আশিয়ানা - পর্ব ৬৯ - শারমিন আক্তার বর্ষা - ধারাবাহিক গল্প


দ্রাক্ষাক্ষেত্রে আবৃত ঘূর্ণায়মান পাহাড়ের মধ্য দিয়ে নিজেকে ঘুরিয়ে, সূর্যে ভেজা পাহাড়ের চূড়ায় মধ্যযুগীয় শহর পেরিয়ে, এবং দিগন্তে অবিরামভাবে প্রসারিত সাইপ্রেস-রেখাযুক্ত রাস্তা ধরে গাড়ি চালিয়ে যাচ্ছে সেহরিশ। মধ্যরাত। এই সময় রাস্তার একপাশে হঠাৎ গাড়ি থামাল সে, দূর কোথা থেকে ওয়াইনের তীব্র গন্ধ নাকে আসছে। গাড়ি থেকে নামল সেহরিশ, কিছুটা দূরে রাস্তার পাশে গহনার দোকানের পাশে এক চকচকে নদী। জলোর উপর ল্যাম্পপোস্টের সাদা রঙের নাচ দেখে একটু দাঁড়িয়ে গেল সেহরিশ। শ্বাসরুদ্ধকর প্রাকৃতিক দৃশ্য তার হৃদয়কে মুগ্ধ করেছে। সেহরিশ মাথা তুলে আকাশের দিকে তাকিয়ে গভীর নিঃশ্বাস ফেলল। সে সময় হঠাৎ এক কাঠখোট্টা পুরুষ কণ্ঠ ভেসে এলো।
  'দুদিন হল তোর কোনো খোঁজ নেই, রোদেলা তোর জন্য দুঃশ্চিন্তা করছে। জানিস, আমাকে আর তূর্ণ কে কতবার ও কল দিয়েছে?'
সেহরিশ সাদাফের দিকে তাকানোর আগ্রহ পেল না। মেরুদণ্ড টানটান করে দাঁড়িয়ে সে গম্ভীর কণ্ঠে বলল, 
  'কাল ফিরে যাব।'
সাদাফ সেহরিশের দিকে এগিয়ে এলো। তারপর জিজ্ঞেস করলো, 'হুটহাট এখানে আসা তোর জন্য সেফ না। জানিস তো, জায়গাটায় কিছুদিন পরপর মার্ডার হয়।'
সেহরিশের গম্ভীর ও সপটচোস্ত জবাব, 
  'আমার চুল বাঁকা করার সাহস এখানে কারোর নেই।'
সেহরিশ এবার ঘুরে দাঁড়াল। সাদাফের দিকে তাকিয়ে প্রশ্ন করলো, 'তূর্ণ কোথায়?'
  'ওর বাড়িতেই আছে।'
সেহরিশ হাফ ছাড়ল। ভ্রু কুঞ্চিত করে বলল, 
  'আমরা এখানে এসেছি ওকে বলার দরকার নেই।'
সাদাফ প্রশ্ন ছুড়ল,
  'এখানের কাজ?'
সেহরিশ সরু পথ দিয়ে হেঁটে যেতে লাগল। তারপর উচ্চ গলায় বলল, 'শেষ।'
সাদাফ দ্রুত পায়ে হেঁটে সেহরিশের পেছনে এলো তারপর বলল,
  'ওদিকে কোথায় যাচ্ছিস?'
সেহরিশ এবার সাদাফের দিকে তাকাল৷ নরম গলায় বলল, 'রোদের জন্য চুড়ি কিনব। ওই গহনার দোকানে ভালো ভালো চুড়ি আছে।'
সাদাফ হাল্কা হেসে বলল, 
  'শুধু কি চুড়িই নিবি শাড়ি নিবি না?'
সেহরিশ বলল, 
  'নেবো, নেবো, আকাশের চাঁদ, তাঁরা সব নেবো।'
সাদাফ হঠাৎ গম্ভীর হয়ে উঠল। দূরের এক উঁচু পাহাড়ের দিকে তাকিয়ে বলল, 'ওখানে কেউ আছে। তোকে ফলো করছে।'
সেহরিশ ওষ্ঠাধর প্রসারিত করে রহস্যময় একটা হাসি দিয়ে বলল, 
  'জানি।'
সাদাফ অবাক গলায় বলল,
  'তুই জানিস তারপরও।'
সাদাফের কথা শেষ হতে দিল না সেহরিশ। সে ম্লানমুখে বলল, 'বাংলায় একটা প্রবাদ আছে, পিপীলিকার পাখা গজায় মরিবার তোরে।'


দুপুর গড়িয়ে গেল, এই সময় রোদেলা বিছানার এককোনায় ঘাপটি দিয়ে বসে আছে। উইন্ডো দিয়ে বাহিরে তাকালেই নজর কাড়ছে ঝলমলে রোদ। মৃদু হাওয়া এসে রোদেলার খোলা চুলে হালকা নাড়া দিয়ে গেল। সঙ্গে সঙ্গে চুলগুলো আঙুল দিয়ে ধরে কানের পেছনে গুঁজে ফেলল রোদেলা। তার হাতে এখন অফুরন্ত সময়, কোনো ভাবে শেষ হচ্ছে না যেন। এত বড় বাড়িতে একাকী তার ভালো লাগে না। বারে বারে মনে মনে পড়ে গ্রামের আঁকাবাঁকা মেঠোপথ, মামার সেই ছোট্ট টিনের ঘরখানি। আজকাল সেহরিশ বাড়ি থেকে বের হলেই রোদেলার একাকী লাগে। দিনদিন যেনো এই বদঅভ্যেসটা তাকে জেঁকে বসছে। একা হলেই শুধু এদিক সেদিকের কথা মনে পড়ে। রোদেলা কিছুক্ষণ আগেই তার মামাকে ফোন করেছিল কয়েকবার, ফোনটা বন্ধ তাই কারো সঙ্গে কথা হলো না। বহুদিন হলো কাউকেই চোখের সামনে দেখতে পাচ্ছে না। মনটা কেমন কেমন করে আপন জনের জন্য। রোদেলা খাটের এক পাশে আধা শুয়া হয়ে নিজের জীবনের কথা ভাবতে লাগল । কোথায় ছিল কোথায় এল, কি করার কথা ছিল আর এখন কি করছে, আপন জনের চেহারা গুলো নিজ চোখের সামনে থেকে সরাতে পারছে না। নদীর স্বচ্ছ জলের মতো মুখগুলো চোখের পাতায় ভেসে ওঠছে। বিশেষ করে জোজো। প্রচন্ড চঞ্চল সে। গতকাল শ্বশুরবাড়ির সবার সঙ্গে কথা বলেছিল রোদেলা, তারা সবাই ভালো আছে। ভিডিও কলে জোজোকেও দেখিয়েছে, আগের চেয়ে তার স্বাস্থ্য ভালো হয়েছে, চোখ দুটো জলে ছলছল করছিল। যেনো জোজো রোদেলাকে চোখের ভাষায় বোঝাচ্ছে, সে তাকে ভীষণ মিস করে। রোদেলা সামনে থাকলে তার কাছে একছুটে চলে যেত। জোজোর কথা ভাবতে ভাবতেই রুম থেকে বেরিয়ে সিঁড়ির দিকে এগিয়ে গেল রোদেলা। বিকালের স্নিগ্ধ রোদের আলো এসে আছড়ে পড়ছে ছাদের মেঝেতে, রোদেলা নিশ্চল পায়ে ছাদের একপাশে এসে দাঁড়িয়ে গেল। আজ তূর্ণর সোলো অ্যালবাম প্রকাশ হবে, এজন্য সেহরিশ অনেক ব্যস্ত, সে গতরাতে বাড়ি আসেনি। এখন পর্যন্ত তার কোনো খবর নাই। রোদেলা ভারী নিঃশ্বাস ফেলল, বুকটা হালকা করতে চাইলো জেনো সে। কয়েক ঘন্টা মানুষটাকে সে দেখেনি রোদেলা তাতেই মনে হচ্ছে কত বছর দেখেনি। রোদেলা অল্প কিছুক্ষণ ছাঁদে থেকে পরোক্ষণেই ধীর পায়ে ছাদ থেকে নেমে রুমে ফিরে গেল। কিছুক্ষণের মধ্যে বাইরে অল্প আঁধার নেমেছে। রোদেলা আনমনা হয়ে উইন্ডোর কাছে দাঁড়াল। হঠাৎ দরজা খোলার একটা শব্দ হলো, রোদেলার বুকটা ধড়ফড় করে উঠল। দ্রত পায়ে হেঁটে রুমের মাঝখানে এসে দাঁড়াল রোদেলা। দরজার সামনে দাঁড়ানো মানুষটাকে দেখে যেন প্রাণ ফিরে পেল রোদেলা। দীর্ঘ শ্বাস ছেড়ে তা প্রমাণ করলো। কখন? কোন সময় মানুষটা তার এত প্রিয় হয়ে উঠল? বেমালুম সে! সেহরিশ রোদেলার চিন্তিত মুখের দিকে তাকিয়ে এলোমেলো কণ্ঠে জিজ্ঞেস করলো,
  'রোদ তুমি ঠিক আছো তো? তোমাকে এত টেনসড দেখাচ্ছে কেনো?'
রোদেলা ভারী নিঃশ্বাস ফেলল, সেহরিশের মুখের দিকে তাকিয়ে কোমল গলায় বলল, 'কোথায় ছিলেন এতক্ষণ? একটাও ফোন করেননি। আপনি জানেন আমার কত চিন্তা হচ্ছিল?'
সেহরিশ মৃদু হাসলো। তারপর দু এক কদম পা বাড়াল, রোদেলার সামনে গিয়ে তাকে গভীর আবেশে জড়িয়ে ধরল। সেহরিশ নরম গলায় বলল, 'যেখানেই যাই না কেনো দিনশেষে তোমার কাছেই ফিরে আসব।'
রোদেলা বলল, 'তাই বলে সারাদিন।'
সেহরিশ হুট করে বলল, 'হুঁশ কথা বলো না, এভাবেই থাকো কিছুক্ষণ।'
রোদেলা চুপ করে রইল। খানিকক্ষণ পর সেহরিশ বলল, 'তোমাকে নিতে এসেছি, চলো।'
রোদেলা জানতে চাইল, 'এভাবেই?'
সেহরিশ ছোট্ট করে বলল, 'হুুম।'
সেহৌরিশ ভালো করে রোদেলার মুখখানা খেয়াল করল তারপর আবার জিজ্ঞেস করল, 'কোথায় যাব জিজ্ঞেস করলে না যে?'
রোদেলা লহু কণ্ঠে বলল, 'আপনার সঙ্গে কোথাও 
যেতে আমার কোনো আপত্তি নেই।'
সেহরিশ নরম গলায় বলল, 'গার্ডেনে যাচ্ছি।'
রোদেলা আচমকা চোখ বড়বড় করে সেহরিশের দিকে তাকাল। সেহরিশ বলল, 'এভাবে তাকিও না, আমরা এখন গার্ডেনে যাব।'
রোদেলা স্বাভাবিক গলায় বলল, 'জামা কাপড় চেঞ্জ করতে হবে তো।'
সেহরিশ রোদেলা কে আরেকটু কাছে টেনে নিল। তারপর বলল, 'প্রয়োজন নেই। এই শাড়িতে ভালো লাগছে।'
রোদেলা মাথা দুলালো। সেহরিশ বড় বড় পা ফেলে ওয়াশরুমে গেল। হাত দুটো ভাল করে ধুয়েমুছে তারপর আবার রুমে এলো। রোদেলা আমতাআমতা করে বলল, 'আপনি দুদিন কোথায় ছিলেন? ফোন করেননি আর কারো কাছেই আপনার খোঁজ ছিল না।'
সেহরিশ ভারী নিঃশ্বাস ফেলল। সে রোদেলাকে মিথ্যা বলতে চায় না গম্ভীর কণ্ঠে সোজাসাপ্টা বলল,
  'তুস্কানি। এখন চল দেরি হচ্ছে!'
  'তুস্কানি?' প্রশ্ন ছুড়ল রোদেলা।
সেহরিশ শান্ত গলায় বলল,
  'সময় করে তোমাকে ওখানে একদিন নিয়ে যাব।'
রোদেলা আর কিছু বলল না। সেহরিশের পেছন পেছনে চলতে লাগল। কিছুক্ষণ পর ওরা গার্ডেনের একপাশে দাঁড়াল। চারিদিকে আলো জ্বলজ্বল করছে হঠাৎ সমস্ত আলো নিভে গেল। রোদেলা বিস্মিত। আকাশে হলুদ রঙের কিছু ফানুস উড়ছে ও সব ফানুসে রোদেলার নামের একটা করে অক্ষর লেখা। রোদেলা মৃদু হাসলো তারপর ঘুরে দেখল বলিষ্ঠ দেহের মানুষটাকে। এই অচেনা একটা মানুষের সঙ্গে তার জীবনের একটা মাস কেটে গেল। রোদেলা মাথা নিচু করে মাটির দিকে তাকাল তার পরোক্ষণে আবারও সেহরিশের দিকে তাকিয়ে মৃদু কণ্ঠে বিড়বিড় করে বলল, 
  'এক অচেনা শহরে আর এত অচেনা মানুষের ভিড়ে, শুধু আপনি আমার আপন প্রিয়জন!'
সেহরিশ কথাটি স্পষ্ট শুনতে পেল না। পুরো শরীরে ঘুরে রোদেলার মুখের দিকে তাকিয়ে জিজ্ঞেস করলো, 
  'কিছু বলেছ?'
রোদেলা ডান থেকে বামে নিবিড়ভাবে মাথা নেড়ে বলল,
  'কিছু না।'
সেহরিশ নিশ্চল পায়ে হেঁটে রোদেলার কাছাকাছি এলো। হাতের ভাজে একটা চাদর রয়েছে সেটাই রোদেলার গায়ে জড়িয়ে দিয়ে বলল,
  'হীমশীতল ঠান্ডা বাতাসে তোমার ঠান্ডা লেগে যাবে চাদরটা গায়ে জড়িয়ে রাখ।'
রোদেলা সঙ্গে সঙ্গে জিজ্ঞেস করলো,
  'চাদর কোথায় পেলেন?'
সেহরিশ যেন মৃদু হাসলো। মূহুর্তে শান্ত গলায় বলল,
  'তুমি নাওনি তাই আমাকেই নিয়ে আসতে হল। রুম থেকে বেরিয়ে আসার সময় আলমিরা থেকে বের করে সঙ্গে নিয়ে আসছি।'
রোদেলা আকাশের দিকে তাকাল। আকাশে এ সময় একটা তাঁরা ও নেই। তবে বিশাল একটা চাঁদ জ্বলজ্বল করছে। রোদেলা দু কদম পা সামনের দিকে প্রফুল্লচিত্তে ছুটে গেল। তারপর হঠাৎ বলল,
  'দেখুন কি সুন্দর চাঁদ।'
সেহরিশ এগোল। মোহনীয় দৃষ্টিতে রোদেলার দিকে তাকিয়ে নেশালো গলায় বলল, 
  'তুমি আমার সাথে থাকলে আমার আর কিছু দেখতে ইচ্ছে হয় না।'
রোদেলা সঙ্গে সঙ্গে লজ্জায় নিজেকে গুটিয়ে নিল। আগের মতই তার গাল লজ্জায় লাল হয়ে গেল।
.
.
.
চলবে................................................

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন