এক হাজার টাকা - পর্ব ০৮ - মৌরি মরিয়ম - ধারাবাহিক গল্প


জীবন ও মরনের মাঝামাঝি দাঁড়িয়ে আছি আমি। পুরো শরীর ঠান্ডা হয়ে আসছে। দাঁড়ানোর শক্তিটুকু নেই। সত্যি সত্যি ভয়ে কেউ মারা যায় কিনা জানি না। আর ভয়ে না মরলেও, শুনেছি চা বাগানে নাকি মেছো বাঘ থাকে ; নিউজ পেপারে পড়েছি। এ কথার সত্যতা কতটুকু তা জানি না। তবে মেছোবাঘ যদি থেকেই থাকে তবে আজ মৃত্যু অনিবার্য। মেছোবাঘ না থাকলেও সাপ নিশ্চয়ই আছে। সাপের কামড়ে কি মানুষ বাঁচে? মৃত্যু অনিবার্য জেনে সেই মুহূর্তে ঠিক কী কী করা উচিত? আমি দোয়া পড়তে লাগলাম। বাবা মায়ের মুখটা ভেসে উঠলো আমার চোখে। আমি মরে গেলে বাবা মা কি এই ধাক্কাটা সামলাতে পারবে? আর দাদা? দাদা কি পারবে তার সবচেয়ে আদরের নাতনীকে ছাড়া থাকতে? মিন্নি কি কষ্ট পাবে নাকি খুশি হবে? ছি ছি খুশি কেন হবে? আমি তো ওর নিজের বোন। যতই ঝগড়া করি আমি যেমন ওকে ভালোবাসি তেমন মিন্নিও নিশ্চয়ই আমাকে ভালোবাসে। ছোট চাচ্চু ও ভীষণ কষ্ট পাবে। আচ্ছা বাবা মা কি চাচ্চু কে দোষারোপ করবে? কারণ এই ট্যুরের প্ল্যান চাচ্চু র ছিল। না না আমার বাবা মা এতটা অবুঝ নন। আচ্ছা আদনান কি কষ্ট পাবে? না, আদনান কীভাবে কষ্ট পাবে? সেতো জানতেই পারবে না তিন্নি বলে যে মেয়েটা তার জন্য অসীম ভালোবাসা বুকে পুষে রেখেছিল, সে মেয়েটা মরে গেছে। আমার যে সিক্রেট ডিপিএসটা আছে সেটার নমিনি মাকে করেছিলাম। সে নিশ্চয়ই টাকাগুলো পাবে? খুব বেশি টাকা না হলেও একেবারে কম নয়। তার মেয়ে যে একেবারে বোকা নয়, ভবিষ্যতের কথা একটু হলেও ভাবে এ কথা জেনে কি মা খুশি হবে? ভার্সিটির ক্যান্টিনে কিছু টাকা বাকী ছিল সে সব দেয়া হলো না। মরে গেছি শুনে নিশ্চয়ই দাবি ছেড়ে দেবে? কিন্তু যদি দাবি না ছাড়ে? হঠাৎ আলো দেখতে পেয়ে পেছনে তাকালাম। দেখলাম দূরে কিছু টর্চের আলো এদিক ওদিক করছে। আমি আলোর দিকে দৌড় দিতে গিয়েও পারলাম না। আমার পা চলছে না। আমি কোনোভাবে হেঁটে আলোর দিকে যাচ্ছিলাম। আমার পায়ের সাথে যেন এক মন ওজনের বস্তা বেঁধে দিয়েছে কেউ। আলোগুলোও আমার দিকে আসছিল। আমি যত কাছে যাচ্ছি আবছা শুনতে পাচ্ছি, চাচ্চু আমার নাম ধরে ডাকছে। তার সাথে আরও অনেক লোকজন আছে বলে মনে হচ্ছে। ওইতো বাংলোর ম্যানেজারকেও দেখা যাচ্ছে। আমি যেন প্রাণ ফিরে পেলাম।

আমি চিৎকার করে ডাকলাম,
"চাচ্চু ..." 

চাচ্চু দৌড়ে এসে আমাকে ধরতেই আমি মূর্ছা গেলাম। আমার যখন জ্ঞান ফিরলো তখন আমি বাংলোর ঘরে শুয়ে আছি। আমার বিছানার পাশে উৎসুক কিছু মুখ।

মা আমার মাথায় হাত বুলিয়ে বললেন,
"কিছু হয়নি তোর। বাংলোতে আছিস। আমরা সবাই আছি এখানে। ভয়ের কিছু নেই।"

পরদিন বাংলোটা খুঁজে না পাওয়ার রহস্যটা জানতে চাইলে ম্যানেজার বললেন, আমি যে বড় পাহাড়ের ওপর ছিলাম তার সামনে আরো একটা বড় পাহাড় ছিল। বাংলোটা সেই পাহাড়ের আড়ালে ছিল বলেই হয়তো আমি খুঁজে পাইনি। তবে তারা খুব অবাক হয় আমি চা বাগানের এত গহীনে কেন গিয়েছিলাম! এই প্রশ্নের উত্তর অবশ্য আমি দিতে পারিনি! কীভাবে তাদেরকে বোঝাবো যে, চা বাগানের সূর্যাস্ত আমার সাথে ছলনা করা প্রেমিকের মত বেইমানি করেছে! সেদিনই আমরা নভেরা টি এস্টেট থেকে ঢাকায় ফিরে এলাম। জনাব আফতাব আমাদের সাথেই ঢাকায় এলেন। জানি না কেন বাবার এত সুদৃষ্টি পড়লো এই আপদের উপর। যাক সে কথা! পুরোটা রাস্তা আমি শুধু একটা কথা ভাবতে ভাবতেই এলাম, মৃত্যুর মুখে দাঁড়িয়েও আমি আমার পরিবারের মানুষদের সাথে সাথে আদনানের কথাও ভেবেছি! কেন ভেবেছি? তবে কি সে বিবাহিত জানার পরেও, এখনো আমি তাকে... আমার এখন আবার লজ্জায় মাটির সাথে মিশে যেতে ইচ্ছে করছে! নিজেকে খুব সস্তা মনে হচ্ছে!
.
.
.
চলবে...............................................

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন