রাতের নিস্তব্ধতাকে আরোও গাঢ় করছে ঝিঁঝিঁ পোকার ডাক। আকাশে ধূসর কালো মেঘ। চারিদিকে বইছে মৃদুমন্দ ঠান্ডা হাওয়া। কেমন যেনো বৃষ্টি বৃষ্টি ভাব ডেকে আনছে প্রকৃতিতে। নীলিমা দাঁড়িয়ে আছে থম মেরে। সে এখনও পুরো ব্যাপারটি বুঝে উঠতে পারেনি। স্মরণের কথাগুলো তার মস্তিষ্কে প্রক্রিয়া হতে সময় নিচ্ছে খানিক। সে তব্দা মেরে বসে আছে। স্মরণ যে এরূপ হুমকি ধামকি দিয়ে প্রপোজ করে বসবে এ যেনো তার কল্পনাতীত ছিলো।
স্মরণের চাহনিতে একই সাথে উন্মাদনা ও ক্রোধ। হঠাৎ করেই সে কেমন যেনো লাগামহীন হয়ে পড়েছে। নিজের উপর হারিয়েছে নিয়ন্ত্রণ। তবুও শান্ত রাখছে নিজেকে। হয়তো সুযোগ পেলে নীলিমাকে এক্ষুণি তুলে নিয়ে বিয়ে করে বসবে। কি সাংঘাতিক চিন্তাভাবনা তার মস্তিষ্কে ঘুরপাক খাচ্ছে!
নীলিমা চরম বিস্ময়ে বললো,
" স্মরণ ভাই, এসব কি ছিলো! আপনি আমাকে থ্রেট দিলেন! আপনার আচরণ গুন্ডাদের মতো হয়ে যাচ্ছে, খেয়াল করেছেন কি?"
স্মরণ ভাবলেশহীন কণ্ঠে বললো,
" হোক, আমার সমস্যা নেই। কিন্তু অন্য কোথাও বিয়ে করার চিন্তাভাবনা করলে তোমাকে তুলে নিয়ে আসতে দ্বিতীয়বার ভাববো না৷ "
নীলিমা অবাক হলো। চরম বিস্ময়ে হাসলো। বললো,
" আপনার উপর কোনো জ্বিন ভূত আছর করেছে? আপনি তো এমন ছিলেন না। দুদিনের প্রেমে এমন থ্রেট! না জানি দু বছরের প্রেম হলে কি করতেন!"
" দু বছর আর প্রেম থাকতো না। সোজা বিয়ে করে সংসার শুরু করতাম। আমার পক্ষে এতো অপেক্ষা দেয়া সম্ভব না। তোমাকে পছন্দ করি, তোমাকে ভালোবাসি। ব্যস, আমার ডিসিশন নেয়া শেষ। বিয়ে করলে তোমাকেও করবো। "
নীলিমা হাসলো৷ এ মুহূর্তে স্মরণের কথাগুলো তার কানে ভীষণ অবাস্তব শোনাচ্ছে। সে তাচ্ছিল্যের হাসি হেসে বললো,
" অনেক মজা হয়েছে স্মরণ ভাই। এবার বন্ধ করুন। আমি জানি আপনি আমাকে ভালোবাসেন। কিন্তু এসব কথা একটু বেশিই বলে ফেলছেন। প্রথমবার এসব অনুভব করছেন বলে একটু বেশিই ডেস্পারেট হয়ে পড়েছেন। নিজেকে সময় দিন, ভাবুন। কয়েকদিন পর সবকিছু ঠিক হয়ে যাবে। "
" আমি ডেস্পারেট হয়ে পড়েছি ঠিকই। কিন্তু আজ যা বলছি, কয়েকদিন বা কয়েক মাস সময় নিয়ে ভাবলেও ঠিক একই কথাগুলো বলবো।
দেখো নীলিমা, আমার বিয়ের বয়স হয়েছে। আম্মু আমাকে প্রায়ই বিয়ের জন্য প্রেশার দেয়। তুমি হয়তো জানো বা জানো না, আমার জন্য বেশ কিছুদিন যাবত মেয়ে খুঁজছে। কিন্তু আমি এসবে গুরুত্ব দেই না। নিজেকে এসব নিয়ে ভাববার জন্য সময় দিয়েছিলাম। এখন এই পয়েন্টে এসে আমি বুঝতে পারছি, আমি নিজেকে যথেষ্ট সময় দিয়েছি। এন্ড ফাইনালি আই ফাউন্ড দ্যাট গার্ল, যার সাথে আমি নির্দ্বিধায় আমার বাকিটা জীবন কাটিয়ে দিতে পারবো। এখন এ নিয়ে আমি দ্বিতীয়বার ভাবতে চাই না। আবেগের বশে হোক বা বিবেকের সাড়ায় হোক, আমি এটা অনুভব করতে পারছি যে তোমার প্রতি আমার অনুভূতি আছে, ভালোবাসা আছে। "
নীলিমা এবার হাল ছাড়তে বাধ্য হলো। সে বুঝতে পেরেছে স্মরণকে এখন এভাবে বুঝানো সম্ভব নয়। তাকে বুঝাতে হবে সম্পর্ক দিয়ে। এজন্য তৎক্ষনাৎ সে বলে বসলো,
" কিন্তু আপনি যতটা সহজ ভাবছেন ততটা সহজ নয় এসব৷ আপনি......"
স্মরণ জোর গলায় বললো,
" এ পৃথিবীতে কিছুই সহজ না নীলিমা। সবকিছুই কঠিন। নিজের যোগ্যতা, দক্ষতা, আবেগ অনুভূতি দিয়ে সবকিছু সহজ করে নিতে হয়। "
নীলিমা কিঞ্চিৎ বিরক্ত নিয়ে বললো,
" আহহা, আপনি বুঝতে পারছেন না স্মরণ ভাই। আপনি আর আমি কাজিন। এমন না যে দূর দূরান্তের সম্পর্কের কাজিন। আমরা আপন কাজিন। আমাদের কারোর বংশেই কাজিন বিয়ে নেই। আমাদের ফ্যামিলির কেউ এসব ভালো চোখে দেখবে না। আমাদের সম্পর্ক মেনেও নিবে না। কাজিনদের মাঝে পছন্দ, প্রেমই ঠিক আছে। বিয়ে করাটা বাড়াবাড়ি হয়ে যায়। "
" আমি এমন ছেলে না নীলিমা যে প্রেম করার বেলায় একশ কিন্তু বিয়ে করার বেলায় শূন্য। আমি তার সাথেই প্রেম করবো যাকে বিয়ে করার যোগ্যতা বা ইচ্ছা আছে আমার। "
" আচ্ছা আচ্ছা, এসব কথা পরের বিষয়। কিন্তু আমাদের দুজনের সম্পর্ক কেউই মেনে নিবে না। না আমার আব্বু আম্মু, না আপনার আব্বু আম্মু। "
" কেনো মেনে নিবে না! মেনে না নেয়ার কারণ কি! এমন অনেক ফ্যামিলিতেই কাজিন বিয়ে আছে। আমাদের ফ্যামিলিতে নেই, আমাদের দিয়ে শুরু হবে।"
নীলিমা এবার ভীষণ ত্যক্তবিরক্ত নিয়ে বললো,
" আপনি এত বাড়াবাড়ি করছেন কেনো বলুন তো! আমি বলছি তো কেউই আমাদের এ সম্পর্ক মেনে নিবে না৷ "
" আচ্ছা, আমি তবে এক্ষুণি আমার আম্মুকে ডেকে জিজ্ঞেস করে নেই।"
বলেই সে গলা উঁচিয়ে নাজমা বেগমকে ডাকলো। মুহূর্তেই ঘাবড়ে গেলো নীলিমা৷ তার ডাক নাজমা বেগম অব্দি পৌঁছানোর পূর্বেই সে স্মরণকে থামালো। অতি ভয়ে ট্রেনের গতির মতো হড়বড় করে বলে বসলো,
" থামুন স্মরণ ভাই, আমাকে কিছু সময় দিন। এখনই কাউকে জানাবেন না প্লিজ। "
থেমে গেলো স্মরণ। গলার স্বর নিচে নামিয়ে আনলো। ঠিক নীলিমার বরাবর দাঁড়িয়ে বললো,
" ঠিক আছে, তোমার যত সময় লাগবে তুমি নাও। এতে আমার কোনো আপত্তি নেই। "
খানিক স্বস্তির নিঃশ্বাস ফেললো নীলিমা। কিছুটা সময় নিয়ে কিঞ্চিৎ দ্বিধাদ্বন্দ নিয়ে জিজ্ঞেস করলো,
" যদি আমার জবাব 'না' হয় তবে?"
স্মরণের মুখটা ছোট হয়ে এলো। এতক্ষণের উত্তেজনা, উন্মাদনা মুহূর্তেই যেনো উবে গেলো। কখনো তো ভাবেনি নীলিমা 'না' শব্দটাও তাকে বলতে পারে! হঠাৎ বুঝি তার মাঝে বিবেক জাগ্রত হলো। এই সিদ্ধান্তটা নিশ্চয়ই তার একার হবে না। নীলিমাকেও এ সিদ্ধান্ত একমত পোষণ করতে হবে।
স্মরণ কিছু সময় নীরবে দাঁড়িয়ে রইলো। তার দৃষ্টি মাটিতে। সে ভাবছে। আপাতত এই জটিল প্রশ্নের জটিল জবাব দিতে ইচ্ছুক নয় সে। তাই বললো,
" সে 'না' বলার পর দেখা যাবে। তুমি আপাতত সময় নিয়ে ভাবো।"
বলেই সে দেরি না করে ব্যালকনি থেকে চলে গেলো। তার প্রস্থান মাত্রই হাফ ছেড়ে স্বস্তির নিঃশ্বাস ফেললো নীলিমা। মেহেদি দেয়া হাত দুটো মনের অজান্তে গ্রিলে ঠেকিয়ে পিঠ দিয়ে হেলান দিলো সে। কয়েক মিনিট ব্যপ্তির এ ঘটনাপ্রবাহ শুরু থেকে ভাবতে লাগলো। স্মরণের এরূপ আচরণ তাকে ভাবাচ্ছে বেশ। সে আপনমনে প্রশ্ন করছে নিজেকে, এসব কিছু স্মরণের স্বল্প সময়ের আবেগ বা পাগলামি নয়তো? অথবা স্মরণ তাকে জ্বালানোর জন্য এমন নাটক করছে না তো? আসলে স্মরণের মন মস্তিষ্কে কি চলছে তা সম্পূর্ণরূপে অজানা তার। পুরো ব্যাপারটি তার কাছে ভীষণ অগোছালো লাগছে। বারংবার স্মরণের আচরণ তাকে এসবের স্থায়িত্ব নিয়ে ভাবাতে বাধ্য করছে।
নীলিমা বেশ কিছুক্ষণ ব্যালকনিতেই ওভাবে দাঁড়িয়ে রইলো। হঠাৎ তার হাতে থাকা মোবাইলটা টুং শব্দে বেজে উঠলো। রুমে আসার সময় সে মোবাইল হাতে নিয়ে এসেছিলো।
সে আলতো হাতে মোবাইল অন করে দেখলো স্মরণ ম্যাসেজ দিয়েছে। ম্যাসেজে লেখা,
" তুমি যেই সিদ্ধান্তই নাও না কেনো কাল রাতের মধ্যে আমাকে জানাবে। পরশুদিন ভোর ৬টায় আমি ঢাকা ব্যাক করবো। "
নীলিমা এর কোনো জবাব দিলো না। নিঃশব্দে মোবাইলের স্ক্রিন অফ করে সেখানেই দাঁড়িয়ে রইলো। স্মরণের ভাবনায় মশগুল হলো সে।
--------------
মানতাসার বিয়ের অনুষ্ঠান বেশ ভালোভাবেই সম্পন্ন হলো। তবে পুরোটা দিনের একটি মুহূর্তও স্মরণ ও নীলিমার চোখাচোখি হয়নি, কথা হয়নি। দুজনই দুজনকে দেখেও না দেখার ভান করেছে।
স্মরণ গতকাল রাতে ঘুমোতে পারেনি। শুধুমাত্র নিজের ঐ উন্মাদের মতো কথাগুলো ভেবে। সে বারবার অনুতপ্ত হচ্ছে নীলিমাকে বলা কথাগুলো ভেবে। গতকাল তার হঠাৎ করে কি হয়েছিলো সে জানে না। হঠাৎ করেই সে নীলিমার উপর জোর খাটাতে আরম্ভ করেছিলো। কিন্তু কি কারণে তার মাঝে এই দ্বিতীয় সত্তা জেগে উঠেছিলো সে এ ব্যাপারে অনবগত।
কাল ভোর ৬টায় ঢাকার উদ্দেশ্যে রওনা হবে স্মরণ। তাকে জরুরী ভিত্তিতে জয়েন হতে বলা হয়েছে। যদিও অতিরিক্ত একদিন তার ছুটি ছিলো। কিন্তু কিছু কারণবশত কালই তাকে অফিসে জয়েন করতে হবে। এজন্যই ভোর হওয়া মাত্রই বাড়ি ছাড়তে হবে তাকে।
সবাই ঘুমিয়ে যাওয়ার পরও রাত প্রায় ১টা পর্যন্ত নীলিমার অপেক্ষায় প্রহর গুনেছে স্মরণ। বাইরের প্যান্ডেলের প্লাস্টিকের চেয়ারে বসে অপেক্ষা করছিলো সে। কিন্তু নীলিমার কোনো দেখা নেই। নীলিমার জবাব জানার জন্য সে উতলা হয়ে বসে আছে। অথচ নীলিমা তাকে সামান্য দর্শনটুকু দেয়নি। তাই হতাশ হয়ে, জবাব 'না' ভেবেই রুমে গিয়ে ঘুমিয়ে পড়েছে স্মরণ।
------------------
সকালে নীলিমা বাদে প্রায় সবাই স্মরণকে বিদায় জানাতে এসেছে। কিন্তু স্মরণের দু চোখজোড়া আকুল হয়ে নীলিমাকে খুঁজছে। সে অধৈর্য্য হয়ে এক পর্যায়ে রাফাকে নীলিমা সম্পর্কে জিজ্ঞেস করে বসে। কিন্তু রাফা বললো প্রচন্ড ঘুমে নীলিমা সামান্য সাড়াও দেয়নি। এ শুনে ফোঁস করে নিঃশ্বাস ছাড়লো স্মরণ। নিজের কষ্টটুকু বুকের ভেতর পুষে রেখে বাড়ি ছাড়লো সে। প্রথম ভালোবাসায় প্রত্যাখান হওয়া মন নিয়ে গেট থেকে বেরিয়ে শেষ বারের মতোন পিছে ফিরে চাইলো সে। কিন্তু নীলিমা এলো না। নীলিমার দেখা পেলো না স্মরণ। হয়তো ভবিষ্যতেও পাবে না। সেদিনের ঐ ঘটনার রেশ ধরে নীলিমা হয়তো তার সাথে একফোঁটা যোগাযোগ করার চেষ্টাও করবে না।
স্মরণ ঢের টের পেলো তার প্রথম ভালোবাসার যাত্রা এই অব্দিই। অসম্পূর্ণ তার প্রথম ভালোবাসা।
.
.
.
চলবে..............................................