তুমি রবে নীরবে - পর্ব ২৯ - নাদিয়া সাউদ - ধারাবাহিক গল্প


তড়িঘড়ি করে ফোন হাতে নিয়ে ম্যাসেজটা ওপেন করলো রিশা। এতক্ষণ পায়চারি মন অপেক্ষারত ছিল।খুব সুন্দর করেই ঠিকানাটা লিখেছে রাতিম। আর একমুহূর্তও দেরি করলো না রিশা। দ্রুত তৈরি হয়ে নিল। নাশতা না খেলেও মা হাজারটা প্রশ্ন করে বসবে। কাঁধে ব্যাগ ঝুলিয়ে কোনোরকম বেরিয়ে আসলো সে। ডাইনিং রুমে আসতেই অচেনা একটা মেয়ের মুখোমুখি হলো। যত্ন নিয়ে টেবিল মোছায় ব্যস্ত সে। রিশাকে দেখেই ঠোঁট ছড়িয়ে হাসলো। যেন কতদিনের চেনা! হতবুদ্ধি হয়ে তাকিয়ে রইল রিশা। কি প্রতিক্রিয়া জানাবে বুঝতে পারলো না। প্লেটে খাবার তুলতে তুলতে বলল জুলেখা,

"এই যে আপা আপনের নাশতা। ভাই আর ভাবী তো কিছুক্ষণ আগেই কলেজে চইলা গেল। আপনে এত দেরি করলেন ক্যান?

এই মেয়ের কথায় নিজেকে বুদ্ধিশূন্য লাগছে রিশার। এমনিতেই তাড়া আছে। এর মাঝে এ কে এসে জুটলো? রিশার মুখের দিকে তাকিয়ে বলল জুলেখা,

" আমারে চিনেন নাই তাই তো? আমি এই বাড়িতে কাম করতে আইছি। নাম জুলেখা। রান্নাবান্না, কাপড় কাচা থিকা শুরু কইরা সবই পারি। জুলেখার কাজের প্রশংসা না কইরা.....

রিশা অহেতুক বকবক শুনলো না। নাশতা না খেয়েই বিদায় নিল। মেয়েটাকে মনে হলো প্রয়োজনের তুলনায় কথা একটু বেশি বলে। মা যে কোথা থেকে যে ধরে এনেছে একে! রিশার যাওয়ার পানে নিশ্চুপ তাকিয়ে রইল জুলেখা। এইসব আদুরীদের হাবভাব বোঝা মুশকিল! ভেংচি কেটে নিজের কাজে মনোযোগী হলো সে।


ভার্সিটি থেকে খানিকটা দূরেই বাইক থামিয়ে কুহুকে নামিয়ে দেয় রওনক।তাদের একসঙ্গে আসাটা যেন কারো চোখে না পড়ে। অন্যদিন হলে সারারাস্তা বকবক করতো কুহু। আজকে বেশ নিশ্চুপই লাগলো। কালকে রাতের ঘটনা কি তবে মেয়েটার মনে দাগ কেটেছে? এ ছাড়া আর কোনো কারণ খুঁজে পাচ্ছে না রওনক। কুহু অন্যমনস্ক হয়ে বাইক থেকে নেমে দাঁড়াল। রিশার জন্য মনটা খচখচে হয়ে আছে। মনে হচ্ছে শরীর ভাল নয় তার। কুহুর কি এভাবে চলে আসাটা ঠিক হয়েছে? আরিয়ানকে বলে রেখেছে আজকে আসবে। ভাবুক কুহুর দিকে কিছুক্ষণ তাকিয়ে থেকে পকেট থেকে ওয়ালেট বের করলো রওনক। কিছু টাকা নিয়ে কুহুর হাত টেনে নিয়ে গুঁজে দিল। ভাবনার ঘোর কাটলো কুহুর। কিছু বলল না সে। এ কাজটা প্রতিদিনই করে রওনক ভাই। কুহু যাওয়ার জন্য পা বাড়াতেই পেছন থেকে গম্ভীর স্বরে বলে উঠলো রওনক,

"আজকের রিহার্সাল করবে না তুমি। নাচ করার কোনো প্রয়োজন নেই। চাইলে বাসায় রেখে আসতে পারতাম তোমাকে। কিন্তু দু'একটা ক্লাস হবে। সে জন্যই নিয়ে এসেছি। তাই বলে এই না যে তোমাকে আমি অনুমতি দিয়েছি।

কুহুর কপাল কুঁচকে গেল। ঘুরে রওনকের দিকে তাকিয়ে বলল সে,

" কেন? আপনি জানেন আমি নাম লিখিয়েছি। তার মানে সত্যিই নাচবো। এটা কোনো ইয়ারকির বিষয় না।

কুহুর দিকে গভীর দৃষ্টি রেখে বলল রওনক,

"এটা ভেবো না আমি তোমার স্বাধীনতায় হস্তক্ষেপ করছি। রিশার বেলায় আমি একই কথা বলতাম। আগে তোমার জীবন কেমন ছিল সেটা জানবার কোনো প্রয়োজন নেই আমার। নাচ একটা প্রতিভা অবশ্যই ইয়ারকির বিষয় না। কিন্তু আমি চাচ্ছি না আমার ওয়াইফের প্রতিভা বা তার রূপ সবাই দেখুক! 

কয়েক সেকেন্ড চুপ থেকে বলল কুহু,

" মানে কি? তাহলে আগে এত সিরিয়াস হয়ে নিষেধ করলেন না কেন? রাতে যখন প্রাকটিস করছিলাম তখনও বারণ করতে পারতেন!

তপ্ত শ্বাস ফেলে আশপাশে চোরা দৃষ্টি বুলিয়ে নিয়ে বলল রওনক,

"কালকে রাতে অন্য মুডে ছিলাম আমি। এত সুন্দর একটা মুহূর্তে এসব সিরিয়াস কথাবার্তা বলতে ইচ্ছে হয়নি। সেই সময়টা শুধু উপভোগ করেছি। আর যেভাবে নাচ করছিলে আমার মাথা রীতিমতো ঘুরে গিয়েছিল। সেই একই নাচে অন্য কেউ তোমাকে দেখুক এটা দুনিয়ার উল্টে গেলেও মানবো না আমি।

হঠাৎই কাল রাতের ঘটনা মানস্পটে ভেসে উঠলো কুহুর। লজ্জায় রক্তিম হয়ে উঠলো গাল দু'টো। দ্রুত দৃষ্টি রাখলো পিচঢালা রাস্তায়। সেটুকু দৃষ্টিগোচর হলো না রওনকের। ওষ্ঠকোণে বাঁকা হাসি নিয়ে তাকিয়ে রইল মেরুন রঙের সেলোয়ার-কামিজ পরা কুহুর দিকে। ওড়নার পাড়ে সোনালী সুতোর চিকণ কাজ। একপাশে কাঁধে রাখা। মৃদু বাতাসে দুলছে।তাল মিলিয়েছে কুহুর কালো কেশগুচ্ছ! আর একমুহূর্তও দেরি করলো না কুহু। দ্রুত পা ফেলে চলে গেল। শব্দ করে হেঁসে ফেলল রওনক। পরক্ষণে হাত ঘড়িতে সময় দেখে নিয়ে বাইক স্টার্ট দিল।


ক্যাম্পাসে কুহুকে দেখে স্বস্তির শ্বাস ফেলল আরিয়ান। এতক্ষণ যাবৎ সোহা, নয়ন বেশ ক্ষ্যাপাচ্ছিল তাকে। বারবার বলছিল কুহু আজ আসবে না। রিহার্সাল মিস যাবে আরিয়ানের। কুহুকে দেখে আত্নবিশ্বাসী আরিয়ান বুক ফুলিয়ে এগিয়ে গেল। কুহুর হাতদুটোকে চেপে ধরে চওড়া হাসলো। তক্ষুনি রওনককে দেখলো পেছনে। হেঁটে আসছে। কুহু আড় চোখে খেয়াল করতেই জোরপূর্বক হাতটা ছাড়িয়ে নিল। খানিকক্ষণ আগের হাসিমাখা রওনক ভাইয়ের মুখ আচমকাই কেমন কাঠিন্য লাগছে! ঈষৎ চোখ রাঙিয়ে অফিস কক্ষের দিকে চলে গেল সে। পাশ থেকে সোহা বাহুতে মৃদু ধাক্কা দিয়ে বলল,

"কিরে দোস্ত! রওনক স্যারকে যেভাবে তাকিয়ে দেখছিলি! এদিকে বেচারা আরিয়ান তোর সামনে সেটা খেয়াল করছিস না?

ঘোর কাটলো কুহুর। কিঞ্চিৎ থতমত খেল সে। হাসার চেষ্টা করলো। কি উত্তর দিবে বুঝতে পারলো না। আরিয়ান তাড়া দিল। রূপসা অলরেডি চলে গেছে অডিটোরিয়ামে। আর কিছুক্ষণ বাদেই আরিয়ানদের রিহার্সাল শুরু হবে। কুহুর হাত ধরে এগোতে চাইলো আরিয়ান। কুহু ঠায় জড়বস্তুর মতো নিজের জায়গায় অটল রইল। দূর থেকে দৃশ্যটা রওনকের দৃষ্টিতে পড়লো। এক সেকেন্ডও দাঁড়াল না সে। করিডোর পেরিয়ে ফাস্ট ইয়ারের ক্লাসে চলে গেল। আরিয়ানের বিষয়টা নিয়ে একটু বেশি বাড়াবাড়ি হয়ে যাচ্ছে। বিষয়টা আর নরমাল মনে হয় না রওনকের কাছে। কথায় কথায় এক মেয়ের হাত ধরে ফেলা নিশ্চয়ই শোভা পায় না। হোক সে যতই ভালো বন্ধু! এই নিয়ে কুহুকে সাবধান করে দিতে হবে।


সবাই সমানে তাড়া দিল কুহুকে। আরিয়ানের দিকে করুণ দৃষ্টিপাত করে বলল কুহু,

" স্যরি আরিয়ান। কথাটা তোকে আরো আগে বলা উচিত ছিল আমার। আমি আসলে নৃত্য করতে পারবো না। কাল রাতে অনেক্ক্ষণ প্রাকটিস করেও পারলাম না। ভয় হচ্ছে আমার।

কুহুর এরূপ কথায় মাথায় যেন বাজ পড়লো আরিয়ানের! এমনিতেই সে কনফিডেন্স পাচ্ছিল না তার মধ্যে কুহু পিছু হটে গেলে কিভাবে হবে? নয়ন মিটিমিটি হাসছে আরিয়ানের চিন্তিত মুখাবয়ব দেখে। সোহা শুকনো ঢোক গিলে নিয়ে কুহুকে বোঝাতে লাগলো৷ ঝড় কখন উল্টে এসে তার উপর দিয়ে বয়ে যায় ঠিক নেই। শেষমেশ বোমাটা ফাটালো নয়ন। সোহাকে বলল আরিয়ানের ডান্স পার্টনার হতে। সোহাকে কিছু বলার সুযোগ না দিয়ে কুহুও তাল মেলালো। হইহই করে উঠলো কুহু আর নয়ন। আরিয়ান হতবুদ্ধি হয়ে তাকিয়ে আছে সোহার দিকে। এই কানা মেয়ে তো ঠিকঠাক হাটতেই জানে না! সে করবে নাচ! চোখে সর্বক্ষণ মোটা ফ্রেমের চশমা! শাড়ি তো সামলাতেই জানে না! এই নৃত্যে শাড়ি পরতেই হবে! সোহার কাঁদো কাঁদো মুখ। সামান্য কিছুতে প্রতিবাদ না করতে পারলে এই মেয়ে কেঁদে ফেলে! বার কয়েক চোখের পাতা ঝাপটে নিয়ে আমতাআমতা করে বলল আরিয়ান,

"প্লিজ সোহা তুই এখন কাঁদিস না। তোকে কোনো নাচ করতে হবে না। আমিই নাম কেঁটে দিয়ে আসছি দাড়া।

কিছুটা রাগ নিয়েই প্রস্থান করলো আরিয়ান। সোহা চলে গেল সোজা নিজের ক্লাসে। হাসিখুশি পরিবেশটা মুহূর্তে নষ্ট হয়ে গেল। ভীষণ খারাপ লাগছে তার। রওনক ভাই কেন যে তাকে নিষেধ করলো! তার অবাধ্য হতেও মন সায় দিচ্ছিল না। কেন জানি আজ মুখের উপর চার কথা শুনিয়ে দিতে পারলো না কুহু। ফুস করে দম ফেলে বলল নয়ন,

" তুই হঠাৎ সিদ্ধান্ত পাল্টে ঠিক করিসনি কুহু। এক রাতে কি এমন হয়ে গেল? আচ্ছা তুই কিভাবে প্রাকটিস করেছিস বলতো? কাউকে দিয়ে জাজ করিয়েছিলি?

"হ্যাঁ, রও...

কথাটুকু বলে থেমে গেল কুহু। ঠোঁটে চওড়া হাসি নিয়ে বলল,

" মানে হ্যাঁ ভাবীকে বলেছিলাম জাজ করতে। বলল সুন্দর হচ্ছে না৷

কোনোরকম কথা শেষ করে ক্লাসের দিকে হাঁটা ধরলো কুহু। আরেকটু হলেই সব ফাঁস হয়ে যেত! কালকে রাতে প্রাকটিস করার সুযোগ আর পেল কই? রওনক ভাই রীতিমতো অন্য জগতে চলে গিয়েছিল! তার সঙ্গে কুহুও তাল মিলিয়ে ফেলেছিল! সেগুলো মনে পরলেই সব তালগোল পাকিয়ে যায়! নয়ন জানাল অডিটোরিয়ামের দিকে যাচ্ছে সে। এই নতুন খবরটা রূপসাকে জানাতে হবে। পাল্টা আর কিছু বলল না কুহু। দ্রুত চলে গেল। দোতলায় উঠতেই দেখলো রওনক বেশ ধীরগতিতে উপর থেকে নামছে। পরনে নেভি ব্লু ফুল হাতার শার্ট। কনুই পর্যন্ত গুটানো। ছাই রঙা ফর্মাল প্যান্ট। চোখে চশমা। বাম হাতে মোটাসোটা একটা বই। দেখে মনে হচ্ছে অতিশয় একজন ভদ্রলোক! অথচ কতটা অসভ্য, অভদ্র এই পুরুষ সেটা কেবল কুহুর জানা! আশেপাশে অনেক শিক্ষার্থী রওনককে সালাম জানাচ্ছে। সবাই ছুটছে অডিটোরিয়ামের দিকে। সাধারণ দিনের তুলনায় স্টুডেন্টস অনেক কম। কুহুকে দেখে থেমে গেল রওনক। স্বাভাবিক ভাবে তাকিয়ে বলল,

"আমি যেটা একবার নিষেধ করেছি সেটা নিয়ে দ্বিতীয়বার কিছু শুনবো না। মাঝেমধ্যে তুমি এমন আচরণ করে ফেলো যেটাতে আমি খুব কষ্ট পাই কুহু! আজকে একা বাসায় চলে যাবে তুমি।

রওনক যতেষ্ট শান্ত ভাবে কথাগুলো বলে গেল। আশেপাশে যারা ছিল তাদের বোঝার ক্ষমতা নেই রওনক ঠিক কি বলছে। কুহু হতবিহ্বল দৃষ্টিতে তাকিয়ে আছে। পাল্টা কিছু জিগ্যেস করার সুযোগ পাচ্ছে না। সে তো নাচ করবে না। এটুকু জেনেই না হয় কথা শোনাতো রওনক ভাই! রওনক পা বাড়াতেই শাহিনূর মাহি ম্যামের দেখা মিলল। মুখে হাসি নিয়ে বলল সে,

" ছুটির পর আপনিও থাকবেন রওনক স্যার? যদি থাকেন তাহলে বলবো মিটিং শেষে আমাকে একটু বাড়ি পৌঁছে দিবেন। বেশি দূরে নয় আমার বাসা। বাইকে করে যেতে দশমিনিট সময় লাগবে।

কুহুর চোখ ঝাপসা হয়ে উঠলো। এই জন্যই কি তবে রওনক ভাই তাকে একা চলে যেতে বলল? ধুপধাপ পা ফেলে সিড়ি ভেঙে উপরে চলে গেল কুহু। রওনক বোকার মতো দাঁড়িয়ে রইল। কুহুকে এই মুহূর্তে আঁটকাবার সাধ্য তার নেই। নিজের কষ্ট প্রকাশ করতে গিয়ে মেয়েটাকে উল্টো কষ্ট দিয়ে ফেলল! মাহি ম্যামের কথার কোনোরূপ জবাব না দিয়ে চলে গেল রওনক। 


মোবাইলে ঠিকানাটা ভালমতো দেখে নিয়েছে রিশা। ঠিক জায়গায় এসেছে মনে হচ্ছে। কলিং বেল চেপে অনেক্ক্ষণ যাবৎ দাঁড়িয়ে আছে। ভেতরে রাতিম ভাই ঠিক আছে তো? যতক্ষণ না স্বচক্ষে লোকটাকে দেখছে মন দুদণ্ড শান্তি মিলবে না।কিছুক্ষণের মাঝে দরজা খুলে দিল রাতিম। পরনে কালো রঙা ট্রাউজার আর সাদা টিশার্ট। কপাল ছুঁয়ে আছে এলোমেলো চুলগুলো। রক্তিম হয়ে আছে নাকের ডগা। চোখগুলো লালচে হয়ে আছে।মলিন মুখে একটুখানি হেসে বলল,

"স্বাগতম মিস আইরিশ! আমার চিন্তা করার জন্য নিজেকে ধন্য মনে করছি! স্বয়ং আপনার পদধূলি এই অধমের বাড়িতে পরবে এটা তো অকল্পনীয় ছিল!

কথাটুকু বলে দরজা থেকে সরে দাঁড়াল রাতিম। খানিকটা নতজানু হয়ে রিশাকে অভিবাদন জানাল। রিশা থতমত খেল। স্পষ্ট খেয়াল করলো রাতিম টলছে ঈষৎ! ঘরের ভেতর প্রবেশ করতে করতে বলল রিশা,

" আমি ঠিক কি কাজে এসেছি সেটা আপনি জানেন রাতিম ভাই। যতই সুন্দর সুন্দর কথা বলে মন ভোলাতে চেষ্টা করেন না কেন আমি কিন্তু প্রশ্নের উত্তর থেকে রেহাই দিচ্ছি না আপনাকে।

রাতিম দরজা লক করে দিয়ে এসে খাটে বসলো। আশেপাশে দৃষ্টি বুলাচ্ছে দুই রুমের ছোট একটা ফ্ল্যাট। প্রবেশমুখে যে বড়োসরো রুমটা তাতে দুইটা সিঙ্গেল খাট। একটা আলনা। আর একটা মাঝারি সাইজের টেবিল। তিনটে চেয়ার পাতা। কিছুটা অগোছালো লাগলো সব। রাতিম ভেতরে যে ছোট রুমটায় প্রবেশ করেছে সেখানে কেবল একটা সিঙ্গেল খাট আর কর্নারে একটা ছোট ওয়ারড্রব। তার উপর ফুলদানি রাখা। ছোট জানালা গলিয়ে আলো পরছে খাটে। আকাশী রঙা পর্দাগুলো এই সাইড করা। দেওয়ালে কয়েকটা চিত্র ফ্রেম টানানো। এই রুমটা যতেষ্ট গোছানো লাগলো রিশার। তার বাম পাশেই ছোটখাটো একটা বেলকনি। আর ডান পাশে কিচেন। রাতিমের দিকে ঘুরে তাকাল রিশা। তক্ষুনি বেশ তড়িঘড়ি করে বেরিয়ে গেল রাতিম।বড়ো রুমের সঙ্গে লাগোয়া ওয়াশরুমে ছুটে গিয়ে হরহর করে বমি করে দিল। বিচলিত হয়ে এগিয়ে গেল রিশা। কাল রাত থেকে বলতে গেলে না খাওয়া রাতিম। পানিই বমি করেছে সে।রাতিমের বাহুতে নিঃসংকোচ হাত রাখলো রিশা। গা প্রচন্ড গরম অনুভব হলো! রাতিম জ্বরের ঘোরে চমকালোই খানিক! কন্ঠে কিছুটা রাগ নিয়েই বলল রিশা,

"দেখে মনে হচ্ছে আপনার রুমমেট আছে। তারা কি একবেলা খাবার দিতে পারলো না আপনাকে? এতটা নির্দয় কি করে হয় মানুষ?

নিজেকে সামলে নিয়ে চোখেমুখে পানি দিয়ে কুলকুচি করলো রাতিম। মাথা সত্যি বেগতিক ঘুরছে তার। নিজেকে সামলে নিয়ে ফের নিজের রুমে এসে খাটে বসলো সে। শুয়ে থেকে চোখ বুজলো। না খেয়ে এমন বহু দিন সে পাড় করেছে ঢাকায় এসে। জ্বর না বাঁধলে এতটা নাস্তানাবুদ হতো না। মাথার কাছে এসে বসলো রিশা। বাথরুম থেকে তোয়ালে ভিজিয়ে নিয়ে এসেছে সে। তার দুশ্চিন্তা কমছে বইকি বাড়ছে। চোখ বুঁজে থেকেই বলল রাতিম,

" রুমমেট দু'জন ছুটি পেতেই বান্দরবান চলে গেছে। তারা থাকলে আমি কখনই ফ্ল্যাটের এড্রেস তোমায় দিতাম না। এমনিতেও দেওয়ার ইচ্ছে ছিল না। কিন্তু সবকিছু তোমাকে না বলা অবধি আমিও শান্তি পাচ্ছি না। এই যে আমার বাসায় আসলে আমি আপ্যায়নও করতে পারছি না।

"রাখুন তো আপনার আপ্যায়ন। আমার দুশ্চিন্তা হচ্ছে আপনার জন্য!

রিশার কথায় চোখ মেলে তাকাল রাতিম। রিশা অপ্রস্তুত হলো যেন।কোনোরকমে উঠে দাঁড়াতে গিয়ে খেয়াল হলো তার ওড়নাটা রাতিমের হাতের নিচে চাঁপা পরেছে। আলগোছে হাতটা সরিয়ে নিল রাতিম। রিশা ব্যস্ত স্বরে কিচেনে যেতে যেতে বলল, কিছু একটা তৈরি করে নিয়ে আসছে সে। রাতিম নিশ্চুপ তাকিয়ে রইল। এই মুহূর্তে মনে হচ্ছে আইরিশ তার বিয়ে করা বউ! ঠিক সেভাবেই যত্নআত্তি করছে! চিন্তা করছে! কোথাও একটা ভাল লাগার পরশ ছুঁয়ে দিল তাকে। শরীর খারাপ লাগলেও মন ভাল লাগছে! জানালার বাইরে দৃষ্টি রাখল রাতিম। বেলা মধ্যাহ্নে। রৌদ্রজ্বল আকাশে শুভ্র মেঘের সাঁতার। দিনটা কি আজ খুব চমৎকার? নাকি রাতিমের কাছেই এমন মনে হচ্ছে? রিশা যে শুধু প্রশ্নের উত্তর জানতে এসেছে তা নয়! রাতিমের জন্যও তার ছুটে আসা! অনেক্ক্ষণ সময় পেরুলো।কিচেন থেকে টুংটাং শব্দ ভেসে আসছে। রাতে ঘুম না আসায় চোখ লেগে আসলো রাতিমের।


ঘড়িতে বিকেল চারটা। মাথায় আলতো স্পর্শ পেতেই চোখ পিটপিট করে তাকাল রাতিম। কোমড়ে ওড়না গুঁজে দাঁড়িয়ে আছে রিশা। একমুহূর্তের জন্য হৃদপিণ্ড থমকে গেল রাতিমের। বিকেলের মিইয়ে যাওয়া হলুদ রোদে বেশ মায়াবী লাগছে রিশাকে। খোলা চুলগুলো এখন হাতখোপা করা। চোখের পলক পড়লো না রাতিমের।

"কখন থেকে ঘুমাচ্ছেন। ডাকতে ইচ্ছে করছিল না। না খেলে হবে কি করে? ঔষধ খেতে হবে না? উঠুন? কিচেনে যা পেয়েছি তাই রান্না করেছি। ভাত আর আলু ভর্তা। আর মশলা চা বসিয়েছি।

রাতিম উঠে বসলো। মাথা পূর্বের তুলনায় বেশি ভার লাগছে।জিভে তিতকুটে এক স্বাদ লাগছে। তখন বমি করার ফলেই হয়তো। তবুও খুব ভাল লাগছে তার। ইচ্ছে করছে বলুক, তুমি আজন্ম আমার কাছে এভাবে থেকে যাও আইরিশ! আমার ভাল থাকার মহা ঔষুধ তুমি! আমার বেঁচে থাকার অর্থ! আমার একটুকরো আশার প্রদীপ! আমার জীবন প্রজ্বলিত করার আলো! 

তবে মুখে কিছুই বলল না। উঠে দাঁড়াতে হিমশিম খেল রাতিম। ততক্ষণে রিশা প্লেটে করে খাবার নিয়ে আসলো। খাটে চুপচাপ বসে আছে রাতিম। খাবারের দিকে দৃষ্টি পরতেই বোঝা গেল আইরিশ রান্নাবান্নায় পারদর্শী নয়।

" অনেকটা সময় তো কাটালে। এখানে এসে উল্টো কষ্ট করতে হলো তোমার। বাড়ি যাবে কখন? 

"আমি আপনাকে খাইয়ে দিলে আপনার আপত্তি আছে রাতিম ভাই?

এরুপ কথায় বেশ আশ্চর্য হলো রাতিম! বাকরুদ্ধ হলো। আবারো হৃদপিণ্ডের অস্বাভাবিক গতি অনুভব করলো। মাথা ঝাঁকিয়ে কোনোরকম সায় জানাল সে। সুন্দর করে ভাত মাখিয়ে খাইয়ে দিতে থাকলো রিশা। মেঝেতে দৃষ্টি রেখে সবকিছু বলা আরম্ভ করলো রাতিম। রওনকের করা বিয়ের প্ল্যানিং সব। অপরিচিত এক মহিলা আর পুরুষকে বোন আর বোনের জামাই বানিয়ে নিয়ে গেছে রাতিম। সবটাই বন্ধুত্বের খাতিরে করেছে সে। অন্য কোনোরকম উদ্দেশ্যে ছিল না তার। একটা মেয়েকে অযথা বিয়ের আসরে ফেলে আসেনি সে। নিস্তব্ধ হয়ে সবই শুনলো রিশা। পরক্ষণে চা আনতে কিচেনে ছুঁটে গেল।


একগুচ্ছ টকটকে লাল গোলাপ হাতে নিয়ে বাড়িতে প্রবেশ করলো রওনক। কুহু যে নৃত্য থেকে নাম কেঁটে দিয়েছে সেটা তার কান অবধি এসেছে। ব্যাপারটা খুবই ভাল লেগেছে তার। অথচ না জেনেই কুহুর সঙ্গে রাগ দেখিয়ে ফেলেছিল। এখন মহারানীর মান ভাঙ্গাতে তাকে কতখানি কাঠখড় পোড়াতে হয় কে জানে। রওনকের হাতে ফুল দেখে মিটিমিটি হাসলো জুলেখা। রুমে এসে কুহুকে পেল না রওনক। বেরিয়ে আসতেই জুলেখার মুখোমুখি হলো। সবকয়টা দাঁতের পাটি বের করে দাঁড়িয়ে আছে সে। 

" কি মোহাব্বত! তা যার জন্যি ফুল আনছেন সে তো বাড়িতে ফিরে নাই ভাইজান।

জুলেখার কথায় অবাক হলো রওনক। পকেট হাতড়ে কোনোরকম ফোন বের করে কুহুকে কল দিল। বজ্জাত মেয়েটা রাগে-অভিমানে নিশ্চয়ই বাড়িতে চলে গেছে! অনেকবার ফোন বেজে কেটে গেল। দ্রুত বেরিয়ে গেল রওনক। দ্রুত পা চালালো কুহুর বাড়ির উদ্দেশ্যে। অনবরত ফোন করতেই থাকলো। এবার রিসিভ হলো। একরাশ রাগ নিয়ে বলল রওনক,

"বাড়িতে কার অনুমতি নিয়ে গিয়েছ তুমি?

ওপাশ থেকে মিইয়ে যাওয়া স্বরে বলল কুহু,

" আমি তো বাড়িতে যাইনি।

"মানে? তাহলে কোথায়?

কিয়ৎক্ষণ নীরবতার পর বলল কুহু,

" আমি ট্রেনে। কোথায় যাচ্ছি জানি না। সব আপনার জন্য হয়েছে।
·
·
·
চলবে................................................

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন