সন্ধ্যায় মানতাসার হলুদ ও ক্ষীর খাওয়ানোর অনুষ্ঠান বেশ বড় পরিসরে আয়োজন করা হলো। আশেপাশের পরিচিত অনেকেই মানতাসার হলুদ অনুষ্ঠানে এলো। সব মিলিয়ে বেশ জমজমাট পরিবেশ তৈরী হলো উঠোনে।
রাত প্রায় দশটা নাগাদ পুরো অনুষ্ঠান শেষ হলো। সারাদিনের এই দৌড়ঝাঁপে ক্লান্ত হয়ে রুমে যাওয়া মাত্রই ঘুমিয়ে পড়েছে মানতাসা। আর বাড়ির বাকি সদস্যরা খাওয়াদাওয়া, গোছগাছ, খোশ গল্পে মশগুল। আনিস সাহেব ও আনোয়ার সাহেব শেষ মুহূর্তে বাবুর্চিদের সাথে আরোও একবার কথা বললেন। কাল দুপুর থেকে উঠোনে রান্না শুরু হবে। ফলে দুপুরে আর বাড়ির মহিলাদের রান্নাবান্নার ঝামেলাও থাকবে না। আবার কাল মেহেদি অনুষ্ঠানের আগে ফাহাদের পরিবার থেকে বিয়ের শাড়ি, গহনাসহ পুরো লাগেজ দিয়ে যাবে। তাদেরও নাস্তা পানির ব্যবস্থা করতে হবে। এ নিয়ে চার ননদ ভাবী মিটিং এ বসেছে। মোটকথা বাড়ির বড়রা সকলেই ব্যস্ত। আর ছোটরা? কেউ ঘুমিয়ে আছে, কেউ টিভি দেখছে, কেউ ফোন চালাচ্ছে। আজ রাফা মানতাসার পরপরই ঘুমিয়ে পড়েছে। কিন্তু নীলিমা ঘুমায়নি। সে ভার্সিটির গ্রুপ চ্যাটে ব্যস্ত। সিঁড়ির প্রায় সামনে দেয়ালে ঠেস মেরে দাঁড়িয়ে আছে সে। পরনের সুতির সাধারণ একটা থ্রিপিস। কোমড় অব্দি ছাপিয়ে পড়া চুলটাও খোলা। কিছুক্ষণ আগেই গোসল করে এসেছে সে।
" এভাবে খোলা চুল নিয়ে বাইরে থাকলে জ্বিন এসে ভর করতে পারে নীলিমা।"
হঠাৎ স্মরণের কণ্ঠস্বরে চমকে ওঠে নীলিমা। ফলস্বরূপ অসাবধানতায় আচমকা তার হাত থেকে ফোনটা পড়ে যায়। তার ফোন পড়ে যাওয়ায় যতটা না সে ব্যথিত হয় তার চেয়েও দ্বিগুন ব্যথিত হয় স্মরণ। এই ফোন পড়ে যাওয়াকে নিজের ভুল মনে করে জিব কাটলো সে। দ্রুত এগিয়ে গিয়ে মেঝে থেকে ফোনটা তুলে নীলিমাকে দিতে দিতে বেশ কয়েকবার সরি বললো। স্মরণের এতবার সরি বলায় নীলিমা খানিক অবাক হয়ে জিজ্ঞেস করলো,
" রিল্যাক্স স্মরণ ভাই! এতবার সরি বলছেন কেনো? "
স্মরণ নীলিমার স্বাভাবিক কণ্ঠস্বরে খানিকটা আশ্বস্ত হলো। ঠিক তার সামনে এসে দাঁড়িয়ে বললো,
" এই যে হঠাৎ পিছন থেকে কথা বলায় ফোন পড়ে গিয়েছে যে!"
নীলিমা আলতো হাসলো। ফোনটা হাত উঁচিয়ে দেখিয়ে ঠাট্টার সুরে বললো,
" এই আধ নিহত ফোনটাকে নিয়ে এতবার সরি বলার কিছুই নেই। আমিই আরোও চাচ্ছি যেনো ফোনটা একেবারে ভেঙেচুরে নষ্ট হয়ে যায়। তাহলেই আব্বু নতুন ফোন কিনে দিবে। "
নীলিমার কথায় স্মরণ তার ফোনের দিকে তাকালো। দেখলো স্ক্রিনের প্রায় ৯০ শতাংশ জায়গায় ফাটল ধরা। বোঝাই যাচ্ছে ফোন ভেঙেচুরে ফেললেও তার আয়ু কমবে না। নীলিমার কাছে লম্বা আয়ু নিয়ে এসেছে সে। স্মরণ এবার ফোনের দিকে আঙুল দিয়ে বললো,
" এখনই ফোন চাচ্ছো না কেনো? ফোনের অবস্থা তো ভালো না। "
" আব্বু কখনোই দিবে না। এই ফোনটাই অনেক রিকুয়েষ্ট করে নিয়েছিলাম। "
" আচ্ছা তাহলে আমি একটা ফোন কিনে দেই।" হঠাৎ বলে বসলো স্মরণ। নীলিমা প্রথম দফায় তাজ্জব বনে গেলো। অতঃপর হেসেই ব্যাপারটি উড়িয়ে দিয়ে বললো,
" আপনি? হা হা। আপনি ফোন কিনে দিবেন কেনো? মেয়েদের ফোন কিনে দেয় তাদের বাবা বা বর। অথবা সে নিজেই কিনে। আপনি এর মধ্যে কোনোটাই নন। এজন্য আপনার ফোন কিনে দেয়াটা বেমানান।"
স্মরণ এর প্রত্যুত্তরে নির্দ্বিধা ও নিঃসংকোচ গলায় বললো,
" বাবা হিসেবে তো আর কিনে দেয়া সম্ভব না। কিন্তু তুমি চাইলে বর হিসেবে কিনে দিতে পারি। "
নীলিমা অবাক হলো। ভীষণ অবাক হলো। শুকনো গলায় বিষম খেলো সে। একসময়ে স্মরণে দূর্বল হওয়া হৃদপিণ্ডখানা কয়েক সেকেন্ডের জন্য থামলো বোধহয়। অতঃপর তীরের বেগে ছুটে চললো। যেনো এখনই বুকের খাঁচা থেকে বেরিয়ে আসবে। স্মরণের বেফাঁস কথায় বিস্ময়ে হতবাক নীলিমা বাকরুদ্ধ হয়ে কয়েক সেকেন্ড চেয়ে রইলো। তার এরূপ প্রতিক্রিয়ায় স্মরণ মিটিমিটি হেসে বললো,
" কি হলো? বেশিই বলে ফেলেছি আমি?"
নীলিমা শুকনো ঢোক গিললো। এই দুদিন স্মরণকে নিয়ে একটু আধটু যা অনুমান করেছিলো তবে কি তা সত্য ছিলো? সত্যিই কি স্মরণ তাকে পছন্দ.... না না। এসব কি ভাবছে সে! স্মরণ তাকে পছন্দ করতে যাবে কেনো!
নীলিমা আমতা আমতা করে বললো,
" না মানে... ইয়ে.... উমম... হ্যাঁ।"
নীলিমার কান্ডে হো হো করে হেসে ফেললো স্মরণ। নীলিমার মাথার উপর হাত রেখে উপরের দিকের চুলগুলো সামান্য এলেমেলো করে বললো,
" বোকা মেয়েটা কি এবার বুঝেছে কিছু?"
নীলিমা এবার আরোও বিস্মিত হয়। এর মানে স্মরণ সবকিছু সত্যিই বলেছে। কোনো মজা ছিলো না এসব। নীলিমা এবার শুকনো একটা ঢোক গিললো। নিজের এলেমেলো মন মস্তিষ্ককে জায়গায় এনে সাহস জোগালো। অতঃপর নিজের মাঝে তৈরী হওয়া সামান্যতম সন্দেহকে আজ মিথ্যে প্রমাণ করতে সরাসরি জিজ্ঞেস করে বসলো,
" আমি যা বুঝছি আপনি কি তাই-ই বুঝাতে চেয়েছেন স্মরণ ভাই? আপনি কি আমাকে....."
স্মরণ বুকে হাত দিয়ে মুখ গোল করে স্বস্তির নিঃশ্বাস ফেললো। আহ, সেই সুবর্ণ মুহূর্তটুকু বুঝি এসেই পড়েছে। শেষমেশ নীলিমা তার মনের গোপন চিনলো! স্মরণের ভেতরটা আদুরে এক ভালোলাগায় ছেয়ে যায়। বিস্তৃত হাসি দিয়ে বলে,
" তুমি যা বুঝেছো তোমাকে সেটাই বুঝাতে চেয়েছি নীলি। আমি তোমাকে....."
ভেতর থেকে নওরীনের ডাকে স্মরণের অনুভূতি প্রকাশে আচমকা ব্রেক বসলো। মুহূর্তেই বিরক্তিতে তিতকুটে অনুভূতি হলো তার সমস্ত অঙ্গ জুড়ে। ওদিকে নীলিমা যেনো যারপরনাই স্বস্তি পেলো। স্মরণের নিকট হতে ঐ ধারালো শব্দটি শোনার মতো সাহস নেই তার। ভাগ্যিস নওরীন ডেকেছিলো। নাহলে আজ কিছু অঘটন ঘটে যেতো নিশ্চিত।
নীলিমা আর দেরি করলো না৷ মুহূর্তেই দৌড়ে স্মরণের দৃষ্টি সীমানার বাইরে চলে গেলো। সে যেতেই স্মরণ চটে যাওয়া মেজাজ নিয়ে দাঁতে দাঁত পিষে বললো,
" আমাদের মাঝে যখনই কোনো কথা হয় তখনই কেউ না কেউ এসে বাগড়া দেয়। উঁহু সামনে থেকে না। ভেতর থেকে নীলিমাকে ডাক দিয়ে বাগড়া দিয়ে। কি এক যন্ত্রণা! উফ! কোথায় প্রথম প্রথম প্রেমে পড়েছি বলে প্রপোজাল দিয়ে প্রেম করবো। তা না! মেয়েটাকে প্রপোজালই দিতে পারছি না। ধ্যাত।"
বলেই স্মরণ পাশের দেয়ালে পা দিয়ে একটা লাথি দিলো। তবে এতে দেয়ালের কোনো ক্ষতি না হলেও তার বুড়ো আঙুলে বেশ ব্যাথা পেয়েছে। সে ব্যাথা নিয়েই সিঁড়িতে বসে বসে মনে মনে বিলাপ করতে লাগলো স্মরণ।
-------------------------
দুপুরে রান্না হলো। বাবুর্চিরা রান্না করলো দুপুরের খাবার। আশেপাশের পরিচিতদের আজ দুপুর থেকেই খাবারদাবার দেয়া হচ্ছে। আজকের রান্না মুরগির গোশত ভুনা, মুড়ি ঘণ্ট ও সাদা ভাত। আগে প্রতিবেশীরা খাবার খেয়ে চলে গেলে তারপর বাড়ির লোকেরা খেতে বসলো। বাহাদুর শেখ ও আসমানী বেগম ব্যতিত প্রায় সকলেই খেতে বসেছে। তবে নীলিমার বাবা ইমাদ সাহেব সবার চেয়ে একটু দেরিতে খেতে বসলেন। ইমাদ সাহেব বাজারে গিয়েছিলেন কিছু কাজে। সেখান থেকে ফিরতেই একটু দেরি হলো বলে খেতে বসতে দেরি হয়েছে। ইতোমধ্যে সবার প্লেটে সাদা ভাত ও মুড়ি ঘণ্ট দেয়া হয়েছে। ইমাদ সাহেব এলে তাঁর সামনেও একটা প্লেট দেয়া হলো। অতঃপর দেয়া হলো সাদা ভাত। মুড়ি ঘণ্ট দেয়ার পূর্বেই সাদা ভাত দেখে ইমাদ সাহেবের ফুরফুরে মেজাজটা মুহূর্তেই চটে গেলো। কেননা তাঁর প্লেটে পাতিলের শেষের কড়কড়ে ও হালকা পোড়া বাদামী ভাত দেয়া হয়েছে। ইমাদ সাহেবের পোড়া ভাত বা পোড়া খাবারের সাথে ভীষণ এলার্জি। তিনি এসব পোড়া জিনিস দু চোখে সহ্য করতে পারেন না। প্লেটে পোড়া ভাতের অংশ বা তরকারি দেখা মাত্রই তার মেজাজ বিগড়ে যায়। ভাতের প্লেট রেখেই তিনি উঠে পড়েন। আজও তার ব্যতিক্রম হলো না। অঘোষিতভাবে তিনি প্লেটটা পিছিয়ে দিয়ে উঠে পড়লেন। থমথমে উষ্ণ মেজাজে গম্ভীর গলায় বললেন,
" আমি ভাত খাবো না। আমার খাওয়ার রুচি শেষ।"
ব্যস এই বলেই তিনি চেয়ার পিছিয়ে উঠে গেলেন। তাঁর এ কান্ডে উপস্থিত সকলের খাবার মাঝে বিরতি ঘটলো। সকলেই অবাক হয়ে দেখলেন ইমাদ সাহেবের কান্ড। কিন্তু আনিস সাহেব ও আনোয়ার সাথে চিন্তিত গলায় মিলি বেগমকে প্রশ্ন করলেন,
" কি রে মিলি? কি হয়েছে ইমাদ সাহেবের? উনি হঠাৎ চলে গেলেন কেনো?"
এদিকে খাবার পরিবেশন করা ছেলেটা মুড়ি ঘণ্টের ডিশ হাতে তাজ্জব বনে দাঁড়িয়ে আছে। সে এখনও বুঝতে পারছে না ইমাদ সাহেবের কি হলো? উপস্থিত সকলেই একে অপরকে প্রশ্ন করছে এ নিয়ে। নীলিমা ও নওরীনও বাবার এ কান্ডে অবাক। নীলিমা চিন্তিত হয়ে ভাত মাখা হাত নিয়ে উঠে ইমাদ সাহেবের চেয়ারের সামনে এলো। দেখলো ইমাদ সাহেবের প্লেটে খানিকটা কড়কড়ে ও বাদামী পোড়া ভাত উঠে গিয়েছে। ব্যস নীলিমার আর বুঝতে বাকি রইলো না যে তার বাবা কেনো উঠে গিয়েছে।
এই দেখা মাত্র নীলিমা অপর টেবিলে বসে থাকা তার মা মিলি বেগমকে বললেন,
" আব্বুর প্লেটে বাদামী পোড়া ভাত উঠেছে আম্মু। তাই আব্বু উঠে গিয়েছে। "
মিলি বেগম ক্ষণেই মাখো হাত নিয়ে উঠে দাঁড়িয়ে হায় হায় করতে করতে বললেন,
" নওরীনের আব্বা দু চক্ষে পোড়া ভাত দেখতে পারে না। আর ওর পাতেই পোড়া ভাত পড়েছে। হায় আল্লাহ!"
মিলি বেগমের এহেন কথায় সকলেই বিস্মিত হলেন। এক পোড়া ভাত নিয়ে এই কাহিনি! নাজমা বেগম ইমাদ সাহেবের এ কান্ডে ঠেস দিয়ে বললেন,
" দেখো তোমার জামাইয়ের কান্ড নাজমা। এই বুড়ো বয়সে এসে ভাত নিয়ে এই কাহিনি না করলেও চলতো। বুড়ো বয়সে ভীমরতিতে ধরেছে ওকে। "
মিলি বেগম ভাবীর কথার প্রত্যুত্তর করলেন না। ওমন হাত নিয়েই ছুটে চললেন বাড়ির ভেতর। তার পিছু পিছু নীলিমাও ছুটে চললো। কিন্তু স্মরণ এসব এলাহি কান্ড দেখেও না দেখার ভান করে পেট পুড়ে খেতে লাগলো। ভীষণ ক্ষিদে পেয়েছে তার। এসময় হবু শ্বশুরের চটে যাওয়া, তেলানো দেখার তার কোনো ইচ্ছা নেই।
এদিকে সাদ খেতে খেতে নিজেদের মধ্যেই বললো,
" এই যে শুরু হলো ঝামেলা। বিয়ে বাড়িতে খালু, ফুফা, মামা, চাচাদের ঝামেলা হবে না এ তো হতেই পারে না। এই তো কেবল শুরু। কাল দেখো কত বড় বো' ম ফাটে আবার। "
.
.
.
চলবে...............................................