আশিয়ানা - পর্ব ৭২ - শারমিন আক্তার বর্ষা - ধারাবাহিক গল্প


রাত পেরিয়ে ভোর। ভোরের মিষ্টি আলো ও উষশীর মৃদু হাওয়ায় এই ভোরে হাতে এক কাপ ধোঁয়া উড়ানো কফির কাপ হাতে নিয়ে বাগানের সুন্দর ফুলগুলোর দিকে অপলক দৃষ্টিতে তাকিয়ে আছে সেহরিশ। ভোরবেলা ঘুম থেকে ওঠেই বারান্দায় এসে দাঁড়ায় সে। সকাল বেলার লাল সূর্য উদয় দেখতে দারুণ লাগে তার। সূর্য উদয় আর প্রকৃতির মনোরম পরিবেশ এর সৌন্দর্য উপভোগ করতে পেরে মনটা ফুরফুরে হয়ে উঠে যেন। কফির কাপটা শূন্য হয়ে এল। ফাঁকা টেবিলের উপর কাপটা আলতো ভাবে রেখে নিশ্চল পায়ে রুমে গেল সেহরিশ। পুরো কম্বল দিয়ে মুখ ঢেকে ঘুমিয়ে আছে রোদেলা। সেহরিশ সোজা হয়ে খানিকক্ষণ দাঁড়িয়ে রইল এরপর হাঁটু গেঁড়ে বিছানার পাশে বসলো। একহাতে মুখের উপর থেকে কম্বল সরিয়ে দিতেই রোদেলার স্নিগ্ধ মুখটা সদ্য ফোঁটা গোলাপের মতো উন্মুক্ত হয়ে গেল। সেহরিশ বিড়বিড় করে বলল, 'কম্বল মুড়িয়ে শুয়ে আছো কেন রোদ? এভাবে থাকলে যে তোমার শ্বাস নিতে কষ্ট হবে।' 
ঘুমন্ত রোদেলার কর্ণপাত হলো না কিছুই! সেহরিশ খানিক এগিয়ে এল। একটু ঝুঁকে রোদেলার কপালে চুমু খেয়ে বলল, 'শুভ সকাল আমার রোদ! সকালের এই স্নিগ্ধ আলোর চেয়েও তুমি মিষ্টি, নিষ্পাপ।'
সেহরিশ রোদেলার কপালে হাত ছোঁয়ালো। নাহ, এখন আর জ্বর নেই। শরীর ঠান্ডা আছে। বেশ গভীর ঘুমেই তলিয়ে আছে সে। রাতে তেমন ঘুমাতে পারে নি, পুরো রাত কেশেছে। সেহরিশ তার ফোনের দিকে তাকাল আলো জ্বলছে। কল এসেছে সাইলেন্ট করা তাই রিং হচ্ছে না। সেহরিশ কল রিসিভ করে। সাদাফ ওপাশ থেকে উদ্বিগ্ন গলায় বলল,
  'উমাইয়ার অবস্থা ভালো না। আমি ওকে নিয়ে হাসপাতালে আছি। এড্রেস সেন্ট করছি, তুই ওখানে চলে যায়।'
সেহরিশ কল কেটে দিল। ফোনটা বিছানার উপর রেখে এক দৃষ্টিতে তাকায় রোদেলার দিকে। এই মূহুর্তে রোদেলাকে ডাকবে কি-না ভেবে পেল না। কাঁচা ঘুম। ডেকে তুললে সারাক্ষণ মাথা ব্যথা করবে। সেহরিশ সিদ্ধান্ত নিল একাই যাবে। তূর্ণ আর জুবিয়া হাসপাতালে সাদাফের সঙ্গে আছে। ওদের দেখে সেহরিশের পা থেমে গেল। এস্তপায়ে হেঁটে এসে সাদাফের সামনে দাঁড়িয়ে জিজ্ঞেস করলো,
  'কি হয়েছে? ডাক্তার কি বলল? উমাইয়ার এখন কী অবস্থা?'
সাদাফ সেহরিশের দিকে তাকিয়ে বলল,
  'হুট করে মাথা ঘোরানোর জন্য কয়েক সিঁড়ি থেকে পড়ে গেছে। ডাক্তার চেকআপ করছেন। একবার এসে বলেছেন, বাচ্চা কন্ডিশন ভালো না। উমাইয়া সিঁড়ি থেকে পড়ার সময় নিজের সন্তান কে বাঁচানোর চেষ্টা করতে গিয়ে নিজেও অনেক জায়গায় আঘাত পেয়েছে।'
জুবিয়া উৎকণ্ঠিত গলায় বলল, 
  'আমরা উমাইয়ার সঙ্গে দেখা করব কখন?'
তূর্ণ বলল,
  'ধৈর্য্য ধরো। আগে ডাক্তার বেরিয়ে আসুক ওনার মুখের কথা শুনি তারপর দেখা করতে পারব।'
সেহরিশ সাদাফের কাঁধে হাত রেখে নরম গলায় বলল, 
  'চিন্তা করিস না উমাইয়ার কিছুই হবে না।'
সাদাফ উদ্বিগ্ন গলায় বলল, 
  'আর আমার বাচ্চা? ওর যদি কিছু হয়? আমার যে দুজনকেই সুস্থ ভাবে চাই। বাচ্চাকে ঘিরে আমাদের কত স্বপ্ন, সে যদি নাই-ই থাকে তাহলে যে সেসব যে অপূর্ণ থেকে যাবে।'
তূর্ণ হুট করে বলে ওঠল, 
  'মাত্র তিন মাসেই এত চিন্তা ভাবনা করে ফেলছিস। আরও মাস তো এখনও পরেই আছে।'
সাদাফ তীক্ষ্ণ চোখে তূর্ণর দিকে তাকিয়ে দৃষ্টি সরিয়ে ফেলল। ডাক্তার বের হয়ে এসেছেন। ওনার মুখে উমাইয়ার কন্ডিশন সম্পর্কে শুনে শান্ত হলো সাদাফ। বুক ভরে নিঃশ্বাস নিল। জুবিয়া বলল, 'ভাইয়া আপনি আগে গিয়ে উমাইয়ার সঙ্গে দেখা করে আসুন তারপর আমরা না হয় যাব।'
সাদাফ বলল, 'আচ্ছা, তোমরা অপেক্ষা করো। আমি আসছি।'
সাদাফ চলে গেল। তূর্ণ সেহরিশের দিকে যাওয়ার জন্য এক পা বাড়াতে নিতেই সেহরিশ উল্টোদিকে হেঁটে যেতে লাগল। সেহরিশ কিছু একটা ভেবে জ্যাকেটের পকেট ফোন বের করে। সহসা ভ্রু কুঁচকে ফেলল সে। আরুশি দশ বার কল দিয়েছে। সেহরিশ ফোন আনলক করে আরুশির নাম্বারে ডায়াল করে। ফোন বন্ধ! 
বিস্ময়ে কপালের চামড়া চার ভাজ ফেলল। হঠাৎ মেয়েলী কণ্ঠ শুনে মাথা তুললো সেহরিশ। ইতালিয়ান নারী, রূপে ভীষণ সুন্দরী। এক কথায় যে কোনো পুরুষের দৃষ্টি আকর্ষণ করতে সক্ষম সে। সেহরিশ একপলকও ভালো ভাবে লক্ষ করলো না তাকে। সঙ্গে সঙ্গে মাথা নিচু করে অন্য দিকে ঘুরে গেল। নারীটি সেহরিশ কে চিনতে পেরেছে। সে কিছুক্ষণ চেষ্টা করে সেহরিশের সঙ্গে কথা বলার। সামনে থেকে রেসপন্স না পেয়ে সে ক্ষিপ্ত হয়ে চলে গেল। আচমকা তূর্ণর কণ্ঠে চোয়াল শক্ত হয়ে যায় সেহরিশের। তূর্ণ লহু কণ্ঠে বলল,
  'ওয়াও, কি সুন্দর রমণী। তোর সঙ্গে কথা বলতে চাচ্ছিল, হয়তো ফোন নাম্বারটাও নিতো এত কিছু বুঝেও তুই তাকে এড়িয়ে গেলি কেন?'
সেহরিশ শক্ত গলায় বলল, 
  'আমার এসবের দরকার নেই।'
তূর্ণ বিগলিত হাসি ঠোঁটে ঝুলিয়ে বলল,
  'এখনই বয়স ভাই, এখন দুষ্টুমি না করলে কবে করবে? বুড়ো হলে।' সহসা সেহরিশ রাগান্বিত চোখে তূর্ণর দিকে তাকায়। ভীরু তূর্ণ ঠোঁট কামড়ে ধরে ধীরেধীরে হেঁটে সেহরিশের পিছু পিছু যেতে লাগল। সাদাফ এখনও বের হয়ে আসেনি। কেবিনের সামনে দাঁড়িয়ে রয়েছে জুবিয়া। সেহরিশকে দেখে কথা বলার জন্য এগোল সে। জুবিয়া আমতা আমতা করে বলল, 'বড় ভাই, রোদু কোথায়? ওকে সঙ্গে নিয়ে আসেন নি কেনো?'
সেহরিশ শান্ত গলায় বলল, 'ওর জ্বর এসেছে, রাতে ঘুমায়নি। তাই আমি সকাল সকাল ওকে আর ডাকিনি।'
জুবিয়া হাঁসপাঁস করে বলল, 
  'বড় ভাইয়া?'
সেহরিশ জিজ্ঞেস করলো, 'কিছু বলবে?' 
জুবিয়া উপর নিচ মাথা নাড়ল। যার অর্থ হ্যাঁ। সে কিছু বলতে চায়। সেহরিশ পূর্বের মতো শান্ত গলায় বলল, 'বলো, আমি শুনছি।'
জুবিয়া ইতস্তত করছে। দু-হাত কচলাতে লাগল একটু পর চাপা গলায় বলল, 'জোজো খুব অসুস্থ। আমি এখানে আসার আগে জোজোকে দেখতে গিয়েছিলাম। সেটা চারদিন আগের কথা। জোজো অসুস্থ ছিল তাই আমি তাকে পশু হাসপাতালে নিয়ে যাই। আপনি বরং বাসায় গিয়ে রোদেলাকে জোজোর সাথে কথা বলিয়ে দেবেন।'
সেহরিশের চোখেমুখে গাম্ভীর্যের আভা। সেহরিশ ভ্রুকুটি করে বলল, 'হুম।'

ঘড়িতে সময় সকাল ১০টা। হাসপাতাল থেকে বেরিয়ে সোজা নিজের বাড়িতে ফিরে এল সেহরিশ। বাড়ির ভেতর প্রবেশ করে চমকে যায় সে। একজন সার্ভেন্ট ও আশেপাশে কোথাও নেই। সেহরিশ স্বাভাবিক গতিতে হেঁটে সিঁড়ি ভেঙে ভেঙে উপরে চলে গেল। তার রুমের দরজার সামনে সকল সার্ভেন্টদেরকে দেখে বিস্মিত হলো তাত্ক্ষণিক এগিয়ে গেল। সেহরিশ কে দেখে সার্ভেন্ট সকলে এক সাইড হয়ে দাঁড়িয়ে যায়। সেহরিশ গম্ভীর কণ্ঠে ইংরেজিতে জিজ্ঞেস করলো, 
  'সবাই একসঙ্গে এখানে কি করছেন আর ম্যাম কোথায়?'
একজন মহিলা ইতালিয়ান ভাষায় বললেন, 
  'স্যার, ম্যাম রুমের ভেতরে আছেন। আমাদের ভেতরে যেতে অনুমতি দিচ্ছে না। ম্যাম হুট করে কান্না শুরু করেছেন আমরা বুঝতে পারছি না তিনি কান্না করছেন কেন? তাই আমরা সবাই এখানে দাঁড়িয়ে আছি।'
সেহরিশ রুমের ভেতরে ছুটে গেল। অন্ধকার রুম। খোলা জানালা দিয়ে সূর্যের আলো আসছে। আবছা আলোয় বিছানার কোনায় রোদেলাকে বসে থাকতে দেখল সেহরিশ। চাপা কণ্ঠে কান্নার আওয়াজ কানে এসে বাজছে। সেহরিশ হাঁটু ভাজ করে রোদেলার সামনে বসে গেল। আলতোভাবে রোদেলার মাথায় হাত রেখে কোমল গলায় জিজ্ঞেস করলো, 
  'রোদ! এই তোমার কি হয়েছে? তুমি এভাবে কান্না করছে কেন? তুমি জানো না তোমার কান্না আমি সহ্য করতে পারি না। তোমার এই চোখের জল, ডুকরে কেঁদে ওঠা আমার হৃদয় জ্বালিয়ে পুড়িয়ে দিচ্ছে।'
রোদেলা জবাব দিল না। সেহরিশ রোদেলার গালে হাত রাখে তারপর রোদেলার চোখের দিকে তাকিয়ে ধীরে ধীরে গালে লেপ্টে থাকা অশ্রুজল মুছে দিয়ে আবারও জিজ্ঞেস করলো, 
  'কি হয়েছে? কাঁদছো কেনো?'
রোদেলা সেহরিশকে আঁকড়ে ধরে হাউমাউ করে কাঁদতে লাগল। কান্নায় ভেসে যাচ্ছে দু'টি চোখ। রোদেলা কান্না ভেজা গলায় বলল, 
  'জোজো আর নেই।'
.
.
.
চলবে..................................................

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন