তোমায় যত গল্প বলার ছিলো - পর্ব ২৬ - মিশু মনি - ধারাবাহিক গল্প


৫ বছর পর এক রোদ ঝলমলে দিনে..

বাড়িটা পুরনো। আসবাবপত্রে ধূলা জমে আছে। একবার ঝাড় দিলেই ধূলার কুণ্ডুলি হয়ে যায়। আমার ধুলাবালিতে সমস্যা হয় অনেক। তাই একজন মহিলাকে দিয়ে বাসাটা পরিষ্কার করিয়ে নিচ্ছি। 

চাকরিজীবনের প্রথম দিনগুলি দারুণ লাগছে আমার। গত সপ্তাহে জয়েন করেছি। মফস্বলের এই একতলা বাড়িটাতে দুই রুম ভাড়া নিয়েছি নিজের জন্য। বিশাল করিডোর ধরে গিয়ে অন্যদিকের একটা রুমে একজন বৃদ্ধা থাকেন। এছাড়া বাড়িটা ফাঁকা। পুরনো দিনের বাড়ি, শ্যাওলার স্তর পড়েছে উঠোন জুড়ে। বৃদ্ধার কেউ নেই বলে বাড়িটা অনাদরেই পড়ে আছে। আমাকে ভাড়া দিতে পেরে উনিও বেশ খুশি। 

আমিও কি কম খুশি! এ আমার নিজের ঘর। একান্তই নিজের। এখন আমার জীবনে হস্তক্ষেপ করার মতো কেউ নেই। জীবনে প্রথমবারের মতো স্বাধীনতার স্বাদ পেয়েছি। নিজের পায়ে দাঁড়িয়ে, শহর ছেড়ে দূরের এক মফস্বল এলাকায় চাকরি করতে এসেছি। এখানকার পরিবেশ সুন্দর, শান্ত, শীতল। কোনো হর্ণ নেই, মানুষের আওয়াজ নেই, হকারের চেচামেচি নেই। নির্জন এই বাড়িতে আমার খুব আনন্দেই দিনগুলো কাটবে মনে হচ্ছে। 

ঘরে পুরনো আসবাবপত্র রয়েছে কিছু। ওগুলো বের করে রাখার জায়গা নেই বিধায় আমাকেই ব্যবহার করতে অনুমতি দেয়া হয়েছে। ঘরজুড়ে কেমন একটা আটপৌরে গন্ধ। আসবাবগুলো বহু পুরনো আমলের, কিছু কিছু কাঠে ঘুণ ধরলেও এখনো বেশ সুন্দর। আমার যেন শান্তিতে বুক ভরে যেতে লাগলো। সারাজীবন দুঃখ পেতে পেতে শেষে কিনা জীবন আমাকে এই অমোঘ শান্তিপূর্ণ জীবনের আস্বাদন এনে দিলো! জীবনের প্রতি আমার কৃতজ্ঞতার অন্ত নেই। 

কিছুদিনের মধ্যেই এখানে আমার ঘরটা আপন করে নিলাম। সবকিছু মনের মতো করে গুছিয়ে নিয়েছি আমি। ঘরের দেয়াল ঘেঁষে বড় বড় কয়েকটা গাছ, যার ছায়া চালের ওপর এসে পড়েছে। তাই সবসময় ঘর ও বারান্দা জুড়ে শীতলতা বিরাজ করে। অফিস থেকে ফিরলেই আমার দেহ মনে প্রশান্তি ভর করে। 

একদিন সকাল সকাল খুব ঝলমলে রোদ উঠেছে। অফিসের কাজে বের হয়েছি। পথেই একটা বিল দেখে থমকে দাঁড়ালাম। শাপলা ফুলে ভরে গেছে পুরো বিল। দুটো ফুল হাতে নেয়ার জন্য মন আনচান করছে। পানিতে নেমে ফুল তোলার সাহস পাচ্ছি না। এমন সময় ছোট্ট একটা মেয়ে দৌড়ে এলো। জানতে চাইলো ফুল নিতে চাই কি না। আমি মাথা ঝাঁকালাম। মেয়েটা হাত ভর্তি করে শাপলা ফুল তুলে দিলো আমাকে। 

দুহাত ভর্তি ফুল নিয়ে আমি পাশে তাকালাম। 

খানিকটা দূরে একজন দাঁড়িয়ে আছে। সকালের সোনালী রোদ এসে পড়েছে তার মুখের উপর। দূর হতে মুখটা আমার চেনা চেনা লাগছে। লোকটার চেহারা দেখতে রৈনীলের মত। 

একটু একটু করে সে আমার দিকে এগিয়ে আসছে। যতই কাছে আসছে ততই আমি উপলব্ধি করছি রৈনীলের মতো নয়, এটা রৈনীল ই। আশ্চর্য হয়ে শ্বাস নিতেও ভুলে গেলাম আমি।

এত বছর পরে সামনাসামনি রৈনীলকে দেখার পর আমার অনুভূতি কেমন তা কি করে ব্যাখ্যা করব? এই মিশ্র অনুভূতিকে দেবার মতো শব্দ তো আমার ডিকশনারিতে নেই। 

সে কাছাকাছি এসে আমাকে জিজ্ঞেস করলো, সরণী?

আমি মাথা ঝাঁকিয়ে হ্যাঁ বললাম। হাসি ফুটল তার ঠোঁটে। কি আশ্চর্য ব্যাপার! এত বছর পরেও তার চেহারায় খুব একটা পরিবর্তন আসেনি। গায়ের রংটা কিঞ্চিৎ মলিন হয়েছে কেবল। তবে চামড়ায় কোনো ভাঁজ পড়েনি এখনও। আমি বেশ আশ্চর্য হয়ে তাকে দেখছি। 

রৈনীল নিজেও আমার মতো অবাক ভঙ্গিতে এদিক সেদিক তাকাচ্ছে। ফিক করে হেসে জানতে চাইলো, এত বছর পর এই গ্রামে এসে কিনা আমাদের দেখা হলো! তুমি এখানে কি করছো? 

আমি মুচকি হাসলাম। সত্যিই মাঝখানে অনেকগুলো বছর কেটে গেছে। তাই রৈনীল এর সাথে কথা বলতেও আমার কেমন সংকোচ লাগছে। মনে হচ্ছে এর আগে কোনোদিন আমাদের দেখা হয়নি। 

আমি উত্তর দিলাম, আমার জব এখানে। 
- তুমি জব করছো? তাই নাকি? সরণী তাহলে বড় হয়ে গেছে?

কথাটা বলেই হাসলো রৈনীল। আমিও হাসলাম। এরপর আর কোনো কথা নেই। আমি চেয়ে আছি এখনও। 

রৈনীল বললো, আমি এখানে একটা কাজে এসেছি। গতকাল এলাম। তুমি কতদিন ধরে আছো এখানে?
'পনেরো দিনের মতো হবে।'
'বাহ। তুমিও তাহলে নতুন। অনেকদিন পর দেখা হয়ে ভালো লাগলো।'
'আমারও।'

রৈনীলের পিছনে একজন ভদ্রলোক এসে দাঁড়ালো। তাকে দেখিয়ে দিয়ে রৈনীল বললো, আমার বন্ধু ফারহান।
ফারহান আমাকে 'হাই' জানালো। আমিও 'হ্যালো' বলে মৃদু হাসি দিলাম। এরপর রৈনীল স্থির চোখে আমার দিকে তাকালো। আমি উশখুশ করছি। রৈনীলের চোখের দিকে তাকাতে পারছি না। কয়েক সেকেন্ড পর সে বললো, 'তোমার নাম্বার কি আগেরটাই আছে?'
'হুম।'
'ওকে। দেখা হবে।'

আমাকে 'বিদায়' জানিয়ে রৈনীল ও তার বন্ধু রাস্তায় গিয়ে একটা গাড়িতে উঠল। গাড়িতে ওঠার পর জানালা খুলে রৈনীল আমাকে হাত নেড়ে বিদায় জানালো। তার মুখে তখনও লেগে আছে মিষ্টি হাসি। গাড়িটা মুহূর্তেই চোখের আড়াল হয়ে যাওয়ার পরও আমি খানিকক্ষণ স্তব্ধ হয়ে রইলাম। সবকিছু আমার কাছে স্বপ্ন স্বপ্ন লাগছে। হুট করে আশ্চর্যজনক ভাবে রৈনীলের সাথে দেখা হওয়া আবার হঠাৎ করে তার অদৃশ্য হয়ে যাওয়ার বিষয়টা কোনো অর্থেই আমার কাছে বাস্তবিক মনে হচ্ছে না। কিন্তু এই রোদ ঝলমলে দিনে কি আর মানুষ স্বপ্ন দেখে!

পাশে দাঁড়ানো পিচ্চিকে আমি বললাম, ওরা কি গাড়িতে গিয়ে উঠলো? 
পিচ্চি কয়েক সেকেন্ড কি উত্তর দিবে বুঝতে পারছিল না। আমার দিকে ফ্যালফ্যাল করে তাকিয়ে রইল।

আমি আবারো জিজ্ঞেস করলাম, দুইজন মানুষ গাড়িতে গিয়ে উঠল না?
 - জি। গাড়িতেই তো উঠলো। আপনি চোখে দেখেন না?

আমি হেসে বললাম, ভেবেছিলাম শুধু আমি একাই দেখেছি। 
'আপনারে কি এর আগে ভূতে ধরছিল নাকি?'

আমি হেসে ফেললাম। রৈনীলের ভূত আমাকে ধরেছিল বটে। পাঁচ বছর ধরে সেই ভূত ঘাড়ে বয়ে নিয়ে বেড়াচ্ছি! প্রকৃতি কেন আবার আমাদের দেখা করিয়ে দিলো! এবারে কি ভূতটা ঘাড় থেকে নেমে মুক্তি দেবে আমায়?

এই কয়েক বছরে আমি বেশ বদলে গেছি। তবুও অফিসের কাজের ফাঁকে ফাঁকে আমার এই ভেবে ভালো লাগছিল যে রৈনীলের সাথে আবার দেখা হতে পারে। মনে মনে আমি অপেক্ষা করতে লাগলাম তার ফোন কলের জন্য।

সন্ধ্যার পূর্বে সবে মাত্র বাসায় ফিরেছি। আমার আটপৌড়ে ঘরে এখনো প্রথম আলোটা জ্বালাইনি। তার আগেই একটা অপরিচিত নাম্বার থেকে কল এলো। আমি জানি এটাই রৈনীল। আমার ভেতরে বেশ উচ্ছ্বসিত অনুভব করলাম।

অতঃপর বহু বছর পর আমি ফোনের ওপাশ থেকে রৈনীলের কণ্ঠস্বর শুনলাম, হ্যালো.. 

আজ আমার ঘরের বাতি জ্বালাতে ইচ্ছে করলো না। সন্ধ্যার আবছা অন্ধকারের মাঝেই রুমের এক কোনায় ইজি চেয়ারটায় এসে বসলাম আমি। আমার জানালাটা এখনো খোলা। বাইরের সন্ধ্যাকালীন মৃদু আলো এখনো ঘরে প্রবেশ করছে। সেই জানালার দিকে তাকিয়ে থেকে বললাম, আপনি এখনো আগের মতই আছেন। কিচ্ছু বদলায়নি। দেখতেও যেমন একদম আগের মতো, তেমনি আপনার গলার স্বরটাও। 

রৈনীল বলল, তোমার ক্ষেত্রে এর পুরো উল্টো। তোমার চেহারাটাও যেমন অনেকটা বদলে গেছে তেমনি কণ্ঠও। কথা বলার স্টাইল চেঞ্জ হয়েছে। সবকিছুই বদলে গেছে তোমার। 
'এই এক পলকের দেখায় আপনি এত কিছু বুঝে ফেললেন? অবশ্য আপনি তো আবার সবকিছুই বুঝেন। ভুলে গিয়েছিলাম।'
'তোমার কথার ধরন বদলে গেছে।'
'মাঝখানে কত বছর কেটে গেছে বলুন তো?'
'কত? তিন বছর?'
'পাঁচটা বছর পার হয়ে গেছে।'
'সত্যি নাকি! বিশ্বাসই হচ্ছে না।'
'আপনার ওয়াইফ কেমন আছে?'

সে হাসতে হাসতে বলল, আমার ওয়াইফ? আমার ওয়াইফ আছে কে বলছে তোমাকে?
- ওয়াইফ নেই?
- আশ্চর্য! ওয়াইফ কি ভাই বোন থাকার মতো নাকি? এটা আগে থেকে থাকে না। বিয়ে করলে তবেই থাকে। 
- তারমানে আপনি বিয়ে করেননি এখনও। 
- কি করে করব? তুমি যেভাবে আমাকে ফেলে রেখে চলে গেলে..

আমি কয়েক সেকেন্ড আশ্চর্য হয়ে রইলাম। ক্ষনিকের জন্য আমার হৃদপিণ্ড বন্ধ হয়ে আসতে চেয়েছিল। তবে পরক্ষণে বুঝে ফেললাম সে আমার সাথে মশকরা করছে। 

আমি হেসে বললাম, এখন আপনার এসব কথায় সরণী হুট করে প্রেমে পড়বে না। জীবনের অনেকগুলো অধ্যায় আমি পার করে এসেছি। 
'ওয়েল ডান। পরিণত লাইফে আপনাকে স্বাগত।'
'পরিণত লাইফে আমি আরো অনেক আগেই প্রবেশ করেছি।'
'তাই নাকি।? 

আমি বললাম, কি ব্যাপার বলুন তো? আপনি কথায় কথায় এত তাই নাকি, সত্যি নাকি এসব ইউজ করছেন? আগে তো এগুলো কখনো বলতেন না। 
'তাই নাকি?'
'আবারও তাই নাকি?'

রৈনীল শব্দ করে হেসে উঠলো। আমি অবাক হয়ে খেয়াল করলাম রৈনীলের হাসির শব্দও খানিকটা পরিবর্তন হয়েছে। সে এখন মধ্য বয়সী মানুষের মত করে হাসছে। মধ্যবয়সী তাকে বলা যেতেই পারে। এই কয়েক বছরে তার বয়স তো অনেক বেড়েছে। আমি মুচকি হাসলাম। 

বাইরে থেকে আলো আসা বন্ধ হয়ে গেছে। কারণ বাইরেও এখন অন্ধকার। রাত নেমেছে। আমি ফোন কানে ধরেই উঠে হাতরে হাতরে লাইট জ্বালালাম। পাশের রুমে আমার রান্নার জায়গা। আলাদা করে রান্নাঘর নেই। দুই রুমের মধ্যে এক রুমকে আমার বেডরুম বানিয়েছি। আর অন্য একটা রুমে বসার জায়গা ও লাইব্রেরি করব ভেবেছি। সেই রুমেরই এক কোনায় ছোট্ট টেবিলের ওপর স্টোভ রেখেছি রান্নার জন্য। সেখানে এসে আমি চুলা জ্বালালাম। বড্ড চায়ের চেষ্টা পেয়েছে। 

সে জিজ্ঞেস করল, কি করছো তুমি?
চুলা জ্বালিয়েছি। 
কি রান্না করবে? 
চা বানাবো। 
এক কাপ?
জি।
আমার জন্য এক কাপ দাও। 

আমি চমকে উঠলাম। গলার স্বরে বিস্ময় এনে জিজ্ঞেস করলাম, 'আপনি খাবেন? কল্পনায়?'
'আমি তো তোমার আশেপাশেই আছি। তুমি চা বানালে চা ঠাণ্ডা হওয়ার আগেই চলে আসবো।'
'ফ্লার্টিং হচ্ছে নাকি?'
'ছি ছি, তোমার সঙ্গে এটা মানায়?'
'আপনাকে আমি বুঝতে পারি না। ঠিক আছে আমি কিন্তু দুই কাপ চা বানাচ্ছি। আমি এক কাপের বেশি খাবো না। চা যদি ফেলে দিতে হয় তবে আর কোনদিন কথা বলবো না।' 
'বা:রে! সরণী দেখি মানুষকে ট্র‍্যাপে ফেলতে শিখে গেছে।'
'আমার নামে আজেবাজে কথা বলবেন না। চায়ের সঙ্গে আনএক্সপেক্টেড জিনিস মিশিয়ে দিবো।'
'হা হা হা।' 

অনেকক্ষণ শব্দ করে হাসলো রৈনীল। আমিও মুখ টিপে হাসছি। যার শব্দ ওর কানে পৌঁছবে না। সে বললো, 'চা'কে বলো ধীরেধীরে হওয়ার জন্য। আর লোকেশনটা পাঠাও।'

আমি চুলা বন্ধ করে দিলাম। আরেকটু সময় পর চা বানাবো। রৈনীল আসছে! যাঃ এখনো স্বপ্নের মতো লাগছে আমার। কিন্তু আশেপাশে কেউ নেই বলে জিজ্ঞেস করতে পারছি না এটা আদৌ স্বপ্ন কী না।
.
.
.
চলবে.........................................................................

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন

WhatsApp