সকালের নাস্তার জন্য অপেক্ষা করছি। সকালের নাস্তাটা বেশ আয়োজন করে একসাথে হয় আমাদের বাড়িতে। কেউ একা খেয়ে ফেলে নিজের কাজে যাওয়ার নিয়ম যেমন নেই, তেমনি নাস্তার সময় কেউ ঘুমিয়ে থাকার নিয়মও নেই। সকাল ৭ টায় সকলে একসাথে বসে নাস্তা করে এবাড়িতে। সকলে বলতে দাদাজান, বাবা, ছোট চাচ্চু, মা, আর আমার ছোটবোন মিন্নি। এই পরিবারে আমার সবচেয়ে খাতিরের লোক হচ্ছেন দাদাজান। তিনি রেলের কাস্টমসে চাকরি করতেন। ছোট চাচ্চু যখন ছোট, তখন দাদীজান মারা জান। দাদাজান তারপর আর বিয়েসাদি করেননি। তিনি ভীষণ মজার মানুষ। আমার বেশিরভাগ সময় তার সাথে গল্প করেই কাটে। আর তার যত আবদার সব কেবল আমার কাছেই করেন। বাবা হয়েছেন দাদাজানের ঠিক বিপরীত। তিনি রাশভারি মানুষ। তিনি যতক্ষণ বাড়িতে থাকেন, আমি এবং মিন্নি যথাসম্ভব তার সামনে না পড়ার চেষ্টা করি। শুধু আমরা না, বাড়ির সকলেই তাকে ভয় পায়। তিনি পেশায় কলেজের শিক্ষক। আমার মা সাদাসিধে গৃহিনী। বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়ার সময়ে বিয়ে হয়ে যায়। তারপর বাবা নিজেই তার পড়াশোনার দায়িত্ব নেন। অনার্স পাশ করার পর আর পড়াশোনা হয়নি। চাকরি করার সুযোগও পাননি। দাদীজান মারা যাওয়ায় সংসারের হাল ধরতে হয়েছে। আমার মেজ চাচা-চাচী আলাদা থাকেন। তাদের দুই ছেলেমেয়ে আছে। ছোট চাচ্চু আমাদের সাথেই থাকেন। বিসিএসের পড়াশোনা করেন আর টুকটাক টিউশনি। চাচ্চু হচ্ছে আমাদের বাড়ির একমাত্র অঘটনঘটনপটিয়সী। ধরুন আপনি ঘুমুচ্ছেন, তার মনে হলো আপনাকে ভিজিয়ে দেয়া উচিত। সে ডাইনিং টেবিল থেকে জগ এনে আপনার গায়ে ঢেলে দেবে। এই বালিশ, তোষক কীভাবে শুকানো হবে সেটা তিনি একবার ভাববেন না। একবার চাচ্চু আমাকে জিজ্ঞেস করলেন, তিন্নি চা খাবি? আমি নিজের জন্য একটা স্পেশাল চা বানাচ্ছি তোর জন্যও বানাব? আমি তার কথা বিশ্বাস করে খেতে চাইলাম। সেই চা মুখে দিয়ে আমার বমি করার মত অবস্থা হয়েছিল। কারণ সে চায়ে প্রচুর পরিমানে লবন দিয়েছিল। ভুলে নয়, ইচ্ছে করেই দিয়েছে। তার একজন সুন্দরী প্রেমিকা আছে। জানি না সেই প্রেমিকা কীভাবে এই পাগলের সাথে এতবছর পর্যন্ত সম্পর্কে আছেন! মিন্নি আমার বাবা মায়ের আদরের কন্যা। ক্লাস টেনে পড়ে। বাবা অতটা আহ্লাদ না দিলেও মা তাকে আহ্লাদ দিয়ে মাথায় তুলেছেন। তার চাহিদার শেষ নেই। আমার মনে হয় মায়ের মিন্নিকে আরেকটু শাসন করা উচিত। মা যে আমাকেও খুব শাসন করেছেন তা নয়। কিন্তু আমি এমনিতেই একটু লক্ষী ধরনের মেয়ে। তেমন বিশেষ কোনো চাহিদা নেই। আজ পর্যন্ত বাবা মা যেমন বলেছেন তেমন করেই চলেছি। মা সবার প্লেটে খাবার তুলে দিচ্ছেন। গরম গরম খিচুড়ি। এই খিচুড়ি দেখে আমার মনে পড়ে গেল আদনান সেদিন রাতে খিচুড়ির কথা জিজ্ঞেস করেছিল। তার মানে আদনানের খিচুড়ি পছন্দ? এরপর বিদ্যুৎ চমকানোর মত করে আমার মাথায় একটা কথা ঘুরপাক খেতে লাগলো। আদনান আমাকে কেন জিজ্ঞেস করলো যে আমি খিচুড়ি রাঁধতে পারি কি না? আবার তার প্রিয় পিঠা বানাতে পারি কি না এটাও কেন জিজ্ঞেস করল? তার মানে কি সেও আমাকে নিয়ে সারাজীবনের জন্য কিছু ভাবছে? এসব ভাবতে ভাবতে খুশিতে গলায় খাবার আটকে গেল আমার। মা পানি এগিয়ে দিল।
পানি খেয়ে হঠাৎই জিজ্ঞেস করলাম,
"আচ্ছা মা তুমি কি পাকন পিঠা বানাতে পারো?"
মা বললেন,
"না। যেই ঝামেলা! বড় আপার শাশুড়ী বানাতো। এত ঝামেলা করার সময় কোথায় আমার?"
"রেসিপি তো জানো। আমাকে শেখাও।"
"নারে পাগল দুএকদিন তাকে পিঠা কাটতে দেখেছি। কী কী উপকরণ দিতো, কতটুকু করে তা তো আর জানি না।"
"সে তো এখন আর বেঁচে নেই আমি শিখবো কী করে?"
"তুই শিখে কী করবি?"
দাদাজান বললেন,
"আহা বড় বৌ তিন্নির যে একটু রান্নাবান্নার শখ তা তো তুমি জানোই৷ তোমার বড় বোন পারে কি না দেখো, পারলে ওকে শেখাতে বলো।"
দাদাজানের কথায় মা ব্যবস্থা করে দিলেন। বড় খালামনি পাকন পিঠা বানাতে পারেন। তার বাসায় গিয়ে পিঠা বানানো শিখতে লাগলাম। তিন দিন চেষ্টা করার পর চার দিনের দিন সফল হলাম। আদনানের সাথে যদি আমার কিছু হয় তবেই তাকে তার প্রিয় পাকন পিঠা খাইয়ে সারপ্রাইজ দেব। আর কিছু না হলে, আদনানকে কখনো জানতেও দেব না বহুদূরে তার নিজ দেশে একটি মেয়ে তার জন্য এত কঠিন একটা জিনিস বানানো শিখেছে! মোবাইল হাতে অবাক হয়ে বসে রয়েছি। কারণ নোটিফিকেশন প্যানেলে দেখা যাচ্ছে আদনান আমার ছবিতে কমেন্ট করেছে! এই প্রথম আদনান একটা কমেন্ট করলো! আমি কমেন্টটা দেখার জন্য ঢুকলাম। আদনান লিখেছে 'দ্যাট রেস্টুরেন্ট' সাথে লাভ ইমোজি। আজ মিন্নিকে নিয়ে একটা কাজে গিয়েছিলাম। মিন্নি কী মনে করে হুট করেই বাসার সামনের রাস্তায় আমার একটা ছবি তুলেছে। আমি অবশ্য তখন খেয়াল করিনি। ছবিটা বেশ সুন্দর হওয়াতে ফেসবুকে পোস্ট করেছি। আদনান সেই ছবিতেই কমেন্টটা করেছে। ছবিতে পেছনে একটা রেস্টুরেন্ট দেখা যাচ্ছে।
আমি কমেন্টে রিপ্লাই দিলাম,
'তোমার পছন্দের রেস্টুরেন্ট?'
আদনান আর কমেন্ট না করে মেসেজ দিল,
"এই রেস্টুরেন্টের সাথে আমার অনেক স্মৃতি জড়িয়ে আছে তিন্নি। আমি এখানে কাজ করতাম। আমার প্রথম চাকরি এই রেস্টুরেন্টে।"
আমি বেশ অবাক হলাম,
"এখানে! কি কাজ করতে এখানে?"
"প্রথমে কিচেনে কাজ করতাম। কিছুদিন পর ওয়েটারের কাজ দিয়েছিল।"
"ওহ বুঝেছি।"
"এই রেস্টুরেন্টের প্রত্যেকে এত আদর করত! আজও সবার কথা মনে পড়ে।"
"বাহ! আচ্ছা এই রেস্টুরেন্ট বরাবর ঠিক সামনে একটা দোতালা সাদা বাড়ি আছে জানো?"
"খেয়াল করিনি।"
"আছে। আর ওটা আমাদের বাড়ি।"
"তাই নাকি!"
"হ্যাঁ দোতলায় আমরা থাকি, নিচতলাটা ভাড়া দেয়া।"
দিন শেষে আমার আবার মন খারাপই হলো। কারন আমি ভেবেছিলাম আদনান বুঝি আমার ছবি দেখে আমাকে নিয়ে কিছু বলবে! ক'দিন বাদে রাতের বেলায় পড়তে বসেছিলাম। হঠাৎ আদনানের মেসেজ এলো। ঘড়িতে তাকিয়ে দেখি রাত ১২ টা বাজে মাত্র! এত তাড়াতাড়ি আদনানের মেসেজ দেখে কিছুটা অবাক হলাম! আদনান তো বাংলাদেশী সময় রাত একটার আগে বাড়িতেই ফেরে না। তাই একটা বাজার আগে আগে মেসেজ দেই। যেখানে আমি মেসেজ না দিলে আদনানের খবরও থাকে না সেখানে আজ আদনান নিজ থেকে মেসেজ দিয়েছে! অবিশ্বাস্য ব্যাপার!
মেসেজ ওপেন করে দেখলাম আদনান লিখেছে,
"হাই তিন্নি।"
আমি লিখলাম,
"হ্যালো।"
"ফোন করতে পারি?"
ইদানীং আদনানের সাথে প্রতিদিন ফোনেই কথা হয়। সে নিজেই প্রতিদিন ফোন করতে চায়। কিন্তু ফোন করে বেশিরভাগ সময় সে চুপ করে থাকে। আমিই বকবক করি। তবু ফোনের ওপাশে আদনানের ওই চুপ থাকাতেও আমার কোথায় যেন আনন্দ। চুপ থাকুক তবু সাথেই তো আছে।
ফোন ধরেই জিজ্ঞেস করলাম,
"আজ এত তাড়াতাড়ি?"
"তাড়াতাড়ি কাজ শেষ, তাই তাড়াতাড়ি বাড়ি ফিরেছি।"
হঠাৎ সমুদ্রের গর্জন শুনতে পেয়ে জিজ্ঞেস করলাম,
"সমুদ্রের গর্জন?"
"হ্যাঁ।"
"তুমি কি বীচে?"
"আমি আমার বাসার বারান্দায়।"
"সমুদ্রের গর্জন এতদিন শুনিনি তো।"
"আমি বারান্দায় বসে তোমার সাথে কখনো কথা বলিনি তেমন, তাই হয়তো শুনতে পাওনি।"
"বারান্দায় বসে কথা বলো না কেন তাহলে?"
"আমি তো সবসময় রান্না করতে করতে খেতে খেতে, শুতে শুতে কথা বলি। এরপর তো পরেরদিন অফিসের প্যারায় ঘুমিয়েই পড়ি। বারান্দায় আসার সময় কোথায়?"
"ওহ আচ্ছা। আদনান আমার জন্য একটা কাজ করতে পারবে প্লিজ?"
"বলো।"
"কাল সকালে এই সমুদের একটা ছবি দেবে?"
"ঠিক আছে দেব।"
"থ্যাংকস। আচ্ছা আজ হঠাৎ বারান্দায় গেলে যে?"
"অনেক দিন পর ক'দিন ছুটি পেয়েছি। কাল অফিসে যেতে হবে না। বেলা করে ঘুম থেকে উঠলেও চলবে।"
"আচ্ছা। কী করবে এই কদিন? মানে হলিডে কীভাবে কাটে তোমার?"
"একেক হলিডে একেক ভাবে কাটে। কাল সিটিতে যাব। সেখানে আমার এক বন্ধু আছে, তার সাথে মুভি দেখতে যাব। পরশু কাপড় ধোবো। তারপরের দিনগুলোর কোনো প্ল্যান এখনো করা হয়নি।"
তিন্নি সুযোগ পেয়ে একটা খোঁচা মারলো,
"মুভি! গার্লফ্রেন্ডের সাথে?"
আদনান হেসে বলল,
"না। ছেলে বন্ধু, কলিগ।"
"তোমার গার্লফ্রেন্ড নেই?"
আদনান আবারো হাসলো,
"না।"
"কেন নেই?"
"মানে? আচ্ছা বাংলাদেশের সব মানুষ এটা কেন ভাবে যে বিদেশে যারা থাকে তাদের গার্লফ্রেন্ড অবশ্যই থাকে, তারা রেগুলার মদ খায়, পাবে যায়। এর কি কোনো সুনির্দিষ্ট কারণ আছে?"
"বাকিগুলো জানি না। কিন্তু গার্লফ্রেন্ড থাকাটাই স্বাভাবিক নয় কি?"
"বাংলাদেশে থাকলে হয়তো এতদিনে থাকতো।"
"ওখানে কী সমস্যা? মেয়ের অভাব নাকি ওখানে!"
"অভাব বৈকি, আজ অবধি এখানে সুবিধা মতো একটা বাঙালি মেয়ে পাইনি।"
"বাঙালি মেয়েই লাগবে? ড্যানিশ মেয়েতে কি সমস্যা?"
"বিদেশী মেয়ে দিয়ে আমার হবে না। আমার দরকার খাঁটি দেশী মেয়ে। বাংলায় কথা বলার মত কেউ তো থাকা চাই।"
আমি ভীষণ স্বস্তি পেলাম এ কথা শুনে।
খানিক বাদে আবার জিজ্ঞেস করলাম,
"বাংলাদেশে যখন ছিলে তখন কেউ ছিল?"
"উঁহু, তবে ক্রাশ টাশ খেয়েছিলাম। কিন্তু কাউকেই বলার সাহস হয়নি। নিজের ভবিষ্যৎ যেখানে অনিশ্চিত সেখানে সেই জীবনের সাথে কাউকে জড়ানো অন্যায় হতো। আজ আমি এখানে ভালো চাকরি করছি। কিন্তু এসব ছিল অনিশ্চিত।এমনও হতে পারতো যে আমি ঢাকা শহরের অলিতে গলিতে রিক্সা চালাই।"
এসব কথা শুনলে আমার দম বন্ধ হয়ে আসে।
প্রসঙ্গ পাল্টানোর জন্য বললাম,
"তুমি গিয়েছো কত বছর হলো?"
"৭/৮ বছর।"
"এর মধ্যে একবারও আসোনি?"
"আমার বাংলাদেশে যাওয়ার কোনো কারণ নেই তিন্নি। কেউ নেই সেখানে আমার।"
মনটা খারাপ হয়ে গেল আমার। আমি কি আদনানের কেউ নই? একদম কেউ নই?
আদনান বলল,
"আমার কথা বাদ দাও। তোমার কথা বলো, তোমার বয়ফ্রেন্ডের কথা বলো।"
মনে মনে হাসলাম। আমার মতই সেও ভাবছে তাহলে?
বললাম,
"আমার বয়ফ্রেন্ড নেই।"
"কেন? আজকাল তো শুনি বাংলাদেশের সব ছেলেমেয়েরা প্রেম করে।"
"আমার মাথাটা একটু গরম। ছেলেরা মাথাগরম মেয়েকে সহ্য করতে পারে না।"
আদনান হেসে ফেলল,
"মাথা গরম তোমার! কই আজ অবধি তো দেখলাম না।"
"তুমি দেখবে কীভাবে, তোমার সাথে তো আমার কখনো দেখাই হয়নি।"
"কথা তো হয়েছে।"
"হুম।"
"মাথা গরম মেয়েদের মাথা কিন্তু আবার খুব সহজে ঠান্ডাও হয়ে যায়।"
"তাই নাকি?"
"হ্যাঁ আমার ধারনা তোমারও এমন হয়।"
বিশ্বাস করুন, হঠাৎ কোত্থেকে একদল মেঘ এসে যেন পড়লো আমার গায়ে। খুব ভালো লাগলো। সবাই আমার রাগটাই দেখে, অল্পতেই যে তার রাগ ঠান্ডাও হয়ে যায় সেটা তো কেউ দেখে না। শেষমেশ ব্যাপারটা কি না সবচেয়ে কাঙ্ক্ষিত মানুষটার চোখে পড়লো!
.
.
.
চলবে.............................................