তোমায় যত গল্প বলার ছিলো - পর্ব ৩১ - মিশু মনি - ধারাবাহিক গল্প


সকালের সোনালী রোদ এসে পড়লো আমার বারান্দায়। খাবার টেবিল গুছিয়ে আমি ঝটপট গোসল সেরে নিলাম। জানিনা কেন আমার আজ খুব শাড়ি পরতে ইচ্ছে করছে। নীল রঙের শাড়ি। নীল শাড়ি পরে ভেজা চুলগুলো পিঠের উপর এলিয়ে দিয়ে রৈনীলের মুখোমুখি বসে থাকলে আমার খুব ভালো লাগবে। কিন্তু আমার তো শাড়ি নেই। তাছাড়া এ জীবনে মাত্র কয়েকবারই শাড়ি পরেছিলাম, ভার্সিটির প্রেজেন্টেশন উপলক্ষে।

গোসল শেষ করে দৌড়ে গেলাম দাদীমনির ঘরে। জানালাম আমার একজন স্পেশাল মেহমান আসবে। শাড়ির কথা বলতেই মুচকি হেসে নিজের আলমারি খুলে দিলেন তিনি। আলমারির অর্ধেক পর্যন্ত ভর্তি শুধু শাড়ি দিয়ে। এর মধ্যে গোটা কয়েক নীল শাড়ি তো আছেই। উনি নিশ্চয়ই যৌবনে অনেক আভিজাত্যে ভরা জীবন কাটিয়েছেন। আমি আমার পছন্দ মত একটি নীল শাড়ি বেছে নিলাম। 

সমস্যা হলো ব্লাউজ পাওয়া গেল না। আমার একটা টপসের সঙ্গে শাড়ি পরার সিদ্ধান্ত নিলাম। সেখানেও বাধলো আরেক বিপত্তি। ইউটিউব দেখে দেখে একদমই শাড়ি পরা ঠিকমতো হলো না। বিদঘুটে দেখতে লাগছে আমায়। আবারো দ্বারস্থ হলাম দাদীমনির। তিনি এক গাল হেসে খুব যত্ন করে আমাকে শাড়ি পরতে সাহায্য করলেন। 

ভেজা চুলগুলো আচড়িয়ে পিঠে এলিয়ে দিলাম। চোখে আঁকলাম শুধুই কাজল। আয়নার সামনে দাঁড়ানো মাত্রই গেট খোলার শব্দ শুনতে পেলাম। পায়ের আওয়াজ শুনে মনে হল রৈনীল আসছে। আমি দরজা খুলে বের হয়ে এলাম। রৈনীল এসে দাঁড়ালো আমার সামনে। অনেকক্ষণ নীরবে সে আমার মুখের দিকে শুধু চেয়ে রইল। তারপর মুচকি হেসে বলল, আমাকে আটকানোর জন্য এই ফন্দি এঁটেছ তাই না?

আমি অবাক হয়ে বললাম, মানে?
- তুমি জানো, এই মুহূর্তে আমি ঠিক কি ফিল করছি?
- কি? 
- বাকি জীবনটা তোমার সামনে বসে শুধু তোমার দিকে তাকিয়ে তাকিয়ে কাটিয়ে দেই। 
- যা: আপনি এত রোমান্টিক আমি জানতাম না। 
- সিরিয়াসলি বলছি। আরও একটা ইচ্ছে করছে। 
- কি ইচ্ছা? 
- বুকের মধ্যে তোমাকে শক্ত করে চেপে ধরে রাখি। 

রৈনীলের এই কথা শোনার পর আমি আর স্থির হয়ে দাঁড়াতে পারলাম না। লজ্জায় অন্যদিকে মুখ ঘুরিয়ে সোজা নিজের ঘরে চলে এলাম। কিছুক্ষণ পর রৈনীল এসে দাঁড়ালো আমার পিছনে। বলল, খিদে পেয়েছে। নাস্তা দাও। 

আমি চমকে উঠে তাড়াতাড়ি টেবিলে খাবার পরিবেশন করলাম। টেবিল দেখে রৈনীল আশ্চর্য হয়ে বলল, এতকিছু কি তুমি করেছ? 
জি 
কিভাবে? 
ভোরবেলা থেকে। 
কখন উঠেছ ঘুম থেকে? 
চারটা 
সিরিয়াসলি ?

অবিশ্বাসের সুরে হাসলো রৈনীল। তারপর একটা চেয়ারে বসলো। প্রত্যেকটা খাবারে চোখ বুলিয়ে বলল, মনে হচ্ছে প্রফেশনাল শেফ রান্না করেছে। ডেকোরেশন অনেক সুন্দর। খেতে কেমন লাগবে জানিনা। থ্যাংক ইউ আমাকে সারপ্রাইজড করার জন্য। 

আমার ইচ্ছে করছিল সময়টাকে বেঁধে রাখি। নিজের বহু আকাঙ্খিত মানুষ আমারই সম্মুখে বসে আমারই বানানো খাবার খাচ্ছে। এরচেয়ে আনন্দের মুহুর্ত আর কী হতে পারে! ধীরেধীরে খাবার মুখে দিতে লাগলাম। যেন সময়টা আরো দীর্ঘ হয়। 

খাওয়াদাওয়া শেষ হতেই রৈনীল উঠলো। থালাবাসন সব নিজে গিয়ে সিংকে রেখে এলো। তারপর আমাকে আলতো করে জড়িয়ে ধরে বললো, 'এত দ্রুত তোমাকে রেখে চলে যেতে হবে ভাবিনি। আমি যত তারাতাড়ি পারি, আসবো।'

তারপর আমার মুখোমুখি দাঁড়িয়ে জিজ্ঞেস করলো, 'তুমি কি এখনো আমাকে পছন্দ করো?' 

আমি চুপ করে রইলাম। আমার নীল শাড়ি, এই নাস্তার টেবিল, আমার লজ্জাবরণ চাহনি দেখেও কি সে অনুমান করতে পারছে না? নাকি বুঝেও না বোঝার ভান?

রৈনীল বললো, 'আমি তোমাকে ভীষণ পছন্দ করি সরণী। প্রথমদিন স্বাগতার বাসার দরজায় দেখা হওয়ার পর থেকেই।'
'কেন? কেন এতদিন জানাননি আমাকে? এভাবে আমাকে কষ্ট দিয়েছেন কেন?'

চুপ করে রইলো সে। আমি বললাম, 'বলুন? এতকিছুর উত্তরের জন্য অপেক্ষা করা কঠিন। আপনি পুরোটাই রহস্যে জড়িয়ে রেখেছেন। আমার আর ভালো লাগছে না। আপনি এই রহস্যের জট খুলে না দিয়ে যেতে পারবেন না। যাওয়ার আগে প্লিজ সবকিছু খোলাসা করে যান।'

রৈনীল কিছুক্ষণ চুপ থেকে উত্তর দিলো, 'আগে বলো তুমি সবকিছু শোনার পরও আমারই থাকবে?'
'যে মেয়েটা ৫ বছর পরও আপনারই আছে, সে একটা কথা শুনেই আপনাকে ছেড়ে চলে যাবে? কি করে ভাবছেন এমন? আর কি সেই গোপন কথা যা শোনার পর আমি আর আপনার থাকবো না?'

'নিশ্চয়ই তোমার জন্য কষ্টদায়ক কিছু। আমিও আজকে চলে যাব। সে কারণে বলতে চাইছিলাম না। অন্তত কথাগুলো বলার পর আমি তোমার পাশে থাকতে চাই।'
'আমার জীবনে নতুন করে আর কষ্ট পাওয়ার কিছু নেই। আপনি বলুন প্লিজ। সবকিছু পরিষ্কার করে বলুন আমাকে।'

রৈনীল আমার হাত মুঠোয় ভরে শক্ত করে চেপে ধরে বললো, 'তুমি তোমার বাবার নিজের মেয়ে না।'

আমি হতবিহ্বল হয়ে পড়লাম। নিজের কানে শোনা এরচেয়ে আশ্চর্যজনক বাক্য আর কক্ষনো শুনিনি। রৈনীল আমাকে বুকে চেপে ধরে বললো, 'শান্ত থাকো। এত বড় সত্য মেনে নেয়া কঠিন আমি জানি। কিন্তু তুমি জেদ করছো তাই বলতে বাধ্য হলাম। আমি তোমার সঙ্গে আজীবন থাকবো। প্লিজ দুঃখ পেও না।'

আমি কোনো শব্দ করতে পারলাম না। যদি সে বলতো, আমি মায়ের নিজের পেটের মেয়ে নই, তাহলে হয়তো মেনে নিতে পারতাম। কারণ মা আমাকে কখনো ভালোই বাসেন নি। কিন্তু বাবা! আমি বাবার মেয়ে নই, তাহলে কার? 

রৈনীল বললো, 'তোমার ফ্যামিলি সম্পর্কে আমি আরও অনেক কিছু জানি। এগুলো তোমার পক্ষে হজম করা কঠিন। এজন্য সময় নিয়ে বলতে চেয়েছিলাম। শুরুটা এমন ছিলোনা। শুরুটা একেবারেই অন্যরকম ছিলো..'
'কিসের শুরু?'

রৈনীল আমাকে সামনে বসালো। আমার মুখোমুখি তাকিয়ে বললো, 'স্বাগতার বাসার গেটে প্রথমবার দেখেই তোমাকে আমার খুব ভালো লেগে যায়। কিন্তু পরে তোমার সঙ্গে মেশার পরে বুঝলাম তুমি বয়সে অনেক ছোট। আমাদের দুজনের জগত একদমই ভিন্ন। সবসময় চেষ্টা করেছি তোমার প্রতি যেন ফিলিংস বাড়তে না পারে। সাধারণ ভালোলাগা হিসেবেই ধরে নিতে চেয়েছিলাম। যা দুদিন পরেই মানুষ ভুলে যায় সহজে। কিন্তু যতই সময় যেতে লাগলো, তোমার আমার প্রতি সীমাহীন প্রেম দেখে নিজেকে ধরে রাখা কষ্টকর হয়ে যাচ্ছিলো। তোমার মা আমাকে ডেকেছিলেন। দেখা করেছি। আমার পরিচয় জানার পরে ওনার চেহারা অন্যরকম হয়ে গিয়েছিলো। উনি স্বাভাবিক ভাবে কথা বলতে পারেননি। তখনই মনে হয়েছিল কোথাও একটা ঝামেলা আছে। আমি তখন থেকেই ভেতরে ভেতরে এর কারণ জানার চেষ্টা করতে থাকি। তোমার মা সরাসরি বলে দিয়েছেন, আমাদের কোনোদিন রিলেশনশিপ হওয়া সম্ভব না। ওইদিন রিসোর্টে তোমাকে কথাগুলো বলার সময় ভেবেছিলাম আমি সহজেই তোমাকে ভুলতে পারবো। কিন্তু আমি ভুল ছিলাম। তোমাকে ভুলতে পারিনি আমি।' 

আমি জিজ্ঞেস করলাম, 'তারমানে মায়ের নিষেধের কারণেই? আর মা কেন আপনাকে সম্ভব না বলেছিল!'
'সব বলবো। একদিকে ওনার নিষেধ, সম্ভব নয় বলা, আরেকদিকে নিজেও সিদ্ধান্তহীনতায় ভুগছিলাম। কিন্তু তুমি সবকিছু ছেড়ে হঠাৎ করে উধাও হওয়ার পর কেন যেন তোমাকে দেখার জন্য ভেতরে ভেতরে পাগল হয়ে যাচ্ছিলাম...'

আমি রৈনীলের চোখের দিকে তাকালাম। এতক্ষণ ধরে বুকের ভেতর যে আগুন জ্বলছিল, তাতে পানি পড়লো খানিকটা। রৈনীল আমাকে দেখার জন্য পাগল হয়ে যাচ্ছিল, এটা শোনার পর হৃদয়ে শীতল অনুভূতি নেমে এলো খানিকটা।

আমি বললাম, 'আপনি এজন্য আমার সঙ্গে যোগাযোগ করার চেষ্টা করেছিলেন?'
'হুম। দেখা করার জন্য মরিয়া হয়ে উঠেছিলাম।'
'কিভাবে?'
'যতবার তোমার ভার্সিটিতে গেছি, যতবার তোমার বাসার আশেপাশে গিয়েছি, সবসময় দেখা পেয়েছি।'
'আপনি আমাকে দেখার জন্য বাসার আশেপাশে গিয়েছিলেন!'
'হুম। তোমার পেইজটাতে, যেখানে ভিডিও দিতে শুরু করেছিলে। ওটাও ফলো করতাম।'
'কী বলছেন এসব!'
'বিশ্বাস হচ্ছে না?'
'না। এগুলো তো আপনার সঙ্গে যায় না। আপনি তো এমন মানুষ নন।'

রৈনীল শুকনো হেসে বললো, 'আমি নিজেই নিজেকে দেখে অবাক হয়ে গিয়েছিলাম। আমি যা নই তা কেন আমার সঙ্গে ঘটছে? তখন উপলব্ধি করলাম, তোমাকে সত্যিই আমি মন থেকে চাই। কোথাও একটা নরম কোমল অনুভূতি আছে তোমার জন্য। সে কারণেই বারবার তোমার কাছে ছুটে যাওয়া। কিন্তু তুমি তখন আমার প্রত্যেকটা আহবান প্রত্যাখ্যান করতে শুরু করেছো। যেখানেই ডাকি, আসোনি। ফোন ইউজ করা ছেড়ে দিয়েছিলে। স্বাগতার বাসায় আসোনি, আমার জন্মদিনের পার্টিতে আসোনি।''

আমি উৎসুক হয়ে জানতে চাইলাম, 'বলেছিলেন ইউরোপ যাওয়ার আগে আমার সঙ্গে দেখা করতে চেয়েছিলেন। যে ছেলেটার সঙ্গে আমার বিয়ে ঠিক হয়েছিল, তার সঙ্গে আমাকে দেখার পর আপনি ফিরে গেছেন। এত সহজেই কেন ছেড়ে দিয়েছেন আমাকে?'

রৈনীল ফিক করে হেসে বললো, 'তোমার ফ্যামিলি একজনের সঙ্গে তোমার বিয়ে ঠিক করেছে। আর অন্যদিকে আমাকে কোনোভাবেই মেনে নিবে না। দুনিয়া উলটে গেলেও ওরা কোনোদিন আমাদের বিয়ে হতে দেবে না। সেখানে তোমাকে হাসিখুশি দেখার পর ফিরে যাওয়াটাই কি স্বাভাবিক না?'
'তাহলে এখন আবার কেন আসলেন?'

রৈনীল একটা ছোট্ট শ্বাস ফেলে বললো, 'প্রকৃতি চেয়েছিলো আমরা এক হই। আচ্ছা, তোমার ওই ঠিক হয়ে যাওয়া বিয়েটা কেন ভেঙে গিয়েছিলো সরণী?'

আমি অবাক হয়ে রৈনীলের দিকে তাকালাম। 
.
.
.
চলবে.........................................................................

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন

WhatsApp