যান্ত্রিক কোলাহল, অসহ্য ব্যস্ততা, ধুলোবালিতে ঠাসা শহর ঢাকায় এসে পৌঁছেছে স্মরণ। শহরে প্রবেশ মাত্রই তার শরীরের সকল শক্তি যেনো নিঃশেষ হয়ে এলো। আবারো সেই নাইন টু ফাইভ জব, বসের ক্যাচক্যাচানি, আর বাসায় এসে বুয়ার হাতের বেস্বাদ খাবারদাবার। ক'দিন বাদে সাদও চলে আসবে। কিন্তু ততোদিন পর্যন্ত একা একাই এই বাসায় থাকতে হবে।
স্মরণ বাসায় এসে কোনোমতে ফ্রেশ হয়ে গা এলিয়ে বিছানায় শুয়ে পড়েছে। আর এক ঘণ্টার মধ্যে অফিস। আধ ঘণ্টা বিশ্রাম নিয়ে বেরিয়ে পড়বে সে। রাস্তায় দোকান থেকে একটা পাউরুটি আর কলা কিনে খেতে খেতে অফিসে যাবে। স্মরণের বাসা থেকে অফিসের দূরত্ব খুব বেশি না। হেঁটে গেলে ১৫/২০ মিনিটে পৌঁছানো সম্ভব। কিন্তু যেদিন দেরি হয়ে যায় বা আলসেমি জেঁকে বসে তার ঘাড়ে সেদিন রিকশায় করে রওনা হয় অফিসের উদ্দেশ্যে। দূর্ভাগ্যবশত জ্যামে পড়লে মরার উপর খরার ঘা হিসেবে অফিসে আরোও দেরিতে পৌঁছায়। আর সেদিন কানের কাছে বসের প্যানপ্যানানি চলতেই থাকে।
অগোছালো বিছানায় বালিশের উপর বাম হাত রেখে তাতে মাথা দিয়ে শুয়ে আছে। অপর হাতে তার ফোন। ফোনে নীলিমার ছবি। মানতাসার মেহেদির অনুষ্ঠানে এক ফাঁকে চুপিচুপি ছবিটা তুলেছিলো সে। অনুমতিবিহীন এ ছবিতে নীলিমার স্নিগ্ধ হাসির প্রাণখোলা চঞ্চল এক মুহূর্ত সে ক্যামেরাবন্দী করতে পেরেছিলো। অনুমতি নিতে গেলে হয়তো ছবিটাও তোলা হতো না। নয়তো নীলিমা এই জড়তাবিহীন হাসি, জড়তাবিহীন অভিব্যক্তি দিতো না।
স্মরণ যতই নীলিমার ছবি দেখছে ততই তার ভেতর থেকে বিষণ্ণ বাতাসের দীর্ঘশ্বাস বেরিয়ে আসছে। বুকের ভেতর শূন্যতা ঘিরে ধরেছে। নিজেকে চরম ব্যর্থ মনে হচ্ছে তার। স্মরণ নীলিমার ছবির দিকে চেয়ে দীর্ঘশ্বাস ফেলে বললো,
" আমি সত্যিই বুঝতে পারছি না তোমাকে ছাড়া কিভাবে দিন কাটাবো নীলিমা। তুমি যে আমাকে কিছু না বলেই রিজেক্ট করে দিয়েছো তা বুঝতে পেরেছি। কিন্তু আমার মন কিছুতেই মানতে চাইছে না এসব। আমি যদি তোমাকে আমার ভালোবাসার তীব্রতাটুকু বুঝাতে পারতাম!"
বলেই ফের দীর্ঘশ্বাস ফেললো স্মরণ। তাদের এ সম্পর্কের বাধা হয়তো কেউ-ই হতো না, যদি নীলিমা সবকিছু মেনে নিতো। কিন্তু এ সম্পর্কের সবচেয়ে বড় বাধা খোদ নীলিমা।
----------------
রাতে অফিস থেকে ফিরেই নীলিমাকে কল দিলো স্মরণ। কিন্তু পরপর চারবার রিং হওয়ার পরও নীলিমা কল রিসিভ করলো না।
এদিকে স্মরণকে এতোবার কল করতে দেখে রাফা কিছুটা চিন্তিত হয়। নীলিমার এমন উপেক্ষা দেখে রাফা চরম বিস্ময় নিয়ে বললো,
" এসব কি নীলিমা! তুই স্মরণ ভাইয়ের কল রিসিভ করছিস না কেনো?"
নীলিমা নির্বিঘ্ন গলায় বললো,
" আমার এখন কথা বলতে ইচ্ছা করছে না। "
রাফা কণ্ঠে কিঞ্চিৎ উত্তাপ নিয়ে বললো,
" আশ্চর্য! উনি তো কোনো সমস্যায়ও পড়তে পারে তাই না? একবার রিসিভ করেই দেখ না কি বলে উনি।"
নীলিমার মেজাজও চটে গেলো এবার। চরম বিরক্ত নিয়ে বললো,
" কি ধরণের লজিকলেস কথা বলিস রাফা! উনি সমস্যায় পড়লে আমাকে কল করতে যাবে কেনো! আর শোন, উনার সাথে এ মুহূর্তে কথা বলার একটুও ইচ্ছে নেই আমার। আমি জানি উনি কি বলবে। জানা কথা শুনতে আমি মোটেও আগ্রহী না। "
বলেই সে এই গরমেও কাঁথা মুড়ি দিয়ে শুয়ে পড়লো। তার এ আচরণে হতাশ হলো রাফা। দীর্ঘশ্বাস ফেলে নিজের ফোন হাতে নিতেই দেখলো স্মরণ কল করেছে। সে ফোন রিসিভ করতে করতে উঠোনে চলে এলো।
" হ্যাঁ স্মরণ ভাই, বলুন!"
ওপাশে স্মরণের উদ্বিগ্ন কণ্ঠস্বর শোনা গেলো,
" নীলিমা ফোন রিসিভ করছে না কেনো রাফা?"
রাফা মৃদুহাস্যে বললো,
" এতো টেনশন করছেন কেনো স্মরণ ভাই! ওর কিছু হয়নি। আপনি তো জানেনই ও কেনো কল রিসিভ করছে না। "
স্মরণের মুখটা ছোট হয়ে এলো। তবে কণ্ঠস্বর স্বাভাবিক করে বললো,
" আচ্ছা ও ঢাকায় কবে ব্যাক করবে জানো কিছু?"
" আমরা সবাই পরশুদিনের মধ্যেই চলে যাবো স্মরণ ভাই। "
" ওকে। যা বুঝলাম, এভাবে ফোন করে লাভ নেই। ওর সাথে সরাসরি কথা বলতে হবে।"
" সেটাই করুন। সরাসরি কথা বলে হলেও ওকে রাজি করানোর চেষ্টা করুন স্মরণ ভাই। ও কিছুতেই আপনার ওপর বিশ্বাস করতে চাইছে না। ভাবছে আপনার এসব ফিলিংস হয়তো দুদিনের। কিছুদিন গেলেই আপনার মন থেকে নীলিমা উঠে যাবে। "
এ পর্যায়ে চরম বিস্মিত হয় স্মরণ। অবাক গলায় বললো,
" এসব কে বললো ওকে! ও এসব এসব ভাবনা নিয়ে ঘুরে!"
" আমি ওকে বুঝিয়েছি স্মরণ ভাই। কিন্তু ও নিজ কথায় অটল। আপনার ফিলিংস বা আপনার উপর ও কিছুতেই বিশ্বাস করতে চাইছে না। এবার আপনিই সরাসরি ওকে বুঝাবেন।"
" আচ্ছা, তবে আসুক ও ঢাকায়। ওর মাথার এসব উদ্ভট সন্দেহের জবাব ভালোভাবে বুঝিয়ে দিবো ওকে। "
বলেই সে কল কেটে দিলো। রাফাও ফোন নিয়ে চলে এলো রুমে।
-------------------
নীলিমারা ঢাকায় এসেছে আজ তিনদিন হলো। কিন্তু স্মরণ ঢাকায় নেই। যেদিন নীলিমা সপরিবারে ঢাকায় ফিরলো ঠিক সেদিনই রাতে দু সপ্তাহের জন্য অফিসের কাজে শহরের বাইরে গেলো স্মরণ। এই ট্রিপে যাওয়ার কোনো ইচ্ছাই ছিলো তার। কিন্তু ম্যানেজিং ডিরেক্টর সাহেব প্রায় জোরপূর্বক নিয়ে গেলো স্মরণকে। তাঁর উদ্দেশ্য যে স্মরণকে প্রমোশন দেয়া এটা প্রায় সবাই বুঝতে পেরেছে। খোদ স্মরণও। একারণেই স্মরণ অনিচ্ছা সত্ত্বেও ট্রিপে গেলো। কিন্তু ট্রিপে থেকেও সে অনবরত কল করে যাচ্ছে নীলিমাকে। তবে নিজের সিদ্ধান্তে অটল নীলিমা কিছুতেই ফোন ধরছে না। এমনকি বিরক্ত হয়ে ব্লকও করছে না।
এ ক'দিন স্মরণকে নিয়ে ভাবতে না চাইলেও স্মরণের ফোনকল বারবার তার ভাবনাগুলো নীলিমার মস্তিষ্কে জড়ো করে দিচ্ছে। মস্তিষ্কের তীক্ষ্ণ কথাগুলো একপাশে রেখে মাঝেমধ্যে হৃদয়ের নম্র কথাগুলো ভাবছে। মন ও মস্তিষ্কের এ খেলায় মস্তিষ্ক নেতিবাচক জবাব দিলেও মন জবাব দিচ্ছে ইতিবাচক সব যুক্তিতে। কিশোরী বয়সের প্রেমে মত্ত হওয়া হৃদয়খানা তার স্মরণের গুনগানে নানান যুক্তি দেখাচ্ছে। ফুলের মতো কোমল, সকালের মিষ্টি রোদের মতো হালকা অনুভূতিতে ঘেরা ভবিষ্যত কল্পনা করাচ্ছে। কিন্তু পরক্ষণেই তার মস্তিষ্কে এসব ভাবনাকে অনৈতিক দেখিয়ে কিছু কঠোর বাস্তবতা সামনে দেখিয়ে দিচ্ছে। আর এ যুদ্ধে বারংবার নীলিমার মস্তিষ্ক জয়লাভ করছে। নীলিমা হয়তো এই ভয়ে ভীত যে স্মরণের সাথে দ্বিতীয়বার মুখোমুখি হলেই বোধহয় তার হৃদয়ের সকল যুক্তি জিতে যাবে! কিশোরী প্রেম আবারো ধরা দিয়ে হয়তো স্মরণকে আপন করে নিবে! কিন্তু এ হতে দেয়া যাবে না। এ ছোট্ট জীবনে এতোটা ঝুঁকি নেয়া যাবে না৷
--------------
স্মরণ আজ সকালেই ঢাকায় ফিরেছে। এতদিন নীলিমার ফোনে কল করে ব্যর্থ হয়ে আজ বাধ্য হয়ে মিলি বেগমের ফোনে কল দিয়েছে সে। মিলি বেগম কল রিসিভ করলেন,
" কি রে স্মরণ? কেমন আছিস?"
" এই তো ফুপু। আপনার কি অবস্থা? "
" আল্লাহ রাখছে ভালো। কোথায় তুই এখন?"
" ঢাকায় ফিরেছি ফুপু, আজ সকালেই।"
" তাহলে রাতের খাবার খেতে আয় বাসায়। কতদিন বাসায় আছিস না!"
" দেখি ফুপু। নীলিমা বাসায় না?"
" হ্যাঁ। কেনো কথা বলবি?"
" জি ফুপু। জরুরী কিছু কথা ছিলো।"
" আচ্ছা দাঁড়া। আমি নীলুকে ফোন দিচ্ছি। "
বলেই তিনি রান্নাঘর থেকে বেরিয়ে নীলিমার রুমে গেলেন। নীলিমা তখন কাপড় গোছাচ্ছিলো। নীলিমার দিকে ফোন এগিয়ে দিয়ে মিলি বেগম বললেন,
" নে, স্মরণ কথা বলবে তোর সাথে। কি বলে জরুরী কাজ আছে।"
নীলিমা ইশারায় ফিসফিস করে বললো,
" দেখছো না আম্মু আমি এখন কাজে বিজি। পরে কথা বলবো। "
মিলি বেগম টিটকারী মেরে বললেন,
" যে-ই না কাজ! এর আবার ব্যস্ততা দেখাতে আসছে। নে, কথা বল। রান্নাঘরে কত কাজ পড়ে আছে। আজ আবার বুয়া আসেনি। "
বলতে বলতেই তিনি নীলিমার হাতে ফোন ধরিয়ে দিলেন। নীলিমা অগত্যা ফোন কানে নিলো। ভেবেছিলো মা চলে যাওয়া মাত্রই সে কল কেটে দিবে। কিন্তু স্মরণ ঠিক সেই মুহূর্তেই ফোনের ওপাশ থেকে বললো,
" ফোন কেটো না নীলিমা। শেষবারের মতো আমার কথাগুলো শোনো।"
এতোগুলো দিন পরে স্মরণের কণ্ঠস্বর শোনা মাত্র দূর্বল হয়ে পড়লো নীলিমা। বললো,
" কি বলবেন বলুন।"
নীলিমার এরূপ উদাসীনতাপূর্ণ কথায় স্মরণ সেকেন্ডের মধ্যে সিদ্ধান্ত নিয়ে বললো,
" কাল বিকালে দেখা করতে পারবে?"
" কেনো? ফোনে বলা যায় না?"
স্মরণের কণ্ঠে আকুলতা, কিছু হারানোর চরম ভয়। বললো,
" ফোনে এতকিছু বলা সম্ভব না। কাল একবারের জন্য দেখা করো। তোমার যা সিদ্ধান্ত আমি সরাসরি শুনবো। এরপর তোমার যা ইচ্ছে করো। আমি তোমাকে ডিস্টার্ব করবো না। "
নীলিমা কিঞ্চিৎ দ্বিধাদ্বন্দ্বে জবাব দিলো,
" আচ্ছা। কোথায় আসতে হবে, আপনি লোকেশন ম্যাসেজ করে দিয়েন। আমি সময়মতো চলে আসবো।"
স্মরণ এবার স্বস্তির নিঃশ্বাস ফেলে বললো,
" থ্যাংকস নীলিমা। আমাকে শেষ একটা সুযোগ দেয়ার জন্য।"
নীলিমা আর কথা বাড়ালো না। চট করে ফোন কেটে দিয়ে ফোনটা বিছানায় ছুড়ে দিলো। নীলিমা এ মুহূর্তে চরম দ্বিধাদ্বন্দ্বে ভুগছে। স্মরণের সাথে ফোনে কথা বলেই যদি এ অবস্থা হয়, না জানি সরাসরি কথা বললে তার কি হবে! নীলিমা এ পর্যায়ে চরম সিদ্ধান্তহীনতায় ভুগলো।
--------------------
রাতে স্মরণ মিলি বেগমের বাসায় আসেনি। জার্নির ফলে শরীর বেশ ক্লান্ত থাকায় আর জ্যামে বসে থাকার ইচ্ছে হয়নি তার। তাই পরে মিলি বেগমকে কল করে বলে দিয়েছিলো।
খাবার টেবিলে ইমাদ সাহেব, মিলি বেগম ও নীলিমা বসে খাবার খাচ্ছে। খাবার খাওয়ার এক পর্যায়ে ইমাদ সাহেব নিঃসংশয়ে নীলিমাকে বললেন,
" নীলু, পরশুদিন ছেলেপক্ষ তোকে দেখতে আসবে। আমার বন্ধু কবিরকে তো চিনিসই। ওর ছেলের জন্য তোকে সপরিবারে দেখতে আসবে। শুক্রবার যেহেতু, ক্লাস নেই, রেডি থাকিস। "
.
.
.
চলবে............................................