বজ্রমেঘ - পর্ব ০৬ - ফাবিয়াহ্ মমো - ধারাবাহিক গল্প


যে দূরবীক্ষণ দৃষ্টি কাঁচ-ঘেরা চশমায় আবৃত, সেই দৃষ্টি একদিন মারণাত্মক ভয়ংকর ছিল। ঠিক ওরকম ঠাণ্ডা, ওরকম ভয়ানক, ওরকমই বিপজ্জনক। তবে আজ সেসব দিন বদলে গেছে। বদলে গেছে সমস্ত পুরোনো ঘটনা। এখন গায়ে থাকে সিভিল বেশবাস। পকেটে বন বিভাগের কর্ম নিয়ে ফর্দ-তালিকা। মস্তিষ্কের কোষে কোষে বিচরণ করে কর্তৃত্বব্যাঞ্জক চিন্তা। আজও সেই মানুষটির নিস্তার নেই, কোনো ফুরসত নেই, অখণ্ড ছুটিও নেই। সর্বক্ষণ চষে বেড়াচ্ছে পুরো পার্বত্য বনাঞ্চল। ব্যাপারগুলো ভাবতে ভাবতে একগ্লাস ঠাণ্ডা পানি তুলে নেয় রাফান। ঢকঢক করে শুকনো গলায় ঢেলে নেয় পানিটা। এই বিশুদ্ধ আবহাওয়ায় কিছু বিষয় ভাবতে বসলে আজও তার কণ্ঠনালী শুকিয়ে আসে। বুকের ভেতরটা ভীষণ ধড়ফড় ধড়ফড় করে। প্রচণ্ড অস্থির অস্থির অনুভব হয় তার। 

  - অন্যজন কোথায়?  

গুমোট নিস্তব্ধ পরিবেশটা আচমকা যেন বজ্রভরাট স্বরে গমগম করে উঠল। থম ধরা আবহাওয়া নিমিষের ভেতর বদলে গেল তৎক্ষণাৎ। দেয়ালে দেয়ালে ধাক্কা খেয়েছে সেই বজ্রগম্ভীর কণ্ঠের গাম্ভীর্য। গলায় আরেকটু হলে পানিটা আঁটকে যেতো রাফানের। ভাগ্যিস শেষ মুহুর্তে ঢোকটা গিলে ফেলায় বড় বাঁচাটা বেঁচে গেছে। শূন্য গ্লাসটাকে টেবিলের উপর রেখে মুখ ঘুরিয়ে পিছু ফিরল রাফান। দেখল, বেজমেন্টের চওড়া সিঁড়ি ভেঙে উঠে আসছে মানুষটা। গা থেকে এখনো খুলেনি সিভিল বেশ। ডার্ক নেভি ব্লু শার্ট, কালো রঙের প্যান্ট। পড়ণে থাকা কালো স্যূটটা খুলতে খুলতে বাঁহাতে ঝুলিয়ে নিঃশব্দে এসে দাঁড়াল। বসা থেকে ধীরে ধীরে দাঁড়িয়ে একমুখ সৌজন্য হাসে রাফান। বিনম্র শ্রদ্ধায় বিনীত হয়ে জানায়, 

  - পার্থ আসতে পারেনি। রিপোর্ট রেডি করতে ওর সময় লাগবে। কিছু জায়গায় বিশেষ মার্ক করা বাকি। আমি অবশ্য আমারটা কমপ্লিট করে এনেছি। টেবিলে রাখা। 

শব্দহীন ঘরে নিষ্কপট কায়দায় প্রবেশ করেছে শোয়েব। একরাশ ক্লান্তি তার সারা মুখে ছড়িয়ে আছে। চোখদুটি নির্ঘুম রাতের হিসেব নিকেশ বোঝাচ্ছে। তবু চলমান পরিস্থিতির কাছে পূর্ণমাত্রায় সদা টানটান। চোখের চশমাটা আরেকবার ঠিক করে টেবিলের রিভলবিং চেয়ারে বসে পড়ল। চেয়ারে ঝুলিয়ে রাখল পড়ণের সেই কালো স্যূট। একগোছা ফাইল টেবিল থেকে তুলে তাতে সজাগ দৃষ্টি নিক্ষেপ করে চাইল। গাঢ় রক্তাভ ঠোঁটদুটো চিন্তার আঁচে সামান্য কুঞ্চন করেছে সে। ওই মুখভঙ্গিটাই সবচাইতে ভয়ানক ঠেকল রাফানের কাছে! অমন সময় কাঠের দরজায় ঠক্ ঠক্ শব্দে করাঘাত পড়ল। ফাইল থেকে তখনো চোখের দৃষ্টি তুলল না শোয়েব। তেমনি সপ্রতিভ ব্যস্ততায় জবাব ছুঁড়ে দিল, 

  - ভেতরে আসা হোক। 

ক্যাচ্ করে মৃদু শব্দটা ছড়িয়ে পরতেই ভারি দরজাটা ফাঁক হতে লাগল। ঘরটা এতোটাই নীরব, সেই দরজার আর্তনাদ চর্তুদিকে ছড়িয়ে পড়েছে। সরু ফাঁকের মাঝ দিয়ে উঁকি দিল একটি মুখ। সুপরিচিত গলায় সাবধানে বলে উঠল, 

  - ভাইজান, কপি আনুম আফনের জইন্যে? 

চোখের নীলচে তারাদুটো ডান থেকে বামে অনরবত ঘুরে চলেছে। তেমনি কাজে ব্যস্ত চোখদুটি ফেলে জবাব দিল শোয়েব, 

  - রাফানের জন্য আনো। 

  - আফনেরটা? 

  - গোসল করিনি রোকেয়া। এসব শেষ করি। তুমি মতিন, মোখলেসকে নিয়ে খাবার খেয়ে নাও। 

  - আফনে শেষ করেন ভাইজান। একলগে খামো।

এতোক্ষণ নিবিষ্ট ভঙ্গিতে ফাইলের লেখাটা পড়ছিল শোয়েব। এবার বোধহয় চশমা পড়া চোখদুটো কিঞ্চিৎ দরজার দিকে চাইল। এরপরের ঘটনা কী ঘটল তা বলার অপেক্ষা রাখল না। রাফান শুধু কানে শুনল ' খাইতাছি ভাইজান। হেগোরেও দিতাছি! ' বলেই দরজা ভেজানোর ক্ষীণ শব্দ। এরপর সমস্ত ঘর আবারও অখণ্ড নৈঃশব্দে বুঁদ। কয়েকটি নিঃশব্দ মিনিট পেরুনোর পর সশব্দে দম ফেলল শোয়েব। ফাইল বন্ধ করে যথাস্থানে রেখে সামনের দিকে চাইল। রিভলবিং চেয়ারে গা এলিয়ে পাথরের মতো জমাটবদ্ধ স্বরে ডাকল শোয়েব, 

  - রাফান, 

রাফান আচমকা থতমত দৃষ্টিতে টলে উঠলে চট করে নিজেকে শান্ত রাখে। সম্পূর্ণ স্থির গলায় বলে উঠল, 

  - জ্বী স্যার। 

ডানহাতটা মুঠো পাকিয়ে এক বিশেষ ভঙ্গিতে সামনে বাড়িয়ে দিল শোয়েব। ইঙ্গিতে বুঝিয়ে দেয় মনের চাপা অর্থ। চোখের সামনে অমন বহুল প্রত্যাশিত ঘটনাটা দেখে আশ্চর্যে হতভম্ব হয় রাফান। নিজের ডান মুঠোটা সেও সহসা এগিয়ে দেয় স্যারের মুঠোর দিকে। চোখে অবিশ্বাস্যের চাহনি, বুকে দ্রিমদ্রিম কাঁপন, কণ্ঠনালী কাঠের মতো খসখসে! চোখের সামনে সেই শ্রদ্ধাভাজন ব্যক্তিটি তার মুঠোতে মৃদু ধাক্কা দিয়ে মুচকি হাসিতে চাইল। সেই দুর্লভ দর্শন মারাত্মক হাসি! ঢোক গিলল হতবিমূঢ় রাফান। মানুষটা মুচকি হেসে তার দিকেই সমস্ত সন্তুষ্টি জানিয়ে বলল, 

  - পার্ফেক্টলি সার্ভড। ডিটেলিং পয়েন্টগুলো টপ নচ হয়েছে। উই ক্যান সাবমিট দিস রিপোর্ট উইদাউট এনি কনক্লুশান। ভালো করেছ। 

ধড়ফড় ধড়ফড় করে বুকের ভেতরটা কাঁপছে। অসহযোগ অনুভূতিতে পুরোপুরি থমকে আছে রাফান। প্রচণ্ড খুশি, প্রচণ্ড আনন্দ, প্রচণ্ড বিহ্বল এক আবেগে সে যেন কাঠ পুতুল! এই খুশির অট্ট পরিমাপ কখনো সে মাপ-যোগ করতে পারবে না। বাইরে থেকে সম্পূর্ণ স্থির দেখাচ্ছে রাফানকে। বুঝতে দিচ্ছে না অন্দরের উছলে ওঠা বিহ্বলতা। তেমনি শান্ত চেহারা বজায় রেখে ধীরে ধীরে ঠোঁটে হাসি রাখল রাফান। শুষ্ক খরখরে গলায় সামান্য ঢোক গিলে বলল , 

  - আই ওয়াজ . . আই ওয়াজ ওয়েটিং টু হেয়্যর দিজ ওয়ার্ডস্। হাউ হ্যাপি আই অ্যাম, কান্ট স্যা ইট স্যার। 

  - স্যা ইট ভাই। তুমি আমার বাড়িতে আছ। বাড়িতে প্রোফেশনাল সম্বোধনে ডাকতে নিষেধ করেছি। 

রাফানের শেষ শব্দটি অতি যত্নের সাথে শুধরে দেয় শোয়েব। টেবিলের কলমদানি থেকে তুলে নিল কলম। কলমের মাথায় বুড়ো আঙুলের টিপ পরতেই ক্লিক শব্দ করে চোখা মাথাটা বেরিয়ে পরল। ফাইলের ছোট্ট কোণে খসখস করে সাইনটা বসিয়ে ওর দিকে ওটা ঠেলে দিল শোয়েব, 

  - এক সপ্তাহের কাজ একদিনে করা সহজ কথা নয়। এভ্রিথিং ওয়াজ বেটার। ভেরি গুড জব। 

মুখে এতোক্ষণ হতভম্ভ ভাব বিরাজ করছিল রাফানের। বোকা বোকা দৃষ্টিতে একবার চাইল ফাইলের সাইন করা অংশে, পরক্ষণে দৃষ্টি তুলল মানুষটার অসম্ভব সুদর্শন মুখটাতে। রাফান জানে, উনার ওই সমুদ্রের মতো সুন্দর চোখদুটো ঢাকতেই তিনি চশমা ব্যবহার করেন। যত্রতত্র অথবা সবসময় সানগ্লাস পরা যায় না। দৃষ্টিকটু, অশোভন, বিশ্রী দেখায়। কিন্তু তিনি কী জানেন তার মুখ নিঃসৃত ওই কথা শোনার জন্যই পুরো ফরেস্ট ডিপার্টমেন্ট মুখিয়ে থাকে? রাফান বা পার্থর মতো অনেক অধস্তন কর্মীরা উন্মুখ? এই শূন্য, ফাঁকা বাড়িতে 'স্যার' ডাকাটা নিষিদ্ধ করা। তবু দীর্ঘদিনের অভ্যস্ততায় স্যারের বদলে 'ভাই' ডাকাটা আজও সম্ভব হয়নি। ফাইলটা টেবিল থেকে তুলে বসা থেকে দাঁড়িয়ে পড়ে রাফান। তার আগুনের মতো গরম মেজাজ বরফের মতো শীতল। এই শীতল রূপ যে কেবল একজনের নিকট তা পুরো ফরেস্ট এরিয়া জানে। পায়ে পায়ে দরজার কাছে পৌঁছুতেই হঠাৎ স্থির হয়ে গেল রাফান। মাথা ঘুরিয়ে সরাসরি তাকাল রিভলবিং চেয়ারে বসা সেই কর্মরত পুরুষটির দিকে। রাফান শান্তকণ্ঠে গলা খাঁকারি দিয়ে প্রশ্ন করে উঠল, 

  - আপনাকে একটা কথা বলি ? 

রিভলবিং চেয়ারে টানটান পেশাসুলভ ভঙ্গিতে বসে আছে শোয়েব। টেবিলের একপাশে স্তুপী করা ফাইল। সেখান থেকে একটি ডকুমেন্ট বেছে দৃষ্টি বুলাচ্ছিল সে। সহসা রাফানের প্রশ্নে দৃষ্টি তুলে সন্দিগ্ধ চাহনি ছুঁড়ে বলল,  

  - হ্যাঁ, বলো। 

মনে মনে কিছু ভয়ংকর কথা গোছগাছ করে নিল রাফান। বলার পূর্বে একটু সময় নিল সে। জোরে বুকভর্তি দম নিয়ে সরাসরি কথাগুলো জানিয়ে উঠে, 

  - নিজের জন্য এবার কাউকে পছন্দ করুন স্যার। এমন কাউকে বেছে নিন, যে ঢাকার বিলাসিতায় গা ভাসাতে চাইবে না। গুলশান বনানীর আবাসিক এলাকায় বাড়ি গাড়ির জেদ ধরবে না। অর্থলোভী মন নিয়ে এই বাংলোর পরিবেশটা নোংরা করতে চাইবে না। এমন কাউকে বেছে নেওয়াটা বেশ প্রয়োজন স্যার। আপনি এখন বনবিভাগের একজন গণ্যমান্য লোক। এখানকার প্রতিটি ক্যাম্প আপনাকে যথেষ্ট সম্মান করে। আপনাকে নিয়ে যে সমস্ত বাজে কথা ছড়ানো হচ্ছে, তা আপনি বন্ধ করুন স্যার। আমি রাফান, আপনার বিরুদ্ধে একটা বাজে কথাও শুনতে পারছি না। এভাবে হয় না শোয়েব স্যার, এভাবে কখনো হয় না। 

ডকুমেন্টটা একপাশে রেখে কলম বন্ধ করল শোয়েব। সম্পূর্ণ স্থির চাহনিতে রাফানের কথাটা বোঝার চেষ্টা করছে। রাফান যেন কথা বলার রোগে আক্রান্ত। ভীষণ একরোখা হয়ে সে আবারও বলে উঠল, 

  - আপনার দাদী যে সমস্ত পাত্রীর খোঁজ আনেন, বিশ্বাস করুন একটাও ভদ্র চরিত্রের নয়। আপনার পাশে ওসব চরিত্রহীন শাকচুন্নি . . . উহঃ! কল্পনা করাও মুশকিল হয়ে যায়। উনারা আপনাকে পেয়েছে কী? কেন যাচ্ছে তাই মেয়ে এনে আপনার গলায় ঝুলাতে চায়? আপনি কী তাদের কাছে রোবট? যন্ত্রচালিত মেশিন? এবার আপনার দাদী এলে আমি যথেষ্ট বেলাগাম কথা শোনাব। আমি আপনার বারণ মানব না স্যার। সম্মানটা সম্মানীয় পর্যায়ে থাকুক তা আমিও চাই। কিন্তু চোখের সামনে আপনাকে আপনার আপনজনরাই যেভাবে ছোট করছে, ওসব আমি বাইরের লোক হয়ে সহ্য করতে পারব না। আই অ্যাপোলোজাইয স্যার। আই কাইণ্ডলি অ্যাপোলোজাইয! 

চোখের দৃষ্টি, মুখের অবস্থা বেজায় শক্ত রাফানের। ফাইল ধরা না থাকলে হাতটাও বোধহয় মুঠি পাকিয়ে থাকতো। আরো ভয়ংকর সত্যগুলো বলার জন্য এখনো ঠোঁটদুটো কাঁপছে। কিন্তু রাফান বোধহয় ওই মানুষটার নির্লিপ্ততা দেখেই কিছু বলল না। চোখ নামিয়ে ফ্লোরের দিকে দৃষ্টি রাখল রাফান। কানে শুনতে পেল সেই মানুষটার অসম্ভব শীতল কণ্ঠ, 

  - তোমাকে সবসময় বলেছি মাথা ঠাণ্ডা করো। আমার সামনে তুমি গরম মেজাজে কথা বলো না। এভাবে মেজাজ হারিয়ে কথা বললে নিজের অভিধানে বাড়তি অপমান টেনে নিচ্ছ। হসপিটালে যে সমস্ত আচরণ করেছ, সবই আমি শুনতে পেয়েছি। এগুলো কাম্য ছিল না। তোমার কাছ থেকে এরকম উগ্রতা আশা করি না। আমার জন্য তুমি ঠাণ্ডা হও রাফান। আমি তোমাকে ঠাণ্ডা হতে বলেছি। 

কথাগুলোর ধার ধার বাক্যে কিছুটা পরাস্ত হলো রাফান। মেজাজের পারদ একটু একটু করে ভূমিস্পর্শ করল। আগুনের মতো তপ্ত জেদটা বশে এনে শোয়েবের দিকে চাইল রাফান। পুরোপুরি সেকেণ্ডের ভেতর শান্ত, ঠাণ্ডা, স্বাভাবিক হয়ে বলল, 

  - আপনার কোনো বন্ধুও নেই। আপনি আমাদের ছাড়া আর কারোর সাথেই মেশেন না। 

  - তোমরা কী আমার বন্ধু নও? তোমরা আমার ছোট বলে আমি কী তোমাদের ওরকম করে ভেবেছি? কর্ণেল গুলজার আছেন, ডক্টর রেজা আছেন, তুমি আছ, পার্থ আছে, বাকিরাও রয়েছে। 

  - কিন্তু আসল জিনিসটাই আপনার কাছে নেই। দিনশেষে এটাই সত্য। এটা কী আপনি জানেন? 

  - কথা সুগারকোট কোরো না। বি ডাইরেক্ট রাফান। যা বলতে চাও সোজাসাপ্টা বলো। 

দোরগোড়ায় পৌঁছে যাওয়া রাফান এক পা এগিয়ে আসে। ডানহাতে থাকা ফাইলটা বাঁহাতে নিয়ে সম্পূর্ণ গম্ভীর কণ্ঠে বলে, 

  - আপনি বিয়ে করুন। আমি অনুরোধ করছি। একটা ফুটফুটে মেয়ে বিয়ে করে এই বাংলোয় আনুন। এই বিশাল বাংলোর চেহারা পরিবর্তন করা দরকার স্যার। এখানকার পরিবেশ একজন সুস্থ ব্যক্তির পক্ষে স্বাভাবিক নয়। এখানে একা একা বাস করা যায় না। এখানে আপনার আপন বলতে কেউই নেই। রোকেয়া, মতিন, মোখলেস আপনার বাংলোটা পরিচর্যা করে রাখছে। কিন্তু আপনার ব্যক্তিগত মনের পরিচর্যা কে করছে? আছে কেউ? সে জায়গাটা খালি রেখে দিয়েছেন। ভরাটের প্ল্যানটুকুও মাথায় আনছেন না। উল্টো, আপনার দাদী প্রতিবার এসে একটা না একটা নাটক বাঁধিয়ে যান। 

পুরোনো একটা ঘটনা মনে পরতেই আবারও মনে মনে চটে উঠল রাফান। আজ সে বাইরের লোক বলে কিছু বলতে পারে না তেমন। অতো জোর খাটাতে পারে না সে। শুধু মনে মনে অসংখ্য স্মৃতি জমা করে রেখেছে, যা সে ভোলেনি কোনোদিন। একটা মানুষের জীবনে পিতা-মাতার ছায়া নেই, বাবা বলতে কী বোঝায় তা জানেই না। মা বলতে কেমন শান্তির নীড় বোঝায় তা সে টেরই পায়নি। অথচ সেই মানুষটাকেই নানাভাবে ব্যবহার করেছে 'স্বজন' খ্যাত আত্মীয়রা। ঢোক গিলে একবার সামনে তাকাল রাফান। আরো এক পা অগ্রসর হয়ে ভীষণ গভীরভাবে দম টেনে বলল, 

  - আপনার মতো বয়সে ডেভিড স্যার দুধের কৌটা কিনে অফিসে ঢুকেন। ডায়াপার কিনতে কিনতে বাড়ি যান। দুটো বাচ্চার বাপ। তিন নাম্বার বাচ্চা অন দি ওয়ে। বছর বছর ফরেস্ট ডিপার্টমেন্ট উনার মিষ্টির বন্যায় ভেসে যাচ্ছে। অথচ আপনি ফরেস্ট ডিপার্টমেন্টের কার্যনির্বাহী কর্মকর্তা। এ অঞ্চলের প্রত্যেকটা আর্মি অফিসারও আপনাকে ডেভিলিশ হ্যাণ্ডসাম বলে ঘোষণা করেছে। কর্ণেল গুলজারও নিজের মে . .  

কথার মাঝপথে কষে দাড়ি বসালো শোয়েব। এর পরের বাক্য শুনতে একদম আগ্রহী নয়। বিরক্তির শেষ সীমায় নিজেকে ধরে রেখে আরো একবার রাফানকে সাবধান করল শোয়েব,

  - এ পর্যায়ে তুমি বিরক্ত করছ! যেটা আমার মোটেই পছন্দ হচ্ছে না। ভদ্রতা বজায় রেখে বাড়ি ফিরো। আমি এসব বিষয়ে পরে আলোচনা করব।

স্যারের ধৈর্যসীমাকে গুরুত্বই দিল না বেপরোয়া রাফান। ধৈর্যকে আগুনের উপর ফেলে বিশুদ্ধ তেল দিয়ে মেখে মেখে বলল, 

  - এখনো গুরুত্বপূর্ণ কথা বাকি আছে। প্লিজ হোল্ড অন স্যার। আই ওয়ান্ট টু স্পিক নাউ। 

অমন বেপরোয়া, একগুঁয়ে, লাগামহীন আচরণ দেখে সর্বোচ্চ সীমায় অবাক হলো শোয়েব। টেবিলের উপর তার ডানহাতের মুষ্টি ধীরে ধীরে হিংস্রভাবে পাকিয়ে আসছে তা রাফান লক্ষ করেনি। মুদ্রাদোষের ভেতর বড় দোষ, সে যৌক্তিক কথা শুরু করলে না বলে ছাড়বে না। গলায় মৃদু কাশি দিয়ে বিজ্ঞ ব্যক্তির মতো বলতে লাগল,  

  - এবার আপনার দাদী এলে উনি নির্ঘাত ম্যাসিভ স্ট্রোকের প্রতিভা দেখাবেন। আপনাকে ইমোশনালি ডিফিউজ করে একটা শাকচুন্নির গলায় বেঁধে দিয়ে যাবেন। অমন আনডুয়েব্যাল থিংস আমরা অ্যাকসেপ্ট করব না। উই ওয়ান্ট অ্যা বেটার বিউটিফুল ম্যাম ফর ইয়্যু। আপনি যদি রাজী ---- 

পুরো ঘর কাঁপিয়ে বুনো জন্তুর মতো হুংকার দিয়ে উঠল শোয়েব। হাতের কলম ধড়াস করে টেবিলে রাখতেই প্রচণ্ড চাপা আক্রোশে চটে উঠল সে, 

  - রাফান! আমি চেয়ার ছেড়ে উঠলে তোমাকেই পয়েন্ট ব্ল্যাঙ্ক রেঞ্জের প্রতিভা দেখাব! তুমি কী তাই চাও? 

ওই একটি কথার তাৎপর্যে সুড় সুড় করে পিছিয়ে যায় রাফান। দশ নম্বর অতি মহা বিপদ সংকেত। তাড়াতাড়ি পরিস্থিতি বেগতিক দেখে ঝট করে বাইরে বেরুলো রাফান। কিন্তু বিধি বাম! দরজার বাইরে বেলচা দিয়ে পিঁপড়ার চাক নিয়ে যাচ্ছিল মতিন। মনের সাধ মিটিয়ে পিঁপড়ার বাসাটা ভেঙেছে! রাফানের সাথে বেমক্কা ধাক্কা লাগায় সেই বেলচা ছিঁটকে শূন্যে উঠে সম্পূর্ণ মতিনের গায়ে বর্ষিত হলো। এমনিতেই পিঁপড়ারা মতিনের উপর মহাখাপ্পা ছিল। তার উপর ঝরঝর করে তার গায়ে বর্ষিত হতেই চিৎকার আর শোনে কে! রাফান কানে দুহাত চেপে দ্রুত সেখান থেকে পালিয়ে গেছে। কিন্তু উপরতলায় থাকা মোখলেস বানরের মতো মতিনের লাফালাফি দেখে হাসি আর থামাতে পারল না। মতিন সারা বাড়ি মাথায় তুলে চিৎকার করে বলছে, 

  - মোকলেইছা, ওই হারামখোর মোকলেইছা! নীচে আয় জলদি! জলদি আয়! পিঁপড়া কামড়ায়া আমারে রক্তাক্ত কইরা হালাইলো। ভাইজান? ভাইজান আমি মইরা যাইতাছি! মোকলেইছা ভেটকি মারা বন্দ কর! নীছে আয় কইলাম!


সূর্যের আলো ছড়ানো পিদিম একটু একটু ডুবে যাচ্ছে। পশ্চিম আকাশে লালরঙা আঁচড়, যেন রঙে গুলা পানিটা কেউ আকাশে ছিটিয়ে দিয়েছে। সূর্যাস্তের মতো পরম সুন্দর দৃশ্যপট মুগ্ধ চোখে দেখছে কিছু মানুষ। উপভোগ করছে দিনের আলোকে ওমন দূর দিগন্তে তলিয়ে যেতে। প্রায় অনেকক্ষণ ধরে হেলিপ্যাডের উপর দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে দৃশ্যটা দেখল শাওলিন। দলের বাকিরা ক্যামেরায় নিজেদের ছবি তুলতে ব্যস্ত। মুক্ত বাতাসে শোঁ শোঁ করে উড়ছে গায়ের সফেদ ওড়না। পড়ণে আকাশি নীল জামা, নীচে সাদা পাজামা। ওড়নার সঙ্গে পাল্লা দিয়ে উড়ছে ঝরঝরে কোমল চুল। প্রকৃতি মারফত চুলগুলো মেঘের মতো ঢেউ খেলানো। একেবারে সমান নয়, একেবারে কোঁকড়াও নয়। ঢেউয়ের পর সুনিখুঁত ঢেউ। এই চুল নিয়ে শায়খ সবসময় রূপকথার সেই রাজকুমারীর কথা বলতো; যার ছিল বিশাল দীঘল চুল। জাদুবশ করা সেই চুলের জন্যে বন্দি ছিল মেয়েটা। তার নামটা ছিল রূপাঞ্জেল। শায়খ তার আদরের ছোট্ট বোনকে শৈশবের প্রতিটি রঙিন ভুবন চিনিয়েছে। কখনো বুঝতে দেয়নি রঙিন খোলের নীচে কেমন নৃশংস দুনিয়া ওঁত পেতে আছে। সেই আদুরে, ছোট্ট, মিষ্টি বোনটার ঢেউ খেলানো চুলের উপর হাত বুলিয়ে বুলিয়ে বলতো শায়খ, ' শাওলিন, তুমি হচ্ছ তোমার দাদার কাছে ছোট্ট রূপাঞ্জেল। খুবই ছোট্ট একটা বোন। তোমার চুলগুলো দেখো, ওই টিভিতে দেখানো রাজকুমারীর মতো ঢেউ খেলানো না? কত সুন্দর দেখতে! যখন তুমি বড় হবে, তখন তুমি চিনতে শিখবে এই দুনিয়া কত সুন্দর, কত অপূর্ব, কত মায়ায় ভরা। এখন তোমার বয়স কতো বলো তো সোনা? কত হলে? ' চটপটে চঞ্চল শিশুটি প্রত্যুত্তর করে উঠতো, ' পাঁচ! ' ছোট্ট পুঁচকে হাতটা সামনে পাঁচ আঙুল তুলে দেখাতো, ' দাদা পাঁচ!'। ঠোঁটজুড়ে চওড়া হাসিতে হো হো করে হেসে উঠতো শায়খ। সেই হাসিতে তাল মিলিয়ে খাবার নিয়ে ঢুকতো মণি। যাকে শায়খ বিয়ে করেছিল নিজের পছন্দ অনুযায়ী। টুকটুকে লাল বেনারসিতে একদিন বধূবেশে আসে রেবেকা। স্বপ্নাতুর চোখে ছিল ঘর বাঁধার স্বপন। প্রিয় মানুষটির হাতে হাত রাখার সুখ। সেই সুখ সংসারে ছোট্ট শিশুর বিচরণ ছিল সৃষ্টিকর্তার অগাধ আর্শীবাদ। পরম মমতায় বুকে আগলে আগলে রাখলেন রেবেকা নেওয়াজ। কখনো ত্রুটি রাখেননি সেই ছোট্ট মেয়েটার জীবনে। তারপর একদিন . . হঠাৎ দুম করে চুলের ঝাপটা এসে লাগল মুখে। সংবিৎ ফিরে পাবার মতো মৃদু চমকে উঠল শাওলিন। চারপাশে অস্থির দৃষ্টিতে দেখল বাতাস ছেড়েছে। এই জোলো বাতাসই তাকে ফিরিয়ে এনেছে বতর্মান জগতে। 

  - হাই! 

আচমকা একটা অচেনা গলায় বাঁদিকে তাকাল শাওলিন। দেখতে পেল পাশেই একটি মেয়ে দাঁড়িয়ে আছে। বয়সে বোধহয় শ্রেষ্ঠার সমান। পড়ণে সাদা-কালো চিকন স্ট্রিপের শর্ট কূর্তি, গলায় মাফলারের মতো ওড়না প্যাঁচানো, নীচে বোধহয় কালো পাজামা। দেখতে স্মার্টসুলভ সুন্দর। মেয়েটা ওকে দেখে প্রশ্ন করে ওঠল, 

  - তুমি এখানে নতুন? এই এলাকায় আগে কখনো দেখিনি। 

মেয়েটাকে নিজেও ভালোমতো চেনে না শাওলিন। চেনার কথাও নয়। এখানে এসেছে কেবল ক'দিনের জন্যে। তবে মনে হলো মেয়েটা বোধহয় মন্দ নয়। প্রশ্নের উত্তর ভীষণ শান্ত গলায় দিল ও, 

  - একজন ট্যুরিস্ট। এবারই এখানে আসা। আগে কখনো আসা হয়নি। 

  - ওহ আচ্ছা। আমি অবশ্য ট্যুরিস্ট নই। তোমাকে দেখে অপরিচিত লাগল বলে জিজ্ঞেস করা। আমার অবশ্য মাঝে মাঝে এখানে আসতে হয়। আমার বাড়িটা মূলত এখানেই।

সম্পূর্ণ অচেনা, অজ্ঞাত, অপরিচিত মেয়েটার দিকে তাকাল শাওলিন। দূর দিগন্তে অস্তমিত সূর্যের শেষ আলোটা এখনো চারধার রাঙিয়ে রেখেছে। সেই স্বল্প আলোকে মেয়েটার অবয়ব ভালো করে দেখল শাওলিন। খারাপ লাগল না তাকে। মেয়েটা দূরে দৃষ্টিদুটো তাক করে তেমনি অমায়িক কণ্ঠে বলল, 

  - আমি ইলহাম আজিজ। আমাকে ইরা বলে ডাকতে পারো। তুমি?

মেয়েটার আগ বাড়িয়ে কথা বলায় তেমন বিচলিত হয়নি। বরং মনে হচ্ছে মেয়েটা বোধহয় সকলের সঙ্গে মিশুক। হাবভাবে তেমন অশালীন কিছু নেই। সর্বত্রই একটা আভিজাত্যের লেশ মাখানো। ঠাণ্ডা বাতাসের দরুন গায়ে সাদা ওড়নাটা জড়িয়ে নিয়েছিল শাওলিন। সেটাই একটু আঁটোসাঁটো করে মার্জিত কণ্ঠে বলল, 

  - আমি শাওলিন। আমাকে শাওলিনই ডেকো। 

এবার যেন ইরা চোখ ফিরিয়ে শাওলিনের দিকে তাকায়। আইলাইনার টানা চোখদুটো দিয়ে কেমন যেন পর্যবেক্ষণ চাহনি দিয়ে বলে, 

  - তোমাকে কোথায় যেন দেখেছি! কিন্তু . . কিন্তু ঠিক মনে করতে পারছি না। আসলেই কী তুমি প্রথম এসেছ? 

অমন অদ্ভুত গোছের কথা শুনে এবার খানিকটা আশ্চর্যই হল। ইরা মেয়েটা অবশ্যই ওর চেনা নয়। এখানে এসেও একদণ্ডের জন্য মোলাকাত হয়নি। তবে ওকে কোথায় দেখতে পেল? দেখতে কী আদৌ পাবার কথা? অমন আজগুবি ধরণের কথা শুনে মনের বিস্মিত ভাব শান্ত করল শাওলিন। মনে মনে ছক কষে নেওয়াটা কথাটা দ্বিধার সঙ্গে বলল, 

  - ঢাকায় যাওয়া হয় কী? 

প্রশ্নাতুর চোখে তাকিয়ে থাকা ইরা এবার একটু আলো দেখল। চোখদুটো নিমিষের ভেতর উজ্জ্বল করে বলল, 

  - হ্যাঁ, কেন নয়! ঢাকাতেই তো আমার হোস্টেল। তবে কী তোমায় ঢাকায় দেখেছি? 

  - আমি ঢাকাতেই থাকি। ঢাকা থেকে এখানে ট্যূরে এসেছি। 

সহজ অকপট উত্তর পেয়েও কোথায় যেন বিঁধছে ইরার। কিছুতেই মনে করতে পারছে না কোথায় যেন দেখেছে। বারবার অবচেতন মনটা জানান দিচ্ছে ঠিক এই মেয়েটাকেই ও দেখেছে, কিন্তু কোথায়, কখন, কীভাবে দেখেছে সেটাই মনে করতে পারছে না। নীচের ঠোঁট উল্টে কিছুক্ষণ ভেবে আপনমনেই বলতে লাগল ইরা, 

  - তাহলে ঢাকাতেই বোধহয় দেখেছি। তবে কেন জানি মনে হচ্ছে তোমাকে কাছেপিঠে কোথাও দেখা হয়েছে। একঝলক বা একনজর। কিন্তু ভুলোমনার কারণে মনে পড়ছে না। 

এমন উদ্ভট প্রসঙ্গে সত্যিই কিছু বলার নেই শাওলিনের। সত্যি বলতে ও নিজেই কখনো ইলহাম আজিজ নামের কোনো মেয়ের নাম শোনেনি। সেখানে মেয়েটা নির্ঘাত ওকে ভুল কারোর সঙ্গে গুলিয়ে ফেলেছে। এটা অসম্ভব কিছু নয়। পরিস্থিতিটাকে স্বাভাবিক বানাতে একটু অন্য প্রসঙ্গে জিজ্ঞাসা করল শাওলিন, 

  - হেলিপ্যাডে প্রায়ই আসো? 

ভাবনায় ডোবা ইরা ওর ছোট্ট প্রশ্নে এবার ডানদিকে তাকায়। মুখজুড়ে ধীরে ধীরে ফুটে উঠে হাসি। কেমন যেন গর্বিতসুলভ ভঙ্গিতে চোখদুটো সামনে তাক করল ইরা। কণ্ঠে দর্পযুক্ত ভাব টেনে বলল, 

  - শুধু এই ব্যক্তিকে দেখার জন্য আসি! এখান থেকে চাক্ষুষ উনাকে দেখতে পাই। প্রতিদিন এ সময়টায় উনি জীপ নিয়ে আসেন। রেঞ্জার কুকুরকে ওখানেই লাঞ্চ খাইয়ে চলে যান। 

ডানহাতের তর্জনী তুলে সামনের দূরবর্তী জায়গাটায় তাক করল ইরা। সেই আঙুল লক্ষ করে দুটো প্রশ্নাতুর চোখ ধীরে ধীরে সেদিকে ফেলল শাওলিন। কয়েক মূহুর্ত কেমন কাটল জানা নেই। শুধু বুঝতে পারল অদ্ভুত কিছু পরিবর্তন ঘটছে। নিঃশ্বাসে টান কাজ করছে, হাতে ঝিমঝিম হচ্ছে, মাথাটা ভীষণ গরম! ডুবন্ত সূর্যের শেষ ক্ষীণ আলোতে ওই শক্ত, লম্বা গড়নের দিকে স্তব্ধ রইল শাওলিন। দুচোখে শুধু দেখল, সাদা বডি-ফিট টিশার্ট, কালো ডেজার্ট প্যাটার্নের ট্রাউজার, পায়ে কালো বুট। চুলের একদিকে সামান্য আলো লেগে গাঢ় বাদামির আভাস দিচ্ছে, আলো থেকে সরে গেলে ওই চুল ঘন-কালো! 
.
.
.
চলবে.....................................................

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন