এক হাজার টাকা - পর্ব ১১ - মৌরি মরিয়ম - ধারাবাহিক গল্প


টিউশনি থেকে ফিরে ছাদে চলে গেলাম। হাতে সময় থাকলে সূর্যাস্তের সময়য়া ছাদে চলে আসি। এ সময়টা ছাদে ভীষণ ভালো লাগে আমার। আশে পাশে হাজারো গল্প জমা হয় তখন! কোনো বাসার ছাদে দুরন্ত ছেলেমেয়েরা ঘুড়ি উড়ায়। কোনো ছাদে শুকনো কাপড় তুলতে আসা মেয়েটা কাপড়ের ফাঁক দিয়ে পাশের বাসার ছেলেটাকে আড়চোখে দেখে। কোনো ছাদে আবার আচার শুকোতে দেয় গৃহকর্তী, বাচ্চা একটা মেয়ে এসে চুরি করে খেয়ে নেয় কিছুটা। কোনো ছাদে টাঙ্কির উপরে বসে পা দোলায় একজোড়া কপোত-কপোতী। কোনো ছাদে হয়তো কবুতর পালে, সেই কবুতরেরা বৈকালিক ভ্রমণে বের হয়ে আকাশটা চক্কর দেয়। পাশের খালি প্লটে হয়তো একদল ছেলে ফুটবল খেলে। এই সবগুলো গল্প আমি খুব উপভোগ করি। আজও তাই করছিলাম এরই মাঝে মা ছাদে এসে উপস্থিত হলেন। মুখ দেখে বোঝা যাচ্ছে তার মনটা আজ ভালো।
বললেন,
"কিরে তুই এসেই ছাদে চলে এলি! দেখা করবি না?"

"তোমাকে আশেপাশে দেখিনি ভাবলাম ঘুমোচ্ছ হয়তো। তোমাকে এত খুশি লাগছে যে?"

"খুশি লাগবে না? দারুণ খবর এসেছে।"

"তাই নাকি? কী খবর?"

"কমলের মা ফোন করেছিল। কমল নাকি তোকে খুবই পছন্দ করেছে।"

কথাটা শুনে আমি কিছুটা অবাক হলাম। খুব পছন্দ করলে গতকাল আমার উল্টোটা মনে হলো কেন? আমার মনে হচ্ছে কোনো কমিউনিকেশন গ্যাপ সৃষ্টি হয়েছে।
জিজ্ঞেস করলাম,
"তুমি নিশ্চিত তো?"

"আরে হ্যাঁ। কমলের বাবা তোর বাবাকে বলল, দুজনেরই যখন পছন্দ হয়েছে আগামী শুক্রবার একসাথে বসে বিয়ের ডেট ঠিক করতে চায়। গতকাল শুধু শুধু উল্টোপাল্টা বলে আমার মন খারাপ করে দিয়েছিলি!"

এবার আবার আমার মনটা খারাপ হয়ে গেল। কারণ আমি মানুষের মুখ দেখে মনের ভাব বুঝতে পারি না সেটা আরেকবার প্রমাণিত হলো। মানুষের মুখ দেখেই যে আমি বুঝি না সেই আমি কিনা না দেখেই আদনানকে বুঝতে গিয়েছিলাম। ধোকা খাওয়া তো আমার প্রাপ্যই। পূনরায় নিজের উপর বিরক্ত হলাম। আবার আদনানের কথা ভাবছি! অন্য একজনের সাথে বিয়ে হতে চলেছে আর আমি এখনো এমন একজনের কথা ভাবছি যার সাথে আমার কিছুই নেই। আর ভাবব না। একদম না। রাতে ফোন করলেন কমল সাহেব।
বললেন,
"বেশি রাতে ফোন করে আপনাকে সমস্যায় ফেললাম না তো?"

আমি বললাম,
"একদম না। আমি একটু দেরি করেই ঘুমোই। যাই হোক, কেমন আছেন?"

"ভালো আছি। আপনি কেমন আছেন বলুন।"

"আমিও ভালো।"

তিনি গলা খাকারি দিয়ে বললেন,
"গতকাল আমার হাতে একদম কম সময় ছিল। তাড়াতাড়ি চলে আসায় কিছু মনে করেননি তো?"

আমি হেসে বললাম,
"না এতে মনে করার কী আছে?"

"আচ্ছা। আসলে কাল সময়ের অভাবে তেমন কথা বলা হয়ে ওঠেনি। যদি আপনার হাতে সময় থাকে এবং আপনার আপত্তি না থাকে তাহলে আমরা কি এখন কিছুক্ষণ কথা বলতে পারি?"

"জি, কেন নয়?"

"যদিও আমি আমার বাবা মায়ের কাছ থেকে জানতে পেরেছি যে আপনার আমাকে পছন্দ হয়েছে। তারপরেও আমার কিছু ব্যাপার শিওর হওয়া দরকার।"

আমার কেন যেন মনে হচ্ছে সে এখন জিজ্ঞেস করবে আমার কোনো প্রেম-ফ্রেম আছে কি না!
বললাম,
"নির্দিধায় বলুন।"

"আপনার ইচ্ছেতেই বিয়ে করতে যাচ্ছেন নাকি পরিবারের চাপে পড়ে?"

আমি বললাম,
"আমার পরিবার থেকে কোনো চাপ নেই। পরিবার তাদের ইচ্ছের কথা জানিয়েছে, আমারও আপত্তি নেই। তবে আমি তাদেরকে কিছু শর্ত দিয়েছিলাম। নিশ্চয়ই আপনি সেসব ব্যাপারে অবগত আছেন তা না হলে কথা এতদূর এগোতোই না।"

"তবুও আপনি নাহয় নিজের মুখেই আমাকে বলুন।"

"তেমন সিরিয়াস কোনো ইস্যু নয় অবশ্য। আমি পড়াশোনা কন্টিনিউ করতে চাই আর পড়া শেষে চাকরি করতে চাই। দ্যাটস ইট।"

তিনি হেসে বললেন,
"যুগ অনেক বদলে গেছে তিন্নি। আজকাল ছেলেরাও চায় না স্ত্রীরা শুধু ঘর-সংসার করে কাটাক। আমি তো একদমই চাই না। স্ত্রী চাকরি করবে নাকি করবে না এটাকে আমার কাছে একান্তই তার ব্যক্তিগত ব্যাপার বলে মনে হয়।"

তার এই কথাটা আমার ভালো লাগলো।
সে বলল,
"বলতে পারবেন পরিবারের চাপে পড়ে বিয়ে করার কথাটা কেন বললাম?"

"কেন?"

"কারণ আপনার সাথে দেখা হওয়া বা কথা হওয়া যতটুকুই হয়েছে তারমধ্যে একবারও আপনাকে হাসতে দেখিনি।"

তার এই কথাটাতেই কেন যেন আমি হেসে ফেললাম। হেসে বললাম,
"হাসানোর মানুষ থাকলে হাসতাম। এইতো এখন আপনি হাসালেন, আমি হাসলাম।"

কথাটা বলেই মনে হলো আমি ভালোই ফ্লার্ট করতে জানি!

তিনি বললেন,
"তাহলে ধরে নেয়া যাচ্ছে তিন্নি এখন থেকে প্রতিদিনই হাসবে।"

আমি আবারও হাসলাম তারপর তাকে জিজ্ঞেস করলাম,
"আচ্ছা আপনার কোনো শর্ত নেই?"

"কিসের শর্ত ?"

"বিয়ে করার জন্য?"

তিনি হেসে বললেন,
"বিয়ে করার জন্য ছেলেদের বেশিরভাগ ক্ষেত্রে তেমন শর্ত থাকে না। কারণ ছেলেদের পড়াশোনা শেষ করে ক্যারিয়ার তৈরি করার পরেই তার বিয়ের কথা ভাবে বাবা-মা। তখন তারাও মানসিকভাবে প্রস্তুত বিয়ে করার জন্য। কিন্তু মেয়েদের কলেজে উঠলেই বিয়ের কথা শুরু হয়ে যায়। যখন বেশিরভাগ মেয়েরাই মানসিকভাবে প্রস্তুত থাকে না। বিয়ে পরবর্তী জীবন নিয়ে তাদের বিভিন্নরকম ভীতি থাকে। তাই তাদের এধরনের শর্ত থাকে।"

"আচ্ছা তাই তো। এভাবে ভাবিনি।"

"তবে একটা ব্যাপারে আমার অস্বস্তি কাজ করছিল। আপনাকে দেখার পর অস্বস্তিটা কিছুটা কমেছে তবে পুরোপুরি যায়নি।"

"কী বিষয়ে অস্বস্তি?"

"আপনি বয়সে আমার ৭ বছরের ছোট। আমাদের বয়সের গ্যাপটা বেশি হয়ে। এটা নিয়েই অস্বস্তি।"

"আমাকে দেখার পর অস্বস্তিটা কমেছে কেন?"

"আপনাকে দেখে মনে হয়েছে আপনি যথেষ্ট ম্যাচিওর।"

"আসলে আমি তা নই।"

"ম্যাচিওর নন বলছেন?"

"জি। ক'দিন মিশলেই বুঝতে পারবেন। আপাত দৃষ্টিতে দেখে ম্যাচিওর মনে হয়। কারণ আমি চঞ্চল নই।"

"তাহলে রিস্ক থেকে যায় বলছেন?"

"আপনার কী মনে হয়?"

"আমার মনে হয় রিস্ক নেই।"

"কেন এমন মনে হচ্ছে?"

"কারণ আপনি অনেক লক্ষী মেয়ে।"

"একদিনের দেখায় আর একবার ফোনালাপেই এতটা নিশ্চিত হচ্ছে কী করে?"

কমল সাহেব হেসে ফেললেন। হাসতে হাসতেই বললেন,
"আসলে আপনাকে ভীষণরকম পছন্দ হয়ে গেছে, তাই আপনার সব কিছুই আমি আমার সুবিধাজনক পক্ষে আনার চেষ্টা করছি।"

এবার সত্যিকারের হাসি ফুটে উঠলো আমার মুখে, যদিও তিনি সেটা টের পেলেন না। পাওয়ার দরকারও নেই। সবকিছু দেখাতে নেই। কথায় কথায় কথার লতাপাতা বাড়তে লাগলো। আমরা গল্প করতে থাকলাম। কথা বলতে বলতে সারারাত পার করে দিলাম। বেশিরভাগ প্রশ্ন তিনিই করলেন। আমি উত্তর দিয়ে গেলাম। অথচ আদনান আমাকে কোনো প্রশ্নই করতো না। সব প্রশ্ন কেবল আমিই করতাম। সে উত্তর দিয়ে যেত। যেদিন সে অনেক কথা বলত সেদিনও কেবল নিজের কথাই বলত, আমার ব্যাপারে কিছুই জিজ্ঞেস করত না। তবুও আমি বুঝতে পারলাম না যে আমার প্রতি তার কোনো আগ্রহ নেই!
.
.
.
চলবে...............................................

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন