বজ্রমেঘ - পর্ব ০৪ - ফাবিয়াহ্ মমো - ধারাবাহিক গল্প


থমথমে পরিস্থিতি বিরাজ করছে হাসপাতালে। এ যেন ভয় ঘনানো মুহুর্ত। চোখে সুতীব্র শঙ্কা। বাতাসে দম ফেলার শব্দটাও প্রচণ্ড ভীতিকর শোনাচ্ছে এখন। চোখ তুলে একপলক সামনে চাইল শ্রেষ্ঠা। কথাটা অন্য আঙ্গিকে ভেবে দেখবে কিনা এখনো তার আপন সত্তাটা দ্বিধায় ভুগছে। দুহাত বুকের কাছে ভাঁজ করে তেজস্বি খোলসে স্থির হলো শ্রেষ্ঠা, 

  - আমরা পুরোপুরি এখানে বন্দি সেলিম। এখান থেকে একপাও নড়াচড়া করা যাবে না। ঢাকা হাইওয়েতে অবরোধ কর্মসূচি উত্তাল হয়ে আছে, এটা আমাদের জন্য ঘোর বিপদ বৈ কিছুই নয়। রাস্তা ক্লিয়ার না হলে আমাদের রওনা দেওয়া সম্পূর্ণই বৃথা। আমাদের অতি দ্রুত ফ্যাকাল্টির সাথে যোগাযোগ করতে হবে। জানিয়ে দিতে হবে আমরা এখানে ট্যূর দিতে এসে সমস্যায় পরেছি। 

এসি বন্ধ করা কেবিনের সোফায় বসে আছে রোজা। পড়নে গোলাপি রঙের ঢোলা টিশার্ট, নীচে ধবধবে সাদা প্যান্ট। চুলগুলো কোরিয়ান ড্রামার নায়িকাসুলভ মাঝে সিঁথি কেটে দুদিকে দুটো ঝুটি করা। ঠোঁটে ভিন্ন দেশের ভিন্ন কালচার অনুসরণ করে ফোলা ফোলা ঠোঁটবিশিষ্ট লিপ ওয়েল দেওয়া। আগাগোড়া নিজেকে আধুনিক সজ্জায় পরিশীলিত করে রোজা নিজের বিরক্তি ভরা চোখদুটো শ্রেষ্ঠার দিকে রাখল। মুখের ভাব কিঞ্চিত রাগত চেহারায় পরিবর্তন করে সে বলল, 

  - কিন্তু এখানে আর কতক্ষণ! আর কতক্ষণ এভাবে বেয়াদবি সহ্য করা যায়? হসপিটালের নার্সগুলো এমন বেয়াদব কী বলব আমি! আমার মন চাচ্ছে দুগালে চটাশ চটাশ মেরে আসি। আমার তো এসব সহ্য হচ্ছে না। 

বিপন্ন পরিস্থিতি বুঝতে পেরে ভারি শ্বাস ফেলে শ্রেষ্ঠা। সে নিজেও বিষয়টি সম্পর্ক অবগত। বুকের উপর ভাঁজ করা হাতদুটো শিথিল করে গম্ভীর স্বরে বলল, 

  - একজন নার্স বাদে কেউ অভদ্রতা করেনি। বেশি বাজে বকিস না। বাকি নার্সগুলো যথেষ্ট ভদ্র এবং শালীন। নার্স মানে সেবিকা। কিন্তু সেবিকার চেহারায় সবাই যে সেবক হবে এটা ভেবে নিচ্ছিস কী জন্যে? 

দলের সাতজন এখন উপস্থিত হয়েছে কেবিনের ভেতর। কেবিনের দরজা ভেতর থেকে চাপানো। ডক্টর রেজার সর্বশেষ তথ্যমতে এখন সবকিছু স্বাভাবিক রয়েছে। তবে ক্যান্টিন থেকে খেয়ে আসার পর দুটো বিচ্ছিন্ন ঘটনা ঘটে গেছে। শাওলিন মুখে পানি ছিঁটা দেবার জন্য কয়েক মিনিটের জন্য কেবিনের অ্যাটাচড্ বাথরুমে গিয়েছিল। বলা বাহুল্য, এখন কিছুটা সুস্থ বলে কারো সাহায্যের জন্য তেমন হাঁক ডাক দিচ্ছে না। বাথরুম থেকে বেরুবার পর বাসায় যোগাযোগ করার জন্য ফোন বের করে। আশ্চর্যজনক ব্যাপার হলো, ব্যাগের চেইনটা ছিল সম্পূর্ণ খোলা। অথচ, চেতনা ফেরার পর সকালে যখন ব্যাগটা ধরেছিল, সেটা ছিল সম্পূর্ণ চেইনে আবদ্ধ। বিষয়টা চরম রহস্যজনক! ব্যাগের চেইন কেন খোলা থাকবে? এবং কী জন্যে? হাসপাতালের মতো সেবাদান প্রতিষ্ঠানে এরকম অদ্ভুত ঘটনা খুব কমই দেখেছে শাওলিন। কিন্তু এখনো বুঝতে পারছে না ওর ব্যাগের ভেতর আদৌ কিছু খোয়া গেছে কিনা। অন্যদিকে, সোহানার ওপর দায়িত্ব ছিল নাযীফের ব্যাগ-প্যাকটা দেখে রাখা। কিছুক্ষণ পূর্বে জানা গেছে সেই ব্যাগপ্যাক শুদ্ধো সোহানার ছোটো ব্যাগটাও গায়েব। সোহানার মতো অত্যন্ত দায়িত্বশীল মেয়ের কাছ থেকে ব্যাগ হারাবে—এটা বিশ্বাস করা অসম্ভব। ব্যাগপ্যাকের সমস্ত ভার নিজের উপর বুঝে নেওয়ার পর থেকে এক মুহুর্তও কাছ ছাড়া করেনি সে। অথচ, মাত্র কয়েক মুহুর্তের জন্য এক কাপ কফি আনতে গিয়ে সব সেখানে উধাও! সোহানা আতঙ্কিত চেহারায় চুপ করে গেলেও বাইরে থেকে প্রকাশ করল না। ওর স্পষ্ট মনে আছে কফি আনার জন্য পাঁচ মিনিটের বেশি সময় খরচ করেনি। মাত্র পাঁচটে মিনিট! কেবিনের ডানদিকে সোফার স্থানে বসে আছে রোজা ও সোহানা। শাওলিনের বেড সংলগ্ন ডানপাশে টুল টেনে বসেছে নাযীফ। নাযীফ ইচ্ছে করেই কাছেপিঠে বসতে দেয়নি সেলিমকে। চাপা ক্ষোভে দাঁত কটমট করে কেবিনের বাঁদিকে থাকা জানালার কাছে গেছে সেলিম। পিঠটা জানালার গ্রিলে হেলান দিয়ে সরাসরি তাকিয়ে আছে ওদের মুখো। শ্রেষ্ঠা বুকে হাত ভাঁজ করে গম্ভীর পায়ে সারা কেবিনময় পায়চারি করছিল। পায়চারি করতে করতে সে আবার বলল, 

  - আমাদের এই হাসপাতাল ছেড়ে বেরুতে হবে। অতি দ্রুত এবং ফটাফট। আমি চাই তোরা সবকটা সতর্ক অবস্থানে থাকবি। আমার মনে হচ্ছে এখানকার কোনো ঝামেলা আমাদের উপর বর্তে যাচ্ছে; যেটা সম্বন্ধে আমাদের কোনো ধারণা নেই। রাফান আর পার্থ স্যার আদৌ এ বিষয়ে কিছু জানেন কিনা তাও জানি না। কিন্তু এখানে থাকা অবস্থায় উনাদের কাছে এই ব্যাপারে আলাপ করা যাবে না। আমাদের বেরুতে হবে। এক কাজ কর—

কথাটা বলেই পায়চারি থামাল শ্রেষ্ঠা। চোখ তুলে সেলিমের দিকে দৃকপাত করে বলল, 

  - তুই পরিবেশ পরিস্থিতি বুঝে থাকার জায়গা বুক কর। একটা হোটেল বা রেসোর্ট, যেটাই এখন অ্যাভেইঅ্যাবেল দেখবি, সেটাই কনফার্ম করে দে। বিশেষ করে, এমন জায়গা পছন্দ করবি, যেখানে আশপাশে বাড়তি এক্সিটের সুযোগ থাকবে। কথা বুঝতে পেরেছিস? 

মুখের ভাব-গম্ভীর ছাপ দৃঢ় করে সম্মতি জানায় সেলিম। একপলক বেডে আধশোয়া মানুষটির দিকে চোখ ঘুরিয়ে পুনরায় শ্রেষ্ঠার দিকে ফিরল, 

  - আমার সোর্স খাটিয়ে পার্ফেক্ট রেসোর্ট ঠিকই বুক করতে পারব। কিন্তু গতবারের মতো এবার কেউ ফাঁকা রিকোয়েস্ট করলে তা আমি শুনব না। সে যত ছলচাতুরি, রঙ তামাশা করুক না কেন— যেটা আমি কনফার্ম করব সেটাই মানতে হবে। 

কথাগুলো কাকে, কেন, কী ইঙ্গিত করে বলা হল, তা বুঝতে পেরেছে সবাই। একপলকের জন্য চোখের দৃষ্টি সবারই শাওলিনের দিকে পড়ল। শাওলিন নির্বিকার। শান্ত। হাতের মুঠোয় সেলফোনটা নিয়ে এখন ব্যস্ত মণির নাম্বারে সুস্থতার ম্যাসেজ পাঠাতে। কথাগুলো শোনার পর দু সেকেণ্ডের নীরবতা। এরপর গলা খাঁকারি দিয়ে হালকা কাশতে কাশতে পরিস্থিতি স্বাভাবিক করল জিদান, 

  - ঠিকআছে। সেলিম যা বলছে তা-ই করা হবে। তবে একটা কথা, এই মুহুর্তে কেউ এমন কথা বলবি না যেটা শুনে মাথার তার ছিঁড়ে যাবে। বিশেষ করে, সেলিম আর নাযীফ একদম ভদ্রভাবে চলবি। গতকাল ওই ফরেস্টার লোকটা কিছুই তোদের বলেনি। রাফান সাহেবের ভুল ছিল বলে উনি স্রেফ চুপ করে গিয়েছেন। কিন্তু হসপিটালের প্রত্যেকটা লোক ওই ব্যক্তিকে যমের মতো ভয় পায়। ওয়ার্ড বয়ের কাছ থেকে যা শুনলাম, তাতে মনে হয়েছে এখানকার লোকজন ওই লোকটাকে প্রচুর মান্য করে। প্রচুর মান্য বলতে লেভেলটা অন্য পর্যায়ের। উনার কথার উপর পাল্টা কথা কেউ বলেন না। এখানকার পলিসিগুলো আগে বেশ করাপ্ট ছিল; কিন্তু বিগত ক'বছরের মধ্যে পুরো চেহারাই বদলে ফেলেছে ওই লোক! এজন্য তোদের বলছি খুব সাবধান। শহরের মতো ফচকেমি এখানে করিস না। যত্রতত্র রুলস ভাঙলে খেসারতটা চরমভাবে দিতে হবে। এখানকার পলিসি আর ঢাকার পলিসি পুরো ভিন্ন চিত্র।

নতুন ঘটনার আর্বিভাব দেখে সবার কপালেই কুঞ্চন রেখা পড়ল। পড়ল না শুধু একজনের কপালে। সে ফোন ছেড়ে জিদানের দিকে কৌতুহলি চোখে তাকিয়ে রয়েছে। আস্তে আস্তে বুকের হাতদুটো শিথিল করে কপালে খাঁজ ফেলল সেলিম, 

  - অদ্ভুত। একজন সাধারণ ফরেস্টার এমন স্ট্রিক্ট পলিসি ম্যানটেইন কীভাবে করে? তাও এমন জঙ্গলী জায়গায়? ক্যারেক্টার কেমন এই শালার? 

আকস্মিক ওমন মুখ খারাপ দেখে প্রচণ্ড বিরক্ত হয় শাওলিন। কথার কথায় ওরকম বাজে শব্দ ব্যবহার একদমই পছন্দ নয়। বাকিরা হেসে খেলে ব্যাপারটা উড়িয়ে দিলেও শাওলিন ছবকটা দিয়েই ছাড়ল। ফোনটা পাশে রাখল ও। কণ্ঠস্বর শান্ত পর্যায়ে রেখে বলে উঠল, 

  - কথাটা ভদ্র ভাষায় উচ্চারণ করা যেতো। বাক্যের ভেতরে দু চারটা নোংরা শব্দ জুড়ে দিলে কেউ প্রধানমন্ত্রীর নীচের পদটা লিখে দেবে না। 

উত্তপ্ত এক পরিস্থিতির ভেতরে ফিক করে হেসে দিয়েছে শ্রেষ্ঠা। ঠোঁটের ওপর ঠোঁট চেপে জোর হাসি আঁটকাচ্ছে বাকিরা। সেলিমের মতো গোঁয়ার্তুমি ইতরকে একমাত্র শাওলিনই শুদ্ধ জবানে শায়েস্তা করতে পারে। আর করেছেও। সারাক্ষণ যেই ব্যক্তি রাজনীতি নিয়ে আদর্শ কপচায়, তার জন্য ওই ধরণের অপমানই ঠিক। এই ট্যূরে আসার পর থেকে তেমন সুবিধে করতে পারেনি সেলিম। তার উপর নাকের পাতাদুটো রোষ-হুংকারে ফুলিয়ে উঠতেই নাযীফ মাঝখান থেকে বাঁধা দিয়ে বলল, 

  - নাকের ফুলানি বন্ধ করে তুই প্লিজ দূরে গিয়ে বস। জিদানের কথা শেষ করতে দে। জিদান? সময় নেই। লম্বা বয়ান শোনা সম্ভব নয়। ঝটপট কথা শেষ কর। 

জিদান কথার ফুলঝুঁড়িতে ঢাকনা বসিয়ে শেষ দুটো কথা ছেড়ে বলল, 

  - এখানকার স্থানীয় মানুষদের বিরক্ত করবি না। এটা আমাকে রাফান সাহেব গতকালই কড়া জবানে বলে দিয়েছে। ক্ষতি বা বিরক্ত— খুব সাবধান। বিশেষ করে স্থানীয় মেয়েদের কোনো ক্ষতি হলে কলজে উঠিয়ে ফেলবে। 

শেষ কথাটা বলার সময় আড়দৃষ্টি রাখল সেলিমের দিকে। সেলিম তখন জানালার কাছ ঘেঁষে বাইরে তাকিয়ে আছে। জিন্সের ডান পকেটে হাত ঢুকিয়ে বের করছে সিগারেটের প্যাকেট। অন্যহাতে চকচকে পিতল রঙা ছোট্ট লাইটার। বাকিরা জিদানের কথা শুনে ততক্ষণে নিজের কাজে ছুটে গেছে। অতি সত্বর এই হাসপাতাল থেকে বেরুতে হবে। 


আধঘণ্টার ভেতর সমস্ত ফর্মালিটি সম্পণ্ণ করে গাড়ির কাছে উপস্থিত হলো সবাই। সুবিশাল হাসপাতাল চত্বরে দাঁড়িয়ে আছে দুটো গাড়ি। পার্থ ওদের গাড়িটা মালপত্র সহ এনে দিয়েছে। নিজেদের দায়িত্ব সমাপন করে এবার নিজ গন্তব্যে ফেরার পালা রাফান ও পার্থর। রাফান নিজের গাড়িটার সাথে হেলান দিয়ে বুকে হাত ভাঁজ করে দাঁড়িয়ে আছে। কপালে এখনো কোঁচকানো ভাব। চোখে এখনো রাগে ভস্ম করা ছাপ। সেলিমের গাড়িটার সামনে এসে ওদের উদ্দেশ্য বলল পার্থ, 

  - শোয়েব স্যার আজ আসবেন না। তিনি গুরুত্বপূর্ণ মিটিংয়ে আঁটকা পরেছেন। এ যাত্রায় আপনাদের সঙ্গে বোধহয় দেখা হচ্ছে না। তবে আপনাদের জন্য পর্যাপ্ত সহযোগিতা তিনি সুনিশ্চিত করেছেন। আমরাও তার পক্ষ থেকে চেষ্টা করেছি আপনাদের বন্ধু যথার্থ সেবা পাক। আজ তবে এখানেই। ভালো থাকবেন আপনারা। যাত্রা শুভ হোক। 

  - যাত্রা শুভ হোক! 

পার্থর কথার প্রত্যুত্তরে ওরা সবাই একসঙ্গে বলে উঠল। প্রত্যেকের চোখে-মুখে কৃতজ্ঞতার হাসি ফুটে উঠলেও অদূরে দাঁড়ানো রাফানের দিকে তাকাতেই চোখমুখ শক্ত হলো। ওই রাগী, খচ্চর, ইতরটার দিকে তাকিয়ে শ্রেষ্ঠার মুখ আগুনে ঝলসে উঠে। কীরকম ষাঁড়ের মতো মুখটা করে আছে! অসহ্য লোক! আর কিছু না বলে পার্থকে ধন্যবাদ জানিয়ে গাড়িতে উঠে পড়ল শ্রেষ্ঠা। বিদায় জানিয়ে কয়েক সেকেণ্ডের মধ্যেই স্থির বাহনটা সশব্দে ধূলো উড়িয়ে জায়গাটা ত্যাগ করল। গাড়িটা দৃষ্টিসীমানার বাইরে চলে যেতেই রাফানের গাড়ির কাছে ফিরে আসে পার্থ। রাফানকে তখনো দেখল দৃঢ়প্রতিজ্ঞ স্থির। ভ্রুঁদুটো সেভাবেই কোঁচকানো। চোখে আকাশ সম দ্বিধা। কী যেন ভাবছে মনে মনে। কিন্তু সেটা কী? পার্থ ড্রাইভিং সিটে বসতে বসতে রাফানের উদ্দেশ্যে বলল, 

  - দাঁড়িয়ে কী ভাবছিস? যাবার ইচ্ছে নেই নাকি?

রাফান বুকের কাছ থেকে বাঁহাত খুলে কবজির ঘড়িতে তাকায়। সকাল দশটা বেজে চল্লিশ মিনিট। মুখটা তুলে আকাশপানে চাইল। সূর্য ঢেকে গেছে। ঘনঘটা মেঘের কালো স্তুপ জমা হচ্ছে ধীরে ধীরে। মনে কীসের যেন খচখচানি অনুভব করছে রাফান। এই দলটার উপর গতকাল মারণ চক্ষু পরেছিল, সেটা কী রাতারাতি গায়েব হবার কথা? এমনি এমনিই পথ ছেড়ে দিবে ওই রহস্যময় গাড়ি? যদি এদের উপর ভয়ংকরভাবে হামলা করে বসে তখন? ঠোঁটের বাঁকোণে দাঁত বসাল রাফান। স্যারকে একটা কল দিবে? যদিও এই মুহুর্তে প্রচণ্ড ব্যস্ত আছেন তিনি। বড় পর্যায়ের কিছু ব্যক্তিবর্গের সাথে গোল-টেবিলে শলা পরামর্শ চলছে। মুখ তুলে পুনরায় আকাশ দেখল রাফান। অতি দ্রুত জংলী কালো মেঘে আকাশ ছেয়ে যাচ্ছে। বারবার মনে হচ্ছিল ওদের ভেতর কোনো সমস্যা হয়েছে, যা ওরা বলেনি। কিন্তু কেন, কী জন্য বলেনি? হঠাৎ বিদ্যুৎ চমকের মতো খেলে গেল প্রশ্নটা। চট করে মাথা পিছু ঘুরাতেই পার্থর দিকে চ্যাঁচালো রাফান, 

  - স্যারের ব্রেক টাইম কখন? কয়টার দিকে পরেছে! এক্ষুণি পার্থ। দেরি নয়! 


জানালা সংলগ্ন সিটে বসে আছে শাওলিন। চোখের সামনে বন-প্রকৃতির উদার দৃশ্যপট। আকাশের সূর্যপিণ্ডটা মেঘের কালো ঘোমটায় মুখ লুকিয়েছে। গাড়িটা ছুটার পর আর দেখা নেই সূর্যের। হুঁ হুঁ করে ছুটে আসা সতেজ পাতার ঘ্রাণে মন-ইন্দ্রিয় কেমন আনচান করে ওঠে। বুকের ভেতরটা শিরশির কাঁপনে রোমাঞ্চ অনুভব হয়। কোলের উপর রাখা টোট-ব্যাগটা আরো আঁটো করে দুহাতে ধরল শাওলিন। মাথাটা বাঁ'কাত করে বাঁদিকের জানালামুখো হাওয়ায় চোখ বুজে নেয়। প্রতিটি নিঃশ্বাসে নিঃশ্বাসে যেন আল্লাহ প্রদত্ত শান্তির বায়ু অন্তর শীতল করে দিচ্ছে। সেই শীতল স্পর্শ প্রতিটি কোণকে ছুঁয়ে দিয়ে বলছে, থেকে যাও শাওলিন। মনকে স্থির কর। তুমি যে তোমার নামের মতো সবুজ বনে এসেছ! যেখানে তুমি চোখ জুড়োনো শীতলতায় নরম সুখ খুঁজে পাচ্ছ। যেখানে পাচ্ছ বন্য ফুলের মন মাতাল করা সুগন্ধি মিঠে সুভাস। এখানে ক্লান্তি শেষে আরাম জড়ানো ঘুম রয়েছে। যে ঘুম শান্তি মেশানো, মোহ জাগানো, নেশা জড়ানো। তারপর ধরো, আকাশ ভেঙে ফোঁটায় ফোঁটায় প্রখর বৃষ্টি নামল। ভেজা মাটিতে পাদুটো ফেলে তুমি চলে এসো পাহাড়ে। বৃষ্টি ভেজা পাহাড় চূড়োয়! যেখানে আছে অপার্থিব সৌন্দর্যের শান্ত সম্মোহন। হঠাৎ মনের পর্দায় বৃদ্ধ রেজার অমায়িক হাসি ফুটে উঠল। কী অমায়িক সুন্দর আচরণ! হাতের একটি শিরায় সূঁই ঢুকিয়ে দিলে তেমনি হাসিসুলভ মুখে বললেন বৃদ্ধ, 

  - যার নাম তুমি নিয়েছ, পুরো পার্বত্যাঞ্চল তারই তদারকিতে থাকে। খুব বেশি অসুস্থ থাকায় তেমন কিছু জানার সুযোগ পাওনি তুমি। তোমার বন্ধুরা যেই নিষিদ্ধ জায়গায় ঢুকে পরেছিল, ওটা ফরেস্ট ডিভিশন সহ বেশ কিছু অফিসার্সদের বাসস্থান। প্রায় বহু বছর পর কেউ ওখানে নিয়ম ভঙ্গ করে ঢুকেছে। তবে ভাগ্য ভালো, [অব.] কর্ণেল গুলজার আজিজ সেদিন উপস্থিত থাকায় তেমন দূর্যোগ বয়ে যায়নি। নয়তো কী রকম চূড়ান্ত শাস্তি বহাল করা হতো, তা কল্পনা করা কষ্টকর। 

হাতে ইনজেকশনের ব্যথাটুকু সহন করে চোখ খুলল শাওলিন। অভিজ্ঞ ডাক্তার রেজাউল করিম বেশ সহজ শব্দে প্রতিটি বিষয় বুঝিয়ে বললেন। সঙ্গে এও বললেন, এই সুনিবিড় শান্ত বনাঞ্চল যতটা শান্তিপ্রিয় দেখাচ্ছে, তাকে শান্ত ও প্রিয় বানাতে প্রচুর কসরত পোহাতে হয়েছে। কাজটা যত সহজ ও সরল মনে হচ্ছে, ততটাই ছিল আক্রমণাত্মক এবং হিংস্র। এখানে বিধিনিষেধ মানতে হয়। নিয়ম অনুসরণ করতে হয়। কোথায় কতটুকু বিচরণের অনুমতি আছে তাতেও সতর্ক দৃষ্টি ফেলতে হয়। সমস্ত কথা কর্ণগোচরে শোনার পর ভীষণ আগ্রহ জেগেছে ওর। এই অপার সৌন্দর্যে ঘেরা বনভূমিকে দেখভালের জন্য যে মানুষটি অতোখানি তৎপর, তাকে একনজর নিজের চক্ষুতে দেখার। এই দেখাটা লোভ, আকর্ষণ, অর্থপূর্ণ ব্যাপার থেকে নয়; বরঞ্চ শ্রদ্ধার নজর থেকে সামান্য কৌতুহল। হঠাৎ ডানপাশ থেকে কনুই নাড়া দিয়ে কে যেন ফিসফিস করে উঠল, 

  - জানা . . 

দুচোখ বোজা শাওলিন আলতো সুরে বলল, 

  - হুঁ। 

  - চোখ খোল, জানা! একবার সামনে দ্যাখ! 

কণ্ঠের তীব্র উত্তেজনায় বন্ধ চোখের পাতা মেলে তাকিয়েছে শাওলিন। ভীষণ আশ্চর্য নেত্রে অবাক হয়ে দেখল সামনে অপূর্ব এক দৃশ্যপট! দূরবর্তী ওই পাহাড়ের মাথায় কালো মেঘের মুকুট! যেন রাজকীয় চেহারায় প্রকৃতিকে জানান দিয়ে অভিষেক ঘটছে তার। কী সুন্দর . . কী মনোরম . . কী হৃদয় দোলানো রূপ! ঠোঁটের চর্তুদিকে হাসির ঝিলিক ফুটে উঠতেই পাশ থেকে হেসে বলল সোহানা, 

  - সুন্দর না? 

সম্মোহনের মতো অভিভূত কণ্ঠে বলল শাওলিন। চোখে ওর উপচে পড়া খুশির ঝিলিক, 

  - সুন্দরের চেয়েও অসম্ভব সুন্দর। 

কথার ভঙ্গিমা দেখে খিলখিল করে হেসে দেয় সোহানা। গাড়িতে বাকিরা অনুপম রায়ের 'এখন অনেক রাত' গানটা গলা ছেড়ে গাইছে। গানের প্রতিটি পঙতি প্রত্যেকের কণ্ঠে মিলেমিশে যেন একাকার। শাওলিন শুনতে পাচ্ছে ওদের সমজোট সুর,

এখন অনেক রাত . . 
তোমার কাঁধে আমার নিঃশ্বাস 
আমি বেঁচে আছি তোমার ভালোবাসায় . . 

ছুঁয়ে দিলে হাত, 
আমার বৃদ্ধ বুকে তোমার মাথা
চেপে ধরে টলছি কেমন নেশায় . . 

গান মুখর, সৌন্দর্য মুখর, বৃষ্টি আসি আসি মুহুর্তে সবকিছু কেমন স্বপ্নের মতো বদলে গেছে। এই প্রথম ওদের গান নির্বাচনে মুগ্ধ হয়েছে শাওলিন। বাংলা গানের মনোমুগ্ধকর সুরে ডুবো ডুবো হয়েছে মন। শাওলিন ব্যাগের চেইন খুলে ধীরে ধীরে বের করল ডায়েরি। জীবনের আঠারোতম বসন্তের শেষ চিহ্ন এটি। যার হাত দিয়ে এটি পেয়েছিল, আজ সেও জীবন-মৃত্যুর সন্ধিক্ষণে যুঝছে। ওই মেঘ-মুকুটের মতো সেও একদিন সমস্ত আয়োজন শেষে হারিয়ে যাবে। আর ফিরবে না। খোলা জানালা দিয়ে ছুটে আসা একছুট ভেজা বাতাস ঝরিয়ে দিল বাঁ চোখের বিন্দু। সবার অলক্ষ্যে দ্রুত বাঁ হাতের উল্টো পিঠে মুছে নিল চোখ। ডায়েরির দিকে ভ্রুঁক্ষেপ করতেই হঠাৎ চরম আশ্চর্যে চমকে উঠে! এটা কী . . কী করে . . কীভাবে সম্ভব? ঢোক গিলল শাওলিন। ডান হাত এগিয়ে ডায়েরির বাঁকোণাটা স্পর্শ করল। শুকিয়ে গেছে। ডায়েরির বাঁ কোণজুড়ে শুকনো রক্তের ছোপ। কেউ কাটা হাত দিয়ে এটা স্পর্শ করেছে। কিন্তু কে করেছে? নার্স, ডাক্তার, অন্য কেউ? ওদের দলের ভেতরে কারুর হাতে ক্ষত নেই। কাজটা কার দ্বারা ঘটল? প্রশ্ন, শঙ্কা, দ্বিধার স্রোতে শাওলিন বাকরুদ্ধ। এমন সময় আকস্মিক গতিতে সজোড়ে ব্রেক কষে নাযীফ। তার অতর্কিত কাণ্ডে সবাই বিস্ময়-বিমূঢ়! নাযীফের উপর চরম খেপে গিয়ে ধমক ছুঁড়বে জিদান, এমন সময় চোখ স্থির হলো সামনের দিকে। প্রথমে চোখ খাটো করল, কী যেন দেখল, এরপরই বিস্ফোরণ ঘটানোর মতো চ্যাঁচিয়ে উঠল সে, 

  - হলি শি° ! উনি শোয়েব ফারশাদ না? 

সামনে বসা সেলিম ঢোক গিলে একবার। খুব সাবধানে কণ্ঠের ভীরুতা গোপন করে বলল, 

  - হ্য..হ্যাঁ . . উনিই। 

ড্রাইভিং সিটে বসে এখনো স্টিয়ারিং ধরে আছে নাযীফ। অকস্মাৎ এমন ঘটনায় ভড়কে গেছে সে। কপালের ডানপাশ দিয়ে ঘামের চিকন রেখা ফুটে উঠেছে। এমন সময় বিকট রিংটোনে গাড়ির মুহুর্মুহু নীরবতা খণ্ডবিখণ্ড হয়। সন্ধানি দৃষ্টিজোড়া ঘুরতে ঘুরতে অতঃপর থামে নাযীফের দিকে। নাযীফ স্টিয়ারিং থেকে বাঁহাত নামিয়ে প্যান্টের পকেটে চালান দিয়েছে। ক্রমাগত বাজতে থাকা ফোনটা শান্ত করে কানে ধরল নাযীফ। ভয় জড়ানো চোখদুটো সামনে স্থির রেখে মৃদু কণ্ঠে বলল, 

  - হ্যালো . .  

ওপাশের কণ্ঠস্বর কিছু শোনা গেল না। নাযীফকে কী বলা হচ্ছে তাও নয়। তবে সামনে বসার বদৌলতে ব্যাপারটা দেখতে পেয়েছে সেলিম। একশো গজ সামনে দাঁড়িয়ে আছে জীপটি। রঙ কালচের কাছাকাছি গাঢ় সবুজ। জীপের মাথায় হুড নেই। হুড না থাকার ফলে তীব্র বাতাসে লোকটার নরম চুল উড়ছে। ডানহাতের মজবুত মুষ্টিতে স্টিয়ারিং ধরা। বাঁহাত কানের কাছে ফোন চেপে ধরেছে। গড়ণে আসমানি রঙা টান টান শার্ট। কবজির কাফড্ বাটন খুলে গুটিয়ে গুটিয়ে শার্টের স্লিভটা কনুইয়ের একটু আগে ভাঁজ করা। প্রশস্ত হাতের উপর ঘামের আস্তরণ থাকায় ভয়ংকর দেখাচ্ছে। অতো দূর থেকে বাকিরা তেমন স্পষ্ট না দেখলেও চুপ হয়ে থাকল সেলিম। নাযীফ শুধু ফোন চেপে একের পর এক বলে যাচ্ছে, 

  - জ্বী। . . সাতজন স্যার। . . আমাদের উপর? না, রাস্তা স্বাভাবিক ছিল। . . আচ্ছা। আচ্ছা তবে ঠিকআছে। লোকেশন এবং অ্যাড্রেস শ্রেষ্ঠা আপনাকে পাঠিয়ে দিচ্ছে। ওকে। 

কান থেকে ফোন নামিয়ে ঝাড়া ক'মিনিট শ্বাস নিল নাযীফ। মনে হচ্ছিল, এতোক্ষণ সে কট্টর এক ইন্টারভিউ দিয়ে যাচ্ছিল। চোখ খুলে পাশে তাকাতেই ক'জোড়া প্রশ্ন-বিহ্বল চক্ষু দেখতে পায় সে। পরিস্থিতি সুবিধাজনক করতেই প্রাণখোলা হাসিটা ছুঁড়ে দিল নাযীফ, 

  - তেমন কিছু না। শোয়েব স্যার রেসোর্ট পর্যন্ত আমাদের পৌঁছে দিতে এসেছেন। উনার মিটিং কিছুক্ষণ আগে শেষ হয়েছে। যদি মাঝ রাস্তায় কোনো বিপদ হয়ে থাকে . . বলা তো যায় না। তাই আরকি —

সবার উদ্দেশ্যে বলে চললেও নাযীফের দিকে মনোযোগ নেই শাওলিনের। এখনো দুহাতে ধরে রয়েছে ডায়েরিটা। দুচোখ ওর সামনের দিকে। অতো দূর থেকে যদিও কিছু সুস্পষ্ট নয়; তবু ওর মনে হচ্ছে তাঁর বাঁহাতে সাদা কিছু মোড়ানো। ঠিক যেন সাদা ব্যাণ্ডেজের মতো . . . 
.
.
.
চলবে..................................................

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন