বজ্রমেঘ - পর্ব ০৩ - ফাবিয়াহ্ মমো - ধারাবাহিক গল্প


চোখ বিস্ফোরিত করে তাকিয়ে আছে রেহানা। বুকের ভেতরটা ধ্বক ধ্বক করে কাঁপছে। হাতের ব্যাগটা ফেলে দিলেও থামেনি হাতের বেদম কাঁপন। মৃদু শব্দ করে কেবিনের দরজাটি খুলে গেলেও যে ব্যক্তিটি আপাদমস্তক বৃষ্টির স্বল্প ভেজায় সিক্ত হয়ে প্রবেশ করেছেন তিনি একা নন। তার পেছনে সটান শক্তভাবে দাঁড়িয়ে আছে রাফান সিদ্দিকী। চোখদুটো সরাসরি রেহানার হানিফের মুখশ্রীর দিকে তাক করা। ঠোঁট নাড়িয়ে কী যেন বলতে উদ্যত হচ্ছিল রাফান, হাতের ইশারায় ওকে থামিয়ে জায়গাটা এখুনি ত্যাগ করতে বোঝান। রেহানা তটস্ত ভয়ে, আতঙ্কে, জড়বৎ পাথর বনে আকণ্ঠ কেঁপে উঠল। বুঝতে একটুও বাকি রইল না, এই শান্ত মেজাজী নীরব লোক ওর চাপা ইন্ধন বোধহয় ধরে ফেলেছে। গড়িয়ে গড়িয়ে ঠকাস্ করে যে বস্তুটি উনার জুতোর কাছে থামল, সেটির দিকে একপলক নজর রাখলেন বন বিভাগের কার্যনির্বাহী ব্যক্তি। প্রশ্নবোধক ভঙ্গিতে ভ্রুঁটা সামান্য উঁচু করলেন শুধু, কয়েক সেকেণ্ড! এরপরই রেহানার দিকে মন্থর ভাবে চোখদুটো তুললে স্তম্ভিত রেহানা হকচকিয়ে আমতা আমতা সুরে বলল, 

  - ব্যাগটা পে..পেশেন্টের।

মেঝের দিকে তর্জনী তাক করে বরফের মতো হিম-ভরাট স্বরে প্রশ্ন করলেন শোয়েব ফারশাদ, 

  - কী করছিলেন এই ব্যাগের সাথে?

এক মুহুর্তের জন্য মনে হলো ফট করে মিথ্যা কথাটা বলবে রেহানা। বলে দিবে এই ব্যাগটা তারই। তার হাত থেকে ভুলবশত বেকায়দায় পড়ে গেছে। ব্যাগের চেইনটা খোলা থাকায় নিত্যকর্মের জিনিসগুলো ছড়িয়ে ছিটিয়ে পরেছে। কিন্তু অজানা অদৃশ্য কারণে একবর্ণও মিথ্যে বলতে পারল না রেহানা। কাঁচ চশমার আড়ালে ওই স্থির জড়বৎ দৃষ্টি দুটি মিথ্যাকে মিথ্যা, সত্যকে সত্য বলে ধরতে জানে। ননীর পুতুলের মতো লিপস্টিক রাঙা ঠোঁটদুটি নাড়িয়ে উঠে রেহানা, 

  - কিছু করছিলাম না। ব্যাগের চেইনটা ভুলবশত খোলা থাকায় সেটা লাগিয়ে দিচ্ছিলাম স্যার। আপনি হঠাৎ সেসময় কেবিনে চলে আসাতে —

  - হাতে এখন মেডিকেল অ্যাসেসোরিজ থাকলে ফলাফলটা কেমন দাঁড়াতো? ব্যাগের মতোই তাহলে ফ্লোরে জায়গা দিতেন? 

একের পর এক হিংস্র বাণে জব্দ হচ্ছে রেহানা। এর চেয়ে রাফানের মুখোমুখি হয়ে দুটো গালি শোনাও ভালো ছিল। ধার দেওয়া ছুরির মতো প্রতিটি শব্দ বিঁধিয়ে যাচ্ছে এই ভয়ংকর লোক। কথার মাঝে যে স্বল্প বিরতি, তা যেন আসন্ন আরেক ঘা বিঁধানোর জন্য প্রস্তুতিপর্ব। অতি দ্রুত জায়গাটা থেকে বেরুবার উপায় ঠাওরাতে চোখ নীচু করল রেহানা, 

  - স্যরি স্যার। স্যরি ফর বিং ইরেসপন্সিব্যাল। অপ্রত্যাশিত ভুলে এরকমটা হয়ে গেছে। পেশেন্টের জিনিসপত্র কেবিনে অ্যালাউ না বলেই ওটা এখান থেকে ভদ্রস্থ করে সরিয়ে নিতে চাচ্ছিলাম। 

মিথ্যা মেশানো উত্তরটা সন্তুষ্ট করল না তাকে। বরং চোখদুটি তখনো স্থির অটুট রেখে রেহানা হানিফকে শেষ বাক্যে জানালো,  

  - ব্যাগ ভদ্রস্থ করার দায়িত্ব আপনার ছিল না মিস। নার্স ফাইরুজকে ডেকে সুন্দর ভাবে সরিয়ে রাখা যেত। ডক্টর রেজাকে ইনফর্ম করে দিন। ঘুমিয়ে থাকলে বলবেন জরুরি ভিত্তিতে তাকে হসপিটালে আসার অনুরোধ জানানো হয়েছে। ডিটেলিং রিপোর্ট প্রস্তুত করে পেশেন্টের পরিবারকে বুঝিয়ে দেবেন। আর কোনো কাজ নেই এখানে। 

সুস্পষ্ট, অকাট্য, তেমনি বজ্রনির্ঘোষ স্বরে কথাগুলো জানিয়ে ফ্লোরে ঝুঁকে বসে শোয়েব ফারশাদ। সুক্ষ্ম কৌশলে বুঝিয়ে দিয়েছে রেহানার এই কেবিন পর্যন্ত কাজ। কেবিনের বাইরে কতটুকু কাজ করতে হবে সেটাও স্পষ্ট জবানে বোঝানো। ব্যাগের জিনিসগুলো এক এক করে তুলতেই সদা কর্মঠ ব্যক্তিটি কর্ণগোচরে শুনল রেহানার ভীতকণ্ঠ, 

  - ঠি..ঠিকআছে। আমি এক্ষুণি ডক্টর রেজাকে কল দিয়ে ইনফর্ম করছি। রিপোর্ট তৈরির পর আপনাকে জানাব স্যার। 

ত্রস্তপায়ের সাথে সাথে অদূরে থাকা দরজাটি বন্ধ হয়ে যায়। সারা কেবিনময় ছড়িয়ে পড়ে অখণ্ড নির্জীব স্তব্ধতা। ফ্লোরে ফেলে যাওয়া ব্যাগটি হাতে তুলে নেয় শোয়েব। এক এক করে সমস্ত জিনিস তুলতে থাকলে সহসা মসৃণ কপালে কুঞ্চন পরতে শুরু করে। বড্ড তাজ্জব ব্যাপার! মেয়েলি ব্যাগ, অথচ সাজ সরঞ্জাম বলতে কিছু নেই। চুলের চিরুনি, না আয়না, না ঠোঁটে লাগাবার লিপকিট, না গালে ছোঁয়াবার পাউডার। বরঞ্চ মোবাইল ফোন, পরিচ্ছণ্ণ ছোটো রুমাল, কিছু ছোট ছোট রঙিন কাগুজে স্টিকি নোটস, অদূরে উপুড় হয়ে থাকা আরেকটি অদ্ভুত জিনিস। বাঁহাতে ব্যাগটা ধরে অন্যহাতে উপুড় হয়ে থাকা জিনিসটা কাছে আনল শোয়েব। দ্বিগুণ আশ্চর্যে কপালের সুক্ষ্ম ভাঁজ আরো প্রগাঢ় হতে থাকে। বস্তুটি কাঠ মলাটের তৈরি অপূর্ব সুন্দর একটি ডায়েরি। মসৃণ কাঠের উপর গুচ্ছ গুচ্ছ কাঠগোলাপ ফুল খোদাই করে আঁকা। ডায়েরির শেষপ্রান্তে ডানকোণটায় ছোট্ট করে লেখা খোদিত ছোট্ট নাম— SHAWLEEN. সেই আটবর্ণ নামের উপর অজান্তেই নিজের বৃদ্ধাঙুল ছুঁয়ে দেয় শোয়েব। যেন অদৃশ্য কোনো নরম ফুলের উপর স্পর্শ করল তার আঙুল। এমন সময় লক্ষ করল রুমালের নীচে কিছু ছবি। ছবিগুলো বোধহয় ডায়েরির ভেতর থেকেই সটান ছিঁটকে পরেছে। হাত বাড়িয়ে উপুড় হওয়া ছবিগুলো তুলে নিতেই ‘ঠক ঠক’ শব্দের সঞ্চার হল। ছবিগুলোর দিকে না তাকিয়েই মাথা পিছু ঘুরিয়েছে শোয়েব। উল্টো অবস্থাতেই ছবিগুলো ডায়েরির উপর রেখে রাফানের দিকে দৃষ্টি স্থির করে শুধোল, 

  - মনে হচ্ছে তুমি বড্ড বিরক্ত?

দরজার নব্ ছেড়ে ভেতরে ঢুকতে ঢুকতে মুখের আদল সহজ করেছে রাফান। গুরুমান্য মানুষটির কাছে কখনো সে গম্ভীর ধাঁচে থাকে না। এটি তার স্বভাব বিরুদ্ধ। সেও হাঁটু গেড়ে ফ্লোরে বসে পরলে শোয়েবের ভ্রুঁ কোঁচকানো কপাল, কৌতুহল-স্থির চোখ, ঠোঁটের কাছে থমথমে ভাঁজটা দেখে প্রশ্ন গলায় বলল, 

  - আপনি এগুলো ঠিক করে দিচ্ছেন? হসপিটালের নার্সরা কোথায়? 

  - নার্সরা যখন নার্সের প্রটোকল ভেঙে অন্যত্র মনোযোগটা দেয়, তখন সেটা আমার জন্য ভারি অপমান। তোমার ফোনকলের পর যে ব্যক্তিকে বলেছি প্রোপার অ্যারেঞ্জমেন্ট করে রাখতে, উক্ত ব্যক্তি ঠোঁটে লিপস্টিক লাগিয়ে পেশেন্টের ব্যক্তিগত ব্যাগে হাত দিচ্ছে। 

  - হোয়াট! এই হানিফ আবারো? আমি . . আমি! 

রাগ সহন করতে না পেরে দাঁত খিঁচিয়ে তেঁতে ওঠে রাফান। আড়চোখে বদমেজাজী ব্যাপারটার চোখা চোখে দেখতে থাকে শোয়েব। হাত স্থির করে ভীষণ সম্ভ্রন্ত স্বরে সাবধানটা করে, 

  - গরম মাথাটা ঠাণ্ডা করো রাফান। পরিবেশ পরিস্থিতি বুঝে সভ্য আচরণ করো। এরকম কাজ করো না, যাতে লোকে আঙুল তুলে বেয়াদব শব্দটা অনায়াসে ছুঁড়ে দেয়। বিহেভ ইয়োর অ্যাটিটিউট। 

ফুঁসে ওঠা ক্রোধ ফুঁ বহুকষ্টে সামলালো রাফান। যদিও দপদপ করে এখনো মাথার দুদিকের শিরা কাঁপছে। কত বড় স্পর্ধা হলে একজন অজ্ঞাত রোগীর ব্যাগে ওভাবে হাত ঢোকায়! কত বড় দুঃসাহস! আদার বেপারী হয়ে জাহাজের দিকে ছোঁক ছোঁক! শোয়েব সমস্ত কিছু সজাগ মনে টের পেলেও আর কিছু বলল না। নিজের কাজ নিঃশব্দে সেরে উঠে দাঁড়াল সে। ব্যাগের গায়ে যদিও কোনো ধূলো ময়লা লেগে নেই, তবু হাতে মৃদু ঝাড়া দিয়ে সোফা কাছে রেখে আসে। পকেটে অনেকক্ষণ ধরে যান্ত্রিক যন্ত্রটা জানান দিয়ে যাচ্ছিল। পারতপক্ষে সেটা এখানে ধরা সুবিধাজনক নয়। হাতটা প্যান্টের ডান পকেটে ঢুকিয়ে যন্ত্রটা ঠাণ্ডা করে কানে চাপলো শোয়েব। রাফানের দিকে নিঃশব্দে “বেরোচ্ছি” ইঙ্গিতটা ছুঁড়ে কেবিন থেকে বেরুল সে। রাফান তখন কোমরে দুহাত রেখে সৌজন্য হাসিতে বিদায় জানাচ্ছিল। কিন্তু হঠাৎই তার শ্যেন দৃষ্টি গমনরত শোয়েবের দিকে আঁটকায়। ঠোঁটের হাসি আস্তে আস্তে মেঘে ঢাকা সূর্যের মতো মিলিয়ে যায়। ওটা কী? বাঁহাতের তালুটা ওরকম লাল কেন? কেন উজ্জ্বল চামড়ার হাতটা লাল টকটক করে ফুটছে? স্যার কি হাতে ভারি কিছু ধরেছিল? যার ফলে উনার পেশি পাকানো ওই হাত রক্তিম হয়ে আছে? ঘটনা কী!


বুকে অবাধ্য, অসহন, তীব্র ভয়। ভয়ের জোরালো হাওয়া উত্তাল ঝড় বইয়ে দিচ্ছে। বুকে শঙ্কার ছোবল টের পেলেও চুপ করে আছে নাযীফ। শীতল আবহাওয়াতেও চুপ চুপ করে ঘামছে সে। অনবরত হাতের টিস্যুটা দিয়ে কপালের ডানপাশ থেকে বামপাশ অবধি ঘামকণা মুছে নিচ্ছে। নাযীফের গা সংলগ্ন ডানপাশে বসে আছে সোহানা। দুহাতের মুঠোয় সদ্য ধোঁয়া ওঠা ক্যান্টিনের কফি। ওয়ান টাইম পেপার কাপে দুঠোঁট চেপে একটা ছোট্ট চুমুক দিল। সুন্দর দুটি চোখে নাযীফের বিমূর্ত অবস্থা নীরবে দেখছিল। দলের ভেতর সবচেয়ে শান্ত, ভদ্র, নির্বিবাদী ব্যক্তি হিসেবে সোহানার সুখ্যাতি রয়েছে। কখনো কারো সাতে পাঁচে নেই, থাকার রুচিও রাখে না। বরং, আপন ভাবা মানুষগুলো নিয়েই যাবতীয় চিন্তা। দুশ্চিন্তার ঘনঘটা দুচোখে লেপে পাশ থেকে ডাকল ও, 

  - নাযীফ, 

কানে ছোট্ট স্বরটা শুনতে পেয়ে পাশে তাকায় নাযীফ। দেখতে পায় একরাশ উদ্বিগ্নে মাখা মুখ। হাসি-আনন্দের ছিঁটেফোঁটা নেই চোখে। নিজের অকর্মণ্য অবস্থা বুঝতে পেরে ওর হাত থেকে কফির কাপটা নিজের হাতে নিল নাযীফ। সোহানার চুমুক বসানো জায়গায় সেও ঠোঁটদুটো চেপে ছোট্ট চুমুক বসালো। বিষয়টাতে তেমন কিছু না ঘটলেও সোহানা এতে হাসল একটু। মৃদু, স্বল্প, ছোট্ট এক হাসি। নাযীফ তাতেই সন্তুষ্ট হয়ে কফিতে আরেকটা চুমুক দিয়ে বলল, 

  - তুমি মনেহয় আমার জন্য দুশ্চিন্তা করছ। তাই না?

  - হ্যাঁ করছি। দুশ্চিন্তাই করছি। তুমি ওভাবে না বলে-কয়ে ঝড়বাদলার দিনে বেরিয়ে গেলে কেন? কেন গিয়েছিলে তুমি? যদি ওখানে কিছু তোমার হয়ে যেত? আমার এখনো মনে হচ্ছে তুমি বিরাট কিছু লুকোচ্ছ। ভয়ংকর কিছুই লুকোচ্ছ! কাউকে কিছু বলছ না, জানাচ্ছ না। যা যা বলেছ সমস্তই মিথ্যে! কেন তুমি তখন থেকে অস্থির নাযীফ? কী নিয়ে তোমার আতঙ্ক!

আতঙ্কের নামটা শুনেই সমস্ত শরীর শিরশির করে কেঁপে উঠল! নাযীফ কিছু বলতে পারল না। ঠোঁটে যেন শক্তিশালী আঠা লেগে জড়বৎ হয়ে গেছে। নাড়াতে পারছে না . . বলতে পারছে না . . জানাতে পারছে না কিছু! এমন সময় কাছ থেকে ভরাট-গম্ভীর স্বরে চমকে উঠল নাযীফ, 

  - মিস্টার নাযীফ, পেশেন্ট হাই ফিভার আপনার বন্ধু? 

তৎক্ষণাৎ মাথাটা বাঁপাশে ঘুরিয়ে ফেলল নাযীফ। কণ্ঠের মালিককে দেখে আপনা আপনি বসা থেকে ঝট করে উঠে দাঁড়িয়েছে। ভীষণ অপ্রস্তুত মুখে প্রশ্ন চোখে জানালো, 

  - জ..জ্বী। পেশেন্ট হাই ফিভার আমার বন্ধু। 

কথাটা বলেই হঠাৎ থতমত খেল নাযীফ। এটা আবার কী ধরণের নাম? হাই ফিভার? পেশেন্টের নাম ‘পেশেন্ট’ না হয়ে ‘হাই ফিভার’ কী জন্যে? উজবুকের মতো ফ্যালফ্যাল চোখে তাকিয়ে থাকলে সোহানা সেই উদ্ভট কথাটায় খুবই মজা পেল। শাওলিন যদি এখন জেগে থাকতো তাহলে এই সম্বোধন শুনে চেহারাটা কেমন দেখাতো? রাগে শক্ত, ক্ষোভে কঠোর, জেদে আগুন? ফিসফিসে চাপা হাসিতে হাসতে লাগল সোহানা। এদিকে মেজাজটা চিড় চিড় করে খিঁচড়ে উঠল নাযীফের! এই সোহানাকে এখন কী করতে মন চায়! নাযীফ ওর দিকে দৃষ্টি না দিয়ে প্রশ্নকর্তাকেই প্রশ্নবিদ্ধ করে দিল, 

  - মিস্টার, আপনি ওকে ‘পেশেন্ট হাই ফিভার’ বলছেন কেন? ওর নাম শেহজানা আলম। শেহজানা আলম শাওলিন। 

প্রয়োজনীয় তথ্য পাবার পর মাথাটা নড করে প্রায় চলে যাচ্ছিল শোয়েব; কিন্তু তখনি পেছন থেকে প্রশ্ন ছুটে আসায় আবারও দৃষ্টি ঘুরিয়ে তাকাল। কানে তখনো এঁটে আছে ফোন। অভিজাত সম্ভ্রন্ত ভঙ্গিতে কথা বলছে এক ফর্মাল ভূমিকায়। কলের ওপাশে “হোল্ড অন ফর টু সেক” বলে কলটা মিউট করল শোয়েব। নাযীফের দিকে প্রশ্ন ইঙ্গিতে বলল, 

  - বুঝিনি? 

  - আপনি ওকে ‘পেশেন্ট হাই ফিভার’ বললেন কেন? ওর তো একটা ভদ্র নাম আছে। না পারলে আমাদের মতো জানা ডাকবেন। নাহলে শাওলিন। 

পাশ থেকে উচ্চ দমকে ফিসফিস হাসির শব্দ ছুটে এল। মুখে হাত চেপে বহুকষ্টে হাসি থামাবার চেষ্টা করছে সোহানা। বুঝতে পেরেছে নাযীফ যে সামনে দাঁড়ানো সুউচ্চ সটান চশমাধারী ব্যক্তিকে চিনতে পারেনি। সুক্ষ্ম ভাবার্থটা বুঝতে পেরে হাতের ফোনটা কেটে দিয়েছে শোয়েব। সোহানার দিকে একনজর তাকাতেই সে হাসি থামাতে না পেরে চোখের ইশারায় “ভেরি ভেরি স্যরি স্যার” বুঝিয়ে দিল। এদিকে নাযীফের মুখ করুণ রাগে উত্তপ্ত। নাম বিকৃতি, বডি শেমিং তার বড্ড অপছন্দ। এই অপরিচিত লোকটার দুর্ব্যবহার, দুর্বৃত্তি দেখে ক্রোধে গজগজ করে বলল, 

  - আপনি এখানকার গণ্যমান্য একজন ডক্টর বলে পার পেয়ে যাবেন তা চলবে না। ডক্টরদের উচিত এসব আদব লেহাজ সবকিছু দেখে দেখে চলা। পেশেন্টকে আপনি পেশেন্ট বলবেন। আর নাহয় বলবেন পেশেন্ট অমুক। নাম ধরে ডাকবেন। তবু দয়াকরে পেশেন্ট হাই ফিভার, পেশেন্ট এক্সট্রা ফিভার এসব নামে ডাকবেন না। শুনতে বড় অসহ্য লাগে। 

নাযীফ বুক ফুলিয়ে জবরদস্ত এক ডাক্তারকে ফালা ফালা করে শ্বাস ফেলল। বুকের ভেতরটা এখন একটু শীতল শীতল লাগছে। ঠাণ্ডা হয়ে যাওয়া কফির কাপটা সোহানার দিকে বাড়িয়ে দিতেই হঠাৎ ধড়াম করে কেবিনের দরজা খোলার শব্দ হয়। পলক ঝাপটানোর আগেই প্রায় আগুনে ভস্ম কঠিন-ক্রুদ্ধ স্বরে কেউ বলল, 

  - আপনি সাবধানে মুখ ও ঠোঁট চালান নাযীফ। আপনি কার সামনে দাঁড়িয়ে উচুঁ গলাতে দুর্ব্যবহার দেখাচ্ছেন? গলার স্বর কার স্পর্ধায় আপনার অতো উঁচুতে উঠল!

বিস্মিত স্তব্ধ নাযীফ মারমুখো চেহারায় রাফান সিদ্দিকীকে দেখতে পেল। কেবিন থেকে বেরিয়ে কখন কথাগুলো রাফান শুনে নিয়েছে জানা নেই। রাফান যেন ছেড়ে বলতে রাজী নয় এমন মারাত্মক ভঙ্গিতে আবারও তেঁতে উঠল, 

  - ভুল করেও বিদ্যাধারী পাঠ দেখাবেন না। ডাক্তার বলে যাকে লেহাজের জ্ঞান দিচ্ছেন, তিনি আপনার বন্ধুর জন্য ডাক্তারকেই এখানে হাজির করে দিচ্ছেন। জায়গা বোঝেন না বলে আপনাকে এখন ছেড়ে দিচ্ছি। নামের পাশে ট্যুরিস্ট লেখা না থাকলে মর্মটা সহজ করে —

কথার মাঝপথে অতি দ্রুত ব্যারিকেড বসালো শোয়েব। রাফানের বদ বিগড়ানো মেজাজটার জন্য আজও সে মহা উত্ত্যক্ত। দুজন অপরিচিত ব্যক্তির সামনে আবহাওয়া ঠিক করতে নিজেই রাফানকে চড়া ইঙ্গিতে বলল, 

  - হসপিটাল রাফান। শান্ত হয়ে যাও। 

কঠিন গলায় হিংস্র কথাটা বলতে গিয়েও কঠোর আজ্ঞার কাছে চুপ হয় রাফান। চোখ সরায় সে। যতটা খিঁচড়ানো মেজাজে কথাগুলো শোনাচ্ছিল নাযীফকে, ততটাই সহজ শান্তকণ্ঠে শোয়েবের দিকে বলল, 

  - এরকম দুরবস্তা দেখে নীরব থাকা যায় না। নীরবতাকে এরা পেয়ে বসে স্যার। বহিরাভূত এসব ছোকরা আপনাকে যাচ্ছে-তা অপমান করবে সেটা আমি মেনে নিতে পারব না। 

  - গরম মগজে পানির ব্যবস্থা করো। তোমার হাই টেম্পার্ড সমস্যা যেন অবাধ্যতা না করে। পার্থ এখানে থাকল। ডক্টর রেজা এলে বুঝে নিবে। 

  - ঠিকআছে। এদিকটা আমার দায়িত্বে রইল। আমি সমস্তটা দেখে রাখছি। 

আর কথা বাড়ায়নি শোয়েব। লম্বা প্রশস্ত করিডোর পেরিয়ে চলে গেল আসল গন্তব্যে। তবে করিডোরের শেষমাথায় থাকা সেলিম ফোনে কথা বলতে গিয়ে বিস্ফোরিত চোখে স্থির। কখন তার কান থেকে ফোন আলগা হয়ে গেছে, তাতে তার হুঁশই নেই। প্রচণ্ড রকম বাকরুদ্ধ হয়ে চোয়াল ঝুলিয়ে রেখেছে। 


দিগদিগন্ত সোনা রঙ মাখিয়ে জানান দিয়েছে ভোর। বন পাহাড়ে ডানা ঝাপটে উড়ে চলেছে পাখিরা। নানা ফুলের সুগন্ধি মিশ্রিত বাতাস ভেসে আসছে থাইগ্লাসের অল্প খোলা জানালা দিয়ে। জানালার কাঁচ ভেদ করে বৃষ্টিস্নাত প্রকৃতি রৌদ্র ছোঁয়ায় ঝলমল করে ঢুকছে। ঘুমন্ত নরম মুখের উপর রৌদ্র মাখা আলতো তাপ ছুঁয়ে যায় একটু। ধীরে ধীরে বন্ধ দুচোখের ঘুম ঘুম পল্লব মেলে তাকাল শাওলিন। পৃথিবীকে আরো একবার বধূবেশী আলোক-সজ্জায় দেখতে পেয়ে মনের কোন জায়গাটা যেন চনমন করে উঠল। মায়ায় পরিপূর্ণ কৃষ্ণ-কালো চোখদুটি এদিক থেকে ঘুরিয়ে ওদিকে নিতেই নিজেকে বুঝল বদ্ধ কোনো ঘরে। যে ঘরে শীতাতপ নিয়ন্ত্রিত এসি আছে। একপাশে ডাক্তারদের সরঞ্জামাদি সাজানো। বাঁদিকে স্টিলের দীঘল স্ট্যাণ্ডের সাথে স্যালাইন ঝুলোনো থলে। হাত একটু নাড়াতেই বুঝল শিরার মাঝে ক্যানোলা বিঁধে আছে। কেবিনের দরজা খুব সাবধানে খুলে যেতেই উঁকি দিল একটি মুখ। ভেবেছিল এখনো ঘুম ভাঙেনি, তাই অল্প একটু দরজা মেলেই চট করে সেটা বন্ধ করতে যাচ্ছিল। কিন্তু তার আগেই পৌঁছুল কাঙ্ক্ষিত সেই সুকণ্ঠ, 

  - শ্রেষ্ঠা, এসো। 

স্বল্প খোলা দরজা পুরোপুরি খুলে ফেলল শ্রেষ্ঠা। ভেতরে ঢুকতে ঢুকতে নব ছেড়ে সে শাওলিনের কাছে এসে বসল। 

  - ঘুম হয়েছে? 

  - হয়েছে। 

  - এখন কেমন লাগছে? 

  - ভালো। 

  - কিছু খাবি? 

জবাব ঠোঁটে না দিয়ে মাথাটা কিঞ্চিত ডানে বাঁয়ে নাড়াল শাওলিন। দুর্বলতার করাল ছাপ এখনো ওর চোখে মুখে। বুক অবধি ঢাকা চাদরে রুগ্ন দৃশ্য শ্রেষ্ঠার মন খারাপ করে দিচ্ছে। ভাল লাগছে না। হাত বাড়িয়ে ওর কোমল কপালের উপর ছোট চুলের বিস্তার হালকা সরিয়ে নরম সুরে বলল, 

  - তোর মণি ফোন করেছিল। আজও মিথ্যে বলেছি। এভাবে কতদিন মিথ্যে বলে কাজ চালাব জানি না। তুই যে বাসে ওঠার পর থেকেই জ্বর নিয়ে ঘুরে ঘুরে ফিরছিস, তা মণির কানে তোলাই যাবে না। আমি তোকে নিয়ে খুব ভয়ে আছি। গতকাল যা ঘটল, তার জন্য আরো আগে এই জায়গাটা ছাড়তে চাই। কী মারাত্মক গা শিউরানো অবস্থা ছিল, উহঃ! 

  - কেন ভয় পাচ্ছ? আর কী পিছু নিয়েছে? 

  - পিছু তো আবারও নিতে পারে। একটাবার তুই ভাব, আমরা শুধু ঘুরতে এসেছি। মামুলি ঘুরাঘুরি। নিজেদের বিশ্বস্ত চেনা বন্ধুদল নিয়ে নেচার ভিউয়ে আসাটা নিশ্চয়ই কোনো অপরাধ নয়। কিন্তু এখানে আসার পরপরই মার্ডার, ফলো করা, ওই অজ্ঞাত গাড়ি! সব কেমন ভয়ংকর ভাবে ঘটে যাচ্ছে। এরপরও কী কিছু বলার মতো অবস্থা থাকে? বিপজ্জনক নয়? 

  - এখন কী করতে চাচ্ছ? 

  - ঢাকায় ফেরার সুযোগ নেই। ওয়েদার ফোরকাস্ট সুবিধার না। ঢাকা চট্টগ্রাম মহাসড়কের অবস্থা কল্পনারও বাইরে! ওখানে সেই সড়ক দুর্ঘটনাকে কেন্দ্র করে তুমুল অবরোধ চলছে। ঢাকা যাওয়া অসম্ভব।

  - বিপদ দেখছি শেষ হচ্ছে না। 

  - মনে হচ্ছে অদৃশ্য কিছু বারবার আমাদের যাওয়া আঁটকাচ্ছে। চাইছে না আমরা এখান থেকে বের হই। এমন সব বাঁধা পেয়ে আসছি যে এটা আমার জন্য রহস্যজনক। বিষয়গুলো স্বাভাবিক ঠেকছে না। 

  - বাকিরা কোথায়? 

  - ওরা হসপিটালের ক্যান্টিনে বসে আছে। সকালের নাস্তা কেউ করেনি। কাল সারারাত তাণ্ডব চালিয়ে ঝড়বৃষ্টি হয়েছে। ভাগ্য অত্যন্ত ভালো বলব, দেবদূতের মতো সেই ভদ্র লোকটা আমাদের ভীষণ সাহায্য করল। এখানে খালি বেডগুলোয় আমাদের শোবার ব্যবস্থা করে দিয়েছে। সকালে উঠে যে যার মতো উঠে হাতমুখ ধুয়ে একটু পরপর তোর কেবিনে এসে ঢুঁ দিচ্ছি। ডাক্তার এসে জানিয়ে গিয়েছে এখন আর চিন্তার কিছু নেই। সব ফিট অ্যাণ্ড ফাইন। 

  - হাতমুখ ধুবো আমি। সাহায্য করো শ্রেষ্ঠা।

কথা না বাড়িয়ে শাওলিনকে নিয়ে ওয়াশরুমে পৌঁছুল শ্রেষ্ঠা। দরজার ছিটকিনি লাগিয়ে বেসিনের মুখোমুখি দাঁড়াতেই দেয়ালের প্রশস্ত আয়নায় তাকাল শাওলিন। বিবর্ণ, রঙ হারিয়ে যাওয়া ক্যানভাসের মতো নিজেকে ফ্যাকাশে দেখাচ্ছে। দুটো দিন মর্মান্তিক ধকলের ভেতরে কাটলেও আজ কেন জানি মন শান্ত। মনে হচ্ছে কোথায় কিছু পরিবর্তন ঘটেছে, গাছের পাতায় রঙিন ফুলের কলি ফুটেছে, আকাশে চড়েছে রঙের মাধুর্য্য। ট্যাপ ছেড়ে মুঠো ভর্তি পানি ঝপ ঝপ করে মুখে ছিঁটিয়ে নিল। নিজেকে পরিচ্ছন্ন কেতাদুরস্ত করে শ্রেষ্ঠার সঙ্গে বেরুল শাওলিন। করিডোরের জায়গাটায় হাঁটাচলা করে শরীরের জড়তা ছাড়ানোর জন্য এল। হঠাৎ সিঁড়িতে ধপ ধপ শব্দ করে উঠে আসছিল রাফান। পেছনে পার্থ সিরিয়াস মুখে ডক্টর রেজার সাথে হাল হকিকত নিয়ে আলোচনা করছে। এমন সময় অসুস্থ অচেতন মেয়েটাকে চলাফেরা করতে দেখে রাফান গতকালকের ঘটনাটা স্মরণ করল। নাযীফের ওই দুর্ব্যবহার এখনো মনে সেঁটে রেখে এক কদম এগিয়ে শাওলিনের সামনে এসে বলল, 

  - হাই ফিভার মনে হচ্ছে সুস্থ হয়ে গেছেন। 

কথার চোখা ইঙ্গিতে চিকন ছাঁচের ভ্রুঁদুটো সামান্য কোঁচকায় শাওলিন। শ্রেষ্ঠার হাতে এখনো দেহের সমস্ত ভর রেখে চুপচাপ কিছু দেখল। এরপর নিষ্কপট সুরে শান্তভাবে জানাল, 

  - আপনি কী কোনো কারণে আমার উপর খুব বিরক্ত? 

এভাবে অকপটে সত্য কথাটা ধরে ফেলবে তা আশা করেনি রাফান। ভেবেছিল ওদের দলে থাকা অন্যান্যদের মতোই না বোঝার ভান করে থাকবে। কিন্তু না, ধরে ফেলেছে। চোখের তিরিক্ষি ছাপটা হয়তো দ্বিতীয় কারো সামনে আপনা আপনি কমে গেল তার। ভীষণ শান্তভাবে বলল রাফান, 

  - ব্যাপারটা ধরতে পেরেছেন দেখে ভালো লাগল। গতকাল কিছু ঘটনা ঘটেছিল যেটার জন্য বলতে পারেন আপনাদের পুরো দলটার উপরই দারুণ খেপা। তবে সাতসকালে আপনার সুস্থতা দেখে সেগুলো মনে করতে চাচ্ছি না। যাই হোক, এখন কেমন বোধ করছেন? ভালো? 

রাফানের প্রশ্নের উপর এক ছটাক বিরক্তি ঢেলে শ্রেষ্ঠা ঝাঁঝিয়ে উঠল। হুংকার, কঠোর, ক্ষোভিত গলায় বলল, 

  - আপনার মুখে কী মধু দেওয়া হয় না? কাল থেকে দেখছি দাঁত কামড়ে ছুঁচো ইঁদুরের মতো খুঁচিয়ে যাচ্ছেন! কাল নাযীফ আপনাকে কী বলেছে? কিছুই তো বলেনি। যা বলার শোয়েব সাহেবকে বলেছেন। উল্টো আপনার আচরণ দেখে মনে হচ্ছে, আপনার মুখে কেউ কালি মেরে দৌড় দিয়েছে। পৃথিবীতে কিছু মানুষের খাসলত এতো খারাপ উফঃ! 

বিরক্তিসূচক অভিব্যক্তিটা ইচ্ছে করে জোরাল করেছে শ্রেষ্ঠা। কাল থেকে এই বেত্তমিজ অভদ্র খিটখিটে লোকটা সমানে ওদের কথা শুনিয়ে যাচ্ছে। যাকে নয় তাকে বারবার দুর্ব্যবহার নিয়ে পাঠ পড়াচ্ছে। অথচ নিজের বেলায় ষোল আনা পবিত্র। শ্রেষ্ঠার ঝাঁঝ মাখানো কথায় শাওলিন কিছুটা অপ্রস্তুত বোধ করলে রাফানকে এসে পার্থ ধরল। টানতে টানতে করিডোরের অন্যপ্রান্তে নিয়ে ঠাস করে একটা শূন্য কেবিনে ঢুকে গেল। এমন অবস্থায় বৃদ্ধ বয়সি ডাক্তার রেজাউল করিম ভ্যাবাচ্যাকা খেয়ে শেষমেশ হেসেই দেন। শাওলিনের দিকে নজর দিয়ে অমায়িক সুরে বলেন, 

  - গতকাল বোধহয় ছোটোখাটো মিস আণ্ডারস্ট্যাণ্ডিং হয়েছিল। ভুলটা যদিও কারো নয়। ফারশাদ এসে তোমার নামটা ‘পেশেন্ট হাই ফিভার’ বলে। এতে তোমার বন্ধু নাযীফ কিছুটা রাগত ভাবে প্রতিবাদ জানায়। ঘটনাস্থলে রাফান এসে হাজির। তারপর থেকে . . বুঝতেই তো পারছ। 

ডক্টর রেজার কথা শুনে শাওলিন সহজ বোধ করলেও শক্ত রইল শ্রেষ্ঠা। তেঁতে ওঠে রাফানের বিষয়টাকে মোটা দাগে বোঝাল, 

  - একজন প্রাপ্তবয়স্ক যুবক কখন কোথায় সিনক্রিয়েট করছে এটুকু জ্ঞানবোধ নেই। শিষ্টাচার বলে কিছুই এখন আশপাশে দেখছি না। ডক্টর আঙ্কেল, আপনিই বলুন, গতকাল থেকে কতবার এই টপিকে রূঢ় আচরণ দেখিয়েছে? কতবার আমরা স্যরি বলে চুপ করে গেছি? তারপরও যদি বলেন দোষটা এই হতচ্ছাড়া লোকটার না, তাহলে সত্যিই, বিশ্বাস করুন আমি এরপর থেকে সামনে পেলে চড় মেরে বসব। আমার ভাই ব্রাদার বন্ধু নাযীফকে নিয়ে আরেকবার শুধু অপমান করুক। 

ক্ষোভে ফুঁসতে থাকা শ্রেষ্ঠা হনহন করে নীচে ছুটে গেলে শাওলিন ঠোঁট গোল করে দম ছাড়ল। এদের ভেতরে এখনো বড় বয়সের বড়ত্ব ছাপ আসেনি। সকলের পক্ষ থেকে ক্ষমাসুলভ বাক্যে বিষয়টা শিথিল করল শাওলিন, 

  - ওর কথায় কিছু মনে করবেন না আঙ্কেল। হয়তো ব্যাপারটা বেশি ঘোলাটে হয়ে গেছে। আমি সঠিকভাবে কিছু জানি না বলে কিছু বলতে পারছি না। তবু বলব, বয়সে আমরা ছোট বলে দুঃখিত বলে নিচ্ছি। 

কথাগুলো বলতে বলতে দেয়ালে বাঁহাত চেপে দাঁড়িয়েছে শাওলিন। সটান দাঁড়িয়ে থাকতে এখনো কিছুটা হিমশিম খেতে হচ্ছে। বৃদ্ধ অভিজ্ঞ ডাক্তারের চোখে সেটা আর এড়াল না। তিনি এগিয়ে এসে নিজের মেয়ের বয়সি মেয়েটার দিকে হাত বাড়িয়ে বললেন, 

  - ওভাবে পরে যাবে মা। হাত ধরো। আমি তোমাকে কেবিনে পৌঁছে দিচ্ছি। এসো। 

একপলক তাকিয়ে কী যেন পরোখ করে শেষপর্যন্ত হাসল শাওলিন। স্বল্প, মাপা, হালকা হাসি। প্রবীণ ডাক্তার রেজাউল করিমের সাহচর্য গ্রহণ করল ও। প্রবীণ লোকটার পড়ণে কেতাদুরস্ত শার্ট। ইস্ত্রিযুক্ত প্যান্ট, গলায় স্টেথোস্কোপ ঝুলোনো। বয়সের ভারে মাথার চুলে সাদা রঙ এসেছে। চোখে ভারি লেন্সের কালো ফ্রেম চশমা। একসময় ভারি সুপুরুষ যে ছিলেন, আজও উনার সৌম্য চেহারায় আঁচ করা যায়। ধীরভাবে পা ফেলতে ফেলতে বললেন তিনি, 

  - গতকাল তোমার অবস্থা খারাপ ছিল। আমিও ছিলাম আমার ছেলের কাছে। নাতিটার বুকে কফ জমেছে। প্রতিদিন নিয়ম করে দেখে আসতে হয়। কাল ফারশাদ আমায় কল না দিলে তোমার অবস্থা আরো খারাপের দিকে পৌঁছতো। আচ্ছা তুমি কী বৃষ্টিতে ভেজো? 

পরিষ্কার করিডোরে খালি পা ফেলে ফেলে এগোচ্ছে শাওলিন। ঠাণ্ডায় শিরশির করছে পায়ের তলা। ডানহাতটা বৃদ্ধ একজন সরল মানুষের হাতে আবদ্ধ। প্রশ্নটা শুনে দোনোমনা করলেও পরক্ষণে শান্তকণ্ঠে বলল, 

  - ভিজি। কাউকে না জানিয়ে ভিজি। ওদের কাউকে জানালে আমার আর রক্ষে নেই। ওরা কেউ জানে না পরশু রাতে ঝুম বৃষ্টির সময় বারান্দায় দাঁড়িয়ে ভিজেছিলাম। কতক্ষণ ছিলাম জানি না। মনে হয় যতক্ষণ দূরের পাহাড়গুলো ভিজছিল আমিও ততক্ষণ ভিজেছিলাম। এখানকার বৃষ্টি সূঁচের মতো . . খুব তীক্ষ্ম। মনে হয় চামড়া ভেদ করে ঢুকে যাচ্ছে। তবে, ভালো লাগে। 

  - এখানকার বৃষ্টিকে শহরের মানুষ ভীষণ ভয় পায়। সহজে কেউ বেরোয় না। ঠাণ্ডা একবার ধরে গেলে যমে টানাটানি শুরু হয়। আমি গতকালই বুঝেছি রোগটা বৃষ্টিতে ভেজার ফল। তোমার মতো অবস্থা দেখে কী বলব জানি না। এমন ভয়ংকর বৃষ্টি-ভক্ত আরো একজনকে দেখেছি। সে তোমার চেয়ে আরো ক’ধাপ উঁচুতে। হুড খোলা জীপ নিয়ে ঝুমবৃষ্টি দেখতে বেরিয়ে যায় . . এবার বোঝো অবস্থা! 

কথাটা শুনে হাসতে চাইলেও কেন জানি হাসতে পারল না শাওলিন। কর্ণধারে বারবার ‘ফারশাদ’ নামটা উচ্চারিত হচ্ছে। নামটা ওর কাছে বড্ড অচেনা। একবার কী প্রবীণ ডক্টরকে জিজ্ঞেস করবে মানুষটা আসলে কে? কী করে? কেন তার নাম বারবার উচ্চারণ করছে সবাই? কেবিনের দোরগোড়ায় পৌঁছে টানটান বিছানো বেডে বসে পরে শাওলিন। ডক্টর রেজা ব্লাড প্রেশারের মাপযন্ত্র নিয়ে স্টিলের টুলটায় বসেন। কিছু একটা নিয়ে শাওলিনকে ভাবুক দেখে নিজেই প্রশ্ন করে উঠলেন, 

  - মনে হচ্ছে তুমি কিছু বলতে চাইছ। কিন্তু দ্বিধার কারণে বলতে পারছ না। আমাকে তুমি বলতে পারো, যদি বলার মতো কিছু হয়ে থাকে। তোমার বন্ধুদলের কাছে সেটা যাবে না। 

বাঁ হাত বাড়িয়ে নির্দিষ্ট জায়গায় যন্ত্রটা বুঝে নিল শাওলিন। ছোট্ট একটা ঘড়ির মতো যন্ত্রে ডক্টর রেজা পরোখ করছেন। শাওলিন খানিকক্ষণ নীরব থেকে দ্বিধাবোধ ঝেড়ে বলল, 

  - গতকাল থেকে অচেতন থাকায় কিছু একটা মিস করেছি। তাই একজন সম্বন্ধে কিছু জানি না। ঘুম থেকে ওঠার পর শ্রেষ্ঠার মুখেও অপরিচিত নামটা শুনলাম। এখন আপনার কাছেও নামটা শুনছি। তাই কৌতুহল থেকে আগ্রহ, ফারশাদ নামের ভদ্রলোকটি কে? তিনি কী এখানকার বিশেষ কেউ? 


কেবিনের দরজা আঁটকে ফিরে এল পার্থ। রোগহীন শূন্য বেডে বসে আছে রাফান। রাগে মুখের অবস্থা ভয়ংকর। না পারছে একদণ্ড সহ্য করতে, না পারছে মুখের উপর কড়া করে ঝাঁঝিয়ে উঠতে। মাঝ থেকে পার্থ ওকে টানতে টানতে এই কেবিনে ধরে এনেছে। চোখের সামনে একজোড়া পা দেখলে আস্তে আস্তে ফ্লোর থেকে চোখ উপরে তুলল। দেখল বুকে হাত ভাঁজ করে ওর চেয়েও দ্বিগুণ রাগ নিয়ে তাকিয়ে আছে পার্থ। পুরো কেবিন গমগম করে কাঁপিয়ে সে নিজেই খেপে উঠল, 

  - কী শুরু করেছিস! 

ক্ষোভিত মুখের দিকে আর তাকাল না রাফান। দৃষ্টি পুনরায় ফ্লোরে ফেলে ভারি শ্বাস ছেড়ে বলল, 

  - আই ওয়াজ গন ব্ল্যাঙ্ক। 

  - মেজাজের উপর লাগাম বসানো উচিত না? গতকাল থেকে খ্যাস খ্যাস করে যাচ্ছিস, যা থামছেই না। তোর ব্যাপারে আমি খুবই ডিস্টার্বড রাফান। সীমানা ছাড়িয়ে ব্যাপারটা ঘটছে। 

  - জানি। কিন্তু আমার সামনে বাইরের একটা ছেলে ওরকম চোটপাট দেখালে ওটা অবশ্যই সহ্য হবে না। 

  - যেরকম আচরণ করছিস স্যারের ঘরে যদি ইন ফিউচার ম্যাম আসেন, তাহলে তোর সাথেই ম্যামের লঙ্কাকাণ্ড বেঁধে যাবে। স্যারের বউ স্যারকে চড়া চড়া কথা শোনাবে; আর পেছন দিয়ে তুই গিয়ে স্যারের বউকেই শত ঝাঁঝরা করে শোনাবি। 

  - দরকার পরলে তাই-ই করব, শুনে রাখ। ওসব মেয়েলোক যদি শোয়েব স্যারকে তিল পরিমাণ অপদস্থ করে, সুরতহাল ঠিক রাখব না। 

পার্থ এ পর্যায়ে হার মেনে ওর ডানপাশ ঘেঁষে বসল। পার্থ জানে রাফানের মনে ওই মানুষটার জন্য কতটুকু শ্রদ্ধাবোধ রয়েছে। এই শ্রদ্ধার পরিমাণ বড্ড বেশি বলেই এক ইঞ্চি পরিমাণ দুর্ব্যবহার সহ্য হয় না। পার্থ হাত বাড়িয়ে রাফানের কাঁধ জড়িয়ে ধরল, 

  - এই একটা দোষে আজ পর্যন্ত তুই পার্ফেক্ট পার্টনার পেলি না। কোনো মেয়েকে তুই কাছে ঘেঁষতে দিস না। মেজাজটা আয়ত্ত আনার চেষ্টা কর রাফান। এভাবে জীবনটাকে হেলাফেলা করে নষ্ট অন্তত করিস না। তোর এই মেজাজের কারণে আরো একটা মানুষ অমন সুনশান বাংলোয় একা একা থাকে। তোর কী মনে হয় না ওই বাংলোর জন্য উপর্যুক্ত কাউকে আনা দরকার? যিনি ওই বাংলো, বাংলোর মালিক, মালিকের জীবনটাকে ঠিক করে দেবে? 

কয়েক সেকেণ্ড শান্ত থাকে রাফান সিদ্দিকী। আপন মনে বিষয়গুলো ভেবে নিয়ে বলে, 

  - একজন বিশ্বাসযোগ্য, ভরসাযোগ্য, আত্মনির্ভরশীল নারী দরকার। স্যারের দাদীজান পাত্রীর নামে যে সমস্ত ছবি আনেন, ওগুলোর ব্যাকগ্রাউণ্ড ঘেঁটে দেখলে বিশ্বাস হারাতে হয়। যাদের কাছে বিয়ের মানেই মালদ্বীপে হানিমুন, লাক্সারিয়াস শপিং, এলিট ক্লাবে দাওয়াত, তাদের জন্য শোয়েব ফারশাদের প্রোফাইল নট রিকোমাণ্ডেড ফ্রম মি। 

হাল ছেড়ে দেবার ভঙ্গিতে ফোঁস করে শ্বাস ছাড়ল পার্থ। কাঁধ থেকে হাত সরাবার বদলে আরো ভালো করে তার কাঁধ জড়িয়ে ধরল। চোখেমুখে চিন্তার ছাঁচ ফেলে অদ্ভুত স্বরে বলল রাফান। যেন দূর থেকে কোনো অশনি বিদ্রোহের গন্ধ পেয়ে বলল, 

  - পার্বত্যাঞ্চলের বাইরে যাওয়া যাবে না। এই অঞ্চল ছাড়া মানেই মৃত্যু। আমরা কেউ চাই না সেই নির্মম কালরাত্রি ফিরে আসুক। সর্বোচ্চ সতর্কতায় থাকা দরকার . . .  
.
.
.
চলবে...................................................

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন

WhatsApp