অতিথি নিবাস - পর্ব ২৬ - তানজিল মীম - ধারাবাহিক গল্প


সন্ধ্যা তখন খুব নিকটে। প্রকৃতি জুড়ে বিরাজ করছে নিয়মহীন নীরবতা। বাতাস বইছে চারিধারে। গাঁ করছে ছমছম। শীতল বাতাস শরীর দিচ্ছে পুরো নাড়িয়ে। ফাবিহা দাঁড়িয়ে আছে তার কক্ষের কপাট মুখে। আরহান বিছানায় ঘুমোচ্ছে। পাশেই টেবিলটার ওপর জ্বলতে থাকা পঞ্চম মোমবাতিটা নিভু নিভু আলো ছড়াচ্ছে। ফাবিহা খানিকটা চিন্তিত– বাসায় আর একটা মোমবাতি আছে। এখনও কারেন্ট না আসলে দারুণ বিপাকে পড়বে ফাবিহা। খানিকক্ষণ কিছু ভাবল। চট করে মাথায় বুদ্ধি খেলল। ভাবি তো বাহিরে নিশ্চয়ই এখন বাড়ি ফেরার তাগিদে থাকবে। আর ভাবল না। দ্রুত নিজের ফোনটা নিয়ে কল তার ভাবিকে। তাদের ঘরে চার্জার লাইট আছে। কিন্তু সমস্যাটা হলো সেটায় চার্জ নেই। লাস্টবার ব্যবহার করে আর চার্জ দেয়া হয়নি।'

 “হ্যালো ভাবি।”

অপরপাশের মানুষটা তখন খানিকটা চিন্তিত। সে শুধায়, “তুমি ঠিক আছো তো ফাবিহা?”

ফাবিহা বেশ অবাক স্বরে বলল,
 “আমার আবার কি হবে?”
 “না বাহিরে যে ঝড় শুরু হয়েছে। তারওপর তুমি একা। আমি যে আসব তারও উপায় নেই। আচমকা এত ঝড়-বৃষ্টি নামবে বুঝতে পারিনি।”
 “আমি ঠিক আছি ভাবি।”

উর্মি শান্ত হলো। ফাবিহা আরো বলল,
 “শোননা ভাবি, তুমি আসার সময় এক প্যাকেট মোমবাতি নিয়ে এসো। বাসায় কারেন্ট নেই। চার্জার লাইটটারও চার্জ নেই। বাসায় যা মোমবাতি ছিল তাও প্রায় শেষের পথে। রাতে কারেন্ট না আসলে আমরা বিপাকে পড়ব।”

উর্মি মন দিয়ে ফাবিহার প্রতিটি কথা শুনল। এরপর বলল,
 “ঠিক আছে। আমি এক্ষুণি আসছি।”
 “তাড়াহুড়ো করতে হবে না ভাবি। তুমি তোমার মতো সময় নিয়ে এসো। ভাইয়াকে সঙ্গে নিয়ে এসো।”
 “দেখি। বেশি দেরি হলে আমি চলে আসব।”
 “আচ্ছা ভাবি। সাবধানে এসো।”

কল কেটে গেল।'

 “রৌদ্রময়ী শুনছেন?”

আরহানের নিম্নস্বরের কণ্ঠ শোনা যায়। ফাবিহা দ্রুত এগিয়ে আসে। বলে,
 “জি বলুন। ঘুম ভেঙে গেছে আপনার?”

আরহানের উসখুস চাহনি। চোখ দুটোয় হাল্কা লাল রঙ বিদ্যমান। সে শুধায়,
 “আমি অতিথি নিবাসে যেতে চাই।”
 “এখানে কি আপনি খুব অসস্থিবোধ করছেন আরহান?”
 “বিষয়টা তেমন নয়।” 
 “তাহলে কেমন বুঝিয়ে বলুন।” 
 “বুঝিয়ে বলতে পারছি না।”
 “কেন?”

কৌতূহলী প্রশ্ন ফাবিহার। আরহান উত্তর দিল না। শুধু বলল, 
 “সব কেনর উত্তর হয় না।”
 “আমি কি অবুঝ?”
 “হতে পারে।”

চোখ রাঙিয়ে তাকাল ফাবিহা। আরহান মৃদু হাসল। ফাবিহা বলল,
 “লোকমুখের ভয় পাচ্ছেন?”
 “আপনি পাচ্ছেন না?”
 “মানুষের কথা আজকাল আর ভাবি না।”
 “তবুও কলঙ্কিত হতে তো সময় লাগে না।”
 “আমার চেয়ে আপনার বেশি ভয় পাওয়াটা খুব কি স্বাভাবিক কিছু?”
 “আমি তো অস্বাভাবিক কিছুও দেখি না।”
 “আপনার সাথে কথায় পারা যাবে না।”
 “আপনি বোধহয় ভুলে যাচ্ছেন আমি একজন আরজে যার কাজই হলো কথা বলা।”

থেমে গেল ফাবিহা। আরহানও কিছু বলল না। চুপ করে রইল কিছুক্ষণ। হঠাৎই আকস্মিক এক প্রশ্ন করে বসল ফাবিহা। বলল,
 “কখনো কাউকে ভালোবেসেছেন আরহান?”

কথাটা বলেই ঠোঁটে কামড় দিল ফাবিহা। এ কি বলে ফেলল সে। আরহান কিছু সময় ফাবিহার দিকে তাকিয়ে থেকে লম্বা একটা দীর্ঘশ্বাস ফেলল। এরপর দৃষ্টিতে সরিয়ে শীতল কণ্ঠে শুধাল,
 “কাউকে ভালোবাসার জন্য মানুষের মধ্যে একটা বিশেষ গুন থাকার প্রয়োজন। আমি মনে করি আমার মধ্যে সেই বিশেষ গুনটি নেই। আমি প্রেমিক হিসেবে কখনোই ভালো হব না।”
 “জামাই হিসেবে নিশ্চয়ই ভালো হবেন?”

আবারও বিভ্রান্তকর প্রশ্ন। ফাবিহা তবুও বলে দিল। লজ্জিত স্বরে মাথা নুইয়ে বলল,
 “দুঃখিত।”

আরহান হাসল। স্বল্প আওয়াজে জানাল,
 “ক্ষমার চাওয়ার মতো কোনো ঘটনা ঘটল কি?”

ফাবিহা উত্তর দিল না। আরহান বলল,
 “আপনাকে কি ধন্যবাদ দেয়া উচিত?”
 “না দিলেও চলে।”
 “ঠিক আছে ধন্যবাদটা আপাতত আমার কাছেই থাকুক কোনো একদিন ফেরত দিব।”
 “ধন্যবাদ কি ফেরত দেয়া যায়?”
 “ধন্যবাদের পরিবর্তে উপকার করা যায়। আচ্ছা শুনুন আই এম সরি।”

ফাবিহার আকস্মিক চাহনি। বিস্ময় ভরা মুখ। কৌতূহলী প্রশ্ন, “হঠাৎ?”

আরহানের পলকহীন দৃষ্টি। সে আওড়ায়,
 “কোন এক রাতে আমি আপনার সাথে বোধহয় বাড়াবাড়ি রকম কিছু আচরণ করে ফেলেছিলাম আমি।”

ফাবিহা চিন্তায় মশগুল হলো। হাজার চেষ্টা করেও মনে পড়ল না কোনরাতে আরহান বাড়াবাড়ি রকম কিছু করেছিল তার সাথে। আরহান বলল,
 “আসলে আমার একটা সমস্যা আছে আমার যখন মাথায় তীব্র ব্যাথা অনুভব হয় তখন আমি একটু উদঘাটের মতো কাজকর্ম করি। তৌহিদ, শান্ত জানে।”

ফাবিহার বোধহয় এবার মনে পড়ল। গায়ে হলুদের রাতে আরহান একটু অস্বাভাবিক আচরণ করেছিল। ফাবিহা শুঁকনো হেসে জানাল,
 “ওহ্, এই ব্যাপার! ইট'স ওকে। আমি কিছু মনে করিনি।”

আরো কিছু সময় গেল। আকাশের মেঘ জমা ভাব খানিকটা কমলো। বৃষ্টি শেষ হলো বেশ আগে। ফাবিহা তখন রুমে নেই। আরহান অনেক ভেবে আস্তে আস্তে শোয়া থেকে উঠে বসল। এবার ঘরে না গেলেই নয়। মেয়েটা এত জেদি কিছুতেই যেতে দিতে চাইছে না। কিন্তু আরহানের এবার যেতেই হয়। এতক্ষণে নিশ্চয়ই তৌহিদ আর শান্ত চলে এসেছে। শালার ফোনটা নষ্ট হয়ে সবচেয়ে বিচ্ছিরি কান্ড হয়েছে। না হলে ফোন করেই ডাকা যেত। আচ্ছা এখান থেকে চেঁচিয়ে ডাকলে শুনতে পাবে। ছ্যাহ্! আঘাত পেয়ে মাথা খারাপ হয়ে গেল নাকি। একি তো অল্প স্বরে কথা বলতেই কষ্ট হচ্ছে সেখানে নাকি চেঁচিয়ে ডাকবে। রক্তক্ষরণ আবারও ঘটাতে চাইছে বোধহয়। আরহান কপালে হাত দিল। মাথার মধ্যে সে কি তীব্র ব্যাথা।

আরহান আস্তেধীরে উঠে দাড়ানোর চেষ্টা করল। পায়ের ব্যাথার জন্য দাড়ানোও যাচ্ছে না। আরহান তবুও দাঁড়াল। হঠাৎই দু'কদম হাঁটতে গিয়েই পড়তে নিল আরহান। সঙ্গে সঙ্গে ফাবিহা দৌড়ে এসে ধরল তাকে। উত্তেজিত কণ্ঠে বলল,
 “আরে আরে আপনি উঠতে গেলেন কেন?”

আরহান নিজেকে সংযত করে বলল,
 “আমাকে যেতে হবে।”
 “ঠিক আছে। আমি কি আপনাকে ধরে রাখব?”
 “যদি রাখেন।”
 “আপনি চান আমি আপনায় ধরে রাখি?”
 “কারো চাওয়াতে কি কেউ কাউকে ধরে রাখতে পারে রৌদ্রময়ী?”

ফাবিহা উত্তর দেয় না। চুপ করে রয়। আস্তে করে আরহানকে বসিয়ে দেয় বিছানায়। বলে,
 “তৌহিদ ভাইয়ারা চলে এসেছেন। আপনি বসুন আমি তাদের ডেকে নিয়ে আসছি।”

ফাবিহা কথাটা বলেই বেরিয়ে গেল। কারেন্ট চলে আসলো সেই মুহূর্তে। আরহান চুপচাপ বসল খাটে। চোখ বন্ধ করে নিল হঠাৎ।

•••••••••••••

হন্তদন্ত হয়ে মায়াকুঞ্জের দিকে ছুটে আসলো তৌহিদ আর শান্ত। দুজনেরই আতংকিত শরীর, থমথমে চেহারা। তৌহিদ দ্রুত রুমে এসে হতভম্ব কণ্ঠে বলল,
 “আরহান,

তক্ষৎণাৎ চোখ খুলে ফেলল আরহান। চেয়ে দেখল কপাট মুখে তৌহিদ আর শান্ত দাঁড়িয়ে। তারা এগিয়ে এলো। শান্তর চোখ ছলছল করছে। তৌহিদ উত্তেজিত কণ্ঠে বলল,
 “এগুলো কি করে হলো?”

বলে কপাল পায়ে হাত রাখল তৌহিদ। আরহান বলল, “আরে তেমন কিছু হয়নি। সামান্য এক্সিডেন্ট।”

শান্ত হাত ইশারায় বুঝাল,
 “এটা সামান্য এক্সিডেন্ট।”

আরহান বলল,
 “আরে আমি ঠিক আছি। ফাবিহার জন্যই সুস্থ আছি। তোরা আমাকে দ্রুত অতিথি নিবাসে নিয়ে চল।”

তৌহিদ এগিয়ে গেল ফাবিহার দিকে। শান্ত স্বরে বলল, “আপনাকে অসংখ্য ধন্যবাদ ফাবিহা।”

ফাবিহা মুচকি হেসে জবাব দিল, “ইট'স ওকে। এটা তো একজন মানুষ হিসেবে আমার কর্তব্য।”

••••••••••••

আস্তে আস্তে লাফিয়ে লাফিয়ে তৌহিদ, শান্তর কাঁধে হাত রেখে কোনোরকম মায়াকুঞ্জের দরজার সামনে এসে উপস্থিত তৌহিদ, শান্ত আর আরহান। আর তাদের পিছনে ফাবিহা। বাহিরে বৃষ্টি নেই। তবে বৃষ্টির পানিতে উঠোনটা বেশ ভিজে। আরহান তার এক পা উচকিয়ে দাঁড়িয়ে আছে। চিন্তিত স্বরে বলল, এবার কিভাবে যাব?”

তৌহিদ কিছু সময় চুপ থেকে আচমকাই চোখ টিপ মারল শান্তকে। শান্তও ব্যাপারটা বুঝতে পেরে হাসল। এরপরই দুজন মিলে আচমকাই কোলে নিল আরহানকে। সঙ্গে বলল, “এইভাবে।”

 আরহান আকস্মিক কাজে থমকে গিয়ে বলে উঠল, “আরে এটা কি করছিস?”
 “ঠ্যাং ভাঙা বন্ধুকে বাড়ি নিয়ে যাচ্ছি।”

তৌহিদের উত্তর। আরহানকে কোলে নিয়ে উঠোনে নেমে পড়ল শান্ত আর তৌহিদ। পিছনে এদের কান্ড দেখে হেঁসে ফেললো ফাবিহা। যেতে যেতে আরহানের কণ্ঠ শোনা যায়। সে বলে,
 “শালারা আমি যদি পড়ি তাহলে তোদের একটার কপালেও বউ নেই।”

প্রতিউত্তরে শান্ত একহাত নাড়িয়ে কি যেন বলল ফাবিহা বুঝতে পারল না। তবে তৌহিদ বলল,
 “বউ লাগবে না। দরকার পড়লে ভাবিকে নিয়ে থাকব।”

আরহান চোখমুখ কুঁচকে বলল, “ওরে বাটপার। এই ছিল তোর মনে।”
.
.
.
চলবে......................................................................

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন

WhatsApp