আমার কাছে আদনান এক হাজার টাকা ধার চাইছে। ব্যাপারটা অদ্ভুত না?
কিছুটা অস্বস্তি নিয়ে আমি বললাম,
"আমার এক হাজার টাকা দিয়ে তুমি কী করবে আদনান? তুমি নিজেই তো অনেক টাকা কামাই করো।"
"তা করি। কিন্তু এই মুহুর্তে আমার বেশকিছু টাকার দরকার। আমার এমনিতেই বন্ধুবান্ধব কম। তার মধ্যে যারা আছে তাদের সবার কাছ থেকেই ধার করেছি। তাদের সামর্থ্য অনুযায়ী সর্বোচ্চটা তারা দিয়েছে। সব মিলিয়ে হিসেব করে দেখলাম মাত্র ৭৫ ড্যানিশ ক্রোন শর্ট পড়েছে। যা বাংলাদেশী টাকায় ৯৪০ টাকার মত। তুমি কি দিতে পারবে তিন্নি? সামনের মাসের ফার্স্ট উইকে আমি টাকাটা তোমাকে ব্যাক করে দেব।"
বিশ্বাস করেন, আদনানের গলায় কোনো অস্বস্তি ছিল না। আমি জানতে চাইলাম,
"তুমি কি কোনো বিপদে পড়েছো আদনান?"
"বিপদ ভাবলে বিপদ, আপদ ভাবলে আপদ। কিজন্য টাকা লাগবে বলতে গেলে একটু পেছন থেকে বলতে হয়। জানোই তো আমার বাবা মা কেউ নেই, তাই কাউকে আমার টাকা পাঠাতে হয় না। পোস্ট গ্রাজুয়েশন করছি ফুল স্কলারশিপে। যা আয় করি তার বেশিরভাগই রয়ে যায়। এভাবে করে আমার বেশকিছু টাকা জমে গেল। তখন আমি খুব সস্তায় রোমোতে একটা বাড়ি পেয়ে যাই, ছোটো একটা বিচ হাউজ। জমানো টাকা ডাউনপেমেন্ট দিয়ে ইন্সটলমেন্টে বাড়িটা কিনে ফেলি। কখনো সমস্যা হয়নি। এই প্রথম ইন্সটলমেন্টের টাকা দিতে পারছি না। আমাদের কোম্পানির একটা সাময়িক সমস্যার কারনে আমার দু'মাসের স্যালারি আটকে আছে। সামনের মাসেই তিনমাসেরটা একসাথে পাব। জমানো টাকা দিয়ে গত দুই মাস ম্যানেজ করেছি। এই মাসটা ম্যানেজ করতে গিয়ে আমি পাগল হয়ে যাচ্ছি। ইন্সটলমেন্টের টাকা কালকের মধ্যে না দিলে ব্যাংক আমার বাড়িটা নিয়ে নেবে। মাত্র ৭৫ ক্রোনের জন্য!"
এসব শুনে আমার মাথায় সর্বপ্রথম যা এলো সেই প্রশ্নটিই করে ফেললাম,
"তোমার বড় বোন বা মামার থেকেও তো নিতে পারো।"
সে বলল,
"তাদের সাথে আমার এখন যোগাযোগ নেই।"
আমি একটু ভেবে তাকে বললাম,
"আমার কাছে কত আছে দেখতে হবে। দাঁড়াও আমি জানাচ্ছি।"
"আচ্ছা।"
আমার কেন যেন আদনানের আজকের সব কথাতেই খটকা লাগছে। মনে হচ্ছে সব বানিয়ে বলছে। তবে আদনানের সব কথা যদি সত্যি হয় তাহলে টাকা টা দেয়া যায়। কিন্তু ডেনমার্কের মত একটা দেশে একজন ইঞ্জিনিয়ারের স্যালারি ২ মাস কেন আটকে থাকবে? থাকলেও এত টাকা জোগাড় করে কিনা মাত্র এক হাজার টাকায় টান পড়লো? আবার কিনা এই টাকা টা চাওয়ার মত কেউই নেই তার? আমার কাছেই কেন চাইতে হবে? আদনান তো জানে আমি এখনো স্টুডেন্ট, নিজের আয় বলতে একটা টিউশনি। তাছাড়া মাত্র ৪/৫ মাসের পরিচয়ে কোন বিবেকে একটা মেয়ের কাছে টাকা ধার চায় একটা ছেলে? লজ্জাও করলো না? আদনানকে এতদিন যতটা ব্যক্তিত্ববান মনে হয়েছিল আজ ততটাই ছ্যাচড়া মনে হচ্ছে। পরক্ষণেই আবার আমার মনে হলো আচ্ছা আদনান তার ব্যাপারে সবকিছু মিথ্যা বলেনি তো? সে হয়তো ডেনমার্ক ফেনমার্ক কোথাও থাকে না। সে থাকে বাংলাদেশেই। নিজের পরিবার সম্পর্কে মিথ্যা বলে মেয়েদের সিম্প্যাথি আদায় করে। এরপর মিথ্যা ব্যক্তিত্ব দেখিয়ে কিছুদিন কথা বলে এভাবে টাকা ধার চায়? এমনটা তো হতেই পারে। দুনিয়াটা ধান্দাবাজে ভরে গেছে। আমি আদনানের ফেসবুক প্রোফাইলে ঢুকলাম। অসংখ্যবার এই প্রফাইল আমি ঘেঁটেছি তবে আজকের মত উদ্দেশ্য আমার কখনো ছিল না। বেশ কিছুক্ষণ ঘেঁটেঘুঁটে দেখি বিশ্বাসযোগ্য কিছুই নেই তার প্রফাইলে। এবাউটে সব তথ্য থাকলেও ছবিটবি তেমন নেই। প্রোফাইল পিকচারে খুব হ্যান্ডসাম একটা ছেলের দু'তিনটা ছবি আছে শুধু। বিদেশে থাকলে মানুষ অনেক আমোদ ফুর্তি করে, ছবিটবি দেয়। কিন্তু সে সেরকম কিছু দেয়নি কখনো। এমনকি তার সাধের বাড়ির কোনো ছবিও সে দেয়নি। বিচ হাউজ হলে সুন্দর সমুদ্রের ভিউ পাওয়ার কথা। সমুদ্রের কোনো ছবিও সে দেয়নি কখনো। হতেই পারে কোনো হ্যান্ডসাম ছেলের ছবি চুরি করে ফেক প্রফাইল বানিয়েছে! এজন্যই সে কখনো ভিডিও কলে কথা বলতে চায় না। নাহ ডেনমার্কের কোনো নাম্বার থেকেও সে কখনো কল করেনি। সবসময় কোনো না কোনো সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমেই ফোন করেছে। আবার এটাও হতে পারে আসলে সে ডেনমার্কেই থাকে কিন্তু এভাবে মেয়ে পটিয়ে টাকা আয় করাটাই তার ধান্দা। ধান্দাবাজদের জন্য এক হাজার টাকা অনেক টাকা। তাছাড়া সে জানে বেশি চাইলে আমি দিতে পারব না। এক হাজার চাইলে দিতে পারব তাই এক হাজারই চেয়েছে। আজ এক হাজার চেয়েছে, আরেকদিন হয়তো আরো বেশি চাইবে। আর ভাবতে পারছি না। সত্যি বলতে আদনান সম্পর্কে এসব কথা ভাবতে ভাল লাগছে না আমার। ভাবনাচিন্তাকে একপাশে ফেলে রেখে আমি এ মাসের হাতখরচের সব টাকা একসাথে করলাম। গুনে দেখলাম আর মাত্র ২১৬৫ টাকা আছে। এক হাজার আদনানকে দিলে বাকী টাকায় মাস পার করতে বেশ কষ্ট হয়ে যাবে। শেষের দিকে হয়তো মায়ের কাছেও চাইতে হতে পারে। তবু সিদ্ধান্ত নিলাম আদনানকে টাকাটা পাঠাব। আদনানের সব কথা সত্যি হলে ছেলেটা আসলেই বিপদে পড়েছে। একটা এতিম ছেলেকে এইটুকু সাহায্য আমি করতেই পারি। কী ভাবছেন এত যুক্তির কথা বলে শেষমেশ মায়ার কাছে হার মানলাম? জি আপনি সঠিক ভাবছেন! পরদিন সকালবেলা টাকাটা পাঠিয়ে আমি একটু স্বস্তি পেলাম। যেহেতু টাকা ডেনমার্কেই পাঠিয়েছি সেহেতু এইটুকু নিশ্চিত হলাম, আদনান সেখানেই থাকে। এবার শুধু অপেক্ষার পালা, এক মাস পর টাকা ফেরত দেয়ার সময় এলেই বোঝা যাবে আদনান আসলে ধান্দাবাজ নাকি নয়। একদিক থেকে ভাবলে টাকা ধার চেয়ে আদনান খুব ভাল কাজ করেছে। এক হাজার টাকা ফেরত না পেলেও বিশেষ অসুবিধা হবে না আমার। কিন্তু এই এক হাজার টাকার বিনিময়েই আমি জানতে পারব বুক ভরা এত মায়া আর অনুভূতি নিয়ে যার জন্য বসে থাকি, দুনিয়াতে আদৌ কি তার অস্তিত্ব আছে নাকি সবই মিথ্যা?
.
.
.
চলবে.................................................