রৈনীলের জন্য বাড়ির গেটে অপেক্ষা করার সময় আমার হৃদস্পন্দন ক্রমশ বেড়ে যেতে লাগলো। এত বছর পরেও তার জন্য অনুভূতিটা এমন প্রাণবন্ত আছে এটা আমি নিজেও জানতাম না। আবছা অন্ধকারের ভেতর থেকে রৈনীল বেরিয়ে এলো।
আমি বাড়ির প্রবেশ পথ দেখিয়ে ওকে ভেতরে আসার আমন্ত্রণ জানালাম। এক পা দু পা করে রৈনীল আমার কাছ ঘেঁষে দাঁড়ালো। আমি বললাম, কি হলো? ভেতরে চলুন?
হ্যাঁ, চলো।
তবুও সে দাঁড়িয়ে আছে। আমি যখন জিজ্ঞেস করলাম, কি হলো আসুন?
সে চমকে উঠে বাড়ির ভেতরে প্রবেশ করল। বিশাল করিডোরে একটা মাত্র বাতি জ্বলছে। চারিদিকে গহীন নিস্তব্ধতা। আমাদের পায়ের শব্দ ছাড়া আর কোন শব্দ নেই। সবকিছু কেমন ভুতুড়ে লাগছে আমার কাছে। তাকে ভেতরে এনে আমার বসার ঘরটাতে বসতে দিলাম।
বসলো না রৈনীল। আশেপাশে ঘুরে ঘুরে আমার মান্ধাতার আমলের বাসাটা দেখতে লাগলো। পুরনো আসবাবপত্রগুলো ছুঁয়ে ছুঁয়ে দেখছে। আমি চা বসিয়েছি। চায়ের সঙ্গে খাওয়ার জন্য শুকনো কিছু নাস্তা ছিল। সেগুলো পিরিচে সাজালাম। রইল কখন এসে আমার পিছনে দাঁড়িয়েছে আমি খেয়াল করিনি। যখন খুব কাছ থেকে ওর কণ্ঠস্বর শুনতে পেলাম চমকে উঠে পিছন ফিরলাম আমি। দেখি সে একদম আমার কাঁধ ঘেঁষে দাঁড়িয়ে আছে!
বললাম, আপনি আমাকে ভয় পাইয়ে দিয়েছিলেন।
'ভয় কেন পাবে? তুমি কি জানো না আমি এসেছি?'
'এত কাছে?'
'দূরে দাঁড়াবো?'
আমার শরীর শিউরে উঠলো। এই লোকটা এমন করছে কেন আজ? প্রত্যেকটা কথা দুষ্টুমি ভরা। কথাবার্তা শুনলে মনে হয় সে আমার পুরনো প্রেমিক। অথচ আমাদের গত পাঁচ বছরে কোন কথা হয়নি। এমনকি পাঁচ বছর আগেও আমাদের অতটও গভীর সম্পর্ক ছিল না যাকে এভাবে বলা যায়। তবুও কেন সে এমন করছে? আমি খানিকটা দ্বিধান্বিত হয়ে চায়ের কাপে চিনি নাড়ছিলাম। চামচের টুংটাং শব্দ হচ্ছে। এ ছাড়া আর কোন শব্দ নেই। ভর সন্ধ্যাতেই যেন এই গ্রামে গভীর রাত নেমে এসেছে।
পুরনো আমলের কাঠের দুটো চেয়ার পাশাপাশি রাখা। সামনে একটা ছোট্ট টেবিল। টেবিলে চা সাজিয়ে সেখানেই রৈনীলকে বসার আবেদন জানালাম।
রৈনীল বলল, এত কিছু কেন করেছ? এগুলো খেতে গেলে তো চা ঠান্ডা হয়ে যাবে।
'ফর্মালিটিস।'
সে হেসে বলল, তুমিও বসো।
আমি ওর পাশের চেয়ারটা টেনে নিয়ে মুখোমুখি বসলাম। গ্রামীণ নিস্তব্ধতা ভেদ করে চায়ের কাপে চুমুক দেবার শব্দ উৎসারিত হচ্ছে। আমি কোনো শিরোনাম ছাড়াই জিজ্ঞেস করলাম, 'আপনি এখানে কেন এসেছেন?'
'গল্প করার জন্য।'
'কিসের গল্প?'
'তোমায় যত গল্প বলার ছিলো।'
কয়েক সেকেণ্ড শান্ত হয়ে রইলাম। ওর চোখ থেকে দৃষ্টি সরানো কঠিন। শান্ত ভঙ্গীতে সে কথাটা বললো বটে, আমি ক্রমশ দ্বিধান্বিত হয়ে পড়ছি।
জিজ্ঞেস করলাম, 'আমাকে আপনার গল্প বলার আছে?'
'কেন? তোমার নেই?'
আমি চমকে উঠলাম। এতটা শান্ত থেকে সে এই কথাগুলো কেনই বা বলছে!
বললাম, 'গত ৫ বছরের গল্প?'
'৬ বছরের।'
'৫ বছর আমাদের যোগাযোগ হয়নি। ৬ কেন?'
'তোমার সঙ্গে প্রথম দেখা হওয়ার ৬ বছরই তো হলো।'
আমি স্তব্ধ চোখে তাকালাম। চায়ের কাপ কেঁপে উঠলো আমার হাতে। তার একেকটা বাক্য আমার ভেতর তুমুল আন্দোলন তৈরি করছে। এরকম অদ্ভুত আচরণ করার কোনো মানে আমি ধরতে পারছি না। এই আচরণ করাটা আমার পক্ষে শোভা পায়। তার পক্ষে তো নয়! অথচ আজ উল্টোটা হচ্ছে।
রৈনীল এক টানে চা শেষ করলো। আশেপাশে চোখ বুলিয়ে বললো, তোমার বাসাটা সুন্দর। দুই রুম তোমার?
'হুম।'
'দুইটা রুম কেন নিয়েছো? আমি আসবো জানতে?'
আমি কয়েক সেকেণ্ড থমকে গিয়ে উত্তর দিলাম, 'মোটেও না। আমার বেডরুমে অন্যান্য প্রয়োজনীয় জিনিস রাখতে ভালো লাগে না। এই রুমে একটা লাইব্রেরি করবো, রান্নাবান্না এখানেই করি, আর কিছুক্ষণ বসা, খাওয়াদাওয়ার জন্য একটা রুম তো লাগেই। ভাড়াটাও সামান্য। এ কারণেই...'
কথা শেষ করার আগেই আমি রৈনীলের বলা কথাটার ভেতর ঢুকে গেলাম। সে আসবে বলে আমার দুই রুম নিতে হবে এটা কিভাবে তার মাথায় আসে? আশ্চর্য!
'আপনি কি আমার বাসায় রাতে থাকার পরিকল্পনা করছেন?' জিজ্ঞেস করলাম আমি।
রৈনীল বললো, কখনো যদি গল্প করতে করতে দেরী হয়ে যায়, গভীর রাতে আমি বের হবো কি করে? ভয় করবে তো।
'কখনো বলতে? আপনি কি বারবার আসবেন গল্প করার জন্য?'
'৬ বছরের গল্প বললাম না? এটা তো ৬ ঘন্টায় শেষ করা সম্ভব না। ৬ মাস হলে ঠিক আছে।'
আমার চা ঠাণ্ডা হয়ে গেছে। কিন্তু চুমুক দিতে ভুলে গিয়েছিলাম। রৈনীলের কথা শুনে আমি এতটাই বাকরুদ্ধ হয়ে গেলাম যে, আমার হৃদস্পন্দনের শব্দ ছাড়া আর কোনো আওয়াজ আমার ভেতর থেকে এলো না।
রৈনীল ভ্রু নাচিয়ে জিজ্ঞেস করলো, চা খাবা না? না খেলে রেখে দাও। পরের বার খেও।
সে আমার হাত থেকে চায়ের কাপটা নিয়ে টেবিলের ওপর রাখলো।
আমি বললাম, ৬ বছরের রহস্যটা খুলে বলুন?
'গল্পটা তো ৬ বছর আগেই শুরু হয়েছিলো।'
'আপনি বলতে চাচ্ছেন, যেদিন আমাদের প্রথম দেখা হলো সেদিন থেকেই গল্পটা শুরু হয়েছিলো?'
'হুম।'
'তাহলে আপনি এখানে কোনো কাজের জন্য আসেননি? আপনি এসেছেন আমার জন্য?'
'হুম।'
আমার শরীর কেঁপে উঠলো। স্বাভাবিকভাবে বসে থাকতে পারছি না। নিজেকে সামলে নিলাম। অন্যদিকে তাকিয়ে বড় বড় কয়েকটা শ্বাস নিলাম আমি। চেহারায় খানিকটা কাঠিন্যতা এনে বললাম, 'এরকম মজা করার জন্য আমি খুব ভালো একটা মেয়ে তাইনা?'
'মোটেও না।'
'আমাকে কনফিউজড করে দিচ্ছেন কেন?'
'আমি সত্যিটাই বললাম। কনফিউজড করে দিয়ে থাকলে কনফিউশান দূর করার দায়িত্বও নিবো।'
'কী বলেন এসব! আমার মাথা এলোমেলো লাগছে। আপনি আমার সঙ্গে মজা করছেন। এটা আমি জানি। আমাকে নার্ভাস করে দেয়ার চেষ্টা করবেন না। প্রথম কাপ'টা ভালোয় ভালোয় দিয়েছি। পরের কাপে কিন্তু খারাপ কিছু মিশিয়ে দিবো বলে দিলাম।'
রৈনীল ফিক করে হাসলো। আমি চেয়ার ছেড়ে উঠে এলাম। ভীষণ অস্বস্তি হচ্ছে। হার্টবিট হচ্ছে দ্রুত। বারংবার আমার শরীরে বিদ্যুৎ চমকের মতো শিহরণ বয়ে যাচ্ছিলো। ওর কথার অর্থকে যদি সত্যি ধরে নেই, তবে তা বিশ্বাস করা শক্ত। এটা প্রায় অসম্ভব মনে হবে আমার। কিন্তু এতটা সাবলীল ভঙ্গিতে কেউ মজা করবে বলেও মনে হয় না। আমার হার্টবিট আরও বাড়ছে।
অস্থিরতা নিয়ে হাঁটতে হাঁটতে আমার রুমে চলে এলাম। আমার সঙ্গে রৈনীলের কোনো কথা নেই, থাকতে পারে না। কথা যা আছে সব তো আমারই রৈনীলের সঙ্গে। আমিই তো তার ভূতটা নিজের ঘাড়ে এতদিন ধরে বয়ে নিয়ে বেড়াচ্ছি। ৫ বছর তো কম সময় না। এতদিন ধরে কোনোরকম যোগাযোগ না করে কাউকে দূর থেকে ভালোবেসে যাওয়ার মতো বোকামি শুধু আমার পক্ষেই করা সম্ভব। রৈনীলের পক্ষে তো নয়!
আমার চোখ দুটো ছলছল করছে। দ্রুত পায়ে রৈনীলের সামনে এসে দাঁড়ালাম আমি। সবকিছুর উত্তর তার কাছেই পাবো।
আমি জানতে চাইলাম, 'এতক্ষণ ধরে মজা করছিলেন, তাইনা? বলুন? এগুলো ফান ছিলো? যদি ফান হয়ে থাকে তাহলে আর এরকম ফান করবেন না। আমি চাই না আমাদের এতদিন পরে দেখা হওয়াটা এরকম বিচ্ছিরি ঘটনায় রূপান্তরিত হোক।'
রৈনীল আমার দুই কাঁধের ওপর হাত রেখে নরম কণ্ঠে বললো, 'শান্ত হও। এখানে বসো। সব বলছি। এত উত্তেজিত হলে তো কথা বলা যাবে না।'
'আমি উত্তেজিত হচ্ছি না। আমি নার্ভাস ফিল করছি। আমার মনে হচ্ছে আপনি মজা করছেন। কিংবা এখনো আপনার জন্য আমার ফিলিংস আছে কিনা সেটা জানার জন্য এমন করছেন।'
'তোমার সবগুলো ধারণাই ভুল।'
'তাহলে?'
'আমি সত্যি সত্যি গতকাল এখানে এসেছি শুধুমাত্র তোমার সঙ্গে দেখা করার জন্য।'
চেয়ারের ওপর ধপ করে বসে পড়লাম আমি। রৈনীল আমার কোলের সামনে হাঁটুগেরে বসলো। ওর চোখের দিকে তাকানোর সাহস পাচ্ছি না। শুধু মনে হচ্ছে সবকিছু মিথ্যা। সবকিছু স্বপ্ন। এগুলো সত্যি হতে পারে না। কিন্তু এই সন্ধ্যা, এই চায়ের কাপ, এই এক জোড়া চোখ....
রৈনীলের চোখে চোখ রাখলাম। এই চোখ দুটো তো মিথ্যা বলতে পারে না!
.
.
.
চলবে..........................................................................