নভেরা টি এস্টেটের জিপ শ্রীমঙ্গল রেল স্টেশনে আমাদেরকে নিতে এলো। ভোরের ট্রেনে আসায় আমরা এগারোটার দিকে শ্রীমঙ্গল পৌঁছলাম। গাড়িতে উঠে ক্লান্ত মাথাটা সিটে হেলিয়ে দিলাম। তাকিয়ে রইলাম বাইরে। কিছুক্ষণ আশে পাশে দেখে আমার মনে হলো শ্রী মঙ্গল শহরের চেয়ে নোংরা শহর আমি আগে দেখিনি। নোংরা শহর দেখার কোনো ইচ্ছে নেই তাই চোখ বন্ধ করে রাখলাম। একটু তন্দ্রার মতো লেগে এলো। কতটা সময় গিয়েছে খেয়াল নেই। হঠাৎ গাড়িতে ঝাকি লাগতেই আমি সোজা হয়ে বসলাম। চোখ খুলে তাকাতেই দেখতে পেলাম রাস্তার দুই পাশে চা বাগান। সত্যিই ছবির চেয়ে বাস্তব অনেক বেশি সুন্দর। সেই সৌন্দর্য প্রকাশ করার ভাষা আমার জানা নেই। এর আগে সিলেটে গিয়েছি, কিন্তু চা বাগান দেখার সৌভগ্য হয়নি। কিছুক্ষণের মধ্যেই নভেরা টি এস্টেটে পৌঁছে গেলাম। প্রধান ফটক খুলে দেয়া হলো। গাড়ি ঢুকে গেল টি এস্টেটে। চা বাগানের মধ্যে দিয়ে সরু রাস্তা। সেই রাস্তার ভেতর দিয়ে যাচ্ছে গাড়িটা। দুইপাশে পাহাড়ি ঢালু জমিতে চায়ের গাছ। গাড়িটা যেখানে গিয়ে থামলো সেখান থেকেই টিলার উপরে কয়েকটা সাদা কটেজ দেখা যাচ্ছে। যেখানে গাড়ির পথ শেষ হয়েছে আমাদের কটেজটা সেখান থেকে কাছেই কিন্তু রাস্তাটা অনেক ঘুরে গেছে। সবাই রাস্তা দিয়ে হেঁটে গেল, আমি আর চাচ্চু চা বাগানের ভেতর দিয়ে সোজা উপরে উঠে গেলাম। অন্যরা পৌঁছানোর আগেই আমরা পৌঁছে গেলাম। সাদা কটেজের দরজাগুলো ফ্রেঞ্চ ডোর, সেগুলোও সাদা। সাদা টালির ছাদ। সামনে বেশকিছু ফু লের গাছ, বেশ বড় বড়। কটেজগুলোর উল্টোদিকে সুইমিং পুল। দূরের আকাশের শেষ সীমানায় দাঁড়িয়ে আছে আঁকা ছবির মত অসংখ্য পর্বতমালা! গাড়িতে চোখ খুলে চা বাগান দেখার পর থেকে এখন পর্যন্ত আমি কারো সাথে একটা কথাও বলিনি। এত সুন্দর দৃশ্য দেখে কেমন একটা ঘোরের মধ্যে চলে গিয়েছি।
আমরা সবাই ফ্রেশ হয়ে একটু বিশ্রাম নিলাম। এরপর বাংলোর ডাইনিংয়ে লাঞ্চ করে চা বাগানটা দেখতে বের হলাম। এই চা বাগান এবং বাংলোর এরিয়াটা এত সুন্দর যে এখানে থাকলে বাইরে কোথাও ঘুরতে বের হওয়ার প্রয়োজন নেই। বাংলোর ম্যানেজার আমাদের জানালেন পুরো বাগান ভালোভাবে ঘুরে দেখতে তিন-চার দিন সময় লাগবে। ঘুরতে ঘুরতে আমরা একেকজন একেকদিকে চলে গেলাম। আমি হাঁটতে হাঁটতে বাগানের ভেতর চলে গেলাম। যেদিকে চোখ যায় শুধু সবুজ আর সবুজ। একসাথে এত সৌন্দর্য দেখে আমি আবেগপ্রবণ হয়ে গেলাম। বাগানের ভেতর চা গাছের ছায়াবৃক্ষ হিসেবে যে বড় বড় স্থায়ী কড়ই ও শিরীষ গাছগুলো থাকে সেগুলো দেখছিলাম। ঠিক কতদূর পর পর গাছগুলো লাগানো হয় এবং সেগুলোর উচ্চতা কতখানিক তাই দেখছিলাম। হঠাৎ করেই ক্যামেরার ক্লিক ক্লিক শব্দে চমকে তাকালাম। চা গাছের আড়াল থেকে একটা ছেলে বেরিয়ে এলো, হাতে ক্যামেরা। হঠাৎ করেই আমার রাগ উঠে গেল।
উচ্চস্বরে বললাম,
"আপনি আমার ছবি তুললেন কেন?"
ছেলেটা হেসে বলল,
"আপনাকে তুলতে চাইনি। ওই গাছের পাখিটাকে তুলতে চেয়েছিলাম। তখনই আপনাকে চোখে পড়ল। আপনি আপনার দৃষ্টি আর ব্যাকগ্রাউন্ডে এই চা বাগান সবমিলে খুব সুন্দর একটা ফ্রেম তৈরি হয়েছিল। ছবিটা তোলা থেকে নিজেকে রেজিস্ট করতে পারিনি। ছবিটা সত্যিই সুন্দর হয়েছে আপনি দেখুন।"
আমি এবার দ্বিগুণ উচ্চস্বরে বললাম,
"আমার অনুমতি ছাড়া আপনি আমার ছবি তোলার সাহস কোথায় পেলেন?"
ছেলেটার হাসি এবার মিলিয়ে গেল৷
সে আমাকে বলল,
"সরি! কিন্তু আপনার অনুমতি নিতে গেলে তো এই ন্যাচারাল ছবি পেতাম না। আপনি একবার ছবিগুলো দেখুন। আমার খারাপ কোনো উদ্দেশ্য নেই।"
"ক্যামেরাটা আমাকে দিন।"
ছেলেটা ক্যামেরা এগিয়ে দিল। সে মোট ৩ টা ছবি তুলেছে আমার। আমি ছবিগুলো ডিলিট করে দিলাম।
সে আৎকে উঠে বলল,
"কী করলেন! এত সুন্দর ছবিগুলো ডিলিট করে দিলেন?"
আমি তার কথার জবাব দিলাম না। ক্যামেরা ফেরত দিয়ে বাংলোর দিকে হাঁটা ধরলাম। বাংলোর ডাইনিংয়ের সামনে একটা লনের মত জায়গা। সেখানে রাতে বারবিকিউয়ের আয়োজন করা হয়েছে। লনের মধ্যেই সাদা টেবিল চেয়ারে আমাদের বসার ব্যবস্থা। দাদাভাই, বাবা, মা, মিন্নি আর আমি সেখানে বসে গল্প করছি। আমাদের সামনেই মুরগি পোড়ানো হচ্ছে, সুবাসে জিভে জল এসে যাচ্ছে। এমন সময়ে হঠাৎ করেই চাচ্চু কোত্থেকে সেই ফটোওয়ালাকে নিয়ে উদয় হলো। সবার সাথে পরিচয় করিয়ে দিলো। তার নাম আফতাব। সে নাকি খুব ফেমাস ফটোগ্রাফার, এক নামে সবাই চেনে। আমি অবশ্য নাম শুনেও চিনলাম না। আমার বাবার একটু ছবি তোলার বাতিক আছে। ফটোগ্রাফার শুনেই বাবা তার সাথে গল্পে বসে গেলেন। কবে কোথায় গিয়ে বাবা কী ছবি তুলেছিলেন তাও এই ছেলেকে তার বলতে হচ্ছে। ফটোওয়ালা আফতাব বাবার সাথে গল্প করতে করতে বারবার আমার দিকে তাকাচ্ছে। রীতিমতো বিরক্ত লাগছে আমার। এতক্ষণ এই পরিবেশে সবার সাথে বসে মাংস পোড়ানো দেখতে বেশ ভালো লাগছিল, এখন আর লাগছেনা। আমি উঠে গিয়ে আশেপাশে পায়চারি করতে লাগলাম। আমি মাঝেমাঝে নিজের উপর বিরক্ত হয়ে যাই। এত অল্পতে কেন আমার মেজাজ খারাপ হয়? কোথাকার কোন ফটোওয়ালা তার জন্য আমি কেন আমার ফ্যামিলি, আমার ভাগের মুরগিপোড়া, এসব রেখে এখানে হাঁটাহাঁটি করব? বারবিকিউ হতেই সবাই আমাকে ডাকতে লাগলো। আমি ফটোওয়ালাকে সম্পূর্ণভাবে উপেক্ষা করে ফিরে গেলাম এবং খাওয়াদাওয়ায় মনোযোগ দিলাম। খাবার মুখে দিয়ে আমি সব ভুলে গেলাম। এত ভালো বারবিকিউ আমি অনেক দিন পর খেলাম। সকালবেলায় আমরা নভেরা টি এস্টেটের গাড়িতে করে সাইটসিয়িংয়ে বের হলাম। খুব চাঙ্গা লাগছিল কারণ রাতে অসম্ভব ভালো ঘুম হয়েছে। বিছানায় শোয়ার এক ন্যানোসেকেন্ডের মধ্যে ঘুমিয়ে পড়েছিলাম। অথচ গত এক সপ্তাহ আমি শান্তিতে ঘুমাতে পারিনি। ট্যুরে আসলে এত ঘুম আর এত খিদে যে কোত্থেকে আসে কে জানে! আমরা বাংলোতে ফিরে এলাম দুপুরের খাবারের আগে। দুপুরের খাবার খেয়ে প্রচন্ড ঘুম পেল। একটু সময়ের জন্য ঘুমালাম। কিন্তু ঘুম ভেঙে দেখি এখন পড়ন্ত বিকেল। মিন্নিও এখনো ঘুমাচ্ছে। আমি তড়িঘড়ি করে উঠে পড়লাম। বের হতেই দেখি দাদাভাই কটেজের বারান্দায় ইজি চেয়ারে বসে আছেন।
আমাকে দেখে বললেন,
"তিন্নি সোনা, কোথায় যাচ্ছ?"
"চা বাগানে যাচ্ছি দাদাভাই। বাবা-মা, চাচ্চু কাউকে তো দেখতে পেলাম না। কোথায় তারা?"
দাদাভাই বললেন,
"তোমার বাবা-মা সদ্য বিবাহিত যুগলের মত হাত ধরাধরি করে চা বাগানে ঘুরতে গেছে। আর রূপক কোথায় তা তো সে ছাড়া আর কারো জানার কথা নয়।"
আমি হেসে বললাম,
"আমি একটু চা বাগান ঘুরে আসি দাদাভাই।"
"আচ্ছা তাড়াতাড়ি এসো। সন্ধ্যা করো না।"
"না না সন্ধ্যার আগেই ফিরব দাদাভাই। কালকের মত।"
চা বাগান থেকে সূর্যাস্ত দেখেছেন কখনো? আমিও দেখিনি আগে। আজই প্রথম। আমি যখন প্রথমবার সমুদ্রে সূর্যাস্ত দেখলাম আমার ধারণা হলো সমুদ্র থেকে সূর্যাস্ত সবচেয়ে সুন্দর। ডিমের কুসুমের মত একটা সূর্য আস্তে আস্তে সমুদ্রের নিচে চলে যায়! এরপর যখন পাহাড়ের উপর থেকে সূর্যাস্ত দেখলাম তখন মনে হলো আমার ধারণা ভুল। পাহাড়ের সূর্যাস্ত সবচেয়ে সুন্দর। টুপ করে পাহাড়ের আড়ালে লুকিয়ে পড়ে সূর্যটা। আর এখন মনে হচ্ছে চা বাগানের সূর্যাস্ত সবচেয়ে সুন্দর। সূর্যটা চা বাগানের পাহাড়ের আড়ালে পড়ে যায় কিন্তু আলোকরশ্মি থেকে যায় তখনো। ঠিকরে পড়ে দূরের ওই ছোট ছোট চা গাছের উপরে। আবার দৌড়ে ছোট পাহাড়ের সামনে যেতেই দেখি সূর্যাস্ত হয়নি এখনো, সূর্যটা হাসছে আমাকে দেখে। আমিও হাসি তাকে দেখে। কী অদ্ভু ত সুন্দর আলোর এই লুকোচুরি খেলা। আমি দৌড়ে একবার বড় পাহাড়ের সামনে যাই আবার আরেক দৌড়ে ছোট পাহাড়ের সামনে যাই। নিজের মনের অজান্তেই আমি হেসে চলেছি। এই খেলা খেলতে খেলতে একসময় সূর্যটা সত্যিই ডুবে গেল। তখন আমি বাংলোর দিকে হাঁটা শুরু করলাম। হাঁটতে হাঁটতে আমি এক সময় খেয়াল করলাম আমি অনেক দূরে এসে পড়েছি। বাংলোটা এখনো দেখা যাচ্ছে না। অথচ প্রায় অন্ধকার হয়ে এসেছে। আকাশে অপূর্ণ একটা চাঁদও দেখা যাচ্ছে। যেহেতু অন্ধকার হয়ে এসেছে আমি দৌড়াতে লাগলাম। কিন্তু তবুও বাংলো দেখতে পাচ্ছি না। আশ্চর্য এতদূরে কখন এলাম আমি! নাকি ফিরতে গিয়ে ভু ল রাস্তায় চলে এলাম? পুরোপুরি অন্ধকার নেমে এসেছে। আমার হঠাৎ ভীষণ ভয় করতে লাগলো। যেহেতু পূর্ণিমা নয় তাই চাঁদের আলো খুব বেশি প্রখর নয়। আবছা আলোয় রাস্তা, চা গাছ সবই দেখতে পাচ্ছি। আমি এখন যেখানে আছি সেখান থেকে তিনদিকে তিনটা রাস্তা চলে গেছে। আমার কোনদিকে যেতে হবে বুঝতে পারছি না। তাড়াহুড়োয় বের হওয়াতে আমি মোবাইল আনতে ভুলে গিয়েছি। তাই ফ্যামিলির কারো সাথে যোগাযোগ করতে পারছি না। আপনারা কি এখন আমাকে বোকা ভাবছেন? আসলে আদনান আমার জীবনে থাকতে আমি মোবাইলের যতটা কাছে থাকতাম এখন যেন ততটাই দূরে থাকি। কোনো সোস্যাল মিডিয়াতেই এখন আমার একাউন্ট নেই। ফ্যামিলির সবার সাথে থাকায় এখানে আসার পর ফোনটা তেমন কাজে লাগে না। আমি যে চা বাগানের ভেতর হারিয়ে যেতে পারি এমন কিছু একটা বারও আমার মাথায় আসেনি৷ গতকালও আমি নিজের মতো ঘুরে গেছি বাগান থেকে। কাল তো কোনো সমস্যা হলো না। এমন কিছু হতে পারে এই ব্যাপারটা যদি মাথায় আসতো, তাহলে হয়তো আমি ফোনটা সাথেই রাখতাম। আমার পাশেই একটা বড় পাহাড়। পাহাড়ের গায়ে চায়ের গাছ। এর মাঝখান দিয়ে উপরে উঠলেই হয়তো বাংলোটা দেখতে পাব। যেহেতু কটেজগুলো সাদা, দূর থেকে স্পষ্ট দেখা যাবে। তখনই বুঝতে পারব ভুল রাস্তায় এসেছি কিনা কিংবা আমার ঠিক কোনদিকে যেতে হবে। আমি দোয়া কালাম পড়তে পড়তে পাহাড়ের উপরে উঠতে লাগলাম। বেশ খানিকটা সময় লাগলো আমার উপরে উঠতে। উপরে উঠে চারদিকে তাকাতেই আমার দমবন্ধ হয়ে যেতে লাগলো। পা দু'টোর উপর দাঁড়িয়ে থাকতে পারছি না, থরথর করে কাঁপছি। কারণ পুরো বাগানের কোথাও কোনো সাদা বাংলো দেখতে পাচ্ছি না!
.
.
.
চলবে....................................................