এক হাজার টাকা - পর্ব ০৩ - মৌরি মরিয়ম - ধারাবাহিক গল্প


এই মূহুর্তে আমি আমার জীবনের সবচেয়ে বিরক্তিকর সময় কাটাচ্ছি। কেন জানেন? কারণ আমি এমন একজনের কথা ভেবে ভেবে বিচলতি হচ্ছি যে হয়তো আমার কথা ভাবেই না। আর আমি যে তার ব্যাপারে খুব গুরুত্বপূর্ণ কিছু ভাবি তা কিন্তু নয়। আমি ভাবি, আদনান কখনো নিজ থেকে আমাকে মেসেজ দেয় না কেন? পরক্ষণেই আবার ভাবি, আমি নিজেই তো ওকে আগে মেসেজ দেয়ার সুযোগ দেই না। আমার সাথে ওর সময়ের পার্থক্য চার ঘন্টা, আমি ৪ ঘন্টা এগিয়ে। পড়াশোনা করে রাত একটা দেড়টার সময় যখন ঘুমাতে যাই আদনান তখন বাড়ি ফেরে। আমি অতি উৎসাহী হয়ে আগে থেকেই মেসেজ দিয়ে রাখি , আদনান বাড়ি ফিরে সেই মেসেজের রিপ্লাই দেয়। বিশ্বাস করুন আমি নিজেই নিজের উপর বিরক্ত। এত অধৈর্য হওয়ার কী আছে তা আমি নিজেও বুঝি না। নিজেই নিজের জীবনটাকে বিরক্তিকর করে তুলছি। যাই হোক, আমি আজ আদনানকে মেসেজ দিলাম না। দেখতে চাই আমি মেসেজ না দিলেও সে দেয় কি না। কয়েক ঘন্টা অপেক্ষা করে নিরাশ হয়ে ঘুমিয়ে পড়লাম। সকালে উঠে আবার চেক করলাম আদনান মেসেজ দিয়েছে কি না। এবারও নিরাশ হলাম, আদনান মেসেজ দেয়নি। সব অনুভূতি কি তবে আমার একার? আদনানের কি বিন্দু পরিমাণও নেই? আদনান মেসেজ দিল দুদিন পর। শুধু হ্যালো লিখেছে। আমি দেখতে চেয়েছিলাম কতদিন আমি যোগাযোগ না করলে আদনানের আমাকে মনে পড়ে! তাই নিজ থেকে যোগাযোগ করছিলাম না। দুদিন পর্যন্ত আদনানের দিক থেকেও কোনো যোগাযোগ না হওয়ায় রেগে আগুন হয়ে ছিলাম। কিন্তু দুদিন পর আদনানের দুই অক্ষরের এই ছোটো একটা মেসেজ পেয়ে সেই আগুনে যেন ঘি পড়লো। রাগে দুঃখে প্রচন্ড কান্না পাচ্ছিল। কিন্তু কাঁদব না আমি। নিজের আত্মসম্মান বিসর্জন দিয়ে একটা অচেনা ছেলের জন্য কেন কাঁদব আমি?

আদনান আরেকটা মেসেজ দিল,
"ফোন করতে পারি?"

আমি উত্তর দিলাম,
"হ্যাঁ।"

ফোন ধরে খুব স্বাভাবিকভাবেই কথা বলছিলাম আদনানের সাথে। আদনানের কথা শুনে মনেই হচ্ছেনা গত দুদিন যে আমাদের কথা হয়নি ব্যাপারটা সে খেয়াল করেছে। যেন এই কথা না হওয়াটা খুব স্বাভাবিক কিছু! আমার রাগ আরো বেড়ে গেল। কিন্তু তবু স্বাভাবিকভাবেই কথা বলে গেলাম।

আদনান হঠাৎ জিজ্ঞেস করল,
"তুমি কি আজ কোনো কারণে ডিস্টার্বড?"

আমি অবাক হয়ে বললাম,
"হঠাৎ একথা বললে কেন?"

"মনে হলো।"

"আমি কি উল্টোপাল্টা কিছু বলেছি?"

"না না, তোমার কন্ঠটা একটু অস্থির লাগছে আজকে।"

বিশ্বাস করুন আমার হার্ট বিট বেড়ে গেল। আমার ভেতরের অস্থিরতা তাহলে টের পাচ্ছে আদনান? রাগ গলে পানি হয়ে গেল।

বললাম,
"কেমন অস্থির?"

"বোঝাই কীভাবে?"

"আচ্ছা বাদ দাও।"

"দিলাম।"

দেখলেন? বাদ দিতে বললাম আর বাদ দিয়ে দিল। কেন সে কি পারত না এ বিষয়ে আরেকটু কথা বলতে? সে চুপ। ওপাশে টুং টাং আওয়াজ হচ্ছে।

আমিই আবার জিজ্ঞেস করলাম,
"কী করছো?"

"রান্না করছি।"

"কি রাঁধছো?"

"পাস্তা।"

"প্রায়ই দেখি পাস্তা খাও। পছন্দ?"

"তেমন না। কিন্তু সহজে করে ফেলা যায়, অল্পতে পেট ভরে যায় তাই করি।"

"তুমি সব রাঁধতে পারো?"

"না। তবে যখন যেটা ইচ্ছে হয় ইউটিউবে রেসিপি দেখে করি।"

আমি জানি সে জিজ্ঞেস করবে না আমি পারি কি না। তাই আমিই বললাম,
"আমি সবকিছুই রাঁধতে পারি, মায়ের থেকে শিখেছি।"

"খিচুড়ি পারো?"

"না পারার কি হলো? এটা তো সবাই পারে।"

"পাকন পিঠা পারো?"

"এটা আবার কী পিঠা?"

"এটা খুব মজার একটা পিঠা। আমার মা বানাতো। যেদিন মা পাকন পিঠা বানাতো সেদিন আমি এত পিঠা খেতাম যে পরে আর ভাত খাওয়া লাগতো না।"

"কীভাবে বানায় এটা?"

"পিঠাগুলো বানিয়ে প্রথমে তেলে ভাজে। এরপর দুধে ভেজায়। মা যখন পিঠা ভাজতো আমি রান্নাঘরে দাঁড়িয়ে তখন থেকে খাওয়া শুরু করতাম। আবার দুধে ভেজানোর পরেও অনেকগুলো খেতাম। মা চলে যাওয়ার পর কখনো খাইনি। আর কেউ পারে না।"

"ইউটিউব দেখে কখনো এটা চেষ্টা করোনি?"

"করেছি। তবে হয়নি। আসলে পিঠা জিনিসটা তো এমন যে একটু ভুল হলে আর হয় না।"

আমি সিদ্ধান্ত নিয়ে নিলাম এই পিঠা বানানো আমাকে শিখতেই হবে। এরপর হঠাৎ মাথায় ভুত চাপলো।

বললাম,
"আদনান ভিডিও কল দেই?"

সে সাথেসাথে জবাব দিল,
"না।"

"কেন?"

"ভিডিও কল একটা উইয়ার্ড ব্যাপার। এ জীবনে কখনো ভিডিও কলে কথা বলিনি আমি।"

আমি জানি লাভ হবে না, তবু তাকে বোঝানোর চেষ্টা করলাম,
"তো? জীবনে অনেক কিছুই আমরা প্রথমবার করি যা আগে কখনো করিনি। তাতে ক্ষতি কী?"

আমাকে বেহায়া ভাবছেন? ভাবতেই পারেন। তবে সাথে আরো কিছু জিনিস ভাবতে হবে। আমার বয়স ২১। এই ২১ বছরের জীবনে আমি কখনো কোনো ছেলেকে নিয়ে ১ মিনিটও ভাবিনি। অথচ এই মানুষটাকে নিয়ে আমি সারাদিন ভাবি। সারারাত ভাবি। স্বপ্নেও তাকেই দেখি। এবার কিছু বুঝতে পারছেন কেন বেহায়ার মত কথাগুলো বলছি? আমি তাকে জানতে চাই। তার সম্পর্কে আমার জানার একমাত্র মাধ্যম ফেসবুক। তার সেই ফেসবুক একাউন্টটা এত খালি যে তা দেখে তার সম্পর্কে বিশেষকিছু জানার উপায় নেই। তার প্রতি আমার দুর্বল হওয়ার দুটো কারণের একটি হচ্ছে সে এতিম। যেখানে আমরা বাবা মায়ের বটবৃক্ষের ছায়ায় বড় হচ্ছি সেখানে অল্প বয়সেই দুনিয়ার কঠিন রূপ সে দেখে ফেলেছে। বাকি জীবনটা আমি তাকে আগলে রাখতে চাই। আমি এইমাত্র যে বাক্যটা বললাম তা বলতে আমার খানিক লজ্জা লাগলো৷ আমি আসলে অচেনা একটা মানুষ সম্পর্কে এতটা ভাবতে চাই না। আবার নিজের অবচেতন হৃদয়কে আটকাতেও পারি না। আমার তার প্রতি দুর্বল হওয়ার দ্বিতীয় কারণ সে নিজে, তার ব্যক্তিত্ব। মেয়ে পটানোমার্কা একটা কথাও আজ অবধি সে আমাকে বলেনি। নিজেকে শামুকের মত গুটিয়ে রাখে। আবার যেদিন খোলসের বাইরে আসে, শিশু হয়ে যায়। মন খুলে কত যে কথা বলে! তখন কেবলই মনে হয় অনেক অনেক বছর ধরে সে শুধু খুঁজে চলেছে একটি নির্ভরতার হাত। যে হাতে হাত রেখে সে উড়য়ে দেবে তার জীবনের সব অপ্রাপ্তিগুলো।

আমার শেষ প্রশ্নের উত্তরে আদনান জবাব দিল,
"ভিডিও কলে কথা বলতে আমার ইচ্ছে করে না তিন্নি। আমি ইচ্ছের বিরুদ্ধে কোনো কাজ করি না।"

"আমাকে দেখতে ইচ্ছে করে না তোমার?"

"প্রতিদিন তো দেখছি।"

"কীভাবে!"

"তুমি তো প্রোফাইলে ছবি দিচ্ছো।"

আমি আবার রেগে গেলাম৷ কিন্তু রাগটা প্রকাশ করলাম না। মাঝে মাঝে নিজের রাগকে নিজেরই ভয় লাগে। কিন্তু আদনানের সাথে যতবার রাগ হয়েছি কখনোই রাগ প্রকাশ করিনি। কোনোদিন যদি রাগ প্রকাশ করে ফেলি তাহলে ভয়ংকর কিছু হবে নিশ্চিত!
.
.
.
চলবে..............................................

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন