নবোঢ়া - পর্ব ৩০ - ইলমা বেহরোজ - ধারাবাহিক গল্প


সন্ধ্যার অস্পষ্ট আলোয় সুফিয়ান বারান্দায় দাঁড়িয়েছিলেন। তার শরীরের প্রতিটি পেশী অবসন্নতায় ভারাক্রান্ত। ব্যবসায়ে আকস্মিক বিপর্যয়, তার ওপর খামারের গরুগুলোর একযোগে মৃত্যু সবকিছু মিলে মনের ভেতরটা বিষাদে ডুবে গেছে।

পাশে দাঁড়ানো ললিতা মাঝেমধ্যে স্বামীর মন ভালো করার চেষ্টায় দু-একটা কথা বলছিলেন। 

হঠাৎ করেই উন্মত্ত হাতির মতো জাওয়াদ এসে আছড়ে পড়ল দরজায়। তার চোখে-মুখে প্রচণ্ড ক্ষোভের ছাপ। দরজা খুলে ললিতা পাথর হয়ে গেলেন।

"জাওয়াদ... " ললিতার কণ্ঠে বিস্ময়।

জাওয়াদের চোখে জ্বলছে বিদ্রোহের আগুন। গলায় তীব্র ক্ষোভ নিয়ে সে বলল, "কোন অধিকারে আপনি গুলনূরকে হুকুম দিলেন? কে আপনি তার জীবন নিয়ন্ত্রণ করার?"

ললিতার মুখে ক্ষণিকের জন্য বিভ্রান্তির ছায়া। "কী বলছিস তুই?"

"ভান করবেন না!" জাওয়াদের কণ্ঠে এবার তীব্র বিদ্বেষের সুর। "আপনি গুলনূরকে আমার থেকে দূরে থাকতে বলেছেন। কারণ সে একজন দাসী!"

ললিতার চোখে ফিরে এল সেই চিরপরিচিত কঠোরতা, "হ্যাঁ, বলেছি।শুধু দাসী নয়, ও অস্পৃশ্য। ওর সঙ্গে তোর এই মেলামেশা আমাদের বংশমর্যাদায় কলঙ্ক..."

"বংশমর্যাদা?" জাওয়াদের ঠোঁটে ফুটে উঠল তীব্র বিদ্রূপের হাসি। "আপনার এই তথাকথিত মর্যাদা নিয়ে আপনি থাকুন। আমার কাছে গুলনূর শুধুই একজন মানুষ। সে আমার বন্ধু..."

ললিতা গলার জোর বাড়িয়ে বললেন, "তুই আমার ছেলে। তোর সঙ্গে কার সম্পর্ক হবে, কে তোর কাছাকাছি আসবে সব আমি ঠিক করব।"

জাওয়াদের চোখে তখন উন্মাদনার ছায়া। "আপনি?" তার কণ্ঠে বিদ্রোহী প্রশ্ন। "আপনি কে? আমার জীবনের মালিক? আমার হৃদয়ের শাসক? না, আপনি কিছুই না। আপনার এই অহংকার, এই জাত-পাতের বিষাক্ত চিন্তা সব আমি ঘৃণা করি।"

"জাওয়াদ!" ললিতার চোখে জ্বলে উঠল ক্রোধের আগুন। তাঁর কণ্ঠে আহত মায়ের বেদনা। "মায়ের সঙ্গে কীভাবে কথা বলছিস? আমি তোর..."

জাওয়াদ তাঁর কথা শেষ হতে দিল না। "আমি মানুষকে মানুষ হিসেবেই দেখি। আপনার মতো জাতের দোহাই দিয়ে কাউকে ঘৃণা করি না। আপনি আমার জীবন নিয়ন্ত্রণ করতে পারবেন না।"

ললিতার চোখ অশ্রুসজল হয়ে উঠল। কণ্ঠে গভীর বেদনা নিয়ে বললেন, "তুই... তুই আমার ছেলে না। তুই আমার..."

"হ্যাঁ, আমি আপনার ছেলে না। আমি একজন স্বাধীন মানুষ। আপনার এই সংকীর্ণ চিন্তার কারাগারে আমি বন্দি থাকব না।"

ঠিক তখনই অন্ধকারের বুক চিরে সুফিয়ানের গম্ভীর কণ্ঠস্বর ভেসে এল। তার গলায় বজ্রের গর্জন।

"জাওয়াদ!"

সেই ডাকে জাওয়াদের সমস্ত শরীর শিউরে উঠল। সে ধীরে ধীরে পিছন ফিরল। দেখল, অন্ধকার থেকে বেরিয়ে আসছেন সুফিয়ান। তার চোখে জ্বলছে অগ্নিশিখা। মুখের রেখা কঠোর।

"বাবা, আমি..." 

"চুপ!" সুফিয়ানের গর্জনে থমকে গেল রাতের নিস্তব্ধতা। "মায়ের সঙ্গে এভাবে কথা বলার স্পর্ধা কোথায় পেলে? যে রক্ত তোমার শিরায় বইছে, সেই রক্তের মর্যাদা রাখতে শেখোনি?"

জাওয়াদের চোখে জ্বলে উঠল বিদ্রোহের আগুন। কণ্ঠে তীব্র প্রতিবাদের সুর। "রক্তের মর্যাদা? মানুষের রক্ত কি আলাদা হয় বাবা? একজন দাসীর শিরায় যে রক্ত বয়ে যায়, তা কি জমিদারের রক্ত থেকে ভিন্ন? এই অন্ধ কুসংস্কার, এই বিষাক্ত বিভেদ কিছুই আমি মানি না।"

সুফিয়ানের মুখের পেশিগুলো শক্ত হয়ে উঠল। চোয়ালের হাড় কঠিন। মুহূর্তের মধ্যে তার ভারী হাত উঠে এল বাতাসে। 'ঠাস' করে একটা প্রচণ্ড চড় পড়ল জাওয়াদের বাঁ গালে। শব্দটা প্রতিধ্বনিত হল নিস্তব্ধ বারান্দায়।

বাইরে থেকে গুলনূর নিঃশব্দে সব দেখছিল। তার বুকের ভেতরটা মোচড় দিয়ে উঠল। জাওয়াদের গালে ফুটে উঠেছে পাঁচ আঙুলের স্পষ্ট দাগ। রক্তের আভা। কিন্তু জাওয়াদ ধীরে ধীরে মাথা তুলল। বাবার জ্বলন্ত চোখের দিকে অবিচল দৃষ্টিতে তাকিয়ে রইল।

সুফিয়ানের কণ্ঠে ঝরে পড়ল তীক্ষ্ণ বিদ্রূপ, "তুমি আমার ছেলে, না বাজারের অকর্মা গেঁয়ো? সারাদিন শুধু বাড়িতে পড়ে থাকা, কোনো কাজের ধার দিয়ে যাও না। আর যখন তখন দাসীর সঙ্গে ঘুরে বেড়ানো। এর ওপর আবার মা-বাবার সামনে দাঁড়িয়ে উদ্ধত আচরণ!"

জাওয়াদ চড়ের জ্বালা বুকে নিয়ে শান্ত কণ্ঠে বলল, "রক্তের ভেতর কি কারও জাত-পাত লেখা থাকে?"

সুফিয়ান হঠাৎ পাশের টেবিলে প্রচণ্ড মুষ্টিঘাত করলেন। শব্দটা যেন বাজের মতো আছড়ে পড়ল। "তুমি আমাকে জ্ঞান দেবে? তোমার মতো অপদার্থ সন্তান যে আমার ঔরসে জন্মেছে এটাই আমার জীবনের সবচেয়ে বড় অভিশাপ!"

"বাবা..." জাওয়াদের কণ্ঠে আর্তনাদ।

সুফিয়ানের চোখে এখন শুধু অবজ্ঞার আগুন। "তোমার বয়সী ছেলেরা পরিবারের মান-মর্যাদা বাড়াচ্ছে, ব্যবসা সামলাচ্ছে। আর তুমি? তুমি শুধু আমাদের বংশের কলঙ্ক! তোমার দাদা তোমার বয়সে কত বড় জমিদার ছিলেন জানো? আর তুমি? দাসীর সঙ্গে বসে সমাজ সংস্কারের স্বপ্ন দেখছো?"

জাওয়াদের চোখে জল টলটল করছে। "আমি যা করছি, তা ভুল নয় বাবা। মানুষে মানুষে এই বিভেদ..."

সুফিয়ান বিদ্রূপের হাসি হাসলেন। সেই হাসিতে যেন বিষের ছিটে। "তাই নাকি? তবে যাও, তোমার দাসীদের সঙ্গেই থাকো। আমার বাড়িতে তোমার মতো কলঙ্কের স্থান নেই। কেবল তোমার মায়ের অনুরোধে এতদিন তোমার মতো নালায়েককে সহ্য করে এসেছি।"

ললিতা বিস্ফারিত চোখে স্বামীর দিকে তাকালেন। তার কণ্ঠে আতঙ্ক, "কী বলছেন! চুপ করুন।"

"হ্যাঁ, ঠিকই শুনেছো।" সুফিয়ানের কণ্ঠে এখন শুধু বিষ। "ওর জন্ম নেওয়াটাই ছিল একটা মস্ত বড় ভুল।" তিনি ছেলের দিকে জ্বলন্ত দৃষ্টিতে তাকালেন, "তুমি আমার ছেলে হওয়ার যোগ্যতা হারিয়েছ। এমন বিদ্রোহী, অবাধ্য সন্তান আমার প্রয়োজন নেই। এই সম্পত্তির এক কানাকড়িও তোমার ভাগ্যে জুটবে না!"

জাওয়াদের সমস্ত শরীর যেন আগুনে পুড়ে যাচ্ছে। চোখ-মুখ রক্তবর্ণ। বুকের ভেতর লাভার মতো কিছু একটা উত্তাল হয়ে উঠছে। কিন্তু মুখ দিয়ে কোনো শব্দ বের হল না।

সুফিয়ান আবার বললেন, তার কণ্ঠে এবার হুমকির সুর। "যদি এই বাড়িতে থাকতে চাও, তবে মানুষ হয়ে ওঠো। নয়তো..."

কথা শেষ হওয়ার আগেই জাওয়াদ ক্রোধে অন্ধ হয়ে ঘর থেকে বেরিয়ে গেল। তার প্রতিটি পদক্ষেপে আগুন ঝরে পড়ছে। পায়ের শব্দে থরথর করে কেঁপে উঠল বাড়ির মেঝে। 

ললিতা বুকের ভেতর একটা তীব্র যন্ত্রণা অনুভব করলেন। দুই বছর আগের সেই কালো দিনগুলোর স্মৃতি আবার ফিরে এল। কোথায় হারিয়ে গিয়েছিল জাওয়াদ, কী করেছিল কেউ জানে না। কত অপেক্ষায় কেটেছিল প্রতিটি মুহূর্ত! 

"না, না... আবার যদি হারিয়ে যায়? আবার যদি..." ললিতার কণ্ঠ কেঁপে উঠল। তিনি স্বামীর দিকে ফিরে অসহায়ভাবে বললেন, "আপনি এমন করলেন কেন? এত কঠোর কথা বলার কী দরকার ছিল?"

সুফিয়ান পাথরের মতো শক্ত হয়ে দাঁড়িয়ে রইলেন। তার কণ্ঠে অহংকার আর রুক্ষতা, "জমিদার বংশের ছেলে সে। শৃঙ্খলা আর মর্যাদাবোধ থাকা চাই। আমাদের সামাজিক মর্যাদা নষ্ট করার অধিকার ওর নেই।"

ললিতা আর দাঁড়ালেন না। ছেলের দিকে ছুটলেন। ততক্ষণে জাওয়াদ নিজের ঘরে ঢুকে একটা পুরনো ব্যাগে কয়েকটা জামাকাপড় গুছিয়ে নিয়েছে। তারপর সোজা গুলনূরের ঘরের দিকে পা বাড়াল।

গুলনূর তখন বিছানার কোণে গুটিসুটি মেরে বসে। হঠাৎ দরজা খুলে ভেতরে ঢুকল জাওয়াদ। সে কিছু বুঝে ওঠার আগেই তার হাত চেপে ধরে টেনে নিয়ে বের হয়ে এল। গুলনূরের চোখে-মুখে বিস্ময়।

"জাওয়াদ! কোথায় যাচ্ছিস বাবা?" ললিতার আর্তনাদ ভেঙে পড়ল বাড়ির স্তব্ধতায়।

জাওয়াদ ফিরে দাঁড়াল। তার চোখে জ্বলছে অভিমান আর ক্ষোভের আগুন। 
"এই বাড়িতে আমার লাশও কখনো ফিরে আসবে না।"

ললিতা ছুটে এসে ছেলের সামনে দাঁড়ালেন। কাঁপা হাতে ছেলের হাত ধরতে গেলেন। চোখের জলে ভেসে যাচ্ছে তার মুখ। বললেন, "না বাবা, এমন করিস না। তোর বাবার কথায় রাগ করেছিস, আমার ওপর ঝাড়। আমাকে যা খুশি বল, শাস্তি দে। কিন্তু এভাবে চলে যেতে পারবি না।"

বাড়ির সমস্ত দাস-দাসী বারান্দায় জড়ো হয়েছে। কারও মুখে কথা নেই। সবাই হতবাক হয়ে তাকিয়ে আছে।

জাওয়াদ পা বাড়াল। ললিতা আড়াআড়িভাবে দাঁড়িয়ে পথ আটকে ধরলেন। "তোকে ছাড়া কী করে বাঁচব? তোর বাবার শরীর দিন দিন ভেঙে পড়ছে। আমি একা কী করে সামলাব সব?"

গুলনূরের চোখে জল টলমল করছে। একবার ললিতার দিকে তাকাচ্ছে, একবার জাওয়াদের দিকে। তার হৃদয়ের ভেতর ঝড় বইছে। জাওয়াদের হাতের মুঠো আরও শক্ত হল।

"সরে যাও মা। আমাকে যেতে দাও।"

"না, যেতে দেব না।" ললিতা ছেলেকে জড়িয়ে ধরলেন প্রাণপণে।

"ছাড়ো মা।" জাওয়াদ মায়ের হাত সরিয়ে দিল।

"তবে আমার বুকে পা দিয়ে যা। এই বুকে লাথি মেরে যা।" ললিতা দুই হাত দুই পাশে ছড়িয়ে বুক পেতে দিলেন। "আমার দেহের ওপর দিয়ে পথ করে যেতে হবে তোকে।"

জাওয়াদের চোখে জল এল। সে নিজেকে শক্ত করে রাখল। গুলনূরের হাত ধরে টানতে টানতে মাকে পাশ কাটিয়ে সিঁড়ি দিয়ে নামতে লাগল।

ললিতা টলতে টলতে নামলেন পিছনে। শেষ চেষ্টা হিসেবে গুলনূরের হাত চেপে ধরে বললেন, "গুলনূর, তুই একটু বোঝা ওকে। তোর কথা শুনবে। তোর কথা ফেলতে পারবে না।"

চোখের জল আটকে রাখার চেষ্টায় গুলনূরের গলা শুকিয়ে কাঠ। ঠোঁট কাঁপছে, কিন্তু কথা বের হচ্ছে না।

জাওয়াদ গুলনূরকে আরও কাছে টেনে নিল। "যেখানে আমি, সেখানেই তুমি। এই সোনার খাঁচা থেকে তোমাকে মুক্তি দেব আমি।"

ললিতা শেষ চেষ্টা হিসেবে দু'হাতে গুলনূরের হাত আঁকড়ে ধরলেন। এই ক্ষীণ বাঁধনটুকুই ছেলেকে আটকে রাখার শেষ ভরসা। তার চোখে-মুখে অসহায় মিনতি। কাঁপা গলায় বললেন, "একটু থাম বাবা। রাত পোহাক, সকাল হোক। তারপর যা ভাল মনে করিস, করিস। এই রাতে..."

জাওয়াদ প্রথমে আস্তে টান দিল গুলনূরের হাত। ললিতা ছাড়লেন না। তার আঙুলগুলো আরও শক্ত হয়ে গেল। জাওয়াদ আবার টান দিল, এবার আরেকটু জোরে। কিন্তু মায়ের হাতের বন্ধন আরও দৃঢ় হলো। 

তখন হঠাৎই কী ভর করল জাওয়াদের ওপর। একটা প্রচণ্ড টান দিয়ে গুলনূরকে নিজের বুকের কাছে টেনে নিল সে। মুহূর্তের মধ্যে গুলনূরের শরীর ছিটকে এল বুকের কাছে। ললিতার হাত ছিটকে গেল।

জাওয়াদের বুকের উত্তাপ গুলনূরের সারা দেহে ছড়িয়ে পড়ল। তার রক্তের শিরা-উপশিরায় একটা অদ্ভুত শিহরণ খেলে গেল। জাওয়াদের বুকের ধুকধুকানি তার কানের পর্দায় তালে তালে বাজতে লাগল। সেই স্পন্দনে তার শরীরের প্রতিটি স্নায়ু অবশ হয়ে আসছে। মাথার ভেতর একটা ঘোর লেগে গেল।

গুলনূর টের পেল, জাওয়াদের বুকের স্পর্শে তার নিজের হৃৎস্পন্দনও দ্রুত হয়ে উঠছে। দুটো বুকের স্পন্দন যেন এক তালে বাজছে। জাওয়াদের দেহের উষ্ণতা তার শরীরকে আচ্ছন্ন করে ফেলল। চোখের সামনে সব ঝাপসা হয়ে এল। শুধু অনুভব করল জাওয়াদের বুকের স্পর্শ, তার দেহের উত্তাপ, আর সেই নিবিড় আলিঙ্গনের মধ্যে নিজের অস্তিত্বের লীন হয়ে যাওয়া।

জাওয়াদ শেষবারের মতো ললিতার দিকে তাকাল। তার চোখে জমে থাকা অভিমানের মেঘ এবার বৃষ্টি হয়ে ঝরে পড়ল। "আপনারা আমার ক্ষতগুলো সারাতে পারলেন না। বরং আরও গভীর করে দিলেন। এবার আমি নিজেই সেগুলো সারিয়ে নেব।"

সে আর দাঁড়াল না। গুলনূরকে বুকে নিয়ে দ্রুত পা বাড়াল অন্ধকারের দিকে। পিছনে ভেসে আসছে ললিতার করুণ আর্তনাদ।

"ওরে কেউ ডাক্ ওকে। ও শুনছে না। ওরে কেউ ধর্..."

ললিতার কান্না মিলিয়ে গেল রাতের নিস্তব্ধতায়। জাওয়াদ আর গুলনূর মিশে গেল রাতের কালো আঁধারের বুকে।
.
.
.
চলবে...........................................

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন