প্রেমান্বেষা - পর্ব ২৮ - সারা মেহেক - ধারাবাহিক গল্প


মানব জীবন ভীষণ জটিল। জটিল এ জীবনকে আরোও জটিল করে দোদুল্যমানতা, বিভ্রান্ততা মাঝে মাঝে এমন কিছু পরিস্থিতি আসে, এমন কিছু সময় আসে যে সময়ে সে চরম দোদুল্যমান ব্যক্তি ভুল সিদ্ধান্ত নিয়ে বসে। সে সঠিক ও ভুলের পার্থক্য দেখেও যেনো দেখতে পারে না৷ নীলিমার ক্ষেত্রেও হয়েছে তাই। মেয়েটা জীবনের এ পর্যায়ে এসে চরম বিভ্রান্তকর পরিস্থিতিতে পড়ে গিয়েছে। আবেগ ও বিবেক যেনো গুলিয়ে উলোটপালোট হয়ে গিয়েছে। 

আজ নীলিমাকে পাত্রপক্ষ দেখতে আসবে। এ কারণে মিলি বেগম বিকেলের নাস্তা থেকে শুরু করে রাতের খাবার পর্যন্ত তৈরী করেছে। আর ক'দিন বাদে পাত্রপক্ষ এলে লিলি বেগম আসতেন, বোনকে সাহায্য করার জন্য৷ কিন্তু মানতাসার বিয়ের পর তিনি গিয়েছে শ্বশুরবাড়ি। এখনও আসেননি। এদিকে শুক্রবার হওয়ায় ইমাদ সাহেব স্মরণকে ডেকেছেন বাজারের কাজে সাহায্যের জন্য। সকাল সকাল ঘুম থেকে উঠে যে বিধ্বংসী এক সংবাদ পাবে তা স্মরণের কল্পনাতীত ছিলো। নীলিমাকে পাত্রপক্ষ দেখতে আসার কথা শুনে সে কিছুক্ষণ থম মেরে বসে ছিলো। তার কঠিন কণ্টকাকীর্ণ পথটা যে দিনকে দিন আরোও কঠিন হবে এমনটা ভাবতে পারেনি সে। গতকাল নীলিমার সাথে দেখা করার পর তার মনে ক্ষীণ একটু আশা জেগেছিলো। তার মন বলছিলো, নীলিমা একটু নরম হয়েছে৷ হয়তো সময় দিলে সে রাজি হবে। কিন্তু পরেরদিনই যে উটকো ঝামেলার মতো ছেলেপক্ষ দেখতে আসবে এ আর ভাবেনি। 

ইমাদ সাহেবের সাথে বাজার করে আসার পর স্মরণ নীলিমাদের বাসায়ই উঠলো। আজকে রাতের খাবার না খেয়ে তাকে যেতে দিবেন না ইমাদ সাহেব। এদিকে এখানে কাটানো প্রতিটি মুহূর্ত এক রুদ্ধশ্বাস পরিস্থিতি তৈরী করছে তার জন্য৷ না পারছে পরিস্থিতি সামাল দিতে আর না পারছে পরিস্থিতি থেকে পালিয়ে যেতে। যত সময় গড়াচ্ছে, ততই নীলিমাকে পাওয়ার আশা ক্ষীণ থেকে ক্ষীণতর হচ্ছে৷ ঠিক যেনো কালবৈশাখী ঝড়ের তোড়ে নিভু নিভু করা প্রদীপের আলোর মতো৷ 

নীলিমা নিজের রুম থেকে বেরুচ্ছে না৷ কেননা বের হলেই স্মরণের সম্মুখীন হবে সে। আর এ পরিস্থিতিতে স্মরণের মুখোমুখি হওয়া সমীচিন নয়। সে গতকাল রাত হতে জীবনের সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ সিদ্ধান্ত নেয়ার ব্যাপারে ভাবছে। ভাবতে ভাবতে চরম মাথাব্যাথায় কাতর হয়েছে। তবুও এ ভাবনা শেষ হয়নি। নিজের সিদ্ধান্ত ক্ষণে ক্ষণে বদলেছে। কখনও স্মরণকে আপন করে নেয়ার সিদ্ধান্ত ভুল মনে হয়েছে, কখনও বা মনে হয়েছে সঠিক। যেনো নেগেটিভ, পজেটিভ দুটোই একে অপরকে নিরপেক্ষ করে দিয়েছে। তবে নীলিমার সিদ্ধান্তহীন হৃদয়খানা এবার ছেলেপক্ষের সম্মুখে যেতে বাধা দিচ্ছে। তবুও তাকে যেতে হবে। বাবার সম্মানের কথা ভেবে হলেও যেতে হবে। 

মাগরীবের কিছুক্ষণ আগে ছেলেপক্ষ এসে হাজির হলো। ছেলের নাম আকাশ৷ স্বভাবে বেশ চুপচাপ ও ভদ্র গোছের। চেহারায় বিচক্ষণতার ছাপ স্পষ্ট । ইমাদ সাহেবের এমন ছেলে ভীষণ পছন্দের। মেয়ের ভবিষ্যত জীবন সঙ্গীর কাতারে যদি আকাশ ও স্মরণকে পাশাপাশি দাঁড় করানো হয়, তবে ইমাদ সাহেব নিঃসন্দেহে আকাশকে বেছে নিবেন। স্মরণ কিছুক্ষণের মধ্যেই এটা বুঝে গিয়েছে। কেননা ইমাদ সাহেবের চোখমুখে হাসিখুশি একটা ভাব বজায় আছে। ছেলের সাথে খাতির জমানোরও বেশ চেষ্টায় আছেন তিনি৷ আকাশ ও নীলিমার যদি এখনই বিয়ের ব্যবস্থা করা হয় তাহলে ইমাদ সাহেব এ মুহূর্তেই বিয়ে করিয়ে দিবেন, এতে কোনো সন্দেহ নেই। 

স্মরণ, ইমাদ সাহেব ও আকাশের এ ভাব খাতির দেখে আপনমনে তুচ্ছতাচ্ছিল্য করে বললো,
" মেয়ে যদি আমাকে বিয়ে করতে রাজিও হয়ে যায়, মেয়ের বাপকে পটানো হবে সবচেয়ে দুষ্কর কাজ। কেনো যে প্রেমপিরিতি আসলো জীবনে! এর চেয়ে সিঙ্গেল থেকে মরলেও শান্তি পেতাম। এক জ্ঞানী বোধহয় ঠিকই বলেছেন, 'পিরিতের আঠা কাঁঠালের আঠা। "
এই বলে স্মরণ দীর্ঘশ্বাস ছাড়লো। বেশ বড়সড় দীর্ঘশ্বাস। 
কথাবার্তার এক পর্যায়ে ইমাদ সাহেব স্মরণকে সবার সাথে পরিচিয় করিয়ে দিলেন। স্মরণকে দেখিয়ে বললেন,
" ওর নাম স্মরণ। নীলিমার মামাতো ভাই। বর্তমানে একটা বেসরকারি প্রতিষ্ঠানে চাকরী করছে।"

স্মরণ এর প্রত্যুত্তরে সবার সাথে হাসিমুখে কথা বললেও মনে মনে ঠিকই চিবিয়ে চিবিয়ে বললো,
"মামাতো ভাই না ফুপা। বলুন জামাই। আল্লাহ যেনো আমাকে আপনার দুইমাত্র মেয়ের দুইমাত্র জামাই, মানে আপনার মেয়ের একমাত্র বর হওয়ার তৌফিক দান করেন। আমিন! আল্লাহ, আমার দোয়া কবুল করো। সামনের এই ভদ্রলোকের জামাই বানিয়ে দাও আমাকে। "
স্মরণের এই মনে মনে করা দোয়ার মাঝে নীলিমা এসে উপস্থিত হলো। পরনে তার আকাশী রঙের এক জামদানী শাড়ি। জামদানী হলেও বেশ সাদামাটা ডিজাইনের শাড়িটা। মাথায় ঘোমটা দেয়া। দৃষ্টিজোড়া অবনত৷ যেনো লজ্জায় মরি মরি অবস্থা তার। অথচ স্মরণের তাকে দেখে মরি মরি অবস্থা। এমন সাধারণ বেশ ও সাজসজ্জায় তাকে দারুণ স্নিগ্ধ দেখাচ্ছে। কিন্তু এসব সাজসজ্জা তো আর স্মরণের জন্য নয়। বরং আকাশের জন্য। এই ভেবে স্মরণের মেজাজ খারাপ হলো। আপনমনে আকাশের গুষ্টি উদ্ধার করতে করতে নীলিমার গুষ্টি উদ্ধারে ব্যস্ত হলো। চটে যাওয়ার মেজাজ নিয়ে কোনার সোফায় বসে বিড়বিড় করে বললো,
" আকাশের জন্য আকাশী রঙের শাড়ি! বাহ বাহ। এই পোংটাকে ইমপ্রেস করার এতো চেষ্টা! স্মরণ নামের কোনো রঙ নেই কেনো! এমন নামের রঙ তৈরী করতে হবে। তারপর নীলিমাকে স্মরণ রঙের শাড়ি পরাতে হবে। উফ! মেজাজটাই গরম হয়ে যাচ্ছে। "

একদিকে প্রেয়সীকে অন্যের হতে যাওয়া দেখায় হৃদয় ভাঙার ব্যাথা, অন্যদিকে চটে যাওয়া মেজাজ। দুইয়ে মিলে স্মরণ আছে চরম বিপাকে। নাহ, এসব আর ভালো লাগছে না। মন বলছে এক্ষুনি সবার সামনে নীলিমার হাত ধরে দূরে কোথাও পালিয়ে যেতে। কিন্তু তার নীতিতে যে এমন অসভ্যতামি নেই। থাকলে বহু আগেই কোনো অঘটন ঘটিয়ে ফেলতো সে। 

নীলিমা পাত্রপক্ষের সামনে বসলো। ভাগ্যের নির্মম পরিহাসে দু দুটো পাত্র বসে আছে তার সম্মুখে। একজন তাকে বিয়ে করার উন্মাদনায় উন্মাদ হওয়া পাত্র। অপরজন তার বাবার পছন্দের ভদ্র গোছের পাত্র। এখন কাকে বেছে নিবে সে? তা হয়তো সময়ই বলে দিবে। 

নিতান্তই বাবার সম্মান রক্ষার্থে হাসিমুখে লাজুক ভঙ্গিতে সব প্রশ্নের উত্তর দিচ্ছে নীলিমা। যতই পাত্রপক্ষের সামনে সময় গড়াচ্ছে ততই যেনো নীলিমা নিজ সিদ্ধান্ত অটল হচ্ছে, স্মরণকে স্বীকার করে নেয়ার সিদ্ধান্ত। সময়ের সাথে সাথে তার বোধশক্তি উদয় হচ্ছে বোধহয়। নেতিবাচক সকল চিন্তাকে পিছে ফেলে ইতিবাচক ভাবনা আসছে তার মাঝে। 

রাতের খাবার খেয়ে পাত্রপক্ষ চলে গেলে নীলিমা তখনই ইমাদ সাহেবকে বললো,
" আমার সময় লাগবে বাবা। আমি পরে জানাবো ছেলের ব্যাপারে। "

মেয়েকে প্রচন্ড ভালোবাসেন বলেই ইমাদ সাহেব নীলিমার এক কথায় রাজি হয়ে গেলেন। নীলিমাকে সময় দিলেন তিনি। নীলিমাও এ সুযোগ পেয়ে ভীষণ খুশি হলো। কেননা এবার সে সিদ্ধান্তে পৌঁছাতে পেরেছে। স্মরণ ব্যতিত আর কারোর সাথে যে নিজের ভবিষ্যত কল্পনা করা অসম্ভব তা ভালোমতই টের পেয়েছে নীলিমা। এমন একটা পরিস্থিতিরই বোধহয় অপেক্ষায় ছিলো সে। যে পরিস্থিতিতে পড়লে স্মরণকে স্বীকার বা অস্বীকার করার যথাযথ কারণ ও যুক্তি খুঁজে পাওয়া যাবে। 

সারা রাত নীলিমার ঘুম হলো না। স্মরণের চিন্তায় তার মাঝে ভীষণ অস্থিরতা তৈরী হলো। রাত একটায় অবশ্য স্মরণকে ম্যাসেজ দিয়ে বলেছিলো কাল সকাল ১০টায় দেখা করতে। ওদিকে স্মরণ নিরাশা নিয়ে শুধুমাত্র 'হুম' বলে ফোনটা রেখে দেয়। প্রেমে ব্যর্থ হতে হতে সফলতার দ্বারপ্রান্তে এসেও স্মরণ বুঝতে পারেনি, কাল সকালেই হয়তো তার প্রেয়সী নিজেকে তার নিকট সঁপে দিবে।

----------------

সকাল ১০টা,
আজ অফিসে না গিয়ে পার্কে এসে বসেছে স্মরণ। আজই বোধহয় নীলিমার শেষ দেখা পাবে সে। এরপর হয়তো সে অন্য কারোর অর্ধাঙ্গিনী হবে! এই আশা নিয়েই হতাশ হয়ে বসেছিলো স্মরণ। এমনই সময় ঠিকঠাক সময়ে এসে উপস্থিত হলো নীলিমা। পরনে তার শুভ্র রঙের সালোয়ার-কামিজ। যেনো নীলিমাকে আপাদমস্তক স্নিগ্ধতা দিয়ে মুড়ানো হয়েছে। নীলিমাকে হঠাৎ দেখায় কয়েক সেকেন্ড কথাই বলতে পারেনি স্মরণ। শুধু অবাক চোখে দেখে গিয়েছে তাকে। তার এ অবাক দৃষ্টিজোড়া আরোও অবাক হলো নীলিমার প্রশ্নে,
" বিয়ের পর অন্য মেয়ের দিকে তাকালে খুন করবো আপনাকে। রাজি আছেন তো?"

হঠাৎ যেনো অসম্ভব কিছু শুনে মস্তিষ্ক প্রক্রিয়া করতে পারেনি স্মরণ। চোখেমুখে চরম বিস্ময় নিয়ে নীলিমার পানে চেয়ে রইলো সে। তার এ বিস্ময়াবিভূত চাহনি দেখে মিটিমিটি হাসছে নীলিমা। অতঃপর বেশ কিছুক্ষণ বাদে যখন বিষয়টা পরিষ্কার হলো তখন চরম খুশিতে স্মরণ চট করে বলে বসলো,
" বিয়ে করবে আমাকে?"

নীলিমা মুহূর্তেই নাক সিঁটকে বললো,
" ইশ কি জঘন্য প্রপোজাল! যান মোহাব্বতের শরবত খেয়ে আসুন।"
.
.
.
চলবে....................................................

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন