অতিথি নিবাস - পর্ব ২৪ - তানজিল মীম - ধারাবাহিক গল্প


 “জেগে আছেন রাত্রিমায়া? আমি কিন্তু জেগে আছি। এই যে অসময়ে রাত্রির ছবি আঁকছি একা একা। এখন রাত কয়টা বাজে। প্রায় বারোটার কাঁটায় ছুঁই ছুঁই। এই গভীর রাত্রি সময়ে আমি এসেছি আপনাদের সাথে কথা বলতে, কথা শুনতে আর কিছু সময় আড্ডা দিতে। আসসালামু আলাইকুম। আমি আরজে আরহান। আপনারা শুনছেন রেডিও তরঙ্গ নাইনটি টু পয়েন্ট টু রেডিও এফএম। বর্তমানে আমি আছি ফেসবুক লাইভে। এতরাতে অবশ্যই কল করে কথা বলার মতো মুহূর্তে আপনারা নেই। তাই রাতের কথকগুলো না হয় মেসেজ বার্তার মাধ্যমেই আমরা করি। অনেকেই বোধহয় ঘুমিয়ে গিয়েছেন। অবশ্য ঘুমিয়ে পড়াটা অস্বাভাবিক কিছু না। আমিও ঘুমিয়ে ঘুমিয়ে জেগে আছি। না জাগার মতো। কথাটা হাস্যকর লাগল কি! এত রাতে উচ্চ আওয়াজে আবার হাসতে যাবেন না। ব্যাপারটা কিন্তু খুবই বিপদজনক।”

মাইক্রোফোনের মাথায় রাতের আঁধারের ভীড়ে কণ্ঠ শোনা যায় আরহানের। গম্ভীর এক থমথমে কণ্ঠ। বেশিরভাগ শ্রোতারা তখন কানে ইয়ারফুন গুঁজে লেপ্টে আছে বিছানায়, কেউবা রাত্রি জাগা পড়ায় ফাঁকি দিয়ে শুনছে টেবিলে বসে, কেউ কেউ আছে 
বারান্দায় আনমনা রূপে বসে। ইয়ারফুন গুঁজে নিঃশব্দে শুনছে সবাই আরহানের ভাড়ি কণ্ঠখানা। খারাপ লাগছে না মোটেও। কেমন নিস্তব্ধতা ঘিরে ধরেছে চারপাশে। মনে হচ্ছে কেউ বুঝি আছে, আশেপাশে, সঙ্গে, দূরে তবুও কাছে, আলাপ করছে নিঃসংকোচে।

আরহান শান্ত স্বরে শুধাল,
 “রাত-বেরাতে মানুষকে বিরক্ত করা আমার একটা অদ্ভুত স্বভাব। স্বভাবটা বাজে নাকি সুন্দর আমি আজও ধরতে পারিনি। আমার তো এই অদ্ভুত স্বভাবগুলো মাথায় আসলেই গান মনে পড়ে, 'আমার এই বাজে স্বভাব কোনোদিন যাবে না।'—

 স্বল্প আওয়াজে মৃদু হেঁসে ফেলল আরহান। নিস্তব্ধ প্রকৃতিতে খুবই সুন্দর শোনাল সেই হাসিখানা। শ্রোতারা বুঝি তৃপ্তি নিয়ে শুনল। আরহান হাসি থামিয়ে বলল,
 “কি অদ্ভুত না! আমি গানের ভাবনাতেই বলে দিচ্ছি আমার এই বাজে স্বভাব। অথচ বলার বেলাতে বললাম স্বভাবটা বাজে নাকি সুন্দর ধরতে পারছি না। আচ্ছা আমাকে কি আপনাদের বদ্ধ উম্মাদ বা পাগলাটে রকম কিছু লাগে।'

ফেসবুক লাইভে কে যেন কমেন্ট করল, 'লাগে। বড়ই অদ্ভুত আর পাগলাটে লাগে।'

আরহান কমেন্ট পড়ে হাসল। জানাল,
 “বোধহয় আপনি মানুষটা আমায় ধরতে পেরেছেন। আবার বোধহয় পারেননি।”

বিভ্রান্তিকর কথা। তবুও আরহান বলছে। এত রাতে মানুষের সাথে বিভ্রান্তিকর কথা বলাটা খুব কি দরকার আছে। কি জানি আরহানের বোধহয় ভালো লাগছে। সে হেঁসে ওঠে আবার।

••••••••••••••

বিছানায় চিত হয়ে শুয়ে আছে ফাবিহা। কানে ইয়ারফুন। গায়ে জড়ানোর পাতলা কাঁথা। মাথার ওপর সিলিং ফ্যানটা তখন ভনভন করে ঘুরছে। এসি অফ। তবুও খানিকটা শীত শীত লাগছে। ফাবিহার পাশে বেঘোরে ঘুমোচ্ছে অরিন। ফাবিহা শুয়ে শুয়ে শুনছে আরহানের কণ্ঠ। ছেলেটার কণ্ঠটা এত পছন্দ ফাবিহার। তবুও আজ তার বড্ড মন খারাপ। তখনকার ওই মেয়েটার কল করা আর আরহানের বেরিয়ে যাওয়ার ব্যাপারটায় ফাবিহার কেন খারাপ লাগছে। যদিও এতটা খারাপ লাগার মতো কিছু ঘটেনি। তবুও খারাপ লাগছে। ফাবিহা ভাবল, সে কি আরহানের প্রেমে পড়েছে? সঙ্গে সঙ্গে চমকে উঠল ফাবিহা। না না এসব কি ভাবছে সে। ইয়ারফুনে তখনও আরহানের কণ্ঠ শোনা যায়। কি যেন বলছে ছেলেটা! ফাবিহা চোখ বন্ধ করে নিলো। নিঃশব্দে শুনতে লাগল আরহানের কণ্ঠখানা।

••••••••••••••

খটখট করে শব্দ হচ্ছে কপাটে। আকাশে তখন সূর্যটা কেবল মাত্র উঠেছে। চারপাশ বেশ পরিষ্কার। পাখিরা কিচিরমিচির শব্দ করছে। আরহানের ক্লান্তিকর শরীর, অবশ হয়ে আছে হাত-পা, চোখেও বুঝি ঝাপসা দেখছে। কাল রাতে স্টুডিওতেই ক্লান্ত হয়ে ঘুমিয়ে পড়েছিল আরহান। ঘুম যখন ভাঙে তখন ফজরের আজান দিচ্ছিল। স্টুডিওতে শেষরাতে আরহান একাই ছিল। তাই আর কেউ তাকে ডেকে তুলতে পারেনি। আরহান ফজরের নামাজ পড়েই এসেছে বাড়ি। কাল সারারাত বোধহয় বাড়ির গেটটা খোলা ছিল। ভুল হয়ে গেছে। আরহান বুঝতে পারেনি ব্যাপারটা। আরো দু'তিনবার দরজায় খটখট আওয়াজ হতেই তৌহিদ এসে দরজা খুলল। হাই তুলতে তুলতে বলল, “সারারাত তুই কোথায় ছিলি? আর তোর ফোন বন্ধ কেন ছিল?”

আরহার হেলেদুলে ভিতরে ঢুকল। কোনোরকম উত্তর দিল, “স্টুডিতেই ঘুমিয়ে গিয়েছিলাম। ফোনে বোধহয় চার্জ নেই।”

আর কোনো কথা হলো না। আরহান গিয়ে শুয়ে পড়ল শান্তর পাশদিয়ে। আর তৌহিদও কপাট আটকে চলে গেল নিজের বিছানায়। দূর থেকে বিষয়টা লক্ষ্য করল অরিন। কারণ সে মাত্রই এসে দাঁড়িয়ে ছিল ফাবিহার কক্ষের বারান্দায়!'

•••••••••••••

সময়গুলো সব কেমন যেন অদ্ভুতভাবে ছুটে যাচ্ছে। দেখতে দেখতে মাস পেরুল কেমন করে বোঝা গেল না। অরিনরা চলে গেল সেদিনই। এতবার থাকার কথা বলল থাকলোই না। বিয়ের ঝাঁক ঝমক ডেকোরেশন সবই মিলিয়ে গেল সেই কবেই! ফাবিহা আর আরহানের সাথেও তেমন আর সাক্ষাৎ হয় না। হয়েছিল মাসের দু'তারিখ কারণ ওইদিন ভাড়া দিতে এসেছিল আরহান। বাড়তি কোনোরূপ কথা হয়নি তাদের। শুধু আরহান এলো, ভাড়া দিয়ে চলে গেল। মাসুদ উদ্দিন ভিতরে আসতে বললেও। আসলো না। শুধু বলেছিল, 'তাড়া আছে।'

 আজ সোমবার। সকাল থেকেই বৃষ্টি। ফাবিহার মনটন খুব খারাপ। ভার্সিটি অফ। এছাড়াও আজ চারদিন হবে রাহেলা বাড়ি নেই। গ্রামে গিয়েছে। রাহেলা বাড়ি না থাকলে বাড়িটা পুরো খাঁ খাঁ করে। আবার থাকলে এত কথা বলে যে ফাবিহার মাঝে মধ্যে বিরক্ত লাগে। মানে সমস্যাটা হলো, 'রাহেলা থাকলেও জ্বালা না থাকলেও জ্বালা।'

 দরজায় নক পড়ল। ফাবিহা উঠে এসে বলল,
 “কে?”

উর্মি এসে দাঁড়াল তখন। বলল, 
 “কি করছ ফাবিহা?”

ফাবিহা শুঁকনো হাসল। বলল,
 “তেমন কিছু না ভাবি। কিছু বলবে?”
 “হুম। ভাবছিলাম দুপুরের খাবারটা তোমার ভাইয়ার সাথে খাব।”
 “অফিস যেতে চাচ্ছো ভাইয়ার?”

লাজুক মুখে মাথা নাড়াল উর্মি। ফাবিহা মৃদু হেসে বলল, 
 “কিন্তু বাহিরে তো বৃষ্টি?”
 “সমস্যা হবে না। গাড়ি নিয়ে চলে যাব। তুমি কি একা থাকতে পারবে?”
 “হুম, পারব। যাও তুমি?”

উর্মি খুশি হলো। উত্তেজিত কণ্ঠে বলল,
 “সত্যিই যাব।”

ফাবিহাও মাথা নাড়িয়ে জানাল,
 “হুম।”

উর্মি তক্ষৎণাৎ ছুটে গেল ডাইনিং টেবিলের কাছে। বাড়িতে মাসুদ উদ্দিন ও রিনা বেগম নেই আজ একদিন। কাল তারা বেরিয়েছেন— গিয়েছেন দেশের বাড়ি। ফাবিহাদের খুব একটা দেশের বাড়ি যাওয়া হয়না। তবে সেখানে মাসুদ উদ্দিন লোক রেখে চাষাবাদ করেন। সেখানেই কি এক সমস্যার কারণে আচমকা যেতে হলো মাসুদ উদ্দিনকে। প্রত্যেকবার তিনি একাই যান। এবার বউকে সঙ্গে নিয়ে গেলেন। রিনা বেগমই যেতে চেয়েছিলেন। যেহেতু বাড়িতে ফাবিহার ভাইয়া-ভাবি আছে।

  টিফিনবাক্সে করে আহিরের জন্য খাবার বাড়ছে উর্মি। বড্ড উৎফুল্লতার সাথে কাজটা করছে সে। বোঝাই যাচ্ছে আহিরের সাথে একসাথে খাবে বলে কতটা খুশি সে। দূর থেকে ব্যাপারটা লক্ষ্য করে ফাবিহা হাসল। ভালোবাসা বোধহয় বড্ড সুন্দর। হঠাৎ মন খারাপ হয়ে গেল ফাবিহার। তার জীবনে কি কখনো ভালোবাসা আসবে না! আরহানকে বড্ড পছন্দ করে ফাবিহা। সে মনে মনে ভেবেফেলেছিল আরহান যদি তাকে প্রপোজ করত সে প্রথমবারেই রাজি হয়ে যেত। যদিওবা আরহানের তাকে প্রপোজ করার কোনোরূপ ইঙ্গিত নেই। তবুও ফাবিহা ভেবে ফেলেছে। কারণ ফাবিহা মনে মনে কি ভাবছে তা তো কেউ শুনতে পাচ্ছে না। ভাগ্যিস পৃথিবীর কোনো মানুষ মনের কথা, কল্পনার ভাবনা শুনতে বা দেখতে পারে না। তাহলে কি বিচ্ছিরি একটা ব্যাপার হতো। ভাবলেই গা গুলিয়ে আসে ফাবিহার।

 “আচ্ছা ননদিনী আমি তাহলে আসি তুমি সাবধানে থেকো।”

ভাবনা থেকে বের হলো ফাবিহা। বলল,
 “গেট পর্যন্ত এগিয়ে দিব ভাবি?”
 “বৃষ্টি তো।”
 “সমস্যা নেই ছাতা নিয়ে আসছি।”

ঝুমঝুম শব্দে বৃষ্টি হচ্ছে। মেঘ ডাকছে। বিদ্যুৎ চমকাচ্ছে। চারপাশ কি অন্ধকার! অথচ সময়টা কেবল দুপুর দেড়টা বাজে। ফাবিহা ছাতা মাথায় উর্মিকে গেট পর্যন্ত পৌঁছে দিল। গেটের বাহিরে গাড়ি দাঁড়িয়ে। উর্মি হাসিমুখে বলল,
 “আসি। আচ্ছা তুমি একা থাকতে পারবে তো ফাবিহা? নাকি আমার সাথে যাবে?”
 “না না কি বলছ তুমি! আমি পারব থাকতে সমস্যা নেই।”
 “পাক্কা তো?”
 “হুম পাক্কা।”
 “আচ্ছা আমি তাড়াতাড়ি চলে আসব।”
 “সমস্যা নেই তুমি সন্ধ্যা গড়িয়ে এসো।”
 “কি যে বলো তুমি!”

লজ্জা লাগল উর্মির। আর হেঁসে ফেলল ফাবিহা। উর্মি গাড়ি চড়ে বসল। এর কিছুক্ষণ পরই গাড়ি চলে গেল। উর্মি বিদায় দিয়ে চলে গেল। ফাবিহা কিছু সময় চুপচাপ বৃষ্টির ভিড়ে দাঁড়িয়ে থেকে নীরব দীর্ঘশ্বাস ফেলে চলল ঘরে।

 অতিথি নিবাসটা তালাবদ্ধ করে বাড়ি থেকে বের হচ্ছিল তৌহিদ আর শান্ত। দুজনের হাতেই দুটো ছাতা। বৃষ্টির বেগ তখন বেশ তীক্ষ্ণ। নিবাস থেকে বের হতেই হাঁটার পথে ফাবিহাকে দেখে তৌহিদ, শান্ত দুজনেই দাঁড়িয়ে পড়ল। ফাবিহাও দাঁড়াল। ছোট্ট প্রশ্নে জানতে চাইল,
 “কোথায় যাচ্ছেন আপনারা?”

তৌহিদ উত্তর দিল,
 “একটু কাজ ছিল তাই বাহিরে যাচ্ছি। ফিরতে খানিকটা দেরি হতে পারে। একটু খেয়াল রাখবেন।”
 “ঠিক আছে। কিন্তু আপনারা দুজন আরেকজন নেই। সে যাচ্ছে না?”
 “না ওর ফিরতে দেরি আছে। রাত হবে। আমরা তার আগে চলে আসব।”
 “ওহ আচ্ছা।”
 “জি।”
 “সাবধানে যাবেন।”
 “অবশ্যই।”

তৌহিদ আর শান্ত বেরিয়ে গেল। ফাবিহা তখনও ঠায় দাঁড়িয়ে। কিছুসময় পর ফাবিহা আচমকা উপলব্ধি করল এই বিশাল দুই বাড়িতে সে একা আছে। একদম একা। আকাশে মেঘ ডেকে উঠল। শীতল বাতাস তাকে ছুঁইয়ে দিল। খানিকটা আতঙ্কিত লাগল শরীর।'

 ফাবিহা দ্রুত পায়ে হেঁটে গেল মায়াকুঞ্জে। ফাবিহা যেই মুহুর্তে বাড়ির দরজা মুখে গেল। সেই মুহূর্তেই আচমকা পিছনে কিসের যেন পড়ে যাওয়ার শব্দ পাওয়া গেল। সে দ্রুত পিছন ফিরল। দেখল, অতিথি নিবাসের ছোট্ট গেটের কাছ দিয়ে লুটিয়ে পড়ে আছে আরহান। মুহুর্তের মধ্যে কেমন যেন লাগল চারপাশ। ফাবিহা তার মাথার ছাতা ফেলে দৌড়ে গেল আরহানের কাছে।

 আরহানের সমস্ত শরীর বৃষ্টির পানিতে চিপচিপে ভিজে। অতিথি নিবাসের গেটমুখটা খানিকটা ঢালু। হাল্কা বৃষ্টিতেই সেখানে পানি ঝমে। আরহান পড়েছে সেই পানির ওপরই। যার দরুন পড়ে যাওয়ার শব্দটা এত বৃষ্টির ভিড়েও শুনতে পেল ফাবিহা। আরহানের সাদা শার্টটায় লাল লাল কি যেন লেপ্টে! ফাবিহা ছুটে এসে মাথাটা কোলে তুলে নিলো। হতভম্ব কণ্ঠে প্রশ্ন করল, “কি হয়েছে আপনার?”

আরহান জবাব দিল না। ফাবিহা দেখতে পেল আরহানের কপাল চুইয়ে রক্ত ঝরছে। এবার যেন আরো বেশি আতঙ্কিত, বিস্মিত হলো ফাবিহা। বৃষ্টির পানিতে সেও ভিজছে। হুস হলো না তার। আরহানের গাল ধরে অপ্রস্তুত কণ্ঠে আবারও জিজ্ঞেস করল, “এসব কি করে হলো আরহান?”

আরহান উত্তর দিল না। এক পলক তাকিয়ে চোখ বন্ধ করে নিলো হঠাৎ। ফাবিহার অসয়হায় লাগল তখন। আচমকা এসব কি ঘটে গেল? বুঝতে পারল না সে। আকাশটায় আবারও মেঘ ডাকে! বিদ্যুৎ চমকায় বারংবার। চারপাশ লাগে নিস্তব্ধ, বিষণ্ণ। একাধারে ভয় ভয় ভাব! সব মিলিয়ে কেমন যেন এক আতঙ্কিত পরিবেশ!
.
.
.
চলবে......................................................................

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন

WhatsApp