আদনান সমুদ্রের ছবি পাঠালো না। আমার তাতে একটু মন খারাপই হলো। আবার একটু সন্দেহও হলো।
পরদিন রাতে কথা বলার সময় বললাম,
"আমাকে ছবি পাঠালে না!"
সে আকাশ থেকে পড়লো,
"কোন ছবি?"
"সমুদ্রের ছবি।"
"সরি তিন্নি, একদম ভুলে গিয়েছিলাম। কাল পাঠাব।"
কিন্তু পরেরদিনও আদনান ছবি পাঠালো না। এবার আর কিছু বললাম না। এক কথা বারবার বলতে লজ্জাও তো লাগে বলুন? থাক নাইবা দেখলাম তার সমুদ্র । কিন্তু পরেরদিন সকালবেলা আদনান নিজ থেকেই ছবি পাঠালো। এমনকি একটা ভিডিও পাঠালো সাথে।
তারপর লিখলো,
"সরি কালও ভুলে গিয়েছিলাম।"
আমি মুগ্ধ চোখে দেখলাম রোমোর সৌন্দর্য। সমুদ্রের পানিগুলো গাঢ় নীল। কি ভয়ংকর সুন্দর! ভিডিওতে একটা বিচহাউজও দেখতে পেলাম। মনে হলো এটা আদনানের বাড়ি। কনফিউশন থাকলেও জিজ্ঞেস করলাম না। সেদিন রাতে একটা গন্ডগোল হয়ে গেল।
কথা বলতে বলতে হঠাৎ বললাম,
"আদনান আজকে তোমাকে একটা কাজ করতে হবে। কথা দাও করবে।"
"আমি এভাবে আন্দাজে কথা দেই না তিন্নি। বলো কি করতে হবে। আমার সাধ্যের মধ্যে হলে এবং তাতে কারো কোনো ক্ষতি না হলে আমি অবশ্যই করব।"
"ধ্যাত।"
"কী?"
"একটু বিশ্বাস নেই তোমার আমার উপর?"
"এখানে বিশ্বাসের প্রশ্ন আসছে কেন? কী করতে হবে সেটা বলো।"
"ভিডিও কলে আসো। এক মিনিটের জন্য হলেও আসো।"
"ওহ শিট। দু দিন পরপর এই ভুত কোত্থেকে আসে তোমার মাথায়?"
আদনানের এমন কথায় আমার এত রাগ হলো যে অফলাইন হয়ে শুয়ে পড়লাম। সারারাত জেগে কাটালেও আর একবারও অনলাইনে গেলাম না। পুরুষ মানুষের এত ভাব কেন থাকবে? আদনানের ভাষ্যমতে এটা ভাব নয় লজ্জা। তা পুরুষ মানুষের এত লজ্জাই বা থাকবে কেন? আমি মোটামুটি নিশ্চত, যে সব ছবি আদনান প্রোফাইলে দিয়ে রেখেছে সে সব ছবি তার নয়, ভেজাল টা এখানেই। তাই সে কখনো ভিডিও কলে কথা বলতে রাজী হয় না। আদনান কেন কিছুই বোঝে না? সে সব ছবি আদনানের না হোক, সে দেখতে খারাপ হোক তাতে আমার কিছু যায় আসে না। আমার শুধু ওই মানুষটাকে চাই। সারাটা রাত অস্থিরতায় কাটালাম। পরদিন আস্তে আস্তে রাগটা কমে গেল আমার। রাতে প্রতিদিনের মতই খুব স্বাভাবিক ভাবে আদনান কল করতে চাইলো। এমন ভাব যেন কিছুই হয়নি গত রাতে।
আমিও তাই স্বাভাবিক ভাবেই কল করতে বললাম,
"হাই তিন্নি।"
"হ্যালো।"
"কী করছিলে?"
"তেমন কিছু না। তুমি?"
"ডিনার করলাম, এবার একটু বারান্দায় এসে বসেছি।"
"বারান্দায় যে! তোমার ছুটি না শেষ? কাল তো অফিস আছে বলেছিলে!"
"আছে কিন্তু শুয়ে পড়লে ঘুমিয়ে যেতে পারি, সারাদিন বাইরে ছিলাম, জমে থাকা কিছু কাজ সারলাম। প্রচন্ড টায়ার্ড । তাই বারান্দায় এসে বসলাম। তোমার সাথে আজ খুব গুরুত্বপূর্ণ একটা কথা আছে। মাঝ পথে ঘুমিয়ে গেলে চলবে না।"
আমি বললাম,
"টায়ার্ড হলে ঘুমিয়ে পড়ো। কথা তো কালও বলা যাবে।"
"কাল বললে হবে না তিন্নি। তুমি অনেক ফাস্ট আগাচ্ছো। আমার মনে হয় যত দ্রুত কথাটা তোমাকে বলব ততই ভাল হবে, আমাদের দুজনের জন্যই। ঘুমানোর জন্য তো আজীবন পড়ে রয়েছে।"
এবার আমার অকারণেই কেমন যেন একটা ভয় করতে লাগলো। কী কথা বলবে আদনান? ফাস্ট আগাচ্ছি বলতে কি বোঝাচ্ছে সে? কথাটা কি সে পজেটিভলি বলল নাকি নেগেটিভলি?
আমি বললাম,
"আচ্ছা বলো তাহলে।"
"তিন্নি আমি জানিনা ব্যাপারটা তুমি কীভাবে নেবে! আমাকে নিয়ে অনেক নেগেটিভ ধারনা হতে পারে তোমার। কিন্তু আসলে তিন্নি, আমি কখনো আমার খুব ব্যক্তিগত ব্যাপারগুলো কারো সাথে শেয়ার করি না। আমি আমার মত থাকতেই পছন্দ করি। কিন্তু কাল রাতে আমি অনুভব করলাম আমার ব্যক্তিগত হলেও কথাটা তোমাকে বলা দরকার কারণ আমাকে নিয়ে তুমি অনেকটাই ভেবে ফেলেছো।"
ও তাহলে বোঝার ক্ষমতা আছে সাহেবের! একটু ভালোও লাগলো, একটু অভিমানও হলো আমার। কিন্তু দুশ্চিন্তার কাছে সে সব তেমন পাত্তা পেল না।
অধৈর্য হয়ে বললাম,
"কি বলবে বলো তো। রিয়েলিটি শো-এর রেজাল্ট ঘোষণা করার মত এত রহস্য করছো কেন?"
"সরি৷ একটু ধৈর্য্য ধরে শোনো, আমি চাই না তুমি আমাকে ভুল বোঝো।"
"আচ্ছা বলো।"
"আট বছর আগে আমি যখন এদেশে আসি ছোটো বড় অনেক ধরনের কাজ করেছি। যখন যা সামনে পেয়েছি তাই করেছি চারটা বছর। এখন যেমন স্কলারশিপে পোস্ট গ্রাজুয়েশন করছি তেমন কোনো স্কলারশিপ গ্রাজুয়েশনের সময় পাইনি। ভাল থাকার জায়গা ছিল না। এমনকি পেট ভরে খেতে পর্যন্ত পাইনি অনেক দিন। সব মিলিয়ে একা টিকে থাকার লড়াইটা অনেক কঠিন ছিল আমার। অথচ আমি যদি ডেনমার্কের সিটিজেন হতাম তাহলে অনেক সুযোগ সুবিধা পেতাম। ভাল চাকরিও পেতাম। তখন আমার কাছে একটা সুযোগ আসে সিটিজেনশিপ পাওয়ার। আমি সুযোগটা কাজে লাগাই। একটা ড্যানিশ মেয়েকে বিয়ে করে ফেলি।"
আদনানের শেষ কথাটা শুনে আমার মাথার ভেতরটা শূন্য হয়ে গেলো। কিছু ভাবতে পারছি না। অপমানবোধে মরে যেতে ইচ্ছে করলো আমার। কল কেটে ফেসবুক আইডিটি ডিএক্টিভ করে দিলাম। একটা বিবাহিত মানুষকে ভালোবেসেছি আমি! এই লজ্জা আমি কোথায় রাখব?
.
.
.
চলবে.................................................