স্মরণ চলে যাওয়ার পর কেউ ঘুমায়নি আর। আজ মানতাসার বৌভাতের অনুষ্ঠান। ছেলের বাড়িতে কে কে যাবে সে নিয়ে আলোচনায় বসেছে বাড়ির বড়রা। আর রাফা চলে এসেছে মানতাসার রুমে। তবে এখন রুমে মানতাসা নেই। গতকাল থেকে এ বাড়ি আর মানতাসার নেই। সে অন্য বাড়ির বউ হয়ে গিয়েছে।
রাফা রুমে এসেই নীলিমার পাশে শুয়ে পড়লো। নীলিমা জেগেই ছিলো। স্মরণের চলে যাওয়ার ঠিক আগ মুহূর্তে তার ঘুম ভেঙে যায়। যদিও সে রাতে পূর্ণ আত্মবিশ্বাসে ঘুমিয়েছিলো যে সকালে স্মরণের যাওয়ার আগ পর্যন্ত সে ঘুম থেকে উঠবে না। কিন্তু তার অবচেতন মনের বাগবিতণ্ডায় ঘুম ভেঙে যায়। তবুও সে জোরপূর্বক চোখ বন্ধ করে শুয়ে ছিলো। কিছুটা নিজের উপর জিদ দেখিয়ে, কিছুটা স্মরণের সাথে জিদ দেখিয়ে। যদিও তার কান দুটো বাইরের দিকে ছিলো। স্মরণের চলে যাওয়া, সবার কাছ থেকে বিদায় নেয়া সবটাই শুনছিলো নীলিমা। কিন্তু বন্ধ চোখে। কিছুতেই সে স্মরণকে দেখবে না এবং স্মরণকে নিজের দেখা দিবে না, এই প্রতিজ্ঞায় বদ্ধ হয়ে ছিলো আজ। অবশেষে সেই প্রতিজ্ঞা পূরণও করতে পেরেছে নীলিমা। কিন্তু কোথায় যেনো কিছু নেই নেই সুবাস ছড়িয়ে পড়েছে। অজ্ঞাত সেই 'কিছু'র খামতি সে এখন থেকেই অনুভব করতে পারছে। নীলিমার মন সেই 'কিছু' নামক জিনিসটার অস্তিত্ব, নাম-ধাম সবই জানে। কিন্তু মস্তিষ্ক তা মানে না। জেনেও সত্যটা মানতে চাইছে না মানুষের সর্বোৎকৃষ্ট এই অঙ্গটি।
রাফা কিছুক্ষণ পাশ ফিরে শুয়ে অবশেষে সটান হয়ে শুয়ে পড়লো। বড় এক দীর্ঘশ্বাস ফেললো সে। নীলিমা যে জেগে আছে এটা সে টের পেয়েছে রুমে ঢুকা মাত্রই। নীলিমার উদ্দেশ্যে সে এবার বললো,
" জানিস নীলু? স্মরণ ভাই চলে যাওয়ার একদম আগ পর্যন্ত তোর আসার অপেক্ষা করছিলো। উনি হয়তো ভেবেছিলো ঢাকায় যাওয়ার আগে একবার তোর শেষ দেখাটা দেখে যাবে। কিন্তু তুই অকারণে গেলি না। কেনো বল তো?"
নীলিমা জবাব দিলো না। সকাল সকাল নিজের মন মেজাজ নষ্ট করার মানে নেই। এখন স্মরণকে নিয়ে কথা বলতে গেলেই মন মেজাজ তিরিক্ষি হয়ে যাবে। রাফা যে স্মরণের পক্ষ নিবে এটাও সে শতভাগ নিশ্চিত। এজন্য ঘুমানোর অভিনয় এখনও চলমান রাখলো সে।
" দেখ নীলু, আমি জানি তুই জেগে আছিস। শুধু শুধু ঘুমানোর নাটক করিস না। "
নীলিমা তবুও নড়লো না। নিজেকে পাকা অভিনেত্রী দেখানোর প্রয়াস! রাফা ফের বললো,
" কথা শুনছিস, বুঝছিস, তবুও না শোনার, না বোঝার ভান করছিস কেনো?"
এরপরও নীলিমা নড়লো-চড়লো না। ফোঁস করে হতাশার নিঃশ্বাস ফেললো রাফা। বললো,
" আচ্ছা থাক তবে এই টপিক। ঘন্টা দুয়েক ঘুমিয়ে নেই। তুইও ঘুমা। পরে কথা হবে না। আবার এগারোটার মধ্যে বের হতে হবে মানতাসা আপুর শ্বশুরবাড়ির উদ্দেশ্যে।"
বলেই অন্য পাশ ফিরে ঘুমিয়ে পড়লো রাফা। নীলিমা তখনও গভীর চিন্তায় মশগুল। মন মস্তিষ্কের এই প্রতিদ্বন্দ্বিতায় কে জিতে যাবে সেটাই দেখার অপেক্ষা রাখে।
-----------------------
মানতাসার বৌভাতের অনুষ্টানে কয়েকজন বাদে বাকি সবাই গিয়েছে। যায়নি শুধু বাহাদুর শেখ, আসমানী বেগম, নাজমা বেগম, মাসুদা বেগম, নীলিমা ও রাফা। ফাহাদের বাড়িতে নীলিমা ও রাফারও যাওয়ার কথা ছিলো। কিন্তু শেষ সময়ে এসে নীলিমা যেতে বাধ সাধে। কিছুতেই সে ভিড়ভাট্টার মধ্যে যেতে চাইছিলো না। ওকে দেখাদেখি রাফাও যায়নি।
নীলিমা ড্রইংরুমে বসে টিভি দেখছে আর চানাচুর খাচ্ছে। রাফাও খাচ্ছিলো। কিন্তু পানি নিতে এসে হঠাৎ নাজমা বেগম ওকে রান্নাঘরে ডাক দিলেন। সে মুহূর্তে মাসুদা বেগম রান্নাঘরে ছিলেন না। রাফাকে একা পেয়েই নাজমা বেগম গলার স্বর খাদে নামিয়ে ভারী সতর্ক কণ্ঠে শুধালেন,
" নীলুর কি হয়েছে রে রাফা?"
রাফা খানিকটা ঘাবড়ে গেলো। বড় মামির কাছে ভুলবশত কিছু ফাঁস করে দিলেই বিপদ। বিপদখানা এড়িয়ে যেতে তাই তো বড়সড় এক মেকি হাসি দিয়ে বললো,
" কই? কিছু হয়নি তো মামি। কি হবে ওর।"
নাজমা বেগমের মনে সন্দেহ বাতিক রোগটা মাঝেমধ্যে প্রবল হয়ে ধরা দেয়। আজও তার ব্যতিক্রম হয়নি। রাফার কথার শুরুতেই তিনি সন্দেহ করে বসলেন। তাই আরোও জোর দিয়ে জিজ্ঞেস করলেন,
" সত্যি করে বল রাফা। দুদিন আগেও তো নীলু স্বাভাবিক ছিলো। গতকাল থেকে ওকে এমন দেখছি। আজ মানতাসার শ্বশুরবাড়িতেও গেলো না। ব্যাপার কি?"
রাফা শুকনো একটা ঢোক গিললো। নিজ বক্তব্যে অটল থেকে বললো,
" আরে মামি আপনি বেশি বেশি চিন্তা করছেন। ওর কি হবে। এতো এতো অনুষ্ঠান, হৈ-হুল্লোড়ে হয়তো ক্লান্ত হয়ে গিয়েছে। "
নাজমা বেগম তবুও বিশ্বাস করলেন না। তেরছা চাহনিতে চেয়ে এবার আরোও হুঁশিয়ারি গলায় জিজ্ঞেস করলেন,
" আচ্ছা সত্যি করে বল তো, নীলু আর স্মরণের মধ্যে কিছু ঘটেছে? "
রাফা বিস্মিত হলো, ঘাবড়ে গেলো। মুখে না বললেও ওর বিস্ময়ে বড় হয়ে আসা চোখ দুটো নাজমা বেগমকে আরোও সন্দেহ করতে উদ্যত করলো। তিনি তীক্ষ্ণ দৃষ্টিতে চেয়ে বললেন,
" এর মানে সত্যিই নীলু আর স্মরণের মধ্যে...."
নাজমা বেগম কথা শেষ করার পূর্বেই রাফা হেসেই কথাটা উড়িয়ে দিলো। যেনো মস্ত বড় এক কৌতুক বলেছেন তিনি,এমন ভান করে হাসলো রাফা। বললো,
" কি যে বলেন মামি। ঐ দুজনের মধ্যে কিছু হতে যাবে কেনো। আপনি হয়তো খেয়াল করেননি। কিন্তু নীলু আর স্মরণ ভাই তো গতকালও কথা বলেছে।"
" কখন কথা বলেছে? "
" অতো সময় তো মনে নেই। তবে কথা বলেছে। আচ্ছা মামি, আমি পানি নিতে এসেছিলাম। আমি যাই তাহলে। আর এত বেশি ভাববেন না। "
বলেই রাফা এক দৌড়ে রান্নাঘর ছেড়ে পালালো। রাফার এ কান্ডে নাজমা বেগমের সন্দেহ আরোও পাকাপোক্ত হলো। এবার নিশ্চিত হওয়ার পালা। কিন্তু কিভাবে নিশ্চিত হবে এটা ভাববার বিষয়।
এদিকে রাফা এসেই নীলিমার পাশে ধপ করে বসে পড়লো। রীতিমতো হাঁপাচ্ছে সে। ঘেমেও গিয়েছে যেনো বিশাল এক যুদ্ধ জয় করে এসেছে সে। তার এহেন অবস্থা দেখে নীলিমা জিজ্ঞেস করলো,
" কি রে? কি হয়েছে? এত ঘেমে গিয়েছিস কেনো?"
রাফা হাঁপাতে হাঁপাতে বললো,
" তোর হবু শাশুড়ির সাথে যুদ্ধ করে এলাম মাত্র।"
" মানে?"
" মানে বড় মামির সাথে যুদ্ধ করে এলাম। "
নীলিমা কটমট করে চেয়ে রইলো রাফার দিকে। অতঃপর তার বাহুতে এক কিল বসিয়ে বললো,
" মুখের ভাষা ঠিক কর বজ্জাত। হবু শাশুড়ি কিসের! বড় মামি উনি।"
রাফা এবার স্বাভাবিক হয়ে বসলো। বললো,
" আজকের বড় মামি, আগামী দিনের শাশুড়ি। "
নীলিমা এ শুনে দাঁত কিড়মিড় করে বললো,
" মা র খাবি কিন্তু রাফা। শাশুড়ি কিসের হুম? স্মরণ ভাইয়ের সাথে কিছু হয়েছে যে উনি আমার শাশুড়ি হতে যাবে?"
রাফা আচমকা নীলিমার হাত চেপে দাঁড়িয়ে পড়লো। বললো,
" কিছু তো একটা হয়েছে। তুই এক্ষুণি উঠোনে গিয়ে আমাকে এ টু জেড ডিটেইলসে বলবি। এই দুইদিন আমাকে কিচ্ছুটি জানাসনি। এখনই চল। "
বলেই সে নীলিমার হাত ধরে টান দিলো। নীলিমাকে টিভি বন্ধ করার সুযোগটুকুও দিলো না।
উঠোনের আম গাছের নিচে টুলে বসে আছে দুজন। নীলিমা নীরব আর রাফা সরব। রাফা একের পর এক প্রশ্ন করেই যাচ্ছে হলুদের দিনের ঘটনাকে কেন্দ্র করে।
" স্মরণ ভাই যে তোকে ভালোবাসে সে নিজ মুখে বলেছে?"
নীলিমা নিস্তরঙ্গ গলায় বললো,
" হুম।"
" কখন থেকে উনি এটা বুঝতে পারলো কিছু বলেছে?"
" না।"
" কিন্তু আমার মনে হচ্ছে এসব রিসেন্ট হয়েছে। উনি হয়তো রিসেন্টলি এটা ফিল করেছে।"
" হুম। আমিও সেটা বুঝতে পারছি। "
" তাহলে তোর জবাব কি হবে?"
নীলিমা এতক্ষণ মাটির দিকে তাকিয়েছিলো। এ প্রশ্ন শুনে চট করে রাফার দিকে চেয়ে বললো,
" কি জবাব হবে মানে? অবশ্যই 'না' হবে। এর আগে পিছে কোনো কথা নেই। "
রাফা অবাক স্বরে জিজ্ঞেস করে,
" কিন্তু কেনো? 'না' বলবি কেনো? তুইও তো স্মরণ ভাইকে ভালোবাসতি নীলু। আজ উনিও তোকে ভালোবাসে। তাহলে উনাকে রিজেক্ট করবি কেনো?"
" আমি উনাকে ভালোবাসতাম রাফা। এখন বাসি না। হ্যাঁ, এখন যদি নিজেকে সুযোগ দেই, উনাকে নিয়ে ভাবি, হয়তো পুরোনো অনুভূতিগুলো আবারও অনুভব করতে পারবো। এটা আমি নিজে অস্বীকার করলেও বলবো যে, উনার জন্য এখনও আমার মনে কিছু আছে৷ কিন্তু উনার ভালোবাসা বা পছন্দ যা-ই বলি না কেনো সেসব মাত্র শুরু। দুদিনের এই পছন্দ প্রেমে যদি উনি আমাকে বিয়ে করতে চায় সেটা সবচেয়ে বড় ভুল হবে। কেননা আমার মনে হয় উনি পস্তাবেন। অল্প কয়েকদিনের প্রেমে এত বড় সিদ্ধান্ত নেয়াটা আমি সাপোর্ট করি না রাফা। আবার আমাদের ফ্যামিলিতে এমন কাজিন বিয়ে নেই। আবেগের বশে হয়তো স্মরণ ভাই বিয়ে করার সিদ্ধান্ত নিয়েও ফেললেন। কিন্তু আমাদের ফ্যামিলিতে কি কেউ রাজি হবে বলে তোর মনে হয়? বিশেষ করে আব্বু আর বড় মামি যেনো এখনও একে অপরের শত্রু। এতকিছুর পরও আমি নিজেকে এসব নিয়ে দ্বিতীয়বার ভাববার সুযোগ দিতে চাচ্ছি না। "
রাফা নীলিমার সম্পূর্ণ যুক্তি বুঝলো। তবুও সে স্মরণকে সুযোগ দেয়ার পক্ষে রইলো। বললো,
" কাজিন বিয়ে, খালু আর মামির ঝামেলা, এই দুটো বিষয়কে সাইডে রেখে বাকিটা চিন্তা কর নীলু। আর যাই বলিস স্মরণ ভাইকে আমার পিওর মনে হয়। হ্যাঁ উনি দুষ্টুমি করে ঠিক। কিন্তু কারোর ইমোশন নিয়ে খেলার বয়স উনার নেই এখন। বয়স ত্রিশের কোঠায়। কোনোদিনও গার্লফ্রেন্ড, প্রেম এসবের চক্করে ছিলেন না। এই বয়সে এসে যদি তোকে প্রপোজও করে সেটাকে আমি ভুল বলবো না। প্লাস নাটক বা আবেগও বলবো না। উনার বয়সটা এখন আবেগের নেই। উনি যথেষ্ট ম্যাচিউর। তোকে পছন্দ হয়েছে, বলেছে। এখন তুই কি জবাব দিবি সেই অপেক্ষায়। "
ফোঁস করে নিঃশ্বাস ছাড়লো নীলিমা। বললো,
" উনার এ অনুভূতি আবেগ নাকি বিবেকের খেলা সেটা আমি জানি না। কিন্তু এই অল্প সময়ের ব্যবধানে যে অনুভূতি উনার মাঝে তৈরি হয়েছে তা নিয়ে আমি যথেষ্ট সন্দিহান৷ বিয়ের পর যদি আমার প্রতি উনার উদাসীনতা কাজ করে তবে? যদি উনার এই সিদ্ধান্ত পরে গিয়ে তাড়াহুড়ার সিদ্ধান্ত মনে হয় তাহলে? আমি এমন অনেক দেখেছি রাফা, বিয়ের বেশ কয়েক বছর পরও বলে একে অপরকে ভালো লাগছে না। আর এখানে তো উনার সপ্তাহ খানেকের প্রেম। আমি বলবো স্মরণ ভাই খুব দ্রুতই সিদ্ধান্ত নিয়ে ফেলেছে। উনাকে এ নিয়ে আরোও ভাবতে হবে। বিয়ের পর সামনের মানুষটা আমাকে ভালোবাসতো না বা সামনের দিনগুলোতেও ভালোবাসবে না, এ ব্যাপারটা আমি মানিয়ে নিতে পারবো রাফা। কিন্তু বিয়ের আগে সে আমাকে ভালোবাসতো, বিয়ের কয়েক মাস পরও ভালোবাসতো। কিন্তু হুট করেই আমাকে তার ভালো লাগলো না, আমার প্রতি তার আর অনুভূতি রইলো না। এটা আমি সহ্য করতে পারবো না রাফা।"
.
.
.
চলবে...........................................