প্রেমান্বেষা - পর্ব ২৭ - সারা মেহেক - ধারাবাহিক গল্প


" নীলু, পরশুদিন ছেলেপক্ষ তোকে দেখতে আসবে। আমার বন্ধু কবিরকে তো চিনিসই। ওর ছেলের জন্য তোকে সপরিবারে দেখতে আসবে। শুক্রবার যেহেতু, ক্লাস নেই, রেডি থাকিস। "

বাবার মুখে এ কথা শুনে হঠাৎ বিষম খেলো নীলিমা। ফলস্বরূপ কাশি দিতে দিতে পানির গ্লাসটা হাতে নিয়ে ঢকঢক করে পানি খেয়ে নিলো। তার এরূপ হঠাৎ বিষম খাওয়া দেখে মিলি বেগম ও ইমাদ সাহেব একটুখানি ঘাবড়ে গেলেন। ইমাদ সাহেব মেয়ের পিঠে বা হাত দিয়ে আলতো চাপড় দিতে দিতে বললেন,
" কি রে মা, ভাত ঠেকে গেলো কিভাবে?"

নীলিমা সময় নিয়ে স্বাভাবিক হলো। ইমাদ সাহেবের দিকে চেয়ে কিঞ্চিৎ কড়া গলায় বললো,
" আমাকে না বলে ছেলে দেখাতে নিয়ে আসছো কেনো আব্বু? এটলিস্ট একবার আমাকে জিজ্ঞেস করতে পারতে!"
বলেই সে পাতে খাবার রেখেই উঠে গেলো। তার এহেন আচরণে ইমাদ সাহেব অবাক কণ্ঠে মিলি বেগমকে বললেন,
" নীলু ওভাবে বললো কেনো! এর আগে তো কখনো এমন করেনি।"

মিলি বেগম অবাক হলেন না মেয়ে-বাবার এ কান্ডে। তিনি নির্বিঘ্নে খাবার খেতে খেতে বললেন,
" মেয়েকে না জানিয়ে ছেলে নিয়ে এলে এমনই হবে। "

ইমাদ সাহেব আশ্চর্যপূর্ণ গলায় বললেন,
" আজ তো প্রথম না মিলি। এর আগেও তো ছেলে এনেছি। "

" একই জিনিস একবার, দুবার ভালো লাগে, সহ্য করে নেয়া যায়। বারবার না। "
বলে তিনিও উঠে গেলেন প্লেটসহ। এদিকে মা মেয়ে দুজনের ব্যবহারে থম মেরে বসে রইলেন ইমাদ সাহেব। খানিক দ্বিধাদ্বন্দ্বে পড়ে গেলেন, ছেলেপক্ষকে নাকচ করবেন নাকি মেয়েকে বুঝাবেন। এ নিয়ে ভাবতে ভাবতে প্লেটের দিকে তাকালেন। আধ মাখানো ভাতগুলো দেখে এ মুহূর্তে আর খাওয়ার ইচ্ছে হচ্ছে না। তাই ওভাবেই খাবার রেখে বেসিনে হাত ধুয়ে নিলেন। 

এদিকে রুমে ঢুকেই রাগে ক্ষোভে কাঁপতে লাগলো নীলিমা৷ প্রচন্ড ক্রোধে তার চোখজোড়া নোনাজলে ভরে উঠলো। বিছানা থেকে বালিশ নিয়ে ফ্লোরে ছুঁড়ে দাঁতে দাঁত চেপে বললো,
" এমন হচ্ছে কেনো আমার সাথে! জীবনে কম ঝামেলা ছিলো যে এই ছেলেপক্ষ নামের নতুন ঝামেলা এসে ঘাড়ের উপর জুড়ে বসলো! এমনিতেই নিজের সাথে যুদ্ধের উপর থাকতে হচ্ছে। আবার ছেলেপক্ষ! "
বলেই সে মেঝেতে দু হাঁটুর উপর মুখ ভর দিয়ে বসে রইলো। এ ক'টা দিন সে যতই চেষ্টা করছে স্মরণের কথাগুলো না মনে করার ঠিক ততবারই তার মস্তিষ্কে স্মরণের প্রতিচ্ছবি ভেসে উঠেছে। নীলিমা নিজেও জানে না, ঠিক কী কারণে স্মরণকে এতোটা উপেক্ষা করছে সে। ভবিষ্যতের ভয়ে? সে তো অপরিচিত এক ছেলেকে বিয়ে করলেও থেকে যাবে। তাহলে স্মরণের ক্ষেত্রে এমন ভয় পাওয়া কতটা যুক্তিযুক্ত তা নীলিমা খোদ জানে না। 

-------------------------

উষ্কখুষ্ক চুলের ক্লান্ত চেহারার অধিকারী হয়ে স্মরণ অপেক্ষা করছে। নীলিমার অপেক্ষা। এ অপেক্ষা তার ভেতরের ভয়টা ক্রমশ বাড়িয়ে দিচ্ছে। নীলিমাকে হারানোর ভয় তার অন্তর জুড়ে বিস্তার লাভ করেছে। যত সময় গড়িয়ে যাচ্ছে ততই যেনো মনে হচ্ছে নীলিমাকে হারিয়ে ফেলছে সে। আজ হঠাৎ এমন অনুভূতি তাকে কেনো গ্রাস করেছে সে কারণ জানা নেই। এদিকে অপেক্ষার প্রহর যেনো ফুরাবার নাম নিচ্ছে না। 

প্রায় এক ঘন্টা পর এ তিক্ত অপেক্ষার প্রহরের অবসান ঘটলো। নীলিমা এলো। পরনে তার হালকা হলুদ রঙের সালোয়ার কামিজ ও সাদা হিজাব। চাহনি দূর্বল। মুখখানা ভীষণ শুকনো শুকনো লাগছে। স্মরণ ঘাড় ফিরে নীলিমাকে দেখা মাত্রই বুক ভরে প্রশ্বাস নিলো। ঠিক এ জায়গাটায় এসে তার সকল ক্লান্তি, সকল দুশ্চিন্তা, সকল ভয়ের অবসান ঘটলো। হৃদয় জুড়ো অদ্ভুত এক শীতলতা নেমে এলো, শুধুমাত্র নীলিমাকে দেখে। 
এদিকে স্মরণের এহেন অগোছালো রূপ দেখে নীলিমার বুকের ভেতরটা অজান্তেই মোচড় দিয়ে উঠলো। সে এগিয়ে গেলো হাসিমুখে। তবে কৃত্রিম হাসির আড়ালে নিজের আসলটা লুকিয়ে রাখলো। স্মরণ তাকে এগিয়ে আসতে দেখে নিজেই দু কদম বাড়ালো। কম্পিত হাতে চুলগুলো ঠিক করে বিভ্রান্ত হেসে জিজ্ঞেস করলো,
" কেমন আছো নীলিমা? "

নীলিমা সেই মেকি হাসি এঁটে রেখেই বললো,
" আছি ভালোই। আপনি? "

স্মরণের হাসিটা যেনো মুহূর্তেই উবে গেলো। সুদর্শন চেহারায় নেমে এলো একরাশ হতাশা, না পাওয়ার অজস্র দুঃখ। সে কাতর গলায় বললো,
" কিন্তু আমি ভালো নেই নীলিমা। আমি প্রতিনিয়ত যেনো নিঃশেষ হচ্ছি। "

নীলিমার বুকটা কেঁপে উঠলো। স্মরণের ঐ চাহনি, কণ্ঠস্বর সবটাই তাকে ব্যথিত করলো। কিন্তু নিজেকে শক্ত রেখে বললো,
" অন্যের কারণে নিজেকে নিঃশেষ হওয়ার সুযোগ দিবেন না স্মরণ ভাই। আপনার নিজের জীবন বলতেও কিছু আছে। "

" কিন্তু তোমাকে ভালোবাসার পর থেকে নিজের জীবন বলতে কিছুই নেই নীলিমা। "
স্মরণের কণ্ঠস্বর কেঁপে উঠলো। সে পুনরায় বললো,
" নীলিমা, আমাকে একটা সুযোগ দাও। তোমার যত অভিযোগ আছে আমি তা শুধরে নিবো। আমার মধ্যে যত দোষ আছে সব ঠিক করে নিবো। শুধু আমাকে একটাবার সুযোগ দাও। "

নীলিমা নির্বাক। স্মরণের এই আকুতি তাকে নিশ্চল করে দিচ্ছে। তবুও সে কঠোর হবার বড় ধরণের অভিনয় করলো। নির্লিপ্ত গলায় বললো,
" আপনি নিজেকে একটু সময় দিন স্মরণ ভাই। আমাকে নিয়ে এসব অনুভূতি এমনই মিটে যাবে। আপনি..... "

স্মরণ নীলিমাকে কথাটুকু শেষ করতে দিলো না।এর পূর্বেই বললো,
" তোমার প্রতি এ আসক্তি, এ অনুভূতি কখনও মিটবে না নীলিমা। আমি এখন কিশোর বয়সে নেই যে তোমার প্রতি ভালোবাসাকে দুদিনের মোহ বলে চালিয়ে দিবো। "

নীলিমা কিঞ্চিৎ তাচ্ছিল্যের হাসি দিয়ে বললো,
" মোহ শব্দটা শুধু কিশোর বয়সের জন্য না। সব বয়সের মানুষই এই মোহমায়া রোগে আক্রান্ত হয়। মোহ কেটে গেলেই তখন সামনের মানুষটা বিষাক্ত মনে হয়, অসহ্য মনে হয়। বিয়ের পর যদি আমাকেও আপনার..... "

" সেই মুহূর্তেই আমাকে খুন করে ফেলবে নীলিমা। যেদিন তোমার মনে হবে আমার মন থেকে তুমি উঠে যাচ্ছো সেদিনই আমাকে শেষবারের মতো দেখবে তুমি। হয় তুমি আমাকে মারবে, না হয় আমিই নিজেকে মেরে ফেলবো। "

নীলিমার অন্তঃআত্মা যেনো কেঁপে উঠলো। বিস্ময়ের চরম সীমায় পৌঁছে গেলো সে। স্মরণ এসব কি বলছে! মাত্রাতিরিক্ত অনুভূতির বেড়াজালে কি মাথার তার ছিঁড়ে গিয়েছে! নীলিমা স্মরণের এরূপ অসংলগ্ন কথার জবাবে ধারালো গলায় বললো,
" আপনার মাথা ঠিক আছে স্মরণ ভাই! কি সব উল্টাপাল্টা কথা বলছেন! কাউকে না পেলে জীবন থেমে থাকে না। "

" কিন্তু আমার থেমে যাবে নীলিমা। আমি নিজেকে সামলাতে পারবো না। কোনো না কোনো অঘটন ঘটিয়ে ফেলবো। "
স্মরণের চোখেমুখে অস্থিরতা দেখা যাচ্ছে। চাহনি অসংলগ্ন। পূর্বের ন্যায় সে বললো,
" আমার প্রতি তোমার বিশ্বাস নেই তাই না? তোমার মনে হয় আমি তোমাকে ছেড়ে দিবো, তাই তো? "
বলেই সে নীলিমার হাত দুটো নিজের হাতের মুঠোয় নিয়ে বললো,
" এই যে, এই যে আমি ওয়াদা করলাম। তোমাকে কক্ষনো ছেড়ে যাবো না নীলি। আমার ভালোবাসা কখনও কমবে না। আজ যেমন পাগলামি দেখছো, বুড়ো বয়সেও ঠিক এমনই পাগলামি দেখবে। আমি জানি না, সত্যিই জানি না আমার ভেতরের অনুভূতিগুলো তোমাকে কিভাবে দেখাবো। কি করলে তুমি আমাকে বিশ্বাস করবে নীলিমা? "

নীলিমা নিরুত্তর। তার দ্বিধাদ্বন্দ্ব এবার যেনো অস্থিরতায় রূপ নিলো। স্মরণের এ আকুতি, এ ইচ্ছা তাকে স্মরণের প্রতি বিশ্বাস করতে তীব্র নিবেদন জানাচ্ছে। কিন্তু মস্তিষ্ক থেকে সুক্ষ্ম এক বাধা বোধ করতে পারছে সে। 
এদিকে নীলিমার এ নিশ্চল, নিরুত্তর ভঙ্গি দেখে স্মরণ নিজের উপর থেকে ধৈর্য্য হারিয়ে ফেললো। হঠাৎ-ই নীলিমার হাত ছেড়ে তীর্যক কণ্ঠে শুধালো,
" নীলিমা? তুমি কি আমার প্রতি প্রতিশোধ নিচ্ছো? ছয় বছর আগে তোমার বাচ্চামো কানে তুলিনি দেখে আজ আমার সাথে এমন আচরণ করছো? "

নীলিমা অবাক হলো। বিস্ময় নিয়ে শুধালো,
" আপনার কি আমাকে এমন মনে হয় স্মরণ ভাই? ওসব বাচ্চামো মনে রেখে আপনার প্রতি প্রতিশোধ নিবো! এতোটাও নিচ না আমি। "

" তাহলে কি বাধা আসছে নীলিমা? আমাকে একসেপ্ট করতে কিসের বাধা আসছে বলো? "

নীলিমা নিচু দৃষ্টিতে মিনমিনে স্বরে বললো,
" জানি না। আমি কিছু জানি না স্মরণ ভাই। "

" বিশ্বাস? আমাকে বিশ্বাস করতে পারছো না? আমার কথায় ভরসা পাচ্ছো না? তোমার মনে হচ্ছে আমি তোমাকে পরে ছেড়ে চলে যাবো? "

নীলিমা নিরুত্তর রইলে স্মরণ নিজেই ধৈর্য্যহারা হয়ে বললো,
" এই ভয়টা এক অপরিচিত ছেলেকে বিয়ে করলেও পাওয়ার কথা। এমন কি গ্যারান্টি আছে যে ঐ ছেলে তোমাকে ছেড়ে যাবে না? কিন্তু আমি বারবার বলছি, আমি তোমাকে ছেড়ে যাবো না। এমন চিন্তাও মাথায় আনবো না। তুমি জানো না নীলিমা, প্রতিদিন তোমাকে নিয়ে কতবার ভাবনায় মগ্ন থাকি আমি। তোমাকে না পাওয়ার কথা চিন্তা করলেই আমি অস্থির হয়ে উঠি। অথচ তুমি আমার অস্থিরতা দেখছো না। একটুখানি সময় দাও নীলিমা। তোমাকে, আমাকে একটুখানি সময় দাও। "

এই শুনে নীলিমা নিজের মস্তিষ্কের সকল নেতিবাচক ভাবনাকে দূরে ঠেলে ফট করে বলে ফেললো,
" আমাকে একটু সময় দিন স্মরণ ভাই। এবার আমি আপনাকে জবাব জানাবো। গতবারের মতো লুকিয়ে থাকবো না। জবাব যা-ই হোক, আমি জানাবো আপনাকে। "

স্মরণ যেনো কিছুটা স্বস্তি পেলো। তবুও কাতর গলায় বললো,
" ঠিক আছে। সময় নাও তুমি। কিন্তু তোমার এ সময় যেনো আমার শেষ সময় না হয়, সে দোয়া করো। একটা কথা মনে রেখো নীলিমা, তুমি আমার জিদ নও। তুমি আমার নব্য ভালোবাসা, যাকে না পেলে আমার মরণ নিশ্চিত। "
.
.
.
চলবে.................................................

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন