লোকটির মুখায়ব স্পষ্ট নয়। অতোদূর থেকে ভালো করে দেখতে পেল না। তবু দূর থেকে যা যতটুকু দেখা গেল, তাতে কেমন যেন বিচিত্র এক অনুভূতি হচ্ছে। এ অনুভূতি কেমন প্রশ্ন, কিছুটা কৌতুহল, কিছুটা ভয়সর্বস্ব। এভাবে অতর্কিতে কেউ গাড়ি থামিয়ে দাঁড়াবে এটা পুরোপুরি অপ্রত্যাশিত ছিল। বুকের ভেতরটা এখনো দুর দুর করে কাঁপছে। রাগী, বদমেজাজি, অত্যন্ত জঘণ্য সেই রাফান সিদ্দিকীকে একহাত করতে পেরেছিল শ্রেষ্ঠা। কিন্তু ওর অন্তর্ভেদী চোখ বেশ ভালোভাবে বুঝতে পেরেছে এই অঞ্চলের বনকর্মী লোকটা বেশ গভীর। এই রাফান সিদ্দিকীর বর্বর মেজাজ ওই ভদ্রলোকটির সমুখে কিছুই না। এখনো মনে হচ্ছে রাফানের চাইতে অত্যন্ত বিপজ্জনক এই বনকর্মী পুরুষ। চোখে, চেহারায়, চাপা চাতুর্যে কেমন এক নিঃশব্দ পাশবিকতা ফুটে ওঠে; যে দিকগুলোর বর্ণনা আদতে ভয়ংকর বৈশিষ্ট্যের চেয়ে কম নয়। দীর্ঘ অবয়ব, শক্ত কাঠামো, একহারা দৈহিক গঠন। চোখে রিমলেস চশমা। দুটি স্বচ্ছ কাঁচের আড়ালে নীল সমুদ্রের মতো দুটি অদ্ভুত সুন্দর চোখ। ওই চোখের স্পষ্ট বর্ণনা সহজ অর্থে অবর্ণনীয়। অন্তত শ্রেষ্ঠার একবার জিজ্ঞেস করতে মন চেয়েছিল, 'আপনার চোখ দুটো জন্মগত ওরকম? কেমন যেন নীল মণি!' প্রশ্নটা কেন যেন চাপা সংকোচে করেনি শ্রেষ্ঠা। অথচ বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্র সংগঠনের নারী বিভাগের তুখোড় নেত্রী সে। গতকাল বর্ষণমুখর প্রকৃতি যখন ঝড়ো মূর্তিতে উত্তাল অশান্ত, তখন বিশেষ ঘরানার একটি গাড়ি থেকে নেমেছিল এই লোক। পড়ণে ছিল ধূসরবর্ণ শার্ট। কালো প্যান্ট। হয়তো একজন অফিসার পদস্থ ব্যক্তি বলেই কোমরে থাকা বেল্টের সঙ্গে ইন করা শার্টের বেশবিন্যাস তাৎপর্যপূর্ণ ভূমিকায় ছিল। ওদের সামনে যখন নিজের পরিচয় রেখে পেশেন্টের অবস্থা জানতে চাইল, তখনই শ্রেষ্ঠা বুঝেছে এই লোক রাফান সিদ্দিকীর মতো আরো দশটাকে এক কাতারে আনার ক্ষমতা রাখে। বাজে শব্দ, বদমেজাজি কণ্ঠ, তিরিক্ষি আদল নয়; বরং কেমন যেন শান্ত, শীতল, জমাট বদ্ধ বরফের মতো কথা বলে। সম্ভ্রম ভাব কাজ করে। তেমনি সম্ভ্রম সম্মান ভেতরে পোষণ করে নাযীফকে বলল শ্রেষ্ঠা,
- উনার নাম্বারটা বল। পাঠিয়ে দিচ্ছি এড্রেস।
নাযীফ নিজের সেলফোনে তাকিয়ে নাম্বার বলতে শুরু করে। কপালের ঘাম কানের ডানপাশে সুড় সুড় নামছে। নাযীফ নিজেও হতভম্ব, অস্থির। পেছনের সিট থেকে শ্রেষ্ঠা পরপর ডিজিটগুলো শুনে সম্পূর্ণ ঠিকানাটা টেক্সট করে দেয়। কিন্তু বিধি বাম! ফোন কেঁপে উঠতেই শ্রেষ্ঠা মুখ হাঁ করে দেখল টেক্সটটা যায়নি! কী দূর্ভোগ! ফোনের ব্যালেন্সটা এখনই শেষ হতে হলো? এখন কী হবে? ওদের কারোরই ফোনে নেটওয়ার্ক নেই। পার্বত্যাঞ্চলের এসব জায়গায় নির্দিষ্ট কিছু অপারেটর বাদে কোনো সিমেই সিগন্যাল পৌঁছুয় না। ভারি বিপদ! মুখ পানসে করে হাঁ করা চোয়াল ঝুলিয়ে বাঁপাশে তাকাল শ্রেষ্ঠা। বাঁদিকে বসা শাওলিন ওর মুখের দূর্দশা লক্ষ করে ওর ফোনের দিকে একপলক তাকাল। ঘটনা তৎক্ষণাৎ বুঝতে পেরে টোট ব্যাগ খুলে নিজের সেলফোনটা বাড়িয়ে দিল শাওলিন। যেন কোনো বিশেষ ঘটনা ঘটেনি, তেমনি শান্তমুখ করে বলল,
- আমার ফোনে নেটওয়ার্ক আছে। দু নম্বর সিমে ব্যালেন্স। এখান থেকে পাঠাতে পারো।
কোনোকিছু না বলে নিঃশব্দে ওর হাত থেকে ফোনটা বুঝে নেয় শ্রেষ্ঠা। জানে, শাওলিনের ফোনে সচরাচর ব্যালেন্স এবং নেটওয়ার্ক দুটোই থাকে। বিশেষ দূর্যোগ দেখা না দিলে এর বাত্যয় ঘটে না। ফলে অতিদ্রুত টেক্সট পাঠাতেই অপরদিকের জীপটি কয়েক মুহুর্তের মাথায় স্থিরতা ছেড়ে চলৎ ক্ষমতা ধারণ করল। সম্পূর্ণ তিনশো ষাট ডিগ্রি কোণে ঘুরে ওদের পেছনে রেখে চলতে লাগল জীপটি। ভাগ্যিস বৈরি আবহাওয়া ও আকস্মিক কিছু সমস্যার দরুন পথে যান চলাচল অত্যন্ত কম। পার্বত্যাঞ্চলের মসৃণ আঁকাবাঁকা শূন্য পথে সশব্দে চলল ওদের গাড়ি। চলন্ত বেগবান গাড়ির ভেতরে নিজের ফোনটার দিকে চেয়ে আছে শাওলিন। জানে না কেন, ওর মনে হচ্ছে এই পার্বত্যাঞ্চল ছেড়ে ওর কখনোই যাওয়া হবে না। এই রহস্য মায়াবিনী বন-পাহাড় ওকে যেন অদৃশ্য শেকলে বেঁধে দিচ্ছে।
•
গভীর চিন্তার অন্তরালে কিছু হাতাপিতা করছে রাফান। কিছু একটা সাংঘাতিক ঘটছে। মনে হচ্ছে চোখ এড়িয়ে কিছু জিনিস ছুটে যাচ্ছে। তার সচল ইন্দ্রিয় ক্ষমতা জানান দিচ্ছে ওই দলটা সুবিধার নয়। ভেতরে কোনো মারাত্মক ঘটনা লুকোনো। যা সহজ ভাবে, সরল পথে, সাদাচোখে দেখা দিচ্ছে না। গাড়িটা তুলনামূলক উচ্চগতিতে চালালেও তাদের মনের চিন্তার সঙ্গে এ গতি নগণ্য। রাফানের পাশে বসা পার্থ হাতে একটি আইপ্যাড নিয়ে বসে আছে। তার দৃষ্টি স্ক্রিনের উপর অবিরত ঘুরে চললেও আসল দৃষ্টি ঠিকই রাফানের গতিবিধি পর্যবেক্ষণ করছে। তর্জনীর ডগা স্ক্রিনের একটি নির্দিষ্ট জায়গায় স্পর্শ করতেই কাঙ্ক্ষিত প্রশ্নটা ছুঁড়ে দিল পার্থ,
- তোর মনের ভেতরে দুনিয়ার প্রশ্ন ঘুরপাক খাচ্ছে। এটা বাইরে থেকে বোঝা যায় রাফান। আমি অবশ্য স্যারের মতো মনের কথা বলে দিতে পারি না। কিন্তু তুই যে মহা চিন্তায় আচ্ছন্ন আছিস এটুকু অন্তত বলতে পারব।
কথা শুনে একপলক বাঁয়ে তাকাল রাফান। পুনরায় ড্রাইভে মনোযোগ দিয়ে সুস্পষ্ট তিরিক্ষি সুরে বলল,
- খোদার দোহাই, তুই স্যারের মতো ওই বিচিত্র ভয়টা ধরিয়ে দিস না। উনার সামনে কিছুই গোপন করতে পারি না। চোখ আর চেহারা দেখে কীভাবে একটা মানুষ মনের খুঁটিনাটি ধরে ফেলে আমার মাথায় আদৌ ঢোকেনি। মুখস্তের মতো সব বলে দেওয়াটা পৃথিবীর অষ্টম আশ্চর্য!
পার্থ কথাটা শুনে হাসতে হাসতে বলে,
- পৃথিবীর নিষ্ঠুরতম আশ্চর্য বল এটা! ওরকম গুণ আর কারুর ভেতরের পাবি না।
রাফান কথাটার পক্ষে স্বপক্ষ মত দিয়ে বলল,
- অবশ্যই। ওঠা নিষ্ঠুরতম ভয়াবহ আশ্চর্যই। এমন আশ্চর্য যেন আর কারোর ভেতরে না ঘটুক। নাহলে গোপন কথার রাখঢাক নেই।
- এবার সমস্যার কথা বল। ওই দলটাকে যেতে দেবার পর বেশ অদ্ভুত কাজ করছিস। গুরুত্বপূর্ণ ভেবে আমি সেসময় প্রশ্ন করিনি। কিন্তু এখন মনে হচ্ছে বিষয়গুলো পরিষ্কার করে বলা দরকার।
রাফান ক্ষণেকের জন্য কী একটা কী ভেবে দেখল। পরক্ষণে গাড়ির জানালা-বন্ধ নীরব পরিবেশে সশব্দে শ্বাস ছেড়ে উদ্ভট কথাটা উত্থাপন করল,
- ওদের হাতে ও কাঁধে সব মিলিয়ে আটটা ব্যাগ ছিল। সেখানে রাতারাতি ছয়টা হয়ে গেছে। প্রচণ্ড ভারি একটা ট্রাভেল ব্যাগপ্যাক গতকাল সন্ধ্যা থেকে সোহানা মেয়েটার কাছে দেখছি। মেয়েটার কাছেও একটা ট্রাভেল হ্যাণ্ডব্যাগ ছিল। আজ সেখানে সেটাও নেই। এমন নয় যে ব্যাগের সংখ্যা কমাতে অন্যত্র পাঠিয়ে দিবে, অথবা এক ব্যাগের ভেতর অন্য ব্যাগ ঢুকিয়ে রাখবে। এই আবহাওয়াতে হাসপাতালের বাইরে কোনোকিছু পাঠানো পুরোপুরি শক্ত। তাহলে রাতারাতি দুটো ব্যাগ কোথায় গেল? ওদের চেহারা অমন সংশয় যুক্ত কেন ছিল? যাবার সময় কেন ওরকম তাড়াহুড়ো লাগাল? এখানেই প্রশ্ন এঁকে আছে।
আইপ্যাডে কিছু ড্যাটা এনক্রিপ করতেই থমকে গেছে হাতের আঙুল। কপালে ধীরে ধীরে অজস্র স্পষ্ট ভাঁজ ফেলে মুখ তুলে চাইল পার্থ। চিন্তা প্রচ্ছণ্ণ দৃষ্টি দুটি সরাসরি রাফানের দিকে ফেলল। গলায় কুণ্ঠা জড়িয়ে তৎক্ষণাৎ প্রশ্নটা করে বসল,
- সামথিং ওয়াজ রং ?
- ডোননো। দেয়ার ইজ নো ক্লিয়ার ভিশন দ্যাট আই ক্যাচ।
এবার কপালের কুঞ্চল রেখা দৃঢ়তার দিকে ঝুঁকল পার্থর। সে গতকাল গুরুত্বপূর্ণ একটি রিপোর্টের জেরে অমনোযোগ দৃষ্টিতে কাজকর্ম করছিল। যার দরুন রাফানের কথার মর্ম তার দৃষ্টিতে ধরে পড়েনি। এটা অবশ্যই খারাপ হয়েছে। কিন্তু সাধারণ একটি ভ্রমণ পিপাসু দল কেন ওরকম সজাগ দৃষ্টি আকর্ষণ করবে? কোন অধ্যায় লুকিয়ে আছে ওই দলটার অন্দর-মহলে? নীচের অধরে দাঁত বসিয়ে ভ্রুঁদুটির মাঝখানে দৃঢ়তাসম্পণ্ণ ভাঁজ আরো গভীর হয়। মেঘে ছাওয়া অন্ধকার দিনক্ষণে চিন্তিত কণ্ঠে বলে পার্থ,
- ওই দলটা সম্ভবত খারাপ কিছু ঘটিয়েছে, যেটা আমাদের কাছে একবর্ণও জানায়নি। এটা ভালো সংবাদ নয় . .
•
বিরানভূমির মতো খোলা জায়গাটি এখন বানিজ্যিক উদ্দেশ্যে বিরাজমান। সেখানে খুঁটি গেড়েছে একটি চমৎকার প্রাকৃতিক ছাঁচে তৈরি রেসোর্ট। শৌখিন আদলে গড়া নান্দনিক শোভায় ফুটে আছে বাসযোগ্য স্থানটি। চারিপাশের আকাশস্পর্শী উঁচু উঁচু গাছ। জড়বৎ পাহারায় যেন সারি সারি গাছগুলো চতুর্দিকে বাউণ্ডারির মতো ঘিরে রেখেছে। সবুজে ঘেরা নিবিড় ছায়াচ্ছণ্ণ জায়গাটিতে গাড়ি এনে থামায় নাযীফ। ওদের এ জায়গাটিতে জীপ ঢুকিয়ে প্রবেশ করেনি সেই বন রক্ষক। তিনি তার জীপ নিয়ে আগের মতোই নাযীফের সঙ্গে ফোনালাপ করে পথ থেকে বিদায় জানিয়েছে। রেসোর্ট না বলে এটিকে বলা উচিত সুদৃশ্য একটি আধুনিক গ্রাম। যে গ্রামে মানুষ থাকে টাকা দিয়ে; সময় কাটায় টাকা দিয়ে; গ্রাম্য শীতল পরিবেশে খাবার খায় টাকা দিয়েই। এখানে গ্রামের মানুষরাই থাকে না। গাড়িটিকে পার্কিং সাইটে রাখার জন্যই অন্য গেট দিয়ে প্রবেশ করতে হয়েছিল ওদের। ফলে মালপত্র সহ অন্যান্য জিনিস সোজাসুজি প্রবেশ-পথ দিয়ে না ঢুকিয়ে অন্য আরেকটি পথ অবলম্বন করে ঢুকতে হয়েছে। ইট বিছানো সুসজ্জিত পথ। পথের দুপাশে ঝোঁপের জঙ্গল, জঙ্গলের গা ছুঁয়ে দণ্ডায়মান নারিকেল, সুপারি, তাল, অশ্বত্থ। খসমস শব্দে কয়েক পদযুগলের আওয়াজ সেখানকার নীরবতা ছিণ্ণবিচ্ছিণ্ণ করে বহুদূর ছাপিয়ে যাচ্ছে। আকাশে স্তুপাকারে কালো মেঘের পসরা বসেছে বলে বাতাসটা ভারি ঠাণ্ডা। প্রায় দশ মিনিটের মতো সেই পথ মাড়িয়ে অবশেষে ওরা সদর গেটের চৌকাঠ ডিঙাল। চারদিকে দৃষ্টি বুলাতেই আশ্চর্যে বিস্ফোরিত হয়ে ক'জন সমস্বরে চ্যাঁচিয়ে ওঠে,
- কী অদ্ভুত সুন্দর!
ওই ক'জনের বিস্মিত বিহ্বল দৃষ্টি চর্তুদিকে যেন সৌন্দর্যের রূপ-মাধুর্য্যে বাঁধা পড়েছে। হাতে তাদের আইফোন থাকা সত্ত্বেও ক্যামেরা অন করা সিস্টেমে আঙুল আর রাখেনি। মৃদু হাসির চাহনি ছেড়ে নিজের ঘরমুখো পা বাড়িয়েছে শাওলিন। এখানে প্রত্যেকের থাকার জন্য ছোট্ট ছোট্ট কুটির। কুটির আদলটি তৈরি করা হয়েছে মজবুত বাঁশ, পোক্ত কাঠ ও মাথার উপর ছনের আকৃতি দিয়ে। ভূমি থেকে সেই কুটিরে উঠতে হয় কাঠের সিঁড়ি বেয়ে। সিঁড়িগুলো অনেকটা দেখতে মইয়ের মতো, তবে মই নয়। কিন্তু ভুলভাল বা অসতর্ক পা ফেললে মারাত্মক ব্যথা পাবার সম্ভাবনা রয়েছে। ধীরে ধীরে অনভ্যস্ত পা ফেলে উঁচু কুটিরটায় পৌঁছে গেল শাওলিন। ভেতরে পা ফেলতেই শোঁ শোঁ করে এক দঙ্গল টাটকা হাওয়া ওর চোখে মুখে ছুঁয়ে গেল। জায়গাটা যে কী সুন্দর! সত্যিই ক্যানভাসে আঁকা চিত্রের মতো অপরূপ সুন্দর। বাঁশ ও কাঠের তৈরি বিশেষ দরজাটা আঁটকে দিল শাওলিন। চারিদিকে ওর সুন্দর চোখদুটো বুলিয়ে বুলিয়ে দেখল শোবার জন্য একটি নরম বিছানা, বিছানার সঙ্গেই একটি বড় মাপের জানালা, একটি কাঠনির্মিত মাঝারি আলমারি। আলমারির পাশটিতে একটি বন্ধ দরজা। দরজাটি খুলে এক চিলতে খোলা বারান্দায় যাওয়া যায়। কাঁধ থেকে টোট ব্যাগের ফিতাদুটি নামিয়ে বিছানায় রাখল শাওলিন। রেসোর্টের ছোকরাগুলো ইতোমধ্যে ঘরের এককোণে ওর ছোট লাগেজ ব্যাগটি রেখে গেছে। সেখান থেকে প্রয়োজনীয় জিনিসপত্র নিতেই হঠাৎ আবারও ডায়েরিটার কথা মনে পড়ল। ওর অজ্ঞাতে কেউ কী ব্যাগের জিনিসপত্র ঘেঁটেছে? ওভাবে রক্তের ছাপ কেন ডায়েরির কোণে পড়বে? দেখে মনে হয়েছে গতকালকের রক্ত। যা আজ শুকিয়ে খয়েরি বর্ণ ধারণ করেছে। একান্ত ব্যক্তিগত সম্পদে ঠিক কে স্পর্ধাটা দেখাল? ভাবতে ভাবতে ওর ভাবনার রাজ্যে ছেদ ঘটালো মোবাইল ফোন। তারস্বরে সেটি বিছানার উপর বাজছে। মেঝে থেকে উঠে বিছানা থেকে ফোনটা তুলে শাওলিন। দেখল সেই ম্যাসেজ পাঠানো নাম্বারটি থেকে জরুরি কল এসেছে। ক্ষণেকের জন্য দ্বিধাগ্রস্ত হলেও শেষপর্যন্ত কলটা রিসিভ করে কানে চাপলো শাওলিন। শান্ত কণ্ঠস্বর বজায় রেখে বলল,
- হ্যালো।
অদম্য, অটুট, এক নির্মম কর্তৃত্ববাদী স্বর শুনলো,
- শোয়েব ফারশাদ। ফরেস্ট ডিভিশন অফ হিল রিজিয়ন। আপনি সম্ভবত শ্রেষ্ঠা। আপনার নাম্বার থেকে রেসোর্টের এড্রেসটা পাঠানো হয়েছিল। আপনার বান্ধবি শাওলিন যে কেবিনে ছিলেন, সেখান থেকে একটি আংটি কুড়িয়ে পাওয়া গিয়েছে। গতকাল একজন নার্স অসর্তক হয়ে হাত থেকে ব্যাগটা ফেলে দিয়েছিল। সেখান থেকে ছিঁটকে খুব সম্ভবত বেডের নীচে গড়িয়ে যায়। হাসপাতাল কর্তৃপক্ষের কাছ থেকে আংটিটা বুঝে নিবেন। নার্স ফাইরুজ নাম বললেই চলবে।
একনাগাড়ে বলে চলা কথার সমুখে প্রচণ্ড বিস্মিত হয় শাওলিন। ওকে কথা বলার কোনো ফুরসত তো দূরের কথা, 'আমিই শাওলিন' কথাটা পর্যন্ত বলার অবকাশ দিল না। কলটা প্রয়োজনীয় ফর্মালিটিতে 'রাখি' বলে সেভাবেই কেটে দিয়েছে। কী তাজ্জব আচরণ! বড় আশ্চর্য অনুভব করল ও। মনে হলো একজন ট্রেইণ্ড বডিগার্ডের সাথে কথা বলল। আবেগের ছাঁট নেই, শব্দের বাহুল্যতা নেই, কথার নীচে অসংলগ্ন আভাস পর্যন্ত নেই। এ কেমন ব্যক্তি? কান থেকে হতভম্ব মুখ করে ফোন নামাল শাওলিন। ক'সেকেণ্ড সেই উদ্ভট নাম্বারটার দিকে চেয়ে অবশেষে ক্ষান্ত দিল ও। হাতমুখ ধুতে চলে গেল।
•
ঝুম ঝুম করে আকাশ ভেঙে বৃষ্টি পড়ছে। সময়ের কাটায় দুপুর তিনটে। আঁধার ছাওয়া মেঘলা দিনে বাকিরা হাপুস হুপুস পেটভর্তি করে কাঁথামুড়ি দিয়ে ঘুমোচ্ছে। তবে এখনো শোবার তেমন পরিকল্পনা করেনি শাওলিন। রেসোর্টের ব্যূফে থেকে কাঁচের প্লেটভর্তি গরম খিচুড়ি, পেঁয়াজ কাঁচা মরিচ দিয়ে গরম ডিম ভাজা। সঙ্গে প্লেটের এককোণায় তুলে এনেছে শুকনো মরিচের আলুভর্তা। কুটিরে ফিরে বারান্দার দরজা খুলে সেখানে শীতলপাটি বিছিয়েছে। বারান্দার মাথার উপর ছাদ থাকায় বৃষ্টি সরাসরি গায়ে পৌঁছুচ্ছে না। মৃদুমন্দ ছাঁট গায়ে মেখে পাটিতে আসন গেড়ে একা একা খাচ্ছে ও। যেভাবে সারাটা জীবন একা একা খেয়েছে। কলের ডিউরেশন চলতেই ওপাশ থেকে আবার বলে উঠল রেবেকা নেওয়াজ,
- তুমি ওদের সঙ্গে একসাথে খেতে যাওনি কেন? ওভাবে বারান্দায় বসে বসে কেউ খায়?
- হৈচৈয়ের মাঝে খাওয়া যায় না মণি। ওখানে বিকট শব্দে গানবাজনা হচ্ছে। আমার কাছে ওসব অসহ্য লাগে। রাগ করবেন না।
রেবেকা নেওয়াজ চরিত্রের একদিকে ভীষণ নরম। অন্যদিকে কড়া জাঁদরেল মেজাজি। অন্তত কলেজের ছাত্রছাত্রীরা তাদের শ্রদ্ধেয় শিক্ষিকার নামে তাই-ই বলে বেড়ায়। রেবেকা নেওয়াজ পরবর্তী ক্লাসের আগে বিশ মিনিটের ব্রেকটাইম পেয়েছেন। তাতেই তিনি ফোন করেছেন উনার সন্তান সম একমাত্র ননদকে। সেই দশ বছর বয়স থেকে শাওলিনকে লালন পালন করছেন তিনি। রেবেকা নেওয়াজ নিঃসন্তান হলেও সন্তানের ঘাটতি যেন পূরণ হয়েছে বাচ্চা একটি মেয়ের পেছনে। আজও তাই ভাবীর ভূমিকার অন্তরালে একজন মা হয়ে শাষণ করলেন তিনি,
- একা খাবে না। বাসায় একা খাও বলে কিছু বলার থাকে না। কিন্তু বন্ধুদের মাঝে থাকলে অবশ্যই একসঙ্গে খাবে। জ্বর বাঁধানোর কোনোপ্রকার চেষ্টা যেন না দেখি। তুমি জানো আমি এসব অসুখ বিসুখ ভীষণ অপছন্দ করি। সবসময় শ্রেষ্ঠাদের সঙ্গে থাকবে, ওদের সঙ্গে চলবে। তোমাকে নিয়ে ভীষণ দুশ্চিন্তায় পড়েছি শাওলিন। ওরকম পাহাড়ি জায়গায় এলোপাথাড়ি ঘুরা একটুও ঠিক নয়। কথা যদি না শোনো, এবার বাড়ি ফিরলে তোমার সঙ্গে পুরোপুরি কথা বন্ধ করে দেব। বলে রাখলাম।
খিচুড়ির উপর ফুঁ দিয়ে দিয়ে ঠাণ্ডা করছিল শাওলিন। চুলো থেকে নামানো খিচুড়ি। আগুনের মতো গরম। প্লেটটা পুনরায় পাটিতে রেখে ফোনটা কোলে ফেলে বলল,
- আপনার রাগ ভাঙানোর কৌশল জানি মণি। কোন্ আইসক্রিম পেলে আপনি ঠিক আইসক্রিমের মতোই গলে যান। রাগ, অভিমান কোনোটাই মনে থাকে না। এ নিয়ে আমার দুশ্চিন্তা নেই। ঔষুধ খেয়েছেন?
- তুমি দিন দিন মনে হচ্ছে চতুর হয়ে যাচ্ছ! না, আর পারা যাচ্ছে না। শ্রেষ্ঠাকে প্রথমদিন দেখেই বুঝে নিয়েছিলাম ও হচ্ছে লেডি লিডার। ওর সংস্পর্শে তুমি আগের চেয়ে অনেক হুঁশিয়ার হয়ে গেছ।
শাওলিন কথার ভঙ্গিমা দেখে নরম হল। প্রত্যুত্তরে শুধোল,
- চতুর! যেমন?
- গতকাল দুপুরের পর থেকে তোমার ফোন বন্ধ। এটা কী চার্জের জন্য বন্ধ ছিল, নাকি অন্য কোনো কারণে সেটা আল্লাহ তা'য়ালা ভালো জানেন। শ্রেষ্ঠার নাম্বারে টানা ক'বার ফোন দেবার পর অষ্টমবারে যেয়ে ধরল। এরপর সমাজের ইতিহাস মুখস্তের মতো গড়গড় করে একগাদা কথা বলে গেল। যা ছিল পুরোপুরি বানানো সাজানো মিথ্যে। এখন তুমি-ই বলো কার কাছে কীসের খবর পাঠাচ্ছ? গতকাল তুমি কোথায় ছিলে?
মুখে ছোট এক লোকমা পুড়ে চিন্তায় পড়ল শাওলিন। দুনিয়ার যাবতীয় মিথ্যা কথা এই একটা মানুষই চট করে ধরে ফেলে। তার সমুখে সত্য ব্যতীত মিথ্যা বলা ভারি মুশকিল। গ্লাসে নরম পুরুষ্টু ঠোঁটদুটি চেপে ক'ঢোক পানি গিলল শাওলিন। মনের টলোমলো অবস্থা সুস্থির করে জানালো,
- গতকাল সামান্য তাপমাত্রা বেড়েছিল। এর চেয়ে খারাপ কিছু ঘটেনি। দুটো ক্যাপসুল খেয়ে নেওয়াতে আমি পুরোপুরি সুস্থ। গতকাল রেসোর্ট পরিবর্তন নিয়ে শ্রেষ্ঠা বেশ ব্যস্ত সময় কাটিয়েছে। এ কারণে ফোন ধরাটা সম্ভব হয়নি। এছাড়া বিশেষ কিছু ছিল না মণি। আপনি অযথা টেনশন করছেন।
শাওলিন কোনো মিথ্যে বলবে না জেনেও কিছুটা দুশ্চিন্তায় পড়লেন রেবেকা। ওর মুখে সামান্য মানে অত্যধিক। একটু মানে অনেকখানি। অল্প মানে প্রচণ্ড বেশি বোঝায়। বিজ্ঞ মনষ্ক রেবেকা শাওলিনের কথার ফাঁকে কথা আর ধরলেন না। চুপ রইলেন। বেশ খানিকক্ষণ চুপ থেকে গভীর দীর্ঘশ্বাস ছেড়ে হাসলেন তিনি,
- এরপর থেকে আর একা খেতে হবে না মেয়ে। একজন মানুষ সবসময় তোমার সঙ্গে থাকবে। সঙ্গ দেবে, পাশে থাকবে, ছায়া দিবে। ঠিক আছে না?
মুখের খাবার গলায় আঁটকে গেল তৎক্ষণাৎ। নিমিষে ঠোঁটের প্রসন্ন ভাব, চোখের শান্ত চাহনি নিরুদ্দিষ্ট হলো। মজাদার খিচুড়ি যেন মুহুর্তের ভেতর বিস্বাদ। খাওয়ার রুচিটা শূন্যে পৌঁছুতেই বহুকষ্টে পানিটা গলায় ঢালে শাওলিন। প্রতি উত্তরে ফোনটা বাঁহাতে নিয়ে বলল,
- আমি এই স্বাভাবিক জীবনটাতে যে পর্যন্ত আছি , সে পর্যন্ত কী ওই বিষয়ে আলাপ কমানো যায়? আমি প্রস্তুত —
বাকিটুকু শাওলিন শেষ করল না। বলা প্রয়োজন, শেষ করতে চাইল না। হাসি প্রফুল্ল মুখ অন্ধকার বনে গেল রেবেকার। বুঝতে অসুবিধে হলো না কোন ব্যাপারে বলেছে ও। তিনি বিচক্ষণ, বুদ্ধিমতি নারী। কিছুক্ষণ চুপ থেকে শাওলিনের উদ্দেশ্যে বললেন তিনি,
- আমি জানি শাওলিন, এখনো ব্যাপারটার জন্য প্রস্তুত হওনি। কিন্তু তোমাকে যে মানসিকভাবে প্রস্তুতিটা নিতে হবে মেয়ে। একটা মেয়ের জীবন কখনো পুরুষহীন থাকে না। জীবনের একটা পর্যায়ে এসে তার সঙ্গ প্রয়োজন হয়। তাকে নির্দিষ্ট পর্যায়ে অবলম্বন খুঁজতে হয়। কারোর উপর ভরসা করতে হয়। নিজের বিশ্বাসটুকু আশ্বাসটুকু রাখতে হয় শাওলিন। এটা তো উপেক্ষা করা যাবে না। তুমি তো জানো, কেন আমি তোমার উপর এই বিশেষ জুলুমটা চাপাতে যাচ্ছি। তুমি জানো তো।
মুখ ফুটে অনেক কিছু বলার ইচ্ছে ছিল ওর। বলতে ইচ্ছে করছিল, যে ব্যক্তির কাছে একান্ত ভরসাটুকু রাখারই প্রস্তুতি নেই, তার সাথে কী করে সুক্ষ্ম বিশ্বাসটা বজায় থাকবে? জিভের ডগায় কথাটা চলে এলেও তা ফিরিয়ে নিল শাওলিন। সৃষ্টিকর্তার পর এ পৃথিবীতে যে ব্যক্তিটাকে সবচাইতে বেশি ভরসা করে, তার কথার উপর কখনো কথা তুলেনি ও। কখনো ফলায়নি তর্কযুদ্ধের তত্ত্ব। পৃথিবীতে আলো দেখানো মানুষ দুটি গুরুত্বপূর্ণ হয়ে থাকে, তারা ওর জীবনে বেঁচে থেকেও নেই। এক অমামীংসিত নিষ্ঠুরতায় কাছে টানেনি তারা। হঠাৎ ওর মনে পড়ল সেই তথাকথিত আংটিটা ওর কাছে নেই। ওটা হাসপাতালে হারিয়েছে। ঘণ্টাখানেক আগে এক উদ্ভট প্রজাতির লোক সে বিষয়ে সন্ধান দিয়েছে। হঠাৎ কী ভেবে ডানহাতের সেই বিশেষ আঙুলে দৃষ্টি রাখল শাওলিন। কলে থাকা রেবেকা তখনো নানান বিষয়ে কথা বলতে থাকলে অন্যমনষ্ক শাওলিন ভ্রুঁ খানিকটা কুঞ্চন করল। কিছু একটা ভাবনার ভেতরেই রেবেকার উদ্দেশ্যে বলে উঠল,
- আপনাকে রাতে কল দিব মণি। খাবার শেষ করতে হবে। আপনার ঔষুধগুলো মনে করে খাবেন। জোহরা আন্টিকে আমার সালাম। আল্লাহ হাফেজ।
ফোনটা রেখে তখনো কপাল কুঁচকে রেখেছে শাওলিন। একটা বিষয় দেখে ভারি তাজ্জব লাগল। রাত দশটার দিকে ট্যূরের বাসে যখন সফররত ছিল, সে অবস্থায় মনে মনে প্রার্থনা করেছিল আংটি হারিয়ে যাক। এমনভাবেই হারাক, যেন ওকে মিথ্যাও বলতে না হয়; সত্যটাও জানাতে না হয়। শুধু একবার এই আংটিটা গুম হওয়ার ঘটনা ঘটুক! যদি ঘটে, তবে স্রষ্টার কাছে বলা সেই নিঃশব্দ আর্জিটুকু ফলে যাবে।
“যদি এই দূরবর্তী সফরে হাতের চিহ্নটা ঠিক থাকে, তবে বুঝে নিব, এই প্রস্তাবই উপর্যুক্ত ভবিষ্যৎ। যদি এই সফরে বিপদ ঘটে, তবে প্রস্তাবটা আমার জন্য কখনোই নয়। ”
এই সফরে অজ্ঞাত বিপদ, অদ্ভুত ঝামেলা, অলৌকিক ঝুঁকি যেন পরপর এসেই যাচ্ছে। একের পর এক বিস্তর রহস্যময় ঘটনা! শেষপর্যন্ত আঙুলের চিহ্নটাই হারিয়ে গিয়েছে। তবে এর খোঁজ পেয়েছে শাওলিন। কিন্তু শেষপর্যন্ত কী দাঁড়াচ্ছে উত্তর? কোনটাকে প্রাধান্য দিবে জীবনের এই অমোঘ প্রান্তে? মনে হচ্ছে এখনো কিছু ঘটা বাকি। সবচেয়ে আশ্চর্যজনক ঘটনাটাই! সময় কেমন অদ্ভুত গতিতে এগোচ্ছে, ঘনিয়ে আসছে, তেড়ে আসছে। বিরাট বিচিত্র কিছু কী অপেক্ষারত?
.
.
.
চলবে..................................................