বজ্রমেঘ - পর্ব ০৯ - ১/২ - ফাবিয়াহ্ মমো - ধারাবাহিক গল্প


দুটো বাহু ক্রস করে কোমরের কাছে নামাল লোকটা। হুডির শেষপ্রান্ত দুহাতে ধরে একটানে গা থেকে হুডিটা খুলে ফেলল। চাঁদের রূপোলি আলোয় সঙ্গে সঙ্গে ফুটে ওঠল এক অদ্ভুত অবর্ণনীয় দৃশ্যপট। যা কিয়ৎকালের জন্য স্তম্ভিত করে দিয়েছিল খোদ শাওলিনকেও। অবিশ্বাস্য নজরে ও দেখল হুডির নীচে অসম্ভব ভারি, বর্মের মতো কঠোর, প্রচণ্ড শক্তিশালী এক দেহসৌষ্ঠব্য। কায়িক শ্রম, নিয়মতান্ত্রিক জীবন, ব্যায়াম চর্চিত কৌশল তাকে প্রচণ্ড দেহশালী করেছে। হুডিটা অদূরে ঘাসের উপর নিক্ষেপ করতেই পাদুটো নজরে ফেলল সে। হাঁটু গেড়ে বসা সত্ত্বেও লোকটার উচ্চতা অস্বাভাবিক রকম দীর্ঘ। বহুগুণ ছাড়িয়ে গিয়েছে বসে থাকার পরও। মনে খট করে একবার প্রশ্ন জাগল শাওলিনের, ও যদি পাঁচ ফিট চার ইঞ্চির হয়ে থাকে, সেক্ষেত্রে এই লোকটার উচ্চতা কত ফিট কত? মাথায় সেই ভয়ানক সংখ্যাটা ঢুকাল না ও। বরং আশ্চর্যে মাখো মাখো চোখদুটো ছুঁড়ে চাইলে লোকটা ওকে উদ্বেগের সুরে বলল, 

  - আমার কাছে ন্যাপকিন নেই ইয়াং লেডি। পকেটে যা আছে সেগুলো দিয়ে উণ্ডেড স্পটটা ক্লিন করা সম্ভব নয়। টোটব্যাগ থেকে রুমাল অথবা শর্ট ক্লথ নেওয়া যাবে? 

প্রশ্নটা ওর চোখে চোখ ফেলে করল শোয়েব। ওই চোখের অন্দরেই ফুটে আছে অব্যক্ত ব্যথার ছাপ। মেয়েটা নির্নিমেষ তাকিয়ে থেকে ডানদিকে মুখটা ফেরাল। পাশে গা সংলগ্ন টোটব্যাগটা আস্তে আস্তে টেনে থরথর করে কাঁপুনি হাতে তুলে দিল। ঠোঁটদুটো তিরতির করে কাঁপিয়ে সামান্য ঢোক গিলে বলল, 

  - নিয়ে নিন, 

ওইটুকু কথা বলতেও ভীষণ কষ্ট পেল শাওলিন। জায়গাটায় প্রচণ্ড টান লাগছে। মনে হচ্ছে কেউ দুহাতে চামড়াটা টেনে ধরেছে। কম্পনরত হাত থেকে ব্যাগটা বুঝে নিলেও সরুচোখে তাকিয়ে ছিল শোয়েব। কী যেন নিগূঢ়ভাবে বোঝার চেষ্টা করছিল সে। তার মসৃণ কপালে ধীরে ধীরে, সুক্ষ্মভাবে পুরোনো দিনের মতো চিন্তার ভাঁজ পরছিল। ঠিক সেভাবেই চোখদুটো স্থির করে ব্যাগের চেইন খুলে কাজ করল। শাওলিন যখন শুষ্ক ওষ্ঠের ওপর জিভ ছুঁয়ে সহসা তাকাল, তখন ওই স্থিরদৃষ্টির অবস্থা দেখে চমকে উঠল ও। সারামুখে কেমন যেন এক অজানা সংশয়ের ছায়া প্রকট হচ্ছিল। লোকটা ওর দিকে কী তলিয়ে দেখছে? ওমন তীক্ষ্ম, ধারালো, বন্য ক্ষিপ্রতায় কী ঘাঁটছে? কোনোভাবে কী ব্যাপারটা বুঝে ফেলেছে? ডান হাতটা আস্তে আস্তে কোলের ওপর থেকে সরাল শাওলিন। ঠিক তখনি লোকটা তির্যক চাহনিতে চোখদুটো সরু করে বলল, 

  - ইজ এভ্রিথিং ওকে, ইয়াং লেডি? 

কথার বলার ধরণটা সম্পূর্ণ আমেরিকান উচ্চারণে। সাবলীল অ্যাকসেন্টে প্রশ্নটা ছুঁড়ে চোখদুটো নিরীক্ষণ দৃষ্টিতে ছেঁকে রেখেছে। একপলক চোখ নামিয়ে নিজের পায়ের দিকে চাইল শাওলিন। কথা বললেও পা থেকে আলগা ময়লাটুকু সাফ করে যাচ্ছে লোকটা। অথচ চোখদুটো কেমন ধার দেওয়া ছুরির মতো বিদ্ধ। শাওলিন লোকটার মুখে দৃষ্টি স্থাপন করে মৃদু গলায় বলল, 

  - ঠি-ঠিক আছে সব। 

  - কী ঠিক আছে? 

কপালের কুঞ্চন রেখা আরো গাঢ় হলো শোয়েবের। গলার ওই ক্ষীণ কাঁপনটুকু তার দৃষ্টি এড়াল না। সমস্যাটা অন্যদিকে, যা মেয়েটা নিজ থেকে ধরা দিতে চাচ্ছে না। কিন্তু কেন? আঘাত পেলে সেটা লুকোবে কেন? পাদুটো যেভাবে জখম হয়েছে তাতেও সামান্য আর্তনাদ করেনি। নূন্যতম স্বরে 'উহঃ' শব্দটুকুও করেনি। দাঁতে দাঁত চেপে বাইরে থেকে শুধু ঠোঁটদুটোই কাঁপিয়ে যাচ্ছে। বিষয়টা সরল চোখে স্বাভাবিক মনে হলেও এটা মোটেও স্বাভাবিক ঠেকল না। একটা অদ্ভুত ব্যাপার যেন এখানটায় আছে। একটা অস্বাভাবিক ব্যাপার সুঁতোর মতো আলগোছে বুনে রয়েছে। শোয়েব ফের পায়ের দিকে ব্যস্ত হলে এবার সে সহজ ভঙ্গিতে বলল, 

  - বয়সে ভীষণ ছোট বলে আপনি করে বলছি না। তোমাদের দলের সবাইকে তুমি সম্বোধন করেছি। শোনো, এখানে বেশিক্ষণ থাকা সম্ভব নয়। ঠাণ্ডা পড়বে। পাহাড়ি অঞ্চলের ঠাণ্ডা অজপাড়া গাঁয়ের মতো হালকা ঠাণ্ডা নয়। আশাকরি বুঝতে পারছ কেন তোমাকে উদ্দেশ্য করে কথাগুলো বলছি আমি। এখান থেকে উঠতে হবে। দাঁড়ানোর মতো অবস্থায় থাকলে কষ্ট করে উঠে দাঁড়াও। 

মাথাটা তখনো কিঞ্চিত নীচু করে পায়ের জায়গাগুলো পরিচ্ছন্ন করছে শোয়েব। একঝাঁক নরম চুল ঝুঁকে থাকার ফলে নুয়ে আছে। এক মুহুর্তের জন্য শাওলিনের মনে হলো, এরকম পাষাণ গোছের পুরুষ দ্বিতীয়টি হয় না। কোনোপ্রকার সাহায্যের বালাই বা সহযোগিতার কথা মুখ ফুটে বলল না। সরাসরি সোজাসাপ্টা বলে দিল ' অবস্থায় থাকলে উঠে দাঁড়াও!' পরক্ষণে ওর অবচেতন মনটা এও বলল, হয়তো লোকটা চাইছে না ও কোনোভাবে বিব্রত হোক। অপরিচিত একজন পুরুষের স্পর্শ মনে চরম অস্বস্তি জোগায়। মেয়েরা ভেতরে ভেতরে প্রচণ্ড গুটিয়ে যায়, মিইয়ে পড়ে। হয়তো এদিকটা মাথায় রেখেই লোকটা নিরাপদ অবস্থাটুকু নিশ্চিত করতে চাইছে। চাইলে জুতোহীন অবস্থায় ওকে কোলে তুলতে পারতো, অথবা গায়ে হাত দিয়ে বাজে কিছুও ঘটাতে পারতো, কিন্তু এখনো পর্যন্ত ওর জামার ছেঁড়া ফাঁটা অংশে চোখও রাখেনি লোকটা। আড়চোখে এটুকু বুঝতে পেরেছে চোখদুটো বাজে দৃষ্টিতে একবারও ঘুরেনি। বরং, হাঁটু গেড়ে বসার পর থেকে চুপচাপ কাজ করে যাচ্ছে। দুর্বলতার চূড়ান্ত স্তরে ঠোক্কর খেয়ে এসব ভাবছে শাওলিন। মাথার ভেতর তীব্র অকথ্য যন্ত্রণা। ঝিঁঝিঁ পোকার মতো অদ্ভুত একটা স্বর মস্তিষ্কের আনাচে কানাচে প্রচণ্ড ঝড় তুলেছে। চোখের দৃষ্টিও ফ্যাকাশে, ঝাপসা, অস্বচ্ছ। চোখের ডানকোণ বেয়ে একফোঁটা অশ্রু গড়িয়ে পরতেই কেশে উঠল শাওলিন। কাশিটা গলার এমন পর্যায় থেকে উঠে আসছিল, যেন আরেকটু হলে এক্ষুণি রক্ত চলে আসবে। শোয়েব রুমালটা ছেড়ে অজান্তেই এক কদম কাছে চলে আসে। গাছে হেলান দেওয়া মাথাটার পাশে নিজের ডানহাত চেপে ওর মুখোমুখি হয়ে বলে, 

  - ঠিক আছ তুমি! প্রচণ্ড ব্যথা পাচ্ছ পায়ে? 

প্রশ্নের বিপরীতে উত্তর দিতে পারল না শাওলিন। চোখের পাতা ক্রমশ ভারি হয়ে আসছে। মাথায় অদ্ভুত শূন্যতা। আস্তে আস্তে ডানহাতটা পিঠের পেছন থেকে বের করে ও। শোয়েব ভ্রুঁ কোঁচকানো দৃষ্টিতে চোখটা নীচু করেছিল, কিন্তু সহসা কপালের ভাঁজগুলো সমান হয়ে যায়। স্থির হয়ে যায় চোখ। গোলাপি জামাটার কোলে হাতটা ছেড়ে দিয়েছে ও। চাঁদের আলোয় গাঢ় বর্ণের রঙটা জামার উপর মাখামাখি হয়ে গেল। শোয়েব সম্পূর্ণ শান্ত ভঙ্গিতে স্বাভাবিক চেহারায় ওর ঘাড়ের পেছনে ডানহাতটা রাখল। গাছের গা থেকে সম্পূর্ণ আলগা করে নিজের বুকের উপর দেহটা হালকা মেশাল সে। বাঁহাত দিয়ে ওর ঘাড়ের কাছ থেকে সমস্ত চুল ডান থেকে বাঁয়ে সরিয়ে আনল শোয়েব। পিঠের দিকে নজর বুলিয়ে দেখল, ছুরির কোপ বসানো দাগ। চোখ উপরে তুলে দেখল, গাছের গায়েও টাটকা রক্তের ছাপ।  


হট শাওয়ারের নীচে চমৎকার গোসল দিয়ে বারান্দায় বসেছেন সুনীল দত্ত। বারান্দার ওপাশে বন রূপিণীর নিস্তব্ধ রাত। ঘনঘটা আঁধারে মাঝে মাঝে তিনি একলা বসে প্রকৃতি উপভোগ করেন। কখনো সঙ্গে থাকেন স্ত্রী শ্যামা। বারান্দার এককোণে চেয়ার টেবিল পাতা জায়গায় আজও বসে আছেন তিনি। যত্ন করে সাদা পোর্সেলিন কাপে চুমুক দিচ্ছেন চা। চায়ের মৌ মৌ সুগন্ধে ভরে আছে খোলা জায়গাটা। ডানহাতে কাপ, বাঁহাতে কাপের তলায় পিরিচ ধরে আরেকদফা চুমুক দিচ্ছিলেন তিনি, হঠাৎ তার চুমুকের মাঝে ঘণ্টা বাজাল বিকট ফোনের বাজনা। ভদ্রলোক সচরাচর বিরক্ত হন না, তবে আজ এই মধুর রজনীতে ফোনের শব্দ কিছুটা মেজাজ রুক্ষ করল। চায়ের কাপ সহ পিরিচটা টেবিলে নামিয়ে ফোনটা তুলে নেন তিনি। কলার নামটা দেখে সঙ্গে সঙ্গে যেন ফুঁ দেওয়া মোমের মতো বিরক্তিটা নিভে যায় উনার। তৎক্ষণাৎ ঠোঁটে খুশির খই ফুটিয়ে কলটা কানে চেপে বললেন, 

- কী হে, বৎস! কী ভাবিয়া মোরে রজনীকালে স্মরণ করিয়াছ? 

কলের ওপাশ থেকে ভ্রুঁক্ষেপ করারও অবকাশ পেল না শোয়েব। চিন্তিত সুরে সরাসরি প্রসঙ্গে ঢুকল সে, 

  - বাড়ি আছেন মিষ্টার দত্ত? 

  - আছি এখন। কী বলবে বলো। বাড়ি আসবে নাকি? 

  - না। আজ নয়। আপনার কাছ থেকে একটা হেল্প দরকার মনে হচ্ছে। এ ব্যাপারে কী করা যায় এখন? হেল্প করতে . . 

বাকি কথা আর পূরণ করতে দিলেন না সুনীল দত্ত। তার আগেই কথার খেই ধরে তিনি নিজেই আগ বাড়িয়ে বললেন,   

  - এসব কী কথা? হেল্প লাগবে হেল্প নিবে, এখানে অতো ভাবনা কষছ কেন? কী হেল্প লাগবে বলো দেখি। এখন তো বাড়িতে আছি, বাইরের খবর হলে কাল সকালে দেখতে পারব। 

  - বাড়ির কর্ম। আপনার ব্যক্তিগত বাহনটা এখন লাগবে মিষ্টার দত্ত। আপনার বাহনটা গ্যারেজে আছে? 

  - জীপ? হ্যাঁ, ওটা তো গ্যারেজেই। কিন্তু জীপ দিয়ে. . আচ্ছা তোমার বাহন কোথায়? সমস্যা করেছে? 

  - হ্যাঁ, সেরকম কিছু। বাহনটা চাবি সহ রেডি করে দিন। বাড়ির প্রায় কাছাকাছি আছি। 

এ পর্যায়ে সুনীল দত্ত নিজেই ভ্যাবাচ্যাকা খেয়ে চারপাশে চোখ বুলালেন। দূরের নিশ্ছিদ্র অন্ধকার ছাড়া কিছুই নজরে পরল না। কান থেকে ফোন নামিয়ে দ্রুত জীপটা রেডি করতে বললেন তিনি। যদিও জানেন না শোয়েব যাচ্ছে কোথায়। যথাযথ জীপটা গ্যারেজ থেকে বের করে জায়গামতো প্রস্তুত করে রাখল উনার কর্মচারী। বারান্দার হলুদ আলোতে দাঁড়িয়ে দ্বিতীয় চায়ের কাপে সদ্য চুমুক দিচ্ছিলেন সুনীল দত্ত। এমন সময় মুখভর্তি চাটুকু আর গিলতে পারলেন না তিনি। দূরে এমন এক দৃশ্য দেখে থমকে গেছেন, ফলে মুখ দিয়ে ফস করে চাটুকু বাইরে ফেলেন তিনি। আকাশ থেকে ঠাস করে পরার মতো আশ্চর্য হলেও প্রচণ্ড অবাক কণ্ঠে বললেন তিনি, 

  - হায় ভগবান! এসব কী হচ্ছে! 

সুনীল দত্তের স্ত্রী কাছেপিঠেই কোথাও ছিলেন। স্বামীর ওমন প্রগলভ শুনে সঙ্গে সঙ্গে বারান্দায় পৌঁছে বলেন, 

  - কী হলো? কোথায় কী হচ্ছে? 
 
ভদ্রলোক কোনো উত্তর দিতে পারলেন না। উনার চোখের সামনে যেন সবচাইতে আশ্চর্যকর ঘটনাটিই ঘটেছে। তিনি বারান্দার রেলিং দুহাতে খামচে প্রচণ্ড অস্থির কণ্ঠে চ্যাঁচিয়ে উঠলেন, 

  - শোয়েব! তোমার কোলে ওই মেয়েটা কে! মেয়েটার কী হয়েছে? এমন সর্বনাশী কাণ্ড কী করে ঘটল? 

জীপের দরজা খুলতে খুলতে ব্যগ্র স্বরে প্রত্যুত্তর করল শোয়েব, 

  - সবকিছু জানাব আপনাকে, মিষ্টার দত্ত। সময় এখন প্রশ্নোত্তরের নয়। জীপটা সকালে পাঠিয়ে দেবার ব্যবস্থা করব। যাই! 

আর কোনো কথা না বলে দ্রুত জীপটা স্টার্ট করল শোয়েব। যেভাবে অন্ধকারের গা ফুঁড়ে দৌড়ে এখানে পৌঁছেছিল, তেমনি ক্ষিপ্র গতিতে জীপ হাঁকিয়ে বেরিয়ে গেল সে। পেছনে রেখে গেল একরাশ প্রশ্ন, ঘুটঘুটে আতঙ্ক, দুটি মনুষ্য মূর্তির অসংখ্য কৌতুহল! যা ঘটল, তা যেন বিশ্বাস করতে পারছেন না। স্বপ্নের ঘোর বলে পুরো ব্যাপারটা ভ্রম মনে হচ্ছে। 


দুটো জ্বলন্ত হেডলাইটের আলো গ্রোগ্রাসে রাতের বুনো অন্ধকারকে গিলে খাচ্ছে। চারপাশ আলোয় ফরসা করে ছুটে যাচ্ছে জীপ। অন্য জীপের কন্ট্রোল সিস্টেম নিয়ে বিড়ম্বনায় পরার কথা, কিন্তু অবাক করার বিষয় হচ্ছে হাতের কৌশলগুলো একটাও ভুল পরছে না। আঁধার ঘনিয়ে যাওয়ায় পুরো মসৃণ পথ ভূতুড়ে নিস্তব্ধতা ধারণ করেছে। একটানে উর্ধ্বশ্বাসে স্পিড বাড়িয়ে চলছে শোয়েব। স্পেডোমিটারের প্রতি নজর না ছুঁড়েই হাই রেটের স্পিডটা গুণতে পারল সে। মাথাটা পিছু ঘুরিয়ে একবার দেখার ইচ্ছেটা ছিল, কিন্তু ব্যালেন্স বিগড়ানোর ছকে সে কাজটুকু আর করল না। চিরচেনা পথের নির্দিষ্ট সাইনবোর্ডটা চোখে পরতে দ্রুত ডানে মোড় নিল জীপ। এক লহমায় বাড়ির ত্রিসীমানায় পৌঁছে সোজা স্থির করল লোহার গেটে। গেটের ওপাশ থেকে টুং টাং শব্দে দ্রুত তালা খোলার স্পষ্ট আওয়াজ হচ্ছে। যেন পাহারাদার অপেক্ষাতেই ছিল এইমাত্র জীপ আসবে! এদিকে জীপ থেকে বেরুতেই সরাসরি পেছনে গিয়ে ব্যাক ডোরটা খুলল শোয়েব। এক মুহুর্ত কী যেন ঠাণ্ডা মাথায় ভাবল। পরক্ষণে চিন্তাটা ঝেড়ে ফেলে দুটো হাত সামনে এগিয়ে দেয় সে। আজ আর হাসপাতালে যাওয়াটা নিরাপদ নয়। রোকেয়াকে সাহায্যের জন্য ডেকে তুলতে হবে। হাঁটুদ্বয়ের নীচে ডানহাত, কোমল ঘাড়ের তলায় বাঁহাত রেখে ঝটিতি শূন্যে তুলে নেয় ওকে। ইতোমধ্যে শীতের ছোবল চামড়ায় কামড় বসাতে শুরু করেছে। চারিদিকে কুয়াশা চাদর নামবে নামবে অবস্থা। বুকের ভেতর কালো হুডিতে ঢেকে আছে শাওলিন। মুখটা এলো চুলে ঢাকা। দুদিক থেকে হাঁ করে খোলা গেটটা দিয়ে ভেতরে ঢুকে গেল শোয়েব। পায়ে হাঁটা পথটা কিছুদূর পেরোতেই হঠাৎ থমকে দাঁড়াল সে। সজাগ দৃষ্টিতে দেখল, বাংলোর দরজায় উজ্জ্বল বাতি জ্বলছে। দরজার বাইরে দুটো মনুষ্য মূর্তি। একটা মূর্তি মারাত্মক বিস্ফোরণে তাকিয়ে আছে! মুখ হাঁ করা অবস্থা দুহাতে ঢেকে রাখা। অবিশ্বাস্য চোখে স্থির বনে আছে। যেন বিশ্বাসই করতে পারছে না, শোয়েব ফারশাদ মেয়ে সহ বাড়ি ফিরেছে! তাও নিজের হুডিতে মুড়িয়ে, বাহুর মধ্যে এইটুকু করে, মাথাটা বুক বরাবর চেপে! অন্যমূর্তিটি ভীষণ শান্ত। পরণে ঘিয়ে রঙা সুতির কাপড়। চোখে সোনালি ফ্রেমের বয়ষ্ক ধাঁচের চশমা। ছোট ছোট কদম ফেলে এগিয়ে এসে বললেন, 

  - অফিসার সাহেব কী এই কারণেই পাত্রীর ছবিগুলো লাইটারে পুড়ান? আপনি তো দেখছি বাপের মতোই বাইম মাছের খেলা দেখাতে ওস্তাদ। বাপও যেমন পিছলা পিছলি করে পালিয়ে যেতো, এরপর জায়গামতো খেতো ধরাটা। আপনার বেলাতেও দেখছি বাপের মতো শয়তানি ঢুকেছে। এজন্যই আপনার ঢাকা, বিদেশ ভালো লাগে না, না? 
.
.
.
চলবে....................................................

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন