অতিথি নিবাস - পর্ব ২২ - তানজিল মীম - ধারাবাহিক গল্প


ঝুনঝুন করে কিসের যেন মৃদু শব্দ কানে ঠেকল। শান্ত গুরুত্ব দিল না। শব্দটা যে খুব একটা টের পেয়েছে তেমনটাও নয়। সে তার চোখের চশমাটা হাত দিয়ে একটু নাড়িয়ে বইয়ের পাতায় চোখ বুলাল। আলতো হাতে চায়ের কাপটি উঠিয়ে ঠোঁট ছোঁয়াতে হলো ব্যস্ত। বইয়ের তার গভীর মনোযোগ। একটু দূরে অরিন দাঁড়িয়ে আছে। বেশিক্ষণ হয়নি মাত্রই দাঁড়িয়েছে। তার দৃষ্টি শান্তর পিঠের দিকে। শান্তর গায়ে জড়ানো হলুদরঙা টিশার্ট। কালো প্যান্ট। অরিনের একরাশ জড়তা কাজ করছে, কি করবে বুঝে উঠতে পারছে না। সে হাল্কা শব্দে কাশি দিল। কাজ হলো না। শান্ত গুরুত্ব দিচ্ছে না।

 এবার অরিন অনেকটা সাহস নিয়ে কাছে এগিয়ে গেল। আচমকাই কি হলো শান্ত পিছন ঘুরে তাকাল। সঙ্গে সঙ্গে চমকে উঠল দুজনেই। অরিন তার পদধ্বনি থামিয়ে দাঁড়িয়ে পড়ল। শান্তর বিস্মিত চাহনি। কিছু বলার চেষ্টা করলেও বলা গেল না। শান্ত কিছুক্ষণের জন্য হলেও ভুলতে বসেছিল সে কথা বলতে জানে না। অরিন অবস্থাটা বুঝল। উত্তেজিত কণ্ঠে বলল,
 “প্লিজ আপনি রেগে যাবেন না। আমার কিছু কথা ছিল আমিই বলেই চলে যাব।”

অরিনের চোখে-মুখে আতঙ্ক। তার কথাটুকু শান্ত বুঝতে পারল কিনা বোঝা গেল না। তবে শান্ত চুপ হয়ে গেল। হাতের বইটা বন্ধ করে ফেলল নিমিষেই। অরিন ইশারায় বুঝাল, “এখানে বসি?”

শান্ত বুঝতে পারল। মাথা নাড়িয়ে চোখ ইশারায় জানাল, “ঠিক আছে।”

অরিন বসল। কতক্ষণ চুপ করে রইল। শান্ত একপ্রকার অবাক হয়ে তাকিয়ে আছে। ঠিক বুঝচ্ছে না এই মেয়েটা এখানে কেন এসেছে। অরিনের দৃষ্টি গেল শান্তর বাম গালের দিকে। কানের লতির পাশ দিয়ে কেটে গেছে। তার এত দুঃখ লাগল। সে মাথা নুইয়ে ফেলল। শান্তর অবস্থা তখন করুন। না সে কিছু বুঝতে পারছে, না সে কিছু বলতে পারছে। অরিনের দেখাদেখি সেও চুপ করে আছে। অনেকক্ষণ পর অরিনের মলিন কণ্ঠস্বর বের হলো। সে শান্তর চোখের দিকে তাকিয়ে বলতে লাগল, “আমি কিছু বললে আপনি কি বুঝতে পারবেন?”

শান্ত তাকিয়ে আছে। কিছু বলছে না। অরিন আবারও বলল, “কি হলো? কিছু তো বলুন। না মানে বুঝান।”

শান্ত পলকহীন তাকিয়ে রইল। অরিনও তাকিয়ে। অরিন আহত কণ্ঠে বলল, “আপনি কিছু না বুঝালে আমি বলব কিভাবে? কিছু তো বলুন।”

শান্ত হাত নাড়াল। কিন্তু অরিন তা বুঝল না। হাতের ভাষা অরিন তো বোঝে না। অরিন অসয়হায় কণ্ঠে বুঝাল, “আমি কিছু বুঝচ্ছি না।”

শান্ত এবার আশেপাশে তাকাল। তেমন কিছু নেই। সে আচমকাই বসা থেকে উঠে দাঁড়াল। অরিন থমকে গেল। উত্তেজিত হয়ে বলল, “প্লিজ আপনি যাবেন না আমার কিছু কথা আছে।”

শান্ত দাঁড়াল না। তড়িৎ পায়ে ঢুকে গেল ভিতরে। এবার অরিনের কান্না পাচ্ছে। এই প্রথমবার অতি দুঃখে তার চোখে পানি এসে ভর করেছে। অরিন যেন অবাক। চোখের পানিটুকু আঙুল দিয়ে ছুঁইল। কি অদ্ভুত! অরিন কাঁদছে। 

শান্ত কিছু সময় পরই ফিরে এলো। হাতে তার সাদা খাতা আর কলম। অরিন তাকে দেখে তাকায়। কিছু যেন বুঝতে পারে। শান্ত বসে পড়ে নিচে। খাতায় কি যেন লেখে! এরপর এগিয়ে দেয় অরিনের দিকে। অরিন দেখে। সেখানে লেখা—
 “আমার শ্রবণশক্তি খুবই কম। আপনার কথা আমাকে শোনাতে হলে আপনাকে আমার খুব নিকটে এসে বলতে হবে।”

শান্তর কথা দেখে চোখ বড়সড় করে ফেলল অরিন। কিছু বলবে তার আগেই শান্ত লিখল,
 “হুর! কথাটার ভুল অর্থ বের করবেন না। আপনাকে আমার কাছে আসতে বলিনি আমি। আমার সমস্যার কথা জানিয়েছি শুধু। তবে আপনি ইশারার ভাষায় কিছু বলতে পারলে আমি বুঝতে পারব।”

অরিন পড়ল বিপদে। এবার কি হবে তাহলে?" ইশারার ভাষা তো সে পারে না। এবার অরিন কাগজে লিখল, “আমার আপনাকে কিছু কথা বলার আছে? কিন্তু আমি ইশারার ভাষা পারি না। সেইভাবে কোনোদিন লাগেও নি। এখন কি করব তবে?”

শান্ত কিছু সময় চুপ থেকে খাতায় লিখল,
 “লিখে লিখে বলতে চাইলে বলুন। আমি শুনছি।”

কথা পড়ে অরিন চুপ করে রইল। এত কথা লিখে লিখে কতবছর নিয়ে বলবে! হঠাৎই অরিনের মাথায় কিছু আসলো। সে খাতায় লিখল, “মোবাইলের ম্যাসেজের মাধ্যমে আমরা কথা বলতে পারি তো?”

এবার শান্ত লিখল না। মাথা নাড়িয়ে বলল, “হুম।”

শান্ত আবার উঠে দাঁড়াল। তার হাতের কাছে ফোন নেই। শান্তকে কেউই তেমন একটা কল করে না। তাই ফোনের খুব একটা প্রয়োজন তার পড়ে না। ফোন নিয়ে বসতেই অরিন জিজ্ঞেস করল, “ফোন নাম্বার বলুন?”

শান্ত বলল না। অরিন নিজেই শান্তর হাত থেকে ফোনটা নিয়ে নাম্বার নিতে নিতে বলল, “হোয়াটসঅ্যাপ আছে তো আপনার?”

 উত্তর আসলো না। নাম্বার সেইভ করে হোয়াটসঅ্যাপে এড করল অরিন। এরপর শুরু হলো ম্যাসেজিং বার্তা। যেখানে শুরুতেই অরিন লিখেছে, “আপনি কি আমার ওপর খুব রাগ করেছেন?”

শান্ত দেখল। কিছু সময় পরই উত্তর লিখল,
 “আমার রাগ করাটা স্বাভাবিক নয় কি?”
 “আপনি রাগ করেছেন অাবার আমার সাথে স্বাভাবিক আচরণও করছেন। তাহলে আমি বুঝব কি করে আপনি রাগ করেছেন?”
 “আমি তো স্বাভাবিক মানুষ নই। আমার খামতি আছে। আমি চাইলেও আপনার সাথে চিল্লাচিল্লি, রাগারাগি করতে পারব না।”
 “কথা বলতে না পারাটার সুযোগ নিলাম কি আমি?”
 “বলা যায়।”

অরিন তাকাল শান্তর দিকে। ছেলেটা কিভাবে ধাপ ধাপ উত্তর লিখছে। অরিন লিখল,
 “আমি খুব দুঃখিত। বিশ্বাস করুন আমি যা করেছি না বুঝে করে ফেলেছি৷ খামখাই আপনাকে ঘৃনা করেছি আমাকে কি ক্ষমা করা যায়? আপনি চাইলে আপনিও আমায় একটা থাপ্পড় মেরে দিতে পারেন।”

কথা পড়ে হেঁসে ফেলল শান্ত। অরিন দেখল। সঙ্গে সঙ্গে লিখল,
 “হাসছেন যে?”
 “হাসাটি কি অস্বাভাবিক কিছু?”
 “আমি হাসার মতো অবশ্যই কিছু বলিনি।”
 “বলেছেন। আমি রাগ করিনি। আমি কারো ওপরই খুব একটা রাগ করি না। আপনার পরিস্থিতি আমি বুঝেছি। তাই বেশি ভাববেন না।”
 “ক্ষমা করেছেন?”
 
শান্তর লিখতে ইচ্ছে করছিল। রাগ যেহেতু করিনি ক্ষমা করার প্রশ্নটাই আসে না। কিন্তু বলল না। সংক্ষেপে জানাল, “জি করেছি।”

সঙ্গে সঙ্গে এক প্রশান্তিকর হাসি ঠোঁটে লেপ্টে উঠল অরিনের।

•••••••••••••

“এ শহরে মানুষ চেনা দায়। কে ভালো? কে মন্দ? বিষয়টা বুঝতে আমাদের প্রায় হিমশিম খেতে হয়। আমরা মানুষের দ্বারা প্রতারিত হই, ভালোবাসা পাই, আঘাত আসে, যন্ত্রণা নি। তবুও জীবন কিন্তু সুন্দর। বিচিত্রভাবে সুন্দর। হ্যালো গাইস। আমি আরজে আরহান। আপনাদের আবারও স্বাগত জানাচ্ছি আমার রেডিও তরঙ্গ এফএমের শো তে। মানুষের সাথে কথা বলা আমার একটা দৈনন্দিন রোগ। রোগটা আমায় এমন ভাবে প্রভাবিত করেছে ঢ়ে দু'চার দিন আপনাদের সাথে কথা না বললে আমার কেমন নিশ্বাস আঁটকে আসে। মনে হয় জীবনে কি যেন নেই নেই ভাব। অদ্ভুত বিষয়। আবার কখনো কখনো এই দৈনন্দিন রোগ আমার ভালো লাগে না। মানুষের সাথে কথা বলতে ইচ্ছে করে না। মানে কি বলব, ভালোমন্দ নিয়ে জর্জরিত আমি। তবুও জীবন সুন্দর।”

হঠাৎ কল বেজে উঠল। কলটা আচমকাই আসলো যেন মনে হচ্ছিল অপরপ্রান্তের মানুষটা আরহানের খুব গভীরভাবে অপেক্ষা করছিল। আরহান কলটা তুলল ভাড়ি কণ্ঠে শুধাল,
 “আসসালামু আলাইকুম। আমি আরজে আরহান। আপনি কে বলছেন? আর কোথা থেকে বলছেন?”

ওপরপাশের ব্যক্তির অনেকক্ষণ কোনো সাড়াশব্দ পাওয়া গেল না। আরহান বিরক্তবোধ করল। তবে প্রকাশ করল না। ধাতস্থ কণ্ঠে জিজ্ঞেস করল,
 “কথা কি বলবেন না?”

উত্তর আসে,
 “আমি তো কথা বলতে চাই আরহান। কিন্তু তুমিই তো শুনতে চাও না।”

মুহুর্তের মধ্যে আরহানের চেহারার ভাবভঙ্গি পাল্টে গেল। ফ্যাকাসে হয়ে গেল চারপাশ। অসস্থি, জড়তা, সব কেমন যেন এক সঙ্গে দলা-পাকিয়ে উঠল। আরহান বলল,
 “আমি সবার কথাই শুনি। আপনারটা না শোনার বর্তমানে কোনো কারণ দেখি না।”
 “আমি দশতলার ছাঁদে বসে আছি। আমার চারপাশ জুড়ে বিষণ্ণতা। কেমন যেন কিছু ভালো লাগে না।”

আরহান কি বলবে বুঝতে পারছে না! কতগুলো মানুষ সংযুক্ত আছে তার সাথে। সবার সাথে আগে যোগাযোগ বিচ্ছিন্ন করতে হবে। আরহান কল কেটে দিল। এবং বলল, “সাময়িক কিছু সমস্যার জন্য আমার কলটা কেটে গিয়েছে। একটু পর আপনাদের সাথে আবার যোগাযোগ করা হবে।”

আরহান দ্রুত বসা থেকে উঠে দাঁড়াল। একটা সুন্দর গান ছেড়ে সে চলে গেল বাহিরে। এর কিছুক্ষণ পর আরহানের জায়গায় আরেকজন বসল। নাম রফিক। সে জানাল, "পারিবারিক কিছু সমস্যার কারণে আরহান বেরিয়েছে। তবে দুঃখ পাবেন না ও রাতে থাকবে আবার।" 

••••••••••••

বাড়ির ছাদ ঘরে বসে থাকা ফাবিহা তখন কান থেকে ইয়ারফুন সরায়। তার ভিতর কেমন যেন অস্থিরতা কাজ করছে। কেন যেন বার বার মনে হচ্ছে, কতক্ষণ আগের কল করা ব্যক্তিটি আর আরহানের বেরিয়ে যাওয়ার ঘটনার মধ্যে কোনো সাদৃশ্য আছে। কিন্তু কি! ফাবিহার হঠাৎ প্রবল মন খারাপ হলো। কেন হলো বোঝা গেল না।
.
.
.
চলবে.......................................................................

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন

WhatsApp