“আপনি কি হাসান মাহবুবের বই পড়তে পছন্দ করেন?"
আচমকাই হাসান মাহবুব সম্পর্কের একটি বার্তা মেসেজে দেখতেই খানিকটা ভড়কে গেল শান্ত। সরাসরি চাইল তখন অরিনের দিকে। অরিন আবার লিখল, “না মানে আপনার সামনে ওনার বই রাখা।”
এতক্ষণ পর শান্তর মনে পড়ল তার নিজের লেখা বইটার কথা। সে লিখল,
“ওহ! হুম, আমি ওনার বই পছন্দ করি। শুধু ওনার নয় এছাড়াও বড় বড় লেখক, হুমায়ুন আহমেদ, রবীন্দ্রনাথ, কাজী নজরুল ইসলাম, সমরেশ মজুমদার, জহির রায়হান সহ আরো অনেকের বই আমার পছন্দ।”
“ওহ আপনি বইপ্রেমিক তাই তো?”
“কিছুটা বলা যায়।”
“আমিও হাসান মাহবুবের বই পড়ি। আমি আর ফাবিহা দুজনেই ওনার অনেক বড় ফ্যান। কখনো লোকটাকে না দেখলেও আমি অজানা কারণে তার প্রতি একটা টান অনুভব করি। লোকটা যে কেন সবার সামনে আসে না কে জানে?"
লেখা পড়ে শান্ত কি লিখবে বুঝতে পারছে না। আচ্ছা সে কি বলে দিবে— আমিই হাসান মাহবুব। বলা হলো না। শুকনো হেঁসে জানাল,
“লোকটা হয়তো আড়ালে থাকতে পছন্দ করে।”
“হতে পারে। তবুও এত বড় লেখক কেন সবার সামনে আসে না। আমার সাথে কোনোদিন সাক্ষাৎ হলে আমি নিশ্চয়ই জিজ্ঞেস করব, কেন জনসম্মুখে আসেন না।”
শান্ত এই প্রসঙ্গে আর কিছু লিখল না। অন্যকিছু লিখল, “আপনি এখানে এসেছেন অনেকক্ষণ হয়েছে আইথিংক এবার আপনার যাওয়া উচিত।”
অরিন মেসেজ পেয়ে হাসল। বলল,
“তাড়িয়ে দিচ্ছেন নাকি?”
সঙ্গে সঙ্গে উত্তর এলো,
“বলা যায়।”
অদ্ভুত দৃষ্টি নিয়ে তাকাল অরিন। কি খারাপ লোক! মুখের ওপর বলে দিল তাড়িয়ে দিচ্ছে।
••••••••••••••
প্রকৃতিতে তখন নিভু নিভু অন্ধকার নামছে। তবে আকাশটা বেশ পরিষ্কার। আরহান ছুটে এসে দাঁড়াল পুরান ঢাকার একটা দশতলা বিল্ডিংয়ের সামনে। তার সমস্ত শরীর ঘেমে নেয়ে একাকার। আজ একটা বিহিত না করলেই নয়। আরহানেরই ভুল হয়েছে শুরু থেকে মেয়েটাকে যদি ঝাঁঝাল গলায় কিছু শোনানো যেত তবে বোধহয় আজ রেডিওতে এত লোকের সামনে এভাবে কথা বলতো না। আরহান ফোন করল। সেকেন্ডের মাথায় কল রিসিভ হলো। আরহান গম্ভীর কণ্ঠে বলল,
“কোথায় আছেন?”
অপরপাশের ব্যক্তিটি তখন খুশিতে আত্মহারা। সে বলল, “তুমি এসেছ আরহান?”
খিঁচে চোখ বন্ধ করে নিলো আরহান। রাগে তার সর্বাঙ্গ জ্বলছে। আরহান নিজেকে ধাতস্থ করার চেষ্টা করল। আবারও জিজ্ঞেস করল,
“কোথায় আছেন?”
ছোট্ট উত্তর, “ছাদে।”
কল কেটে গেল। আরহান তড়িৎ বিল্ডিংয়ের ভিতরে ঢুকে লিফটে চড়ে দাঁড়াল। মেয়েটার নাম বিথী। আরহানরা এর আগে যে বাড়িতে ভাড়া থাকত সেই বাড়ির বাড়িওয়ালার মেয়ে। মেয়েটা আরহানকে প্রথম যেদিন দেখেছিল সেদিন থেকে পছন্দ করে। ভালোবাসে বলা যায়। কিন্তু আরহান বাসে না। সে সেইরকম কোনো টান অনুভব করে না বিথীর ওপর। সে তো কখনো ওই নজরে তাকাইনি বিথীর দিকে। এই ভালোবাসা-বাসির ব্যাপারটা বিথীর বাবা জেনে যান মাস খানেকের মাথাতেই। যেদিন শোনেন সেদিনই আরহানদের বাড়ি ছেড়ে বের হয়ে যেতে বলেন। আরহান শুরুতে এসব জানত না। ওই দিনই জানে। তবে বিথীর বিহেভিয়ার সে বুঝত। যে বোঝাত। কিন্তু মেয়েটা বুঝতে নারাজ। বিথীর বাবা নানারকম অপমানজনক কথা শোনায় আরহানকে। আরহান বিনিময়ে কিছু বলে না। নিঃশব্দে বাসা ছেড়ে আসে। কিন্তু তাতেও ক্ষ্যান্ত হয় না বিথী। প্রায় ফোন করে আরহানকে, আরহান কতবার নিজের নাম্বার বদলেছে কিন্তু তবুও বিথী জেনে যেত। কিভাবে জানত আরহানের কাছে আজও অজানা। মোটামুটি সবই ঠিক ছিল। আরহান সেইভাবে কখনো ঝাঁঝাল গলায় কথা বলেনি বিথীর সাথে। সে শান্ত মনে বার বার বুঝিয়েছে। কিন্তু আজ, আজ সহ্যেরসীমা অতিক্রম করে ফেলেছে আরহান। এই মেয়ে তার ক্যারিয়ারে দাগ লাগাতে চাচ্ছে। এটা তো কিছুতেই আরহান মেনে নিবে না।
প্রকৃতিতে নিস্তব্ধ এক বাতাস ছুটছে। ছাঁদের এক কিনারায় রেলিংয়ের ওপর চুপচাপ বসে আছে বিথী। পরনে টপস আর প্লাজু। চুলগুলো খোলা। বাতাসে উড়ছে। তার মন খারাপ! বড্ডই মন খারাপ। আরহান তখন ঢুকল ছাঁদের ভিতর। উচ্চ আওয়াজে ডাকল, “বিথী।”
বিথীর ভাঙা মন সঙ্গে সঙ্গে সতেজ হয়ে উঠল। সে উল্লাসিত এক নজরে পিছন ফিরে তাকাল। রেলিং থেকে নেমে আবেগে আপ্লূত কণ্ঠে শুধাল,
“তুমি এসেছ আরহান?”
আরহান উত্তর দিল না। বিনাবাক্য স্ব-জোরে ঠাস করে একটা থাপ্পড় মেরে দিল বিথীর গালে। বিথী স্তব্ধ। আরহান তীক্ষ্ণ স্বরে বলল,
“সমস্যা কোথায় আপনার? আপনার বাবা আর আপনি মিলে কি শুরু করেছেন আমার সাথে? নাটক মনে হয় সবটা। আপনি ফোন দিয়ে নাটক করেন। আপনার বাবা সামনে গিয়ে নাটক করে। এই আমি তোকে কোনোদিন বলেছি আমি তোকে ভালোবাসি। কোনোদিন বলেছি? উত্তর দে?”
শেষ কথাটা ধমক দিয়ে বলল আরহান। বিথী কেঁপে উঠল। এই প্রথম আরহানকে তার এতটা ভয় লাগছে। আরহান আবারও বলল,
“কি হলো কথা বলিস না কেন?”
“তুমি আমায় তুই করে কেন বলছ আরহান?”
আরেকটা থাপ্পড় দেয়ার জন্য হাত উঠাল আরহান। কিন্তু মারল না। বিথী খিচে চোখ বন্ধ করে নিলো। আরহান বলল,
“কোনো সাহসে রেডিওতে ফোন করেছিস তুই? তোর বাপ কই? তোর বাপরে ডাক। আজ একটা বিহিত না করলেই নয়।”
“এভাবে বলো না আরহান। আমি তোমায় ভালোবাসি। তোমায় না পেলে মরে যাব আমি।”
“আচ্ছা মরে যা। আজ হয় তুই নিজে মরে আমায় শান্তি দিবি। নয়তো আমি তোকে মেরে জেলে গিয়ে শান্তিতে থাকব।”
বিথী পড়ল বিপাকে। আরহান তাড়া দিয়ে বলল,
“আমার হাতে সময় কম আছে। যা করবি দ্রুত কর। তুই মরে যা। যা মরে।”
বিথী শুঁকনো ঢোক গিলল। মিনমিনিয়ে কণ্ঠে বলল,
“সত্যি মরে যাব?”
“তো কি করবি? তোরে তো আমি ভালোবাসব না। আমি আরেকজনকে ভালোবাসি। বিয়ে করলে তো তাকেই করব।”
এবার যেন আর একটু শকড হলো বিথী। আরহানের গার্লফ্রেন্ড আছে! কই সে তো জানত না! অসয়হায় ন্যায় তাকাল বিথী। বলল,
“তোমার গার্লফ্রেন্ড আছে আরহান?“
আরহান জবাব দিল না। বলল,
“এতকিছু বলার সময় নেই। তাড়াতাড়ি মরে যা। আয় আমি তোকে মেরে দেই।”
এই বলে বিথীর হাত ধরল আরহান। বিথী থমকে গেল। বলল, “হাত ছাড়ো আরহান।”
আরহান তাচ্ছিল্য করে বলল,
“কেন ছাড়ব? আমায় না পেলে মরে যাবি নাকি। যা মরে।”
বিথী সেই প্রসঙ্গে কিছু বলল না। শুধু বলল, “হাত ছাড়ো আরহান।”
আরহান হাত ছাড়ল না। সে বিথীকে ছাদের কিনারায় নিয়ে গেল। মাথাটা নিচের দিকে দেখিয়ে বলল, “তাড়াতাড়ি মর।”
ঠিক সেই মুহূর্তে ছাঁদে এসে হাজির হলো বিথীর বাবা আমজাদ হোসেন। আরহানের কান্ডে তিনি বিক্ষিপ্ত মেজাজে বললেন, “এসব কি হচ্ছে আরহান?”
আরহান থেমে গেল। ছেড়ে দিল বিথীকে। বিথী ঘাবড়ে গিয়ে তক্ষৎণাৎ ছুটে এলো বাবার কাছে। কান্না মিশ্রিত কণ্ঠে বলল, “আরহান পাগল হয়ে গেছে বাবা।”
আরহান উচ্চ আওয়াজে হেঁসে উঠল। বলল,
“পাগল হয়ে গেছি মানে। তুমি তো বলেছ আমায় না পেলে মরে যাবে। তো মরে যাচ্ছো না কেন?”
বিথী চুপ হয়ে গেল। পরিবেশ কিছু সময় চুপ থাকল। আরহান নিজের তীক্ষ্ণ মেজাজ দূর করার চেষ্টা চালাল। আমজাদ হোসেন কিছু বলতে গেলেন। আরহান তাকে থামিয়ে ঠান্ডা মাথায় বলল,
“মরে যাওয়া বলাটা যত সহজ। মরে গিয়ে দেখানোটা ততটা সহজ নয় বিথী। আর তুমি মরে গেলে কি হবে? কার কি এসে যাবে? ভাবো কি তুমি মরে গেলে আমি তোমার হয়ে যাব। আজ পর্যন্ত কোনোদিন শুনেছ মরে গিয়ে কেউ কারো হয়ে গেছে। তুমি মরে গেলে আমার কিছু আসবে যাবে না। কিছুদিন খারাপ লাগবে এরপর সব ঠিক। এই ব্যস্ত শহর কোনো মৃত্যু বেশিদিন মনে রাখে না। উল্টো তুমি মরে গেলে ক্ষতি তোমারই হবে। আত্মহত্যা করা মহা পাপ। জানো না। মৃত্যুর পর তোমার দেহখানার সাথে ঠিক কি কি ঘটতে পারে তুমি জানো না। কোরআন, হাদিস পড়েছ কখনো। পরে দেখবে আত্মহত্যা করলে ঠিক কি কি শাস্তি হতে পারে। শুধু শুধু আমার জন্য কেন জীবন নষ্ট করবে। এ জীবন সুন্দর বিথী। আমি তোমার জন্য নই। তোমার জন্য অন্যকেউ আছে। তাই আমি অনুরোধ করব, আমাকে আর কোনোরূপ জ্বালাতন করবে না।"
এরপর আরহান তাকাল আমজাদ হোসেনের দিকে। বলল, “দেখুন আঙ্কেল আমি আপনার মেয়েকে কোনোকালেও ভালোবাসি না। আপনার মেয়েই আমাকে ডিস্টার্ব করত। আপনি ওইদিন আমাকে, আমার বন্ধুদের অনেক কথা শুনিয়েছেন আমি কিছু বলিনি। চুপচাপ চলে এসেছি। আপনার মেয়েকে বোঝান। আমার তাকে চাই না। আর আপনিও জেনে রাখুন আপনার মেয়েকে আমার লাগবে না। ভালো থাকবেন।”
চলে গেল আরহান। পিছনে বাপ-মেয়ে তাকিয়ে আছে। কারো মুখে কোনো কথা নেই। কথারা সব হারিয়ে গেল নাকি।
•••••••••••••
সন্ধ্যা শেষে বাড়ি ফিরছিল তৌহিদ। আজ কেমন কেমন করে যেন ভার্সিটি থেকে বের হতে এত দেরি হয়ে গেল। হঠাৎই তৌহিদের নজর গেল তার থেকে খানিকটা দূরে রিকশা চড়ে বিথী আর আমজাদ হোসেনকে যেতে। তৌহিদ কিছু বলল না। দাঁড়িয়ে থেকে শুধু তাদের যেতে দেখল। কেমন যেন লাগল দুজনকে।
.
.
.
চলবে.....................................................................