টিপ টিপ শব্দে তুমুল হুল্লোড়ে বর্ষণ হচ্ছে। আকাশের কালো মেঘে আঁধারের ছায়ারা বিদ্যমান। ঝনঝন শব্দে জর্জরিত চারপাশ। থমথমে হাবভাব। ফাবিহা আর আরহান তখনও চুপচাপ বসে। বৃষ্টির পানিতে তাদের সমস্ত শরীর ভিজে হচ্ছে একাকার। ফাবিহার অস্থির শরীর, কাঁপা কাঁপা হাত। সে হাত দিয়ে চেপে ধরে আছে আরহানের কপাল। তবুও রক্ত পড়া কমছে না। গলগল করে তারা যেন বেরিয়েই আসছে। একপর্যায়ে ফাবিহা তার গায়ে জড়ানো কালো রঙের ওড়নাটার এক অংশ টেনে ছিঁড়ে ফেলল। দ্রুত পেঁচিয়ে দিল আরহানের কপালে। ভাবতে লাগল কি করা যায়! বাড়িতে কেউ নেই, আরহানের মতো ভাড়ি একজন বলিষ্ঠ দেহের অধিকারী যুবককে তার একার পক্ষে ঘরের ভিতর নিয়ে যাওয়া সম্ভব নয়। অন্যদিকে অতিথি নিবাস তালাবদ্ধ। আরহানকে নিতে হলে মায়াকুঞ্জের ভিতরেই নিতে হবে। ফাবিহা ডাকল,
“আরহান শুনতে পাচ্ছেন, আরহান উঠুন।”
আরহানের কোনোরূপ সাড়াশব্দ পাওয়া গেল না। ফাবিহা উদ্বিগ্ন হয়ে উঠল। আরহান জ্ঞান হারিয়েছে। তার জ্ঞান না ফিরিয়ে কিছুতেই বাড়ির ভিতর নেয়া যাবে না। ফাবিহা আবারও ডাকল,
“আরহান উঠুন প্লিজ।”
আরহান উঠল না। ফাবিহার কান্না পাচ্ছে। আচমকা আরহানের হলো কি! ফাবিহা কাঁদতে কাঁদতে বলল,
“আরহান দয়া করে উঠুন।”
বৃষ্টির পানির ফোঁটারা তখন আরহানের চোখের মুখে পড়ে। প্রায় মিনিট পাঁচেক পর আরহানের হুস আসে। সে চোখ তুলে তাকায়। দেখতে পায় ফাবিহার কান্নাভেজা মুখশ্রী। সে নিম্ন কণ্ঠে ডাকে,
“রৌদ্রময়ী,
ফাবিহা হকচকিয়ে ওঠে। তক্ষৎণাৎ তাকায় আরহানের দিকে। উত্তেজিত কণ্ঠে শুধায়,
“আরহান,
আরহান পলক ফেলে।
তার মনে হয় চারপাশ কেমন যেন ঘুরছে।
ধীরে ধীরে আরহানকে নিয়ে উঠে দাঁড়াল ফাবিহা। ডানহাত তুলে নেয় নিজের কাঁধে। আরহানের পায়েও জখম হয়েছে সে হাঁটতে পারছে না। আরহান ক্লান্তিত স্বরে আওড়ায়,
“আমাকে নিয়ে আপনায় ভাবতে হবে না আমি ঠিক আছি।”
“আমি কিন্তু দেখি আপনি কতটা ঠিক আছেন!”
“ওসব কিছু না। আপনি কষ্ট করে তৌহিদ আর শান্তকে ডেকে দিন ওরা আমায় নিয়ে যাবে।”
“ওনারা কেউ বাড়িতে নেই। একচুয়ালি শুধু ওনারা নয় পুরো নিবাসেই কেউ নেই শুধু আমি আপনি ছাড়া।”
আরহান খানিকটা অবাক হলো। তার মাথার ভিতর তীব্র ব্যাথার অনুভূতি হচ্ছে। সে তার কপালটা চেপে ধরল। বলল,
“আমাকে অতিথি নিবাসে নিয়ে চলুন।”
“ঘর তো তালাবদ্ধ আপনি আমাদের বাসায় চলুন।”
আহত আরহান রাজি হলো না। তবুও জোরপূর্বক ফাবিহা নিয়ে চলল তাকে— তাদের নিবাসে।
ড্রয়িংরুমে তখন ঘোর অন্ধকার। লোডশেডিং হয়ে গেছে। বাড়ির ভিতর বিদঘুটে এক অন্ধকার বিরাজ করছে। ফাবিহা আরহানকে নিয়ে গেল সোজা তার কক্ষে। কোনোরকম বিছানায় শুয়ে দিয়ে বলল, “আপনি শুয়ে থাকুন আমি আলোর ব্যবস্থা করছি।”
আহত আরহান তখন কিছু বলতে চেয়েও বলতে পারল না। তার মাথায় চিনচিনে ব্যথা হচ্ছে। তীব্র জ্বালা-পোড়াও করছে বেশ। আরহান কপালে হাত দিল। ঘটনা ঘটেছিল রাস্তায়। আরহান রিকশা করে স্টুডিওতে যাচ্ছিল। আচমকাই রিকশার গতিবেগ ব্রেকফেল করল। ঠিক সেই মুহূর্তে বামপাশের রাস্তা দিয়ে চলে আসে একটা প্রাইভেট কার। রিকশা পড়ে প্রাইভেট কারের সামনে। ঘর্ষণ লেগে দুই যানবাহনে।
তীব্র বর্ষণে রাস্তাঘাট তখন ফাঁকা প্রায়। আরহান ছিঁটকে রিকশা ছেড়ে নিচে পড়ে। কপাল ঠেকে প্রাইভেট কারের জানালার পাশে। ভাগ্যিস কাঁচে লাগেনি। না হলে কাঁচের জানালা ভেঙে ঢুকে যেত কপালে। পায়ে কেমন ভাবেমচকে গিয়ে ব্যাথা লাগে। রিকশাচালকও আহত হয় খুব। আরহান যেখানে এক্সিডেন্ট করে সেখান থেকে অতিথি নিবাসের দুরত্ব পনের মিনিট। আরহান কি ভেবে বাড়ি চলে আসে। তার মনে হচ্ছিল তার চারপাশ ঘুরছে। আসার পথে পায়ের ব্যাথাটা তেমনভাবে অনুভব হয়নি। কিন্তু গেটের ভিতর ঢোকার পড়ই আচমকা পানি ওপর ছিঁটকে পড়ে আরহান। মূল কথা হলো আচমকা দূর্ঘটনায় আরহান স্তব্ধ, আর মাথায় আঘাত লাগায় বোধশূন্য হয়ে পড়ে। তারওপর প্রবল বৃষ্টি। তাই তো কি করবে ভেবে না পেয়ে ছুটে আসে বাড়ি।'
মোমের আলোটা তখন চোখে এসে লাগে। ফাবিহা হাতগুচ্ছ মোমটা টেবিলের ওপর রাখে। এবং বলে,
“আমি এক্ষুনি ডাক্তারকে কল করছি।”
সঙ্গে সঙ্গে নাকচ করল আরহান। বলল,
“না ডাক্তার লাগবে না। আমি ঠিক আছি।”
“আপনার কপালে বেশ জখম হয়েছে ডাক্তার লাগবে। আপনি বসুন আমি দেখছি।”
ফাবিহা দৌড়ে চলে গেল। মিনিট পাঁচ পর আবার ফিরে এলো। সঙ্গে করে নিয়ে এলো আহিরের একটা শার্ট আর প্যান্ট। ফাবিহা খানিকটা অসস্থি কণ্ঠে আওড়ায়, “এগুলো কষ্ট করে একটু পরে নিন। আপনি অনেকটা ভিজে গেছেন। এভাবে থাকলে আরো অসুস্থ হয়ে পড়বেন আপনি।”
আরহান কিছু বলতে চাইল তার আগেই ফাবিহা বলে উঠল, “প্লিজ কথা বলবেন না।”
আরহান থেমে গেল। বলল না। ফাবিহা জামাকাপড় বিছানার উপর রেখে নিজের কক্ষের ড্রয়ার থেকে এক সেট জামা বের করল নিজের জন্য। তারপর সেও বেরিয়ে গেল দ্রুত!'
বাড়ির কলিং বেল বাজতেই। দ্রুত গিয়ে দরজা খুলল ফাবিহা। দেখতে পেল ছাতা মাথায় তাদের ফ্যামিলি ডক্টর মোস্তফা রহমান দাড়িয়ে। ফাবিহা দ্রুত বলল, “আঙ্কেল আপনি এসেছেন?”
মোস্তফা রহমানও চটজলদি বাড়ির ভিতর ঢুকে বললেন,
“কার এক্সিডেন্ট হয়েছে ফাবিহা?”
“আমার সাথে আসুন আঙ্কেল।”
টিপটিপ আলোতে মোমখানা জ্বলছে। ফাবিহা দাঁড়িয়ে আছে কপাটের কাছে। আর আরহান বিছানায় চুপচাপ বসে। তার কপালে ঔষধপানি লাগিয়ে ব্যান্ডেজ করে দিচ্ছেন মোস্তফা রহমান। আরহান নির্বিকার ভঙ্গিমায় নীরব বেসে বসে। ফাবিহার দৃষ্টিভঙ্গি তখনও আরহানের দিকে নিবদ্ধ। ছেলেটার আচমকা কি হলো? কেন হলো? এখনও জানতে না পারায় বড্ড দুশ্চিন্তা লাগছে।
••••••••••••
ঘড়ির কাঁটায় তখন চারটার কাঁটায় ছুঁই ছুঁই। আরহান শুয়ে আছে ফাবিহার বিছানায়। তুলতুলে নরম বিছানা। বিছানার পাশেই ছোট্ট টেবিল। তারওপর সাদা মোমবাতি জ্বলছে। আরহানের ফোনটা রাস্তায় পরে নষ্ট হয়ে গেছে। মোবাইল খুলছে না। তাই চেয়েও তৌহিদ আর শান্তকে কল করা যাচ্ছে না। এই মুহূর্তে মনে হচ্ছে আরহান কেন শান্ত বা তৌহিদের ফোন নাম্বার মুখস্থ করল না। বেশ বিরক্ত লাগছে। হঠাৎ কারো পায়ের ধ্বনি পাওয়া গেল। বাহিরে বৃষ্টির বেগ বেশ কমেছে। তবে এখনও পড়ছে। পুরোদমে বর্ষণ থামেনি। আরহান পায়ের ধ্বনির আলাপ পেতেই দরজার সামনে তাকাল। সাদা সেলোয়ার-কামিজ আর লাল ওড়না পরিধিত ফাবিহা এসেছে। চুলগুলো খোলা। মুখমণ্ডলে কোনো সাজ নেই। আরহান দৃষ্টি নামিয়ে নিল। ফাবিহার হাতে স্যুপের বাটি। সে এগিয়ে এলো। আরহানের কাছ দিয়ে বসে বলল,
“এগুলো খেয়ে নিন।”
আরহান নাক কুঁচকায়। স্যুপ তার মোটেও পছন্দ নয়। সে বলল,
“এসব নিয়ে যান। এগুলো আমি খাই না।”
“খাই না বললে তো চলবে না। এগুলো খেয়ে দ্রুত ঔষধ খেতে হবে আপনাকে।”
“ডাক্তার কি এগুলো খেতে বলেছে?”
“জি বলেছে।”
“মিথ্যে বলছেন?”
“আপনায় মিথ্যে বলে আমার লাভ।”
আরহান কিছু বলল না। তাকিয়ে রইল ফাবিহার চোখের দিকে। মেয়েটা বার বার পলক ফেলছে। আরহান মলিন কণ্ঠে বলল, “আমি এগুলো খাই না রৌদ্রময়ী।”
এবার ফাবিহাও তাকাল আরহানের চোখের দিকে। মায়া মায় কণ্ঠে শুধাল,
“একটু খেয়ে নিন না। আমি খুব যত্ন করে বানিয়েছি।”
কথাটায় কি ছিল আরহান বুঝতে পারল না। কিন্তু তার খুব মায়া হলো। সে ছোট্ট স্বরে বলল, “দিন।”
চোখেমুখে খুশির ঝলক ফুটল ফাবিহার। সে তাকাল আরহানের দিকে। আরহানও তাকিয়ে। আকাশে তখন মেঘ ডাকে। বাতাস দেয় খানিকটা। গুড়ি গুড়ি বৃষ্টি নামে। বোধহয় জানান দেন প্রেমবর্ষণ দারুণ নিকটে।
••••••••••••••
বিছানায় শুয়ে আছে মোহনা। তার মস্তিষ্কে ঘুরছে তৌহিদ নামক মানুষটা। মানুষটা খুব ভালো। ভীষণ ভালো। দারুণ ভালো। আনমনা হেঁসে উঠল সে। মনে মনে ভাবল, এবার বুঝি প্রেমচিঠিটা দেয়াই যায়। মোহনা ভাবনা শেষে নীরব পানে তাকায় টেবিলের পানে— একগুচ্ছ রঙিন চিঠি ঝুলছে সেখানে।
.
.
.
চলবে......................................................................