এক হাজার টাকা - পর্ব ০১ - মৌরি মরিয়ম - ধারাবাহিক গল্প


হঠাৎ করেই আকাশটা কালো হয়ে এসেছে। প্রচন্ড বাতাস বইছে। বাতাসে ধুলোর রাজত্ব। বিকেলবেলায় মনে হচ্ছে পৃথিবীর বুকে রাত নেমে এসেছে। ঝড় বৃষ্টি শুরু হলে কয়েক বছর আগেও অনেক আবেগপ্রবণ হয়ে পড়তাম আমি। অথচ এখন বিরক্ত লাগে। বিরক্ত লাগার অবশ্য বিশেষ কারণ আছে। তখন বাসায় থাকতাম, দূর থেকে উপভোগ করতাম। কিন্তু এখন প্রতিদিন টিউশনিতে যেতে হয়।

যখন টিউশনির কথা হচ্ছিল তখনই ছাত্রীর মা বলেছিলেন,
"মালিবাগ থেকে তো প্রতিদিন গুলশান এসে পড়াতে পারবে না। সামনে ঝড়বৃষ্টির দিন। মেয়েমানুষ তুমি বৃষ্টি কাদার মধ্যে নিশ্চয়ই নিয়মিত আসতে পারবে না।"

আপনাদেরকে আগেই বলে রাখি, মেয়েমানুষ শব্দটা শুনলেই আমার গায়ে আগুন ধরে যায়। মেয়েমানুষ আবার কী শব্দ? আমরা যে মানুষ এটা বোঝানোর জন্য কি আলাদা করে মানুষ শব্দটা যোগ করতে হবে? শুধু মেয়ে বললে হয় না? যদিও এসব বিষয়ে ভদ্রমহিলাকে কিছুই বললাম না।

শুধু বললাম,
"আমি যদি নিয়মিত আসতে না পারি তখন বাদ দিয়ে দিয়েন।"

এরপর ছাত্রীর মা রাজী হয়। আজ পর্যন্ত একদিনও টিউশনি মিস দেইনি। ঝড়বৃষ্টি হলেও ছাতা নিয়ে চলে গেছি পড়াতে। বৃষ্টি বেশি হলে ছাতায় মানে না। মাথাটা কোনোরকমে বাঁচে। এই টিউশনিটা দুমাস হলো নিয়েছি। এর আগে ৩ টা টিউশনি করে পেতাম ১০ হাজার টাকা। ৩ জায়গায় দৌড়াতেই অনেক সময় নষ্ট হয়ে যেত। এখন এই একটা টিউশনিতেই পাই ১২ হাজার। সময়ও বাঁচে অনেক। নিজের পড়াশোনা ও হাতখরচ চালিয়েও মায়ের হাতে কিছু টাকা গুঁজে দিতে পারি। মধ্যবিত্ত ঘরের মেয়ের কাছে এরচেয়ে আনন্দের আর কিছু কি হতে পারে? পারে না। তাই কোনোভাবেই এই টিউশনিটা হারাতে চাই না। আজ মনে হচ্ছে বের হওয়া অসম্ভব। আমি যদি এর মধ্যে বের হই, ৪৫ কেজি ওজনের আমাকে উড়িয়ে নেয়ার আগে বাতাস একবারও ভাববে না। তবুও তৈরি হচ্ছিলাম।

আমাকে তৈরি হতে দেখে মা ঘরে ঢুকে বললেন,
"কী রে তিন্নি? তুই কি এই ঝড়ের মধ্যেও পড়াতে যাচ্ছিস নাকি?"

আমি নির্লিপ্ত গলায় বললাম,
"হ্যাঁ"

পৃথিবীর সপ্তমাশ্চর্য দেখার মতন অবাক হয়ে আমার মা বললেন,
"তুই কি পাগল? এমন ঝড়ের মধ্যে যাবি কীভাবে? আজ যেতে হবে না।"

মায়ের এসব ভীতু ভীতু আচরণ আমার পছন্দ নয়। এসব আচরণ তার ছোট মেয়ে ননীর পুতুল মিন্নির জন্য প্রযোজ্য। আমি একটু শক্ত ধরনের মেয়ে, অনেকটা আমার দাদার মত। আমি এইমাত্র যে কথাটা বললাম সেই কথাটা আপনারা সিরিয়াসলি নেবেন না। আমার অনেক কাজেই আপনারা বুঝতে পারবেন আমি আসলে শক্ত ধরনের নই। কিন্তু নিজেকে শক্ত বলে উপস্থাপন করতে পছন্দ করি। আমি ব্যক্তিগতভাবে শক্ত, আত্মবিশ্বাসী, স্বনির্ভর, সাহসী ও কর্মঠ মেয়েদেরকে ভীষণ পছন্দ করি। এমন মেয়েদেরকে দেখলে আমার মনে ঈষৎ হিংসা জন্মায়। কারণ এর একটাও আমি নই। কিন্তু প্রতিটিই হতে চাই। ইদানীং অনেকটা সফলও হচ্ছি। তবে ঝামেলা কী জানেন? আমি একরকম কিন্তু হতে চেষ্টা করি আরেকরকম। তাই আমি এখন কেমন তা আমি নিজেই জানি না। কেউ আমাকে বুঝে উঠতে পারে না, অনেক সময় আমি নিজেও পারি না।

মা আবার ধমকে উঠলেন,
"কী হলো কথা বলছিস না কেন?"

"ঝামেলা আছে। যেতে হবে, তুমি বুঝবে না মা।"

"কথা একটা বললেই বলিস বুঝবো না। বুঝবো না কেন? তোকে পেটে ধরেছি আমি। আজকালকার ছেলেমেয়েদের সাহস দেখলে অবাক হয়ে যাই।"

আমার ধারণা বাংলাদেশে এমন কোনো মানুষ নেই যার মায়ের মুখে এই পেটে ধরাধরি বিষয়ক কথা শুনতে হয়নি।

যাই হোক, আমি বললাম,
"মা, বোঝাতে গেলে অনেক কথা বলতে হবে। একদিন সময় নিয়ে বুঝিয়ে বলব।"

বাবার ডাকে মা ঘর থেকে বের হয়ে গেলেন। তারপরই আমার ফোনটা এলো। ছাত্রীর মা ফোন করেছেন।

"তিন্নি আজ তোমার আসতে হবে না।"

"কেন আন্টি?"

"কেন আবার? তুফান হচ্ছে দেখছো না? আজ আবহাওয়া আরো খারাপ হবে। জানি তো এই অবস্থাতেও পাগলের মত চলে আসবে, তাই মানা করলাম। আজ বের হওয়াটা রিস্কি।"

"ঠিকাছে আন্টি।"

কাপড় পালটে ড্রয়িং রুমে যেতেই দেখলাম দাদাজান পত্রিকা পড়ছেন।

তার সামনে বসে বললাম,
"দাদাজান চিড়েভাজা খাবেন?"

দাদাজান এক গাল হেসে বললেন,
"খাব সাথে এক কাপ দুধ চা। জানিস আমাদের ছোটোবেলায় বৃষ্টির দিনে আমার মা চিড়ে ভাজতো, চাল ভাজতো, সিমের বিচি ভাজতো। আমরা সব ভাইবোনেরা গোল হয়ে বসে খেতাম। কি যে আনন্দের ছিল সেইসব দিনগুলো।"

মা রান্নাঘরে যাচ্ছিলেন। আমাকে ঘরের কাপড় পরা দেখে বললেন,
"তুই যাচ্ছিস না?"

"না মা। তুমি মানা করেছো আমি যাই কি করে বলো?"

মা হেসে বললেন,
"ভাবখানা এমন করছিস যেন আমার কথা মতোই তুই সব করিস। নিশ্চয়ই কোনো কারণে ক্যান্সেল হয়েছে?"

আমি হেসে বললাম,
"তুমি কোথায় যাচ্ছো?"

"চা করতে যাচ্ছি।"

"তুমি বসো। আজ আমি চা করব। দাদাজান চেয়েছেন।"

চিড়ে ভেজে চা বানাতে বানাতে ফোনটা টুং করে উঠলো। স্ক্রিনে তাকিয়ে দেখি আদনান মেসেজ করেছে। দাদাজানকে চিড়ে ভাজা ও চা দিয়ে নিজের ঘরে ঢুকলাম।
আমার অনেক বন্ধুবান্ধব। সাধারণত সবার সামনেই তাদের সাথে ফোনে কথা বলি, চ্যাটিং করি। কিন্তু এই একজনের সাথে কথা বলার সময় আমার কেমন যেন লাগে। মানুষটা ঠিক বন্ধু নয় আমার। অন্যকিছুও নয়। আসলে আমাদের কী সম্পর্ক আমি তা জানি না। হয়তো কোনো সম্পর্ক নেই। কিংবা আছে.. কথা বলা সম্পর্ক। যে সম্পর্কে একজন আরেকজনের সাথে শুধু কথা বলে। অপ্রয়োজনীয় সব কথা। আদনানের সাথে কারো সামনে কথা বলতে পারি না আমি। মনে হয় সবাই আমার গোপন কিছু দেখে ফেলছে। অথচ মানুষটাকে সামনাসামনি দেখিওনি আমি। মাঝেমাঝে আমার মনে হয়, এই মানুষটার প্রতি আমার যে অনুভূতি সেটা সহানুভূতি ও মায়া ছাড়া আর কিছু নয়। আবার মাঝে মাঝে মনে হয়, এই অনুভূতি ভীষণ গভীর কিছু। আদনানের সাথে অল্প কয়েকবার ফোনে কথা হয়েছে মাত্র। কিন্তু চ্যাটিং হয় প্রচুর। প্রতিদিন হয় না, একদিন দুদিন পর পর হয়। যেদিন হয় অনেকক্ষণ হয়। আমাদের পরিচয় ফেসবুকে। কে কাকে ফ্রেন্ড রিকোয়েস্ট দিয়েছিলাম তা কারোরই মনে নেই। কতদিন ধরে ফ্রেন্ডলিস্টে আছি তাও জানা নেই। তবে একই স্কুলের ছাত্র-ছাত্রী হওয়ায় আমরা কোনোভাবে এড হয়েছিলাম। হঠাৎ একদিন আদনানের একটা পোস্টে চোখ পড়ে গিয়েছিল আমার। সে তার জীবনের কিছু কঠিন সময়ের কথা লিখেছিল সেই পোস্টে। ছোটবেলা থেকেই সে খুব আদরের ছিল। ৯ ভাইবোনের মধ্যে সবার ছোট। ক্লাস সেভেনে পড়ার সময় তার বাবা মা মারা যায়। বাবা মা মারা যাওয়ার পর সম্পত্তি ভাগাভাগি নিয়ে অনেক সমস্যা শুরু হয়। তখনই ভাইবোনদের রূপ বদলে যায়। এরপর সে বড় বোনের বাসায় থেকে এসএসসি পাশ করে। সেখানে সে খুব একটা আদরে ছিল তা নয়। তার দুলাভাই তাকে পছন্দ করতো না। বোন অবশ্য আদর-যত্ন করতো। এরপর ভাগ্যক্রমে চান্স পেয়ে গেল নটরডেম কলেজে। কলেজের নাম ভাঙিয়ে কিছু টিউশনিও পেয়ে গেল। বোনের বাসা ছেড়ে হোস্টেলে উঠে গেল। এইচএসসি পাশ করার পর মামা ও বড় বোনের সাহায্যে সম্পত্তির নিজের অংশ আদায় করতে পেরেছিল, যা পাওয়ার তার কোনো সম্ভাবনাই ছিল না। এরপর নিজের অংশ বিক্রি করে স্টুডেন্ট ভিসা নিয়ে সে চলে যায় ডেনমার্ক। এখন সেখানে চাকরি ও পোস্ট গ্রাজুয়েশন করছে। সেখানে রোমো নামক ছোট্ট এক দ্বীপে থাকে সে। প্রতিদিন দ্বীপ থেকে শহরে গিয়ে অফিস ও ক্লাস করে। তার ভাইবোনেরা এতদিন তার খোঁজ নিত না। ইদানীং নাকি হঠাৎ খোঁজখবর নেয়া শুরু করেছে। এই বিষয়গুলো একটু বিস্তারিত ভাবেই সেই পোস্টে লিখেছিল আদনান। সবটা পড়ে আমার ভীষণ মন খারাপ লেগেছিল। একটা মায়া কাজ করেছিল। সেদিন আমি প্রথম আদনানকে নক করেছিলাম।

আদনানের প্রথম মেসেজ ছিল,
"দয়া করে সিম্প্যাথি দেখাবেন না। অন্যকিছু বলার থাকলে বলুন।"

আমার মেজাজটা আবার একটু খিটখিটে। দুম করেই রেগে গেলাম,
"আপনি কীভাবে এতটা শিওর হচ্ছেন আমি সিম্প্যাথি দেখাতেই এসেছি?"

"পোস্ট টা দেয়ার পর থেকে অসংখ্য অপরিচিত জনদের মেসেজ পাচ্ছি। সবাই সিম্প্যাথি দেখাচ্ছে। যেহেতু আপনার সাথে আমার আগে কখনো কথা হয়নি সেহেতু আমি ভেবেছি আপনিও তাদের মত... সরি আমি আসলে সিম্প্যাথি নিতে পারি না। তাই এসব কথা কখনো কাউকে বলি না। এই পোস্টটা দেয়ার উদ্দেশ্য ছিল আমার ভাইবোনেদের দেখানো। যেহেতু অন্য কোনো যোগাযোগ মাধ্যম সেভাবে নেই এবং সরাসরি তাদের সাথে আমি কথা বলব না তাই এই পোস্ট টা দেয়া।"

আমার রাগটা একটু কমলো যখন মনে পড়লো আমি আসলে সিম্প্যাথি দেখাতেই এসেছিলাম। পরে প্রসঙ্গ পালটে স্কুলের বিভিন্ন ব্যাপার নিয়ে কথা বলা শুরু করলাম। এরপর থেকে নিয়মিতই কথা হয়। কথা বলতে বলতে আমি একসময় আবিষ্কার করলাম আদনান কথা খুব কম বলে। এরপর একদিন আমি এটাও আবিষ্কার করলাম আদনান আসলে একজন বোরিং মানুষ। কিন্তু তবুও তার বলা হ্যালো তিন্নি, কেমন আছো, আমি ভাল আছি, হ্যাঁ, না, এই সীমিত কথাগুলো শুনতেও খুব ভাল লাগে আমার! আমার ছবি তোলার বাতিক আছে। দেখতেও খারাপ নই। নিত্যনতুন সুন্দর সুন্দর ছবি পোস্ট করি! আদনান কোনোদিন একটা কমেন্ট করেনি, এমনকি ইনবক্সেও কখনো কোনো ছবি নিয়ে এক লাইন লেখেনি। সব ছবিতে শুধু একটা লাইক দেয় সে। একটা লাভ রিয়েক্টও দেয় না। শত শত লাইকের মধ্যে আমি কেবল খুঁজতে থাকি একটা নাম আদনান বিন রশীদ। যখন নামটা পেয়ে যাই তখন এক অদ্ভুত ভাললাগা কাজ করে! তবে হ্যাঁ একটা অদ্ভুত ব্যাপার মাঝে মাঝে ঘটে। আদনানের কি যেন হয়! তখন সে আমাকে ফোন করে। ফোন করে অনেক কথা বলে। অপ্রয়োজনীয় সব কথা। তখনকার আদনানকে সম্পূর্ণ অচেনা লাগে আমার। যে মানুষের ভেতরে এত কথা, সে কীভাবে সারাক্ষণ চুপ করে থাকে? কেন চুপ করে থাকে?

আমি ঘরের দরজাটা লাগিয়ে দিলাম। কিছুটা অপরাধ বোধ কাজ করছে। চিনি না জানি না একটা ছেলের জন্য দাদাজানের সাথে বসে আড্ডা না দিয়েই চলে এলাম। দাদাজান একা একা চিড়ে ভাজা খাচ্ছেন বলে মন কিছুটা খারাপ হলো। এই একই মন আদনানের সাথে কথা বলার জন্যও অস্থির হয়ে আছে। গত দুদিন কথা হয়নি।

আদনানের মেসেজটা খুলে দেখলাম সে লিখেছে,
"তিন্নি তোমার কাছে এক হাজার টাকা হবে? ধার? কীভাবে পাঠাবে সে উপায় আমি বলে দেব। পারলে আজকের মধ্যে জানাও, খুব দরকার।"
.
.
.
চলবে.................................................

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন