বারান্দার চন্দ্রমল্লিকা গাছটায় ফুল ধরছে না। শীত আসা শুরু করলেই ফুল ধরার কথা। মা বললেন পর্যাপ্ত রোদ না পেলে না কি চন্দ্রমল্লিকার গোসা হয়, ফুল দেয় না। এ কথা শুনে আমি টবটা নিয়ে ছাদে গেলাম। কিছুক্ষণ পর দেখি ছোট চাচ্চু আমার পেছনে এসে দাঁড়িয়েছে। বাসায় পর্যাপ্ত ঘর আছে কিন্তু ছোট চাচ্চু তার প্রাইভেসির জন্য চিলেকোঠার ঘরে থাকেন।
আমি কিছু বলার আগেই সে বলল,
"কি রে তিন্নি, তোর কেসটা কী?"
আমি কিছুটা অবাক হলাম। ছোট চাচ্চু কি কিছু টের পেয়েছে?
আমি বললাম,
"কোন কেসের কথা বলছ?"
ছোট চাচ্চু আঙ্গুল উঁচিয়ে বলল,
"দেখ তিন্নি আমার কাছে ন্যাকা সাজিস না। কী হয়েছে বল? ছ্যাঁকা ট্যাকা খেয়েছিস না কি?"
"কি যে বলো তুমি চাচ্চু ! আমি কি প্রেম করি নাকি যে ছ্যাঁকা খাবো?"
"ওই বিদেশি ছেলেটার কোনো চক্কর না তো?"
ছোট চাচ্চুর কাছ থেকে বাড়িতে কেউ কিছু লুকোতে পারে না। আমি পারবো সেটাও সম্ভব না! তার উপর একদিন মুখ ফসকে তাকে আদনানের কথা বলেও ফেলেছিলাম। অন্যের গোপন কথা বের করার এক আশ্চর্য ক্ষমতা নিয়ে জন্মেছে সে।
আমি বললাম,
"আদনান বিবাহিত।"
ছোট চাচ্চু বিরক্ত হয়ে বলল,
"তাহলে তোর সাথে টাংকি মারে কেন?"
"আমারই বোঝার ভুল ছিল। আদনান হয়তো শুধুই বাংলায় কথা বলার একজন মানুষের অভাব বোধ থেকে আমার সাথে কথা বলতো।"
"বউ কি বিদেশি?"
"হ্যাঁ।"
"কিভাবে জানতে পেরেছিস?"
"নিজেই বলেছে।"
ছোট ছোট দীর্ঘশ্বাস ফেলে বলল,
"আচ্ছা যাক, যা হয়েছে হয়েছে। এখন এগুলো মাথা থেকে ঝেড়ে ফেল। চেহারা থেকে দুঃখী দুঃখী ভাব দূর কর। ভাইজান বা ভাবির চোখে পড়লে সমস্যা আছে। এই ছ্যাঁক খাওয়া মার্কা চেহারা আর যেন না দেখি। দেখলে সোজা গিয়ে ভাইজানকে বলবো। মানুষ ১০ বছর প্রেমের পরেও ভুলে যায়। তোর তো মাত্র চার-পাঁচ মাসের ইচিং বিচিং।"
আমি কিছু বললাম না। আমার ভেতর কিরকম ঝড় বইছে সেটা অন্য কারো পক্ষে বোঝা সম্ভব?
ছোট চাচ্চুই আবার বলল,
"ওহ তোর তো আবার এই প্রথম। আচ্ছা যা আর দু'দিন তোকে বিরহ পালনের সুযোগ দেয়া হলো। এরপর যেন আর না দেখি।"
আমি নিচে নেমে এলাম। আমি জানি ছোট চাচ্চু আমার ভালোর জন্যই এসব বলছে। কিন্তু ব্যাপারটা সে যতটা সহজ ভাবে নিচ্ছে, আমার জন্য তত সহজ না। আমি আদনানকে পাব না সেই দুঃখবোধের চেয়েও বেশি অপমান বোধ হচ্ছে আমার। কারণ, আদনান বুঝে ফেলেছে আমি তার ব্যাপারে আগ্রহী এবং এটা বুঝতে পেরেই সে তার বিয়ের কথা জানালো। এতদিন আমি চাইতাম আদনান আমার আগ্রহটা বুঝুক, অথচ সে যখন বুঝল তখন সেটাই আমার জন্য কাল হয়ে দাঁড়ালো। আমার ভীষণ লজ্জা লাগছে। একটা মানুষের সম্পর্কে ভালোভাবে না জেনে না বুঝে কি করে মন দিয়ে ফেলার মত বোকামি করলাম আমি? অন্যদিকে আদনান'এর সাথে কথা বলার জন্যও বেহায়া মনটা ছটফট করছে। প্রায় সপ্তাহ খানেক হয়ে গেছে সেই অঘটনের। আমি কিছুতেই এখনো নিজেকে স্বাভাবিক করতে পারছি না। যাবতীয় সকল সোশ্যাল মিডিয়া থেকে আমার একাউন্ট সরিয়ে ফেলেছি। নাহয় দেখা যাবে বেহায়ার চূড়ান্ত পর্যায়ে গিয়ে আমি আবারও আদনাদের সাথে যোগাযোগ করেছি!
দু'দিন পর দাদাভাই আমাকে ডেকে বললেন,
"তিন্নি সোনা, আমরা ১১ তারিখে ট্যুরে যাচ্ছি। তুই ঝটপট টিউশনি থেকে ৩ দিনের ছুটি নিয়ে নে।"
আমি একটু অবাকই হলাম। বলা নেই কওয়া নেই হুট করে ট্যুর!
আমি জিজ্ঞেস করলাম,
"কই আমি তো কিছু জানি না। কে কে যাব? কোথায় যাব?"
"সবাই যাব। রূপক ঠিক করছে সব। কোথায় যাব তা এখনও জানি না।"
হঠাৎ আমার মনটা ভাল হয়ে গেল। আমার মনে হল ছোট চাচ্চু আমার মন ভালো করার জন্যই এই ট্যুরের আয়োজন করছে। সারাক্ষণ ধমক দিয়ে কথা বলে। সিরিয়াস ধরনের সব অকাজ করে বেড়ায়। তার সে সব অকাজের জন্য আমাদের অনেক প্রিয় জিনিসও ক্ষতিগ্রস্ত হয়। কিন্তু পরিবারের কারো মন খারাপ সে দেখতে পারে না। যে ভাবেই হোক মন ভালো করার একটা ব্যবস্থা করবেই!
.
.
.
চলবে..................................................