আশিয়ানা - পর্ব ৭১ - শারমিন আক্তার বর্ষা - ধারাবাহিক গল্প


শান্ত ও নির্জন দ্বীপের ঘাটে একা দাঁড়ানো সেহরিশ। সবুজ জলের দিগন্তে দেখা যাচ্ছে ভেনিস শহরের রেখা। মাঝ সমুদ্রে ছোট বোটের ব্যস্ত আনাগোনা আর সিগালের কর্কশ ডাক সেহরিশের শ্রবণেন্দ্রিয়ে পৌঁছায়। দু-হাত প্যান্টের পকেটে গুঁজে মেরুদণ্ড টানটান করলো সে। এরপর ক্যানালের ধারে লাল ইট বাঁধানো রাস্তা ধরে হেঁটে যেতে লাগল দ্বীপের ভেতরে। জল জঙ্গল ঘেরা দ্বীপের একটি হোটেলের ভেতরে বসে সেহরিশের জন্য অপেক্ষা করছে সাদাফ। কিছুক্ষণ পরেই হোটেলে পৌঁছে যায় সেহরিশ। এখানে গরম এখনো পড়ে নি, তাই সৈকতে খুব একটা ভিড় নেই। সাদাফ আর সেহরিশ খুব সহজে দ্বীপের অন্য ঘাটে চলে গেল। মধ্যরাতে রোমে পৌঁছাল। রোমের অলিগলিতে ঘুরে হঠাৎ একটা জায়গায় এসে গাড়ি থামাল ড্রাইভার। জানালার কাঁচ গলিয়ে বাহিরে উঁকি দিল সাদাফ। পুলিশ ও বেশ কিছু লোকজন দাঁড়িয়ে আছে। তাদের মধ্য থেকে গুঞ্জন ভেসে আসছে। রাস্তার সামনে দাঁড়িয়ে যেন বোঝার চেষ্টা করছে, ওখানে কি হয়েছে? সেহরিশ গাড়ি থেকে নামে, নিশ্চল পায়ে হেঁটে এগিয়ে গেল ভিড়ের মধ্যে। একজন পুরুষ লোকের মরদেহ পড়ে আছে। মরদেহটি ঘিরে দাঁড়িয়ে রয়েছে পুলিশ ও মানুষজন। সেহরিশ আরেকটু এগিয়ে যেতে লাগল তখনই পুলিশ অফিসার এডউইন সেহরিশের সামনে এসে দাঁড়ায়। একহাত সামনে ফেলে স্পষ্ট করে বলল,
  'আপনি ওদিকে যাচ্ছেন কেন? দেখছেন না, ওখানে একটা অজ্ঞাত লাশ উদ্ধার করা হয়েছে?'

এ মূহুর্তে পেছন দিক থেকে সেহরিশের ম্যানেজার এগিয়ে এল। এডউইনের সঙ্গে সে খুব সহজ সূলভ ভাষায় কথা বলে, একটু পর সেহরিশ আর সাদাফ দূর থেকে মরদেহের মুখ দেখল। এডউইন পাশেই দাঁড়িয়ে থাকল। সাদাফ ভ্রুজোড়া ছোটো ছোটো করে সেহরিশের দিকে তাকাল। সেহরিশ গম্ভীরচিত্তে তাকিয়ে আছে মরদেহের মুখের দিকে। একজন অফিসার মরদেহ চেক দিচ্ছে। বুকের দিকটায় ছুরির কোপের দাগ স্পষ্ট। একটা বিষয় আশ্চর্যজনক লেগেছে লাশের বুকে ছুরি দিয়ে ইংরেজি (J) শব্দ লিখা। দ্বিতীয় অফিসার ভাবুক কণ্ঠে ইতালির ভাষায় বলল, 'স্যার, (J) অর্থ জেগান। ইতালির বিখ্যাত মাফিয়া, সে এভাবেই মানুষ খুন করে (J) লিখে রাখে। এই খুন টাও কি সেই করেছে?'
এডউইন ডান থেকে বামে মাথা নেড়ে বলল, 'এই হত্যা জেগান বা তার লোক করে নি, ওরা যদি করতো তাহলে লাশ মাঝপথে ফেলে যেত না। এই কাজ অন্য কেউ করেছে, যে খুব সহজে জেগানকে ফাঁসাতে চায়। আমাদের জেগানের সঙ্গে কথা বলতে হবে। তাই ওর বাংলোতে যেতে হবে।' 
অফিসার বলল,
  'কিন্তু স্যার জেগানকে আজ পর্যন্ত কেউ দেখে নি, সবাই শুধু ওর সম্পর্কে শুনেই গেছে। আর জেগান কী আমাদের সঙ্গে দেখা করবে?'
এডউইন একটু চুপ করে রইল। ভারী নিঃশ্বাস ফেলে আবার বলল, 'চেষ্টা করতে দোষ কোথায়? জেগানের সঙ্গে দেখা করতেই হবে। আমার অনেক প্রশ্নের উত্তর তার কাছেই মিলবে।'
  'কি প্রশ্ন স্যার?' জিজ্ঞেস করল পুলিশ অফিসার।
এডউইন প্রসঙ্গ পাল্টাতে বলে ওঠে, 
  'লাশটা পোস্টমর্টেমের ব্যবস্থা করো।'
সেহরিশের পাশে এসে দাঁড়াল এডউইন। তারপর বলল, 
  'আপনাদের এখন এখান থেকে যাওয়া উচিত। সাংবাদিক না হলে এই খবর টাকে মসলা দিয়ে বাড়িয়ে চারিয়ে প্রচার করবে।'
সাদাফ মৃদু গলায় বলল, 
  'ধন্যবাদ, আমাদের এতটা সময় দেওয়ার জন্য।' 

গাড়ি চলছে, যতদূর চোখ যায় দিগন্ত বিস্তৃত ঢালু উঁচু নিচু জমি। দূরে রুক্ষ পাহাড়শ্রেণী। গাড়ির জানালা দিয়ে পথের গাছপালা দু'ধারে সরে সরে যাচ্ছে। ঘন্টা দুয়েক পর, হঠাৎ গাড়ি থেমে গেল, বিশাল বড় গেট দিয়ে গাড়ি ঢুকে যায়। বাড়ির সামনে নেমে গেল সেহরিশ। এই সময় ম্যানেজার এসে সেহরিশকে জানাল, 'স্যার আপনাকে একটা খবর দেওয়া হয়নি।'
সেহরিশ স্বাভাবিক ভঙ্গিতে বলল,
  'কি কথা?'
ম্যানেজার আমতা করে বলল,
  'ম্যাম অসুস্থ! আপনার ফোন বন্ধ ছিল তাই এই খবরটা আমাকে জানানো হয়। কিন্তু আমি এটা আপনাকে জানাতে ভুলে যাই।'
সেহরিশের চোয়ালদ্বয় শক্ত হয়ে এলো। রাগ ও ক্ষোভ প্রকাশ করে কড়া গলায় বলল, 
  'এত ইম্পর্ট্যান্ট কথা তুমি আমাকে আগে জানাও নি কেন?' 
শেষের কথাটুকু একটু ধমকের স্বরে বলে থামল সেহরিশ। চোখ দুটো বন্ধ করে ভারী নিঃশ্বাস ফেলে শাসানোর ভঙ্গিতে আবারও বলল, 'এরপর এমন ভুল আবারও হলে আমি তোমাকে ক্ষমা করব না।'

সেহরিশ আর সময় নষ্ট করলো না। ছুটে চলে গেল বাড়ির ভেতরে, রোদেলা অসুস্থ শোনার পর থেকে এই বিশাল বাড়ির অলিগলি তার কাছে অহেতুক আর সময় নষ্ট বলে মনে হচ্ছে। সিঁড়ি ভেঙে উপরে চলে গেল সেহরিশ। ঘড়িতে সময় 4:50 am. নিজ রুমে পৌঁছাল সেহরিশ। রুমের ভেতর আবছা আলোকিত দেখা যাচ্ছে বিছানায় কেউ শুয়ে আছে। সেহরিশ পায়ে পায়ে হেঁটে বিছানার কাছে এসে দাঁড়ায়। হুট করে জ্বর এসেছে, জ্বরে শরীর পুড়ে যাচ্ছে। সেহরিশের পেছন পেছন চারজন কাজের লোক এসে রুমের দরজার সামনে দাঁড়িয়ে গেছে। সেহরিশ ওদের সঙ্গে কথা বলে জানতে পারলো, ওর অনুপস্থিতিতে ডাক্তার এহমাদ এসেছিল। তবে রোদেলা ডাক্তারের সঙ্গে দেখা করে নি, তারপর শুধু জ্বরের জন্য ডেসক্রিপশন লিখে দিয়ে ডাক্তার এহমাদ চলে যান। সেহরিশের নিজের উপর রাগ হলো দুটো দিন সে শহরের বাহিরে ছিল। আর এরইমধ্যে রোদেলা অসুস্থ হয়ে গেছে। কাজের লোকেদের চলে যেতে বলে সেহরিশ, দরজা ভেতর থেকে বন্ধ করে সেহরিশ। এরপর খাঁটি বাঙালী মায়েদের মতো বড় একটা বাটিতে পানি নিয়ে বিছানার পাশে রাখল। নরম কাপড়ের টুকরো পানিতে ভিজিয়ে রোদেলার কপালে রাখে সেহরিশ। এরপর ভেজা কাপড় দিয়ে হাত পা মুছে দিল। রোদেলা পিটপিট করে চোখ খুলে, চকিত রোদেলা অস্ফুটস্বরে বলল,
  'আপনি এসছেন?'
দূর্বল শরীর নিয়ে শোয়া থেকে উঠবার চেষ্টা করে রোদেলা। সেহরিশ আচমকা রোদেলার দুই কাঁধে রেখে শান্ত গলায় বলল,
  'হ্যাঁ, দেরিতে হলেও তোমার কাছে ফিরে এসেছি। তুমি এখন নড়চড় করবে না। চুপচাপ শুয়ে থাকো, শরীর ভীষণ দূরত্ব।' রোদেলা খাটের সঙ্গে হেলান দিয়ে বসে। সেহরিশ রোদেলার হাতখানা হাতের মুঠোয় নিয়ে বলল,
  'আমি দুদিন ছিলাম না তাতেই নিজের এই অবস্থা করে ফেলেছ রোদ। আমি যখন থাকব না তখন ক করবে?'
রোদেলা ঘোর বিরোধিতা করে বলল,
  'উঁহু, আমি আপনার আগে যাব। কারণ এই বিশাল পৃথিবীতে আপনি ছাড়া আমার কেউ নেই। আমি আপনাকে ছাড়া বাঁচতে পারবো না।'
সেহরিশ আলতো ভাবে রোদেলা বুকের মধ্যে লুকিয়ে ফেলল। কপোল দ্বয়ে চুমু দিয়ে বলল,
  'রোদ, আমি তোমাকে ছেড়ে যাব না আমি তোমার সাথে বাঁচতে চাই। তুমি আসার পর থেকে রংধনুর মতো রঙিন হয়ে উঠেছে আমার মরু-জীবন।'
সেহরিশ রোদেলার কপালের জলপট্টি পাল্টে আরও একটা রাখল। রোদেলা জিজ্ঞেস করলো, 
  'আপনি আবারও না বলে চলে গিয়েছেন। এবার দুদিন পর এলেন।'
সেহরিশ রোদেলার মাথায় হাত বুলাতে বুলাতে বলল, 
  'এই তো প্রমিস করছি, তোমাকে রেখে আর যাব না।'
রোদেলা সেহরিশের বুকে মাথা রেখে নরম গলায় বলল, 
  'আপনাকে ছাড়া আমার ভালো লাগে না।'
সেহরিশ রোদেলার পিঠে হাত রাখে তারপর বিড়বিড় করে বলল,
  'আমারও।' বলে একটু থামল সেহরিশ। ফের জিজ্ঞেস করলো, 'রাতে খেয়েছ?'
রোদেলা ছোট্ট করে বলল, 'হ্যাঁ।'
সেহরিশ গম্ভীর কণ্ঠে বলল, 'এহমাদ এসেছিল। ও খুব ভালো ডাক্তার। ওকে দেখাও নি কেনো? ও চেকআপ করে মেডিসিন দিয়ে যেত। আর তুমি এতক্ষণে সুস্থ হয়ে ওঠতে।'
রোদেলা ধরা গলায় বলল, 
  'অন্য পুরুষের সামনে যেতে ইচ্ছে করছিল না। সামান্য জ্বর এমনিতেই সেরে যাবে।'
  'কোনো রোগ এমনিতেই সেরে যায় না রোদ। তুমি নিজের প্রতি উদাসীন, তোমাকে আরও যত্নশীল হতে হবে। আচ্ছা বাদ দাও এইসব কথা, এখন তো আমি এসে গেছি। তোমার যত্ন আমি নেব।'
রোদেলা চোখ সরু করে তাকাল। সহসা সেহরিশ তাকে পাঁজা কোলে তুলে নিল। রোদেলা উত্তেজিত হয়ে জিজ্ঞেস করলো, 'কি করছেন?'
সেহরিশ নরম গলায় বলল, 
  'শাড়ি চেঞ্জ করবে। তোমার জ্বরের তাপমাত্রার কারণে শাড়ি গরম হয়ে গেছে।'
রোদেলা ইতস্তত করে বলল, 
  'এত রাতে শাড়ি পাল্টাবো?'
সেহরিশ রোদেলাকে কোল থেকে নামিয়ে চেয়ারে বসিয়ে দিল। এরপর তর্জনী আঙুল রোদেলার ঠোঁটের উপর রেখে নেশালো কণ্ঠে বলল, 
  'উঁহু, কোনো কথা না। এখন আমি যা বলব শুধু তাই হবে।'
.
.
.
চলবে...................................................

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন