকে নিয়ে এসেছে।
বৃদ্ধ আজমল আলী স্বস্তির শ্বাস ফেললেন। তিনি ঢাকায় যাওয়ার জন্যই রওনা হয়েছিলেন।পথিমধ্যে নাতনির দেখা পেয়ে যাবেন ভাবেননি।ইতিমধ্যে থানায় মিসিং ডায়েরি করা হয়েছে।বাড়িসুদ্ধ সবার অবস্থা বেগতিক।নিজ গৃহে যাওয়ার জন্য কুহুকে অনুনয় করলেন আজমল আলী।বারবার কৃতজ্ঞতা প্রকাশ করলেন।রাফিয়াকে অবশেষে বাড়ি পর্যন্ত নিয়ে আসতে পেরেছে ভাবতেই ভালো লাগছে কুহুর।অগত্যা আজমল আলীর সঙ্গে চলল সে। রওনক না আসা পর্যন্ত রাস্তায় দাঁড়িয়ে থাকা সম্ভব নয়। জায়গাটা একেবারেই গ্রাম।কিছুদূর হাঁটতেই সরু পিচডালা রাস্তার দেখা মিলল।রাস্তার দু'ধারে সারি সারি বাঁশ গাছ। মৃদু বাতাস বইছে।বাতাসে এক অদ্ভুত ভেজা ঘ্রাণ।খুবই ভাল লাগছে কুহুর।কিছুদূর দৃষ্টি থমকে গেল।ঝাকঝমকপূর্ণ এক বাড়িতে প্রবেশ করলেন আজমল আলী।দেখে মনে হচ্ছে কারো বিয়ে।অথচ পুরো বাড়ি নিস্তব্ধ! মরিচ বাতিগুলো জ্বলছে।আশেপাশে দৃষ্টি বুলালো কুহু।বৃদ্ধ বেশ জোড় গলায় রহিমা বলে ডাকলো কাউকে।মধ্যে বয়সী একজন মহিলা বেরিয়ে আসলেন।রাফিয়াকে দেখে চিৎকার করে এগিয়ে এলেন।আজমল আলী সবই খুলে বললেন স্ত্রী'কে।ঢাকায় মেয়েদের আর ছেলের বউকে খবরটা জানিয়ে দিতে বললেন।হাতে থাকা ফোনটা বেজে উঠলো কুহুর।স্ক্রিনে রওনকের নাম।রিসিভ করে কানে জড়ালো সে।রওনক জানাল চলে এসেছে সে।কুহু জানাল একমিনিট পর কল দিচ্ছে সে।পরক্ষণে বৃদ্ধর কাছে এগিয়ে এসে বলল,
"আংকেল আমি চলে যাচ্ছি।আমার হাসবেন্ড নিয়ে যেতে এসেছে আমাকে।
" চলে যাবে মানে? আমার দুই মেয়ের বিয়ে কালকে।তোমার স্বামীরে বাড়িতে আসতে বলো।
কুহু কি বলবে বুঝতে পারছে না।ঘর থেকে রহিমা বেরিয়ে এসেছে।কুহুর দিকে তাকিয়ে আছে নিশ্চুপ। বেশভূষা তো বলছে না সে বিবাহিত! রাফিয়া এগিয়ে এসে কুহুর হাত ধরে বায়না করতে লাগলো যেন বিয়ে পর্যন্ত থেকে যায়। কুহুকে তার ভীষণ ভালো লেগেছে। রহিমাও বেশ জোড়াজুড়ি করলেন।আদৌ কুহুর স্বামী এসেছে কিনা সেটা দেখবেন তিনি।সন্দেহ একটা রয়েই গেছে মনে।অগত্যা রওনককে ফোন করে ঠিকানা বলে দিল কুহু।রহিমা ঘরে চলে গেল নাশতা পানির ব্যবস্থা করতে।গ্রামের কিছু সংখ্যক মানুষ রাফিয়াকে দেখতে আসলো।ছোটখাটো একটা জটলা পাকিয়ে গেল।কুহু কয়েক কদম হেঁটে রাস্তায় দাঁড়িয়ে রওনকের অপেক্ষা করতে লাগলো।কিছু সময়ের মধ্যে রওনকের দেখা মিলল।হন্তদন্ত হয়ে ছুঁটে আসলো সে।উম্মাদের মতো লাগছে তাকে।চুলগুলো এলোমেলো হয়ে কপাল ছুঁয়ে আছে।চোখদুটো স্পষ্ট বলছে বহুক্ষণ ধরে তন্দ্রার স্বাদ পায়নি।লালচে হয়ে আছে ভীষণ।কুহুর সম্মুখে এসে ঘনঘন দম ফেলল রওনক।পরক্ষণে ঝাপটে ধরলো বুকের মাঝে।অপ্রস্তুত হয়ে গেল কুহু।শক্ত হয়ে দাঁড়িয়ে রইল শুধু। গ্রাম্য মহিলারা আশ্চর্য হয়ে তাকিয়ে আছে।কেউ কেউ কানাঘুষা শুরু করে দিয়েছে।ছেলেটার মাঝে বিন্দুমাত্র লজ্জা নেই!ফিসফিস করে বলল কুহু, আশেপাশে সবাই দেখছে!
রওনক শুনলো না।চেপে ধরে রাখলো কুহুকে।যেন সহস্র বছর পর তাদের দেখা! ভরাট স্বর নিয়ে বলল সে,
"এই একটা রাত আমার কিভাবে গিয়েছে কোনো ধারণা করতে পারবে তুমি? কিসের মধ্যে দিয়ে গিয়েছি আমি! এতটা বোকার মতো কাজ কেন করো তুমি? যখন হারিয়ে যাব তখন বুঝবে।
শেষের কথাটুকু শুনতেই রওনককে জড়িয়ে নিল কুহু।পাশে থাকা মহিলাগুলোর চোখ কোটর থেকে বেরিয়ে আসছে রীতিমতো! আজমল আলী ঘরের ভেতরে চলে গেলেন।রহিমা তাকিয়ে আছে দূর থেকে।এমন বেহায়াপনা আগে দেখেনি সে।স্বামী- স্ত্রীর মাঝে মোহাব্বত থাকা ভালো।সেটা বাইরের মানুষকে কেন দেখিয়ে বেড়াতে হবে?
কুহুর চোখ জলে ভেসে উঠলো।শরীর মৃদু কাঁপছে।সত্যিই এই মুহূর্তে আশেপাশের কোনো তোয়াক্কা নেই।সুন্দর মুহূর্তে সবসময় আসে না জীবনে।আজকের দিনটি না আসলে রওনক ভাইয়ের এই তীব্র ভালবাসাটুকু তার চোখে পড়তো? এই লোকটা হারিয়ে গেলে যে কুহুর অস্তিত্ব থাকবে না।রহিমা কিছুটা এগিয়ে এসে বলেই ফেলল,
" এই মাইয়া ঘরে যাও তো।দেখতাছো না আশেপাশে কত মানুষ? এতদূর জার্নি কইরা আসছো ঘরে যাও।বিশ্রাম নাও!
*****
দ্রুত গতিতে সরে আসলো কুহু।রওনক আশপাশে খেয়াল হতেই দেখলে সকলের উৎসুক দৃষ্টি তাদের মাঝে নিবদ্ধ।রহিমা বেগম হরহর করে রুমে চলে গেলেন।তাকে অনুসরণ করলো কুহু।ভীষণ লজ্জা আর অসস্থি তাকে ঘিরে ধরেছে।রওনক কোনোকিছুর পরোয়া করলো না।কুহুর পিছু নিল।তার মনের অবস্থা তো আর লোকে জেনে বসে নেই।বেশ পরিপাটি একখানা রুম কুহুকে দেখিয়ে এক মেয়ে।
রুমে এসে স্বামীর সঙ্গে খানিকক্ষণ আগে ঘটে যাওয়া ঘটনা নিয়ে কথা আরম্ভ করলেন রহিমা বেগম।এমন নিলাজ ছেলে মেয়ে তিনি আগে দেখেননি।শহরে বড়ো হবে বলে কি আদবকেতা নেই? স্ত্রীর কথা কানে তুললেন না আজমল আলী। এই অচেনা মেয়েটির সুবাদেই তো নাতনিকে ফিরে পেয়েছেন।এর বাইরে তার বিষয়ে না ভাবাই ভালো।স্ত্রীকে বললেন নতুন মেহমানদের যেন যত্ন-আত্তির কোনোরকম কমতি না হয়।স্বামীর কথায় সহমত পোষণ করলো রহিমা।যত কিছুই হোক মেয়েটা কিন্তু বেশ বড়ো মনের পরিচয় দিয়েছে।আজমল আলী জানালেন ঢাকায় রাফিয়ার মায়ের অবস্থা ভালো নয়।জ্ঞান হারিয়েছিল সে। তার দুই মেয়ে সামলে নিয়েছে।তারা আপাতত দিনাজপুরে রওয়ানা দিয়ে দিয়েছে।স্বামীর কথা শুনে আশ্বস্ত হলেন রহিমা।ছেলেকে কি জবাব দেবেন ভাবতেই বিপি হাই হয়ে গিয়েছিল।
◾
দক্ষিণে বড়োসরো কাঠের জানালা।নির্মল বাতাস সুরসুর করে প্রবেশ করছে রুমে।বিশাল এই বাড়িটা রাজপ্রাসাদ থেকে কোনো অংশে কম মনে হচ্ছে না কুহুর।শহরে সচরাচর এমন ধাঁচের বাড়ি দেখা যায় না।পাশেই দাঁড়িয়ে আছে ছোট রাফিয়া।টুকিটাকি কথা বলছে কুহুর সঙ্গে।রওনক হাত ভাজ করে দাঁড়িয়ে দেখছিল কুহুকে।এই মেয়ের জন্য আজ কোথা থেকে কোথা অব্দি চলে এলো! নির্লজ্জের তকমাও পেল! অথচ মহারানীর কি কোনো চিন্তা আছে এই বিষয়ে? হিয়নের মন, মস্তিষ্কের উপর দিয়ে কি বয়ে গেছে সেটা কি আন্দাজ করেছে? উল্টো নিজের মতো আনন্দে আছে।জানালা দিয়ে উঁকি দিলেই শানবাঁধানো পুকুর ঘাট দেখা যায়।রাফিয়া টেনেটুনে কুহুকে নিয়ে সেদিকে চলে গেল। বোকার মতো দাঁড়িয়ে রইল রওনক।কুহু বেরিয়ে যেতেই সেই কিশোরী মেয়েটা উপস্থিত হলো শরবত নিয়ে।চোখেমুখে লাজুক ভাব।ঠোঁটে ঈষৎ হাসি।আড় চোখে তাকিয়ে শরবতের গ্লাস হাতে নিল রওনক।মেয়েটা কয়েক সেকেন্ড দাঁড়িয়ে থেকে বলল,
"আপনেরা কি কোনো মুভিতে অভিনয় করেন? দুইজন দুইজনরে যহন জড়ায় ধইরা ছিলেন কি যে চমেৎকার লাগতাছিল!
শরবত খেতে গিয়ে বিষম খেল রওনক।পাশেই সোফায় বসে নিজেকে ধাতস্থ করার চেষ্টা করলো।মেয়েটা ভয়ে ততক্ষণে চলে গেল।কিছুক্ষণের মাঝে উপস্থিত হলেন রহিমা।শান্ত হয়ে শোফায় গা এলিয়ে চোখ বুজেছে রওনক।আপাদমস্তক দেখে নিয়ে প্রশ্ন ছুড়লো সে,
" এই পোলা তোমার বউ কই?
রহিমার শক্ত কথায় চোখ মেলে তাকাল রওনক।সোজা হয়ে বসলো।কুহুর কথা জিগ্যেস করতেই তার অভিমানটুকু আবারও মাথাচাড়া দিয়ে উঠলো।কপালে ঈষৎ ভাজ ফেলে বলল,
"হবে হয়তো কোথাও এদিকসেদিক।আমি দেখিনি।
" দেখো নাই মানে? সবার সামনেই তো পেরেম উতলাইয়া পরতাছিল! এহন এমন দায়সারা উত্তর দিতাছো ক্যান? ওই মাইয়া আসলেই তোমার বউ তো?
রওনকের এবার বিরক্তি ধরে গেল।এ কোথায় এসে পড়লো সে? এখানে আর এক মুহূর্ত থাকা যাবে না।চোখমুখ শক্ত করে জবাব দিল সে।
"নাহ আমার বউ না।কাবিন করে কবুল বলে উঠিয়ে নিয়ে গিয়েছিলাম বাড়িতে।
পান খাওয়া টুকটুকে লাল জিভ টা বের করে কামড়ে ধরে বললেন রহিমা,
" সর্বনাশ! তার মানে বাড়িতে বাপ মায়ে মানে নাই তোমাগো?
রওনক আর দাঁড়াল না একমুহূর্তও।হনহন করে বেরিয়ে গেল।রহিমা হতভম্ব হয়ে দাঁড়িয়ে রইল।
•
পুকুরের ঠিক ডানপাশে ছোটখাটো একটা বাগান।চারিপাশে বাউন্ডারি করা।সারি সারি সুপারি গাছ দাঁড়িয়ে আছে।তার ঈষৎ ছাঁয়া পরেছে ঘাসের উপর।দোলনায় বসে দোল খাচ্ছে কুহু।পাশে রাফিয়া বসে আছে।এই মুহূর্তে পরিবেশটা ভীষণ ভালো লাগছে কুহুর।এমন জায়গায় তো অনায়াসে সহস্র বছর কাটিয়ে দেওয়া যাবে! আচমকা হাতে হ্যাচকা টান অনুভব হতেই হকচকিয়ে উঠলো কুহু।পাশেই কঠোর চোখেমুখে দাঁড়িয়ে আছে রওনক।
"তুমি কি আসলেই বিয়ে খেয়ে যাবে? এরা তোমার কে হয়? চেনো ওদের?
রওনক ভীষণ রেগে আছে এটুকু বুঝতে পারছে কুহু।তবে এই মুহূর্তে কি জবাব দেবে সে? আমতাআমতা করছে।
" এখানে আসার পর আমার সঙ্গে কথা বলেছ তুমি? আমি কি চাই জিগ্যেস করেছ? এই যে সারারাত দুশ্চিন্তা দিয়েছ তার কোনো পরোয়া আছে?
কোনোরকম তুতলে বলল কুহু,
"হ্যাঁ,আছে তো।আপনি কত টেনশন করেছেন ভেবে আমারও সারারাত ঘুম হয়নি ট্রেনে।
রওনক কিছু বলল না।কুহুকে টেনে দোলনায় বসিয়ে দিল।পেছনদিকে দাঁড়িয়ে কুহর গলা আলতো জড়িয়ে ধরে কানের কাছে ফিসফিস করে বলল,
" শাস্তি তুমি অবশ্যই পাওনা আছ নির্বোধ মেয়ে। যতকিছুই হয়ে যাক এই সাজা থেকে কোনোমতেই নিস্তার পাবে না এটুকু জেনে রাখ! সুতরাং মানসিক ভাবে প্রস্তুতি নাও, মিষ্টি এক যন্ত্রণদায়ক যাতনা অপেক্ষা করছে।শুধু বাড়ি পৌঁছাতে দাও আমায়।
প্রতিটা কথায় মৃদু কেঁপে উঠলো কুহু।হৃৎস্পন্দন থেমে গেল তার।কি চলছে এই বদ পুরুষের মস্তিষ্কে? দোলনাটা হালকা দুলিয়ে দিল রওনক।পেছাতেই তার শক্তপোক্ত হাতে ফের থামিয়ে দিয়ে আলগোছে কুহুর গালে গভীর চুম্বন করলো। পাশেই রাফিয়া বসে গল্প শোনাচ্ছে।কুহু বরফের মতো জমে গেল।অত্যল্পকালে তার সমস্ত শরীর শিউরে উঠলো! ফের দোলনাটা দুলিয়ে দিল রওনক।বেশ স্বাভাবিক ভাবেই বলল,
"এটা তোমার শাস্তির আগাম সতর্কসংকেত! পরবর্তীতে সেটা কতখানি আঘাত হানতে পারে ভেবে নিয়ো।
পাশে থাকা রাফিয়া শাস্তির কথা শুনে হেসে ফেলল খিলখিল করে।ঠোঁট উল্টে বলল,
" বড়োদের আবার শাস্তি দেয় নাকি? শাস্তি তো ছোটদের দেয়।পড়াশোনা না করলে তারপর দুষ্টুমি করলে।
পাশ থেকে হতাশার স্বরে বলল রওনক,
"তোমার আন্টিটা ভীষণ দুষ্টু বুঝলে! একদম কথা শোনেনা।এই জন্য তাকে এমন শাস্তি দিব, যেন একেবারে আমার বাধ্যগত হয়ে যায়!
চোখমুখ কাতর করে বলল রাফিয়া,
" আন্টিকে বেশি মেরো না।তার কষ্ট হবে।ভয় পাবে সে।
কুহুর ঘাড়ে আলতো করে আঙ্গুল চালিয়ে বলল রওনক,
"আমি ভীষণ নিষ্ঠুর একজন মানুষ।তোমার আন্টি ভয় পেলেও তার আর নিস্তার নেই।বড্ড জ্বালিয়েছে সে আমাকে।
কুহু আর একমুহূর্ত বসলো না।উঠে দ্রুত প্রস্থান করলো। রওনক ভাইয়ের মনে এই মুহূর্তে ঠিক কি চলছে সেটুকু বুঝতে বাকি নেই তার।নির্লজ্জ পুরুষ কোথাকার। কুহুর যাওয়ার পানে তাকিয়ে থেকে শব্দ করে হেসে ফেলল রওনক।
◾
সন্ধ্যা নাগাদ বাড়ি ফিরেছেন আজমল আলীর দুই মেয়ে আর ছেলের বউ। রাফিয়ার মা বাড়িতে প্রবেশ করেই মেয়েকে বুকে জড়িয়ে নিয়ে হাউমাউ করে কেঁদে ফেলেছিল।কুহুর দুই হাত জড়িয়ে নিয়ে কৃতজ্ঞতায় চোখ ভাসিয়ে দিল। সকলের আবেগঘন মুহূর্ত দেখে খারাপ লাগলেও কোথাও একটা ভাল লাগছে কুহুর।আজকে আজমল আলীর জমজ দুই মেয়ের বিয়ে।বাড়িতে হইহট্টগোল,আনন্দের জোয়ার বইছে।আজ যদি রাফিয়াকে সত্যিই পাওয়া না যেত তবে এই আনন্দ মুখর বাড়িটা এমন প্রানবন্ত থাকতো না নিশ্চয়ই! নিমেষে ধূলিসাৎ হতো সব।কুহু ঠিক সময়ই এসেছে মনে হচ্ছে।তাছাড়া এমন জমজ বিয়ে তার আগে কখনো দেখা হয়নি।লিলি আর ইলি দুই বোনই বেশ হাসিখুশি! মুহূর্তেই কুহুর সঙ্গে মিশে গেছে একদম! রওনক চলে যেতে চাইলেও সবার অনুরোধে শেষ পর্যন্ত থাকা হলো তাদের।সারা বাড়িতে আবারও বিয়ের আমেজে পরিপূর্ণ! রাতের বেলা রঙবেরঙের আলোকসজ্জায় একরকম রাজকীয়তার ছোঁয়া লেগেছে বাড়িতে! ঘুরে ঘুরে সম্পূর্ণ বাড়িটাই রাফিয়ার সঙ্গে হেঁটে দেখেছে কুহু। উচ্চ শব্দে গান বাজছে। একদম মেয়েটা একত্রে গাঢ় বেগুনি রঙা শাড়ি পরেছে। ছেলেরা সব একই রঙা পাঞ্জাবি। মুগ্ধ হয়ে দেখছিল কুহু। অথচ তার বিয়েটা হয়েছিল খুবই সাদামাটা! তাতেও ঝামেলার কমতি ছিল না।অবশেষে অপ্রত্যাশিত ভাবেই রওনক ভাইয়ের হয়ে গেল সে।কথাগুলো ভাবতেই দীর্ঘশ্বাস বেরিয়ে এলো। লিলি আর ইলিকে পার্লার থেকে সাজিয়ে আনা হয়েছে।কাঁচা হলদে শাড়ির লাল পাড়।দুই বোনকে একেবারে পুতুলের মতো লাগছে! কুহুকে দু'জনেই বেশ আঁটসাঁট বেঁধে ধরেছে শাড়ি পরার জন্য।রাফিয়ার মা রত্না যাবে পার্লারে। কুহুকে ছাড়া কিছুতেই যাবে না সে। সম্পূর্ণ অপরিচিত পরিবেশে নিজেকে মানিয়ে নিতে একটু অসস্থিতে পড়লো কুহু। তার উপর আশেপাশে রওনক ভাইয়ের দেখা নেই। অগত্যা সবার জোড়াজুড়িতে রাজি হলো কুহু।
•
রওনককে পাঞ্জাবি পরার কথা বললেন আজমল আলী।বরাবরই নাখোশ করে গেছে সে। ছোট ছোট ছেলেপেলেদের সঙ্গে একই রঙের পাঞ্জাবি পরাটা বেমানান লাগছে তার কাছে। গানের শব্দ থেকে বেশ অনেকটা দূরেই পুকুর ঘাটে বসে আছে রওনক। কুহুকে অনেক্ক্ষণ যাবৎ দেখছে না।মনটা পায়চারি হয়ে আছে কেমন।অন্দরে সব মেয়েদের দল। হুট করে তো প্রবেশ করা যায় না। নির্বোধ মেয়েটাও কি একবার বেরিয়ে আসতে পারে না? পুকুরের ঘোলাটে জলে স্থির দৃষ্টি রাখলো রওনক।চাদের ছাঁয়া পরেছে তাতে। মনে হচ্ছে চাইলেই হাত বাড়িয়ে ছোঁয়া যাবে! তবে মিছে আলো ছাড়া কিছুই মিলবে না। রওনকের একাকিত্ব ঘুচাতে আজমল আলী আসলেন। টুকিটাকি গল্প জুড়লেন।এই গ্রামে একনামেই চেনে তাদের।প্রাচীন জমিদার গোত্রের তারা। চালচলনে তেমনই প্রকাশ পাচ্ছে। দুই মেয়ে আর এক ছেলে নিয়েই তার সংসার।ছেলে প্রবাসী। বেশ উচ্চ শিক্ষিত।গ্রামে ব্যবসা করবে না। বেশ মনোযোগ নিয়ে আজমল আলীর কথা শুনলো রওনক। কোনো প্রতিত্তোর করলো না। খাবারের দিক সামাল দিতে চলে গেলেন তিনি। তপ্ত শ্বাস ফেলে উঠে দাঁড়াল রওনক। রাত ভালোই হয়েছে। ঘুরে তাকাতেই কয়েক সেকেন্ডের জন্য থমকে গেল সে। কুহু দাঁড়িয়ে আছে হলুদ রঙা শাড়ি পরে। হাত ভর্তি চুড়ি। ফুলের গয়না জড়িয়ে আছে গায়ে। হৃৎস্পন্দন বেড়ে গেল রওনকের! ভীষণ মায়াবী লাগছে কুহুকে। আচমকা কোমড়ের কাছে দৃষ্টি থমকে গেল। শাড়ির আচল বোধহয় বেখেয়ালি সরে গিয়ে বেরিয়ে আছে উন্মুক্ত ফর্সা উদর। ধীর পায়ে এগিয়ে আসলো রওনক।কুহুকে টেনে নিল নিজের কাছে। গভীর এক যেন আছন্ন করে রেখেছে তাকে। ফ্যালফ্যাল দৃষ্টি নিয়ে তাকিয়ে আছে কুহু। রওনকের উত্তপ্ত শ্বাস তার কপাল ছুঁয়ে দিচ্ছিল। অদ্ভুত এক ভাল লাগা ছুঁয়ে দিচ্ছে কুহুকে। প্রিয় কারো জন্য সাজলে সে যদি মুগ্ধ নয়নে এভাবে দেখে তাহলে তো ভালো লাগবেই! কুহুর উন্মুক উদরে শক্ত হাতের স্পর্শ পেতেই ভয়ানক চমকে উঠলো কুহু। সরে আসতে চাইলে খেয়াল করলো অপর হাতে আবদ্ধ সে। চারিদিকের ঘটা আলোয় সবকিছু সুস্পষ্ট! যদিও এদিকে কেউ নেই তবুও ভীষণ লজ্জা পাচ্ছে কুহু। রওনকের ধুকপুকানি শুনতে পাচ্ছে। আলতো করে শাড়ি টেনে কুহুর পেটের অংশটা ঢেকে দিল রওনক।গম্ভীর স্বরে বলল,
"আমাকে আর কতভাবে জ্বালাতন করলে তুমি শান্তি পাবে? আমি যদি পাল্টা শোধবোধ নেই সহ্য করতে পারবে তো?
অপ্রতিভ হয়ে বার কয়েক চোখের পাতা ঝাপটালো কুহু। দৃষ্টি রাখলো রওনকের বুকে। মৃদু স্বরে বলল,
" আমি আপনাকে কোনো জ্বালাতন করিনি। আর অপরাধও করিনি। বিনা দোষে শাস্তি দিতে পারেন না আপনি। এবার ছাড়ুন কেউ দেখে ফেলবে।
আরেকটু শক্ত করে জড়িয়ে নিয়ে বলল রওনক,
"দেখুক। গোটা দেশ দেখুক। নিজের বউকে জড়িয়ে ধরেছি।
" সবাই তো আর সেটা জানে না। ছাড়ুন তো।আপনার বউ নই আমি। সাময়িকের জন্য ভুলে যান এটা।
হঠাৎ পাশ থেকে বলে উঠলো রহিমা,
"হায় সর্বনাশ! আমি আগেই সন্দেহ করছিলাম তোমরা যে বিবাহিত না!
*****
রহিমার কথায় ভাবনার ঘোর কাটলো রওনকের। কুহু দ্রুত সরে দাঁড়াল।দৃষ্টি রাখলো মাটিতে। বিরক্তিতে কপাল কুঁচকে এসেছে রওনকের।আসার পর থেকে এই মহিলা দেখছি পিছুই ছাড়ছে না! রওনক উত্তর দেওয়ার আগেই রহিমা মুখ বাঁকিয়ে চলে গেল। কুহু বোকার মতো তাকিয়ে আছে রহিমার যাওয়ার পানে। চোখমুখ শক্ত করে বলল রওনক,
"আমরা বিবাহিত হই বা না হই তাতে এই মহিলার কি সমস্যা? সব জায়গায় কি কাবিন নামা নিয়ে ঘুরবো নাকি?
কুহু মিটিমিটি হাসছে। সেটা দৃষ্টিগোচর হলো না রওনকের।কপালের ভাঁজ সমান হলো তার। অসম্ভব সুন্দর লাগছে কুহুকে! ইচ্ছে করছে আজ গোটা রাত চোখের সামনে বসিয়ে রাখুক মেয়েটাকে।তবে যদি চক্ষু তৃষ্ণা মেটে! কয়েক পা এগিয়ে আবারো কুহুর কাছাকাছি চলে আসলো রওনক।চমকে চারিপাশে দৃষ্টি বুলালো কুহু। কোনোরকম যেন তোয়াক্কা নেই রওনকের।কুহুর হাত চেপে ধরে বড়োসরো একটা গাছের আড়ালে টেনে নিয়ে গেল। মাথা খানিক উঁচু করে রওনকের চোখের দিকে তাকিয়ে বলল কুহু,
" খানিকক্ষণ আগের কথা ভুলে গেলেন? সরুন। সবাই খুঁজবে আমাকে।
রওনকের অস্থির দৃষ্টি। শক্তপোক্ত পুরুষালি হাত দুখানা রাখলো কুহুর উন্মুক্ত কটিদেশে।তৎক্ষনাৎ দৃষ্টি নামালো কুহু।অদ্ভুত এক জড়তা ঘিরে ধরল তাকে। পায়ের তলানি শিরশির করে উঠলো।মৃদু আওয়াজ তুলে বলল রওনক,
"আমার যে তোমাকে ছাড়তে ইচ্ছে করছে না কুহু। নিজেকে স্থির রাখতে পারছি না। বারবার আমাকে অশান্ত করে দিয়ে তো পালাতে পারো না তুমি। আমি তো আর অনুভূতিহীন রোবট নই! দূরত্ব আমাকে ভীষণ পোড়ায়।
এই মুহূর্তে রওনক ভাইয়ের মনের অবস্থা বেশ বুঝতে পারছে কুহু। লজ্জায় কান দিয়ে ধোঁয়া ছুটে গেল তার। সামনে থাকা লোকটা তাকে প্রচন্ড ভালোবাসে এতে বিন্দু পরিমাণ সন্দেহ নেই! চাইলেও রওনককে ফিরিয়ে দেওয়ার সাধ্য তার নেই। কুহুর উত্তরের অপেক্ষা করলো না রওনক। হাত বাড়িয়ে কুহুর নাক থেকে নথ খুলে নিল।ভয়ানক চমকালো কুহু।চোখ গোল গোল হয়ে এলো তার।এই মুহূর্তে ঠিক কি ঘটবে তার মস্তিষ্ক দ্রুত সংকেত দিয়ে দিল। রওনক ধীরে ধীরে এগোতেই ঠোঁটের উপর হাত রেখে আঁটকে দিল কুহু। ভ্রু কুঁচকে এলো রওনকের।কোনোরকম বলল কুহু,
" কি করছেন? দেখছেন না আমার ঠোঁটে লিপস্টিক? সাজ ঘেটে দেওয়ার পায়তারা করছেন তাই না? আমি তো সেটা হতে দিব না।
কথাটুকু বলেই রওনককে একপ্রকার জোরেসোরে ধাক্কা দিয়ে সরিয়ে দিল কুহু। নথ ঠিক করতে করতে দ্রুত পা ফেলে প্রস্থান করলো। রওনক হতবুদ্ধি হয়ে তাকিয়ে আছে। তার ঠিক কিরকম প্রতিক্রিয়া জানানো উচিত বুঝতে পারছে না। তবে মনে হচ্ছে এই গর্দভ মেয়েকে মনের অব্যক্ত অনুভূতি বুঝিয়ে কোনো লাভ হলো না। একবার এই মেয়েকে ভাগে পেলে এবার আর নিস্তার দিবে না রওনক। ইচ্ছাকৃত জ্বালানোর কষ্ট বুঝিয়ে ছাড়বে।
◾
লিলি আর ইলিকে হলুদ লাগাচ্ছে সবাই। এক ঝাঁক মেয়ের দল নাঁচ করছে।কুহুর খুবই আনন্দ হচ্ছে।খানিক আফসোসও হচ্ছে।তার বিয়েটা তো এত ঝাঁকঝমক ভাবে হয়নি।রহিমা আড় চোখে বারবার কুহুকে খেয়াল করছিল আর নাক সিটকে যাচ্ছিল।কোথা থেকে রত্না এসে কুহুর পাশে বসে বলল,
"কোথায় ছিলে গো এতক্ষণ? খুঁজছিলাম।
" এই তো এদিকেই।
একটুখানি হেসে বলল রত্না,
"বুঝেছি।সাহেবের কাছে ছিলে তাই তো? আমিও এতক্ষণ আমার হাসবেন্ডের সাথে ভিডিও কলে কথা বলে এসেছি। সে আমাকে একেবারে চোখে হারায়! প্রেমের বিয়ে বুঝলে। তোমাদেরও নিশ্চয়ই আমাদের মতোই? গ্রামের মানুষ তোমাদের নিয়ে কত কথা বলাবলি করছে। তুমি কিছু মনে কোরো না। কতজন কত কথা বলবে।কানে তুলবে না।
রত্নার কথায় নিশ্চুপ হয়ে গেল কুহু।তাদের তো প্রেমের বিয়ে নয়।বরং ঝুট-ঝামেলা হয়ে বিয়ে। কথাটুকু ভাবতেই মন খারাপ হয়ে গেল।তবে রওনক ভাই তাকে খুব ভালোবাসে এটা ভাবলেও ভালো লাগে। কুহু ভেবেছিল জীবনটা স্বাভাবিক যাবে না।অথচ তার ভাবনা সম্পূর্ণ ভুল প্রমাণিত করেছে রওনক ভাই। কুহুকে চুপ থাকতে দেখে বলল রত্না,
" আরেকটা কথা বলবো ভাবছিলাম।কি মনে করো তুমি। আসলে আমার শাশুড়ি তোমাদের নিয়ে কিসব বলে বেড়াচ্ছে। উনি আগেকার দিনের মানুষ তো। এই যে তোমার হাতে চুড়ি নেই নাকে ফুল নেই তাই হয়তো উনার সন্দেহ হচ্ছে। আমি বুঝিয়েছি উনাকে। সে মানতে নারাজ! তোমার কানে কথাটা আসলেও খারাপ লাগবে তাই আমি আগেই বলে রাখলাম। লিলি আর ইলিও আম্মাকে শাষিয়েছে। কথাটা বাবার কানে গেলে তিনিও রাগ হবেন।
কুহু নিশ্চুপ শুনছিল রত্নার কথা। চুড়ি আর নাকফুল পরার প্রচলন যে খুব একটা শহরে নেই এমন নয়। নিজের শাশুড়িকেও পরতে দেখেছে কুহু। তার বেলায় তো নিয়ম ভিন্ন। কলেজে এসব পরে তো যাওয়া যায় না।রওনক ভাইয়ের নিষেধাজ্ঞা আছে কিনা। কুহুরও তো খুব ইচ্ছে করে একদম বউ সেজে থাকুক! সংসার করুক মন দিয়ে। তা নয়।রওনক ভাই তাকে পড়াশোনা করাতে ব্যস্ত! তপ্ত শ্বাস ফেলে বলল কুহু,
"এখন আন্টির সন্দেহ কিভাবে দূর করবো ভাবী? আমি তো কাবিননামা নিয়ে আসিনি। একসাথে বিয়ের ছবিও নেই ফোনে।
" আরে তোমাকে প্রমাণ দিতে বলেছে নাকি কেউ? আমি শুধু বলে রাখলাম তোমাকে, যে যাই বলুক কানে তুলবে না। মন খারাপ করবে না।
কুহুর মাথায় চট করে একটা বুদ্ধি খেলে গেল। ব্যগ্র স্বরে বলল সে,
"একটা কাজ করলে কেমন হয়? আমি আর আমার স্বামী আবার বিয়ে করে নেই। তাহলে সবার মুখ বন্ধ হয়ে যাবে।
রত্না ভ্যাবাচ্যাকা খেয়ে তাকিয়ে আছে। এমন কিছু শুনবে ভাবেনি।
"মেয়ে তুমি কি মজা করছো? নাকি রাগ হয়ে বললে?
" একদমই না। এত আয়োজন দেখে আমার নিজেরই ইচ্ছে করছে আবার বিয়ে করতে। আসলে আমাদের বিয়েটা একেবারে ঘরোয়া আর সাদামাটা ভাবে হয়েছিল।আকদের মতোই। এভাবে বিয়ে হলে মন্দ হয় না।
কুহুর চোখমুখ দেখে বোঝা গেল সে সত্যিই বলছে। বসা থেকে দাঁড়িয়ে বলল রত্না,
"তাহলে তো খুব ভালো হয়। সবার জন্য যোগ্য জবাব এটা। কালকে লিলি আর ইলির সঙ্গে তোমাদেরও বিয়ে হবে। তার দায়িত্ব আমি নিলাম।
কথাটুকু বলেই প্রস্থান করলো। শেষের কথাটা ভীষণ ভালো লাগলো কুহুর। সব কেমন স্বপ্ন স্বপ্ন লাগছে! হুট করেই যেন অচিনপুরের রাজ্য এসে পৌঁছে গেছে সে। মনের ইচ্ছে গুলো বলতেই কেমন পূরণ হয়ে যাচ্ছে! কিছুক্ষণ মাঝে স্টেজ ছেড়ে নেমে এলো লিলি আর ইলি।গানের তালে নাঁচতে থাকলো দু'বোন। কুহুকেও টেনে নিল সঙ্গে।জগৎ ভুলে একেবারে তাল মেলালো কুহু।হঠাৎই তার আনন্দ দ্বিগুণ হয়ে গেল। ভালোমতো একটু খেয়াল করলে বোধহয় দেখতো একজোড়া রক্তিম চোখ তাকে আবদ্ধ করে রেখেছে। এর পরিণাম নির্ঘাত ভয়ানকই হবে।
◾
কুহুদের বিয়ের জন্য সবাইকে একপ্রকার রাজি করিয়ে ফেলেছে রত্না। অবশ্য দুই ননদী তাকে সঙ্গ দিয়েছে সমান ভাবে। আজমল আলী যেন ঘটা করেই গ্রামবাসীকে জানিয়ে দিলেন তার আরো এক মেয়ের বিয়ে আজ। রহিমার মুখটা বাংলার পাঁচের মতো হয়ে ছিল। সন্দেহ দূর হয়েছে ঠিকই তবে নতুন আরো ঝামেলা যুক্ত হবে ভাবতে পারেনি। এ জন্যই বলে পরের পিছনে লেগে থাকা ঠিক নয়। এর পরিণাম ভালো হয় না। রহিমার মুখ দেখে ভীষণ হাসি পাচ্ছিল রত্নার।
•
রওনক সকাল বেলায়ই জেনেছে তাদের আবারও বিয়ে হবে।কথাটা শুনে চরম ক্ষিপ্ত হয়েছে সে। বিষয়টা তার কাছে মোটেও ভালো লাগেনি। সবাই কি পেয়েছে? সন্দেহের জন্য আবারও বিয়ের পিড়িতে বসিয়ে দিবে? বোকা মেয়েটার জন্য এখানে ফেঁসে গেছে সে। কি দরকার ছিল বিয়ে খাওয়ার? কথাগুলো ভাবতে ভাবতে আয়নায় নিজেকে দেখলো রওনক। সাদা পাঞ্জাবি আর পাজামা পড়েছে সে। অপরিচিত কয়েকটা ছেলে দাঁড়িয়ে আছে তাকে নিয়ে যাওয়ার জন্য। ওদিকে লিলি আর ইলির বিয়ে পড়ানো শেষ। এখন কুহুর পালা। কাজী যখন কাবিনের পরিমাণ জিগ্যেস করেছিল উত্তরে কুহু বলেছিল সে রওনক ভাইকেই চায়। উপস্থিত সবাই ভীষণ অবাক হয়েছে এমন উত্তর শুনে। এর আগে এমন ধাঁচের বিয়ে বোধহয় কারো দেখা হয়নি। এই যুগলের মাঝে ঠিক কতখানি প্রেম আর ভালবাসা সেটা আর বলার অপেক্ষা রাখে না। মুহূর্তে কথা খানা সম্পূর্ণ গ্রামে ছড়িয়ে গেল। কেউ বা ছুঁটে এসেছে তাদের দেখতে। রওনকের কানেও কথাটা এসেছে। মুহূর্তে সব খারাপ লাগা দূরীভূত হয়ে গেল তার। কুহু যে এতখানি ভালোবাসার প্রমাণ দিবে এটা কল্পনাতীত ছিল। সমস্ত চিন্তা বাদ দিয়ে এবার বোধহয় বিয়ের দিকে মনোযোগী হলো রওনক। প্রথমবার বিয়েতে যে ভয় আর নানান চিন্তা ছিল এবার আর সেটা নেই! অদ্ভুত এক ভালো লাগা মিশে যাচ্ছে শরীরের প্রতিটা রন্ধ্রে রন্ধ্রে! বেশ খোশমেজাজেই আর দ্বিধাহীন পরপর তিন বার কবুল বলে নিল রওনক।
লিলি আর ইলির বিদায় বেলা বাড়ির পরিবেশ ভারী হয়ে উঠেছিল সবার কান্নায়।কুহুর বেজায় মন খারাপ হলো।অপরিচিত হলেও এই একদিনে সবার সাথে যেন মিশে গেছে অনেকটা। লিলি আর ইলির রুমেই কুহু আর রওনকের জন্য বাসর সাজানো হয়েছে।এটা দু'বোনের পূর্ব পরিকল্পনা ছিল। সবটা তদারকি করেছে রত্না নিজে। বাহারি ফুলে ফুলে একবারে সাজিয়ে দিয়েছে ঘরটা।
•
ঘড়িতে রাত দশটা। সম্পূর্ণ বাড়ি জুড়ে নিস্তব্ধতা। রহিমার ঘর থেকে মৃদু কান্নার আওয়াজ ভেসে আসছে থেমে থেমে। রওনক বসে আছে পুষ্প বিছানো খাটে। মনটা কখন থেকে পায়চারি হয়ে আছে কুহুকে দেখার জন্য। এখনো তো দেখাই হয়নি মেয়েটাকে।
•
রত্নার রুমে আয়নার সামনে দাঁড়িয়ে আছে কুহু। লাল টুকটুকে জামদানী শাড়ি পরে আছে সে। মুখে সাজ ভালোই আছে। অন্যরকম এক ভালো লাগার অনুভূতি ছুঁয়ে দিচ্ছে তাকে। এবার সে সত্যিই রওনক ভাইয়ের জন্য বউ সেজেছে! ভাবতেই গা শিহরণ তুলছে! এত সাজসজ্জা আর আয়োজন শুধুমাত্র পাগলাটে প্রেমিক পুরুষটার জন্য। পেছন থেকে রত্না বলল,
"সেই কখন থেকে বলছি তোমার স্বামীর কাছে যেতে।বেচারা একা বসে আছে।তার উপর নতুন পরিবেশ। তোমার লজ্জামাখা মুখ দেখে মনে হচ্ছে সত্যিই নতুন বিয়ে হয়েছে। যাও তো মেয়ে। বরের কাছে গেলে দেখবে লজ্জা পালাবে লেজ গুটিয়ে।
কথাটুকু বলেই কুহুর হাত ধরে লিলি- ইলির রুমে চলে আসলো রত্না। ফোনে মনোযোগী ছিল রওনক। রিনঝিন চুড়ির শব্দ পেতেই মাথা তুলে তাকাল সে। সামনে কুহুকে দেখে স্তব্ধ হয়ে গেল যেন। আজ যেন একটু বেশিই সুন্দর লাগছে কুহুকে। এতটা রূপবতী আগে লেগেছিল কখনো? রত্না একটুখানি হেসে বলল,
" শুভ রাত্রি পুরাতন দম্পতিদের বাসর রাতের জন্য।
বলেই দরজা আঁটকে দিয়ে চলে গেল রত্না। কুহু স্থির দাঁড়িয়ে রইল।দৃষ্টি মেঝেতে।বুকে রীতিমতো হাতুড়ি পেটাচ্ছে কেউ। নিশ্বাস আঁটকে রইল। অস্থির হয়ে হাত দলাই-মলাই করে যাচ্ছিল। সবটাই খেয়াল করছিল রওনক। গম্ভীর স্বরে বলল,
"আজকের বিয়ের অভিজ্ঞতা কেমন ছিল? তুমি কি এটা স্বাভাবিক মেনেছ কুহু? আমরা যদি চলে যেতাম তাহলে...
কথা থামিয়ে দিয়ে বলল কুহু,
"এটা আমার সিদ্ধান্ত ছিল। আমিই বলেছি বিয়ের কথা।
রওনক স্তব্ধ হয়ে গেল। অথচ সে কিনা ভেবেছিল এই বিয়ের জন্য নির্ঘাত বিব্রতকর পরিস্থিতিতে পরেছে কুহু। এতকিছু আগে জানলে তো এসব নিয়ে দুশ্চিন্তা করতো না রওনক। খাট থেকে নেমে দ্রুত পা ফেলে এগিয়ে আসলো সে। ধুপ করেই কুহুকে কোলে তুলে নিল। ভারী অবাক হলো কুহু।
" আচ্ছা! তা তোমার ইচ্ছে ছিল আমার সাথে দ্বিতীয়বার বাসর করার তাই তো?
চোখ পাকিয়ে রওনকের দিকে তাকিয়ে বলল কুহু,
"আপনি আসলেই অসভ্য। আমি কি একবারো বলেছি এটা?
কুহুকে আয়নার সামনে দাঁড় করাল রওনক। আঁচল টেনে মাথায় ঘোমটা তুলে দিয়ে পেছন থেকে জড়িয়ে ধরে বলল,
" তাহলে কি শুধু বিয়ে করার ইচ্ছে ছিল?
কুহু কিছু বলল না। আয়নায় দৃষ্টি পরতেই দেখলো রওনক ভাই তার দিকেই তাকিয়ে আছে। তৎক্ষনাৎ দৃষ্টি নামালো কুহু।ঈষৎ শব্দ করে হেসে বলল রওনক,
"পালাতে আর পারলে কই? আসতেই তো হলো আমার কাছে! তা ছাড়া এই যে বিয়ে করার সিদ্ধান্ত একাই নিলে আমার অনুমতি নিয়েছিলে? এখন যদি আমি শাস্তি দেই?
মাথা তুলে বলল কুহু,
" শাস্তি ছাড়া আর কোনো কথা আছে আপনার মুখে? টিচার বিয়ে করেছি কিনা!
ভ্রু কুঁচকে বলল রওনক,
"কোনো শাস্তি দিয়েছি তোমাকে? বিনা দোষে অপরাধী হতে মানতে নারাজ আমি। উল্টো আমাকে শাস্তি দিয়েছ তুমি।প্রতিটা সেকেন্ড প্রতিটা ক্ষণ পুড়িয়েছ আমাকে। তার হিসেব কষতে বসলে তুমি আজন্ম ঋণী আমার কাছে!
কুহু ঘুরে তাকাল রওনকের দিকে। চোখে চোখ রেখে বলল,
" যদি বলি আমি এই ঋণ নিমিষেই শোধ করে দিতে পারি?
ভ্রু বাঁকিয়ে বলল রওনক,
"কিভাবে শুনি?
কুহু পায়ের আঙুলে ভর দিয়ে খানিকটা উঁচু হয়ে রওনকের কানের পাশে ফিসফিস করে বলল,
"ভালোবাসি!
কথাটুকু বলেই একছুটে জানালার কাছে গিয়ে দাঁড়াল কুহু। রওনক স্তব্ধ হয়ে গেল। এমন কিছু শুনবে মোটেও আশা করেনি! সত্যিই কুহু তার সব ঋণ শোধ করে দিল এই একটা মাত্র শব্দে! যার মূল্য কোনো কিছু দিয়ে পরিমাপযোগ্য নয়! তার ধূর্ত মস্তিষ্ক বুঝতে পারলো সম্মোহনী সে দৃষ্টি। দ্বিধাদ্বন্দের প্রাচীর ভাঙলো তবে? বোকা মেয়েটা বুঝতে পারলো তবে রওনকের মনের কথা? কয়েক কদম এগিয়ে কুহুর কাছে আসলো রওনক। দৌড়াবার সময় মাথার ঘোমটা খসে পড়েছে কুহুর। খোঁপায় গাজরা ফুলে গুঁজে দেওয়া। পেছন থেকে আষ্টেপৃষ্টে জড়িয়ে নিয়ে খোঁপায় নাক ডুবিয়ে দিল রওনক। শক্তপোক্ত হাতখানা স্পর্শ করলো পেলব উদরে। মৃদু কেঁপে উঠলো কুহু। কন্ঠস্বর খাদে নামিয়ে বলল রওনক,
" কুহু আজকে তোমায় ভীষণ সুন্দর লাগছে। কারণ কি জানো? কারণ তুমি আজ সেচ্ছায় মন থেকে খুশি হয়ে আমার জন্য বউ সেজেছো! এত সুন্দর সাজ যে ঘেটে দিতে খারাপ লাগবে আমার। লিপস্টিক.......
কুহু তৎক্ষনাৎ ঘুরে দাঁড়িয়ে রওনকের ঠোঁটের মাঝে আঙুল রেখে কথা থামিয়ে দিয়ে বলল,
"আপনি খুব নির্লজ্জ! কিচ্ছু শুনবো না আমি।
তপ্ত শ্বাস ফেলে কুহুকে কোলে তুলে নিল রওনক। খাটে এসে নামিয়ে দিল। মৃদু হেসে বলল,
"বিবাহিত পুরুষরা তাদের বউদের কাছে নির্লজ্জই হয়! এই মুহূর্তে আমি তোমার সব সাজ ঘেঁটে দিব। স্যরি বউ!
কুহু অন্যপাশে মুখ ঘুরিয়ে নিল। কুহুর গা থেকে এক এক করে সব গয়না খুলে নিল রওনক।পাথরের মতো শক্ত হয়ে বসে রইল কুহু। শরীর মৃদু কাঁপছে তার। এই ভয়ানক অনুভূতিটুকু কি সামাল দিতে পারবে সে? কুহুকে বালিশে শুইয়ে দিয়ে খানিকটা ঝুঁকে অধরোষ্ঠে ঘোর লাগা দৃষ্টি নিয়ে তাকিয়ে রইল রওনক। হৃদপিণ্ডের গতিপথ অস্বাভাবিক হয়ে গেল কুহুর। হাতের বৃদ্ধাঙ্গুলি দিয়ে ঠোঁটের লিপস্টিকটুকু মুছে নিল রওনক। তৎক্ষনাৎ চোখ বুজে ফেলল কুহু। ভারী নিশ্বাস আছড়ে পরছে সর্ব মুখায়ব জুড়ে! রওনক নেমে গেল কুহুর পেলব ওষ্ঠযুগলে। গভীর ভাবে ছুঁয়ে দিল। অত্যল্পকালে শরীর শিউরে উঠলো কুহুর। আঁকড়ে ধরলো রওনকের পাঞ্জাবি। রওনকের শক্তপোক্ত হাতের স্পর্শ ক্রমেই আড়ষ্ট হয়ে গেল কুহু। উন্মাদের মতো অনুভূতির মায়া জালে আবদ্ধ হয়ে গেল রওনক। নিজের মতো আবিষ্কার করতে থাকলো কুহুকে। গলার পাশে দন্তাঘাত পেতেই মৃদু আর্তনাদ করে উঠলো কুহু। রওনক স্থির হলো না। গা থেকে শাড়ির আঁচল সম্পূর্ণ নামিয়ে দিল রওনক।মুহূর্তে দু'হাতে চোখ ঢেকে নিল কুহু। লজ্জা বোধহয় এবার পুরোপুরিই গ্রাস করে নিল তাকে।ঘুরে উপুর হয়ে গেল কুহু। রওনক তাকিয়ে রইল নিনির্মেষ। পৃষ্ঠদেশে ওষ্ঠ ছোঁয়াল আদুরে ভাবে। ভয়ানক কেঁপে উঠলো কুহু। মেরুদণ্ড বরাবর নেমে গেল শীতল স্রোত! প্রতিটি লোমকূপ জানালো ভালো লাগার অনুভূতি। লাল রঙা ব্লাউজের ফিতা একটানে খুলে নিল রওনক। তৎক্ষনাৎ ছিটকে সরে গেল কুহু। ঘন ঘন নিশ্বাস ফেলে কোনোরকম বলল আলো নিভিয়ে দিতে। রওনক ভ্রু কুঁচকে কয়েক সেকেন্ড তাকিয়ে থেকে উঠে চলে গেল আলো নেভাতে। কুহুর ভয় যেন বাড়তেই থাকলো। এই ভয়ংকর অনুভূতি থেকে আজ কোনোমতে নিস্তার নেই এটুকু মস্তিষ্ক বুঝে গেল।রওনক ফের এগিয়ে এসে নিঃসংকোচ জড়িয়ে নিল কুহুকে। সম্পূর্ণ শাড়িটাই খুলে নিল।অন্ধকারেই চোখমুখ খিঁচিয়ে নিল কুহু। পায়ের তলানি শিরশির করে উঠলো তার। ঘন ঘন নিশ্বাস তরঙ্গের মতো বাজতে থাকলো বদ্ধ রুমে! অত্যল্পকালে রওনক হারিয়ে গেল কুহুর মাঝে! থেমে থেমে নব্য অনুভূতির সঙ্গে পরিচিত হচ্ছিল কুহু। মিষ্টি এক যাতনাময় আবেশে ক্রমেই তলিয়ে গেল! নিজেকে সম্পূর্ণ উজার করে দিল ভালবাসার পুরুষের কাছে।
·
·
·
চলবে.............................................