মাই মিস্টিরিয়াস প্রিন্স - পর্ব ১০ - মৌমিতা মৌ - ধারাবাহিক গল্প


লারার স্বামী তামং ভেঙে পড়া ডাইনিং টেবিলের টুকরোগুলো একে একে পরিষ্কার করছিল। তার হাত দ্রুত, তবু খানিকটা মেপে মেপে চলে। ভাঙা প্লেটের টুকরো আলাদা করছে, আর খাবারের ছড়িয়ে পড়া অংশগুলো যত্ন করে তুলে ফেলছে। 

ওপাশে লারা রান্নাঘরে দাঁড়িয়ে অনন্যার জন্য আলাদা করে খাবার তৈরি করছিল। তরকারি কড়াইয়ে নাড়তে নাড়তে মাঝে মাঝে তামংয়ের দিকে তাকাচ্ছিল। অনন্যাও প্রথমে লারাকে সাহায্য করছিল রান্নায়। তবে তামংয়ের টেবিল পরিষ্কার করার দৃশ্য দেখে তার মনোযোগ অন্যদিকে সরে যায়।

অনন্যা ফোঁস করে একবার শ্বাস ছেড়ে বললো,
"লারা! স্যারের এক হাতের আঘাতে পুরো টেবিল ধসে পড়লো। বিষয়টা বেশ অদ্ভুত লাগছে আমার কাছে।"

লারার মুখে একপেশে হাসি ফুটে উঠলো। কড়াই নাড়তে নাড়তে বাঁকা চোখে তাকিয়ে বললো,
"আমাদের সাব অনেক কিছুই পারে, ম্যাডাম। বললুম না, সময়ের সাথে সাথে সব জানবা।"

"কিন্তু এক হাতে? কীভাবে করলো? কেমন জানি সন্দেহ হয় আমার। তোমাদের হয় না?"

লারা মৃদু হেসে জবাব দিল,
"না, সন্দেহ করার কী আছে? তাছাড়া সাবের বাকি দুই বন্ধুও একি রকম। তবে সাবের মতো এতো বিষয়ে দক্ষ না। আর একজনের তো এতো মেজাজ ও নাই। কিন্তু সাবের চাইতেও বেশি মেজাজ আছে ম্যাডামের।"

"ম্যাডাম? দুজন! বাকি দুজন কে? তারা কী এখানেই থাকে?"

"হুম! এই বাড়িতে সাবসহ আরো দুজন থাকে! ছোট সাব সন্ধ্যার দিকে বেড়িয়ে গেছে। উনার নাম নিকোলাই ভেস্পার। উনি সকালের সময়টা বাসায় কাটান, সন্ধ্যা হলেই কাজে চলে যান। আর ম্যাডামের নাম ভেনোরা। উনি সবসময় থাকেন না। সাব ডাকলেই আসেন," লারা কথাগুলো বলে আবার কাজের দিকে মন দিল।

অনন্যা কৌতূহলী দৃষ্টিতে তাকিয়ে বললো,
"ওহ! তার মানে স্যারের দুই বিদেশি বন্ধুও এখানে থাকে!"

লারা মাথা নেড়ে বললো,
"হ্যাঁ, আমি শুনছিলাম, উনাদের তিন বন্ধুকে অনেকে তিন রং এ চেনে। সাব হচ্ছে আসমানী রঙ, ছোট সাব লাল রঙ, আর ভেনোরা ম্যাডাম সবুজ রঙ।"

অনন্যা ভ্রু উঁচু করে বললো,
"তিন রং? এটার মানে কী লারা?"

"এসব তো জানি না। যা শুনছি তাই বললাম।"

অনন্যা আবারো প্রশ্ন করল,
"আচ্ছা, নিকোলাই, উনি সন্ধ্যা পর্যন্ত বাসায় ছিলেন। কিন্তু আমি দেখলাম না কেন?"

লারার মুখে সামান্য থমকে যাওয়া ভাব। এরপর সাবলীল ভঙ্গিতে বলল,
"সাবের শরীর খারাপ ছিল, তাই বিশ্রামে ছিলেন। হয়তো সেজন্যই বের হননি।"

অনন্যা মাথা নাড়ল। কিন্তু লারার কথা শুনে যেন নতুন করে কোনো চিন্তার জাল বুনতে শুরু করল। গভীর চোখে মেঝের দিকে তাকিয়ে রইল।
নিজের মনে গুনগুন করে বলল,
"বিশ্রাম নিচ্ছিলেন... কিন্তু বাসায় থেকেও তাকে দেখিনি? খুব অদ্ভুত!"


কৌশিক সোফায় গা এলিয়ে রাগে ফুঁসতে ফুঁসতে বসে আছে। তার হাতের মুঠোয় একটা স্মাইলি বল, যা সে অনবরত চেপে যাচ্ছে। এভাবেই মনের ক্রোধকে বের করে দেওয়ার চেষ্টায় আছে সে। ঘরের চারপাশে তাকিয়ে মনে মনে বলল, "এ কী জঞ্জাল নিয়ে এলাম ঘরে! একটা মেয়ে এতো কথা কীভাবে বলে? ঝগড়া শুরু করে দিয়েছে! তাও আমার সাথে? ডেঞ্জারাস! এই বকবক ধৈর্যের শেষ সীমানাও অতিক্রম করে ফেলেছে আমার।"

বলটা আরও জোরে চেপে ধরল কৌশিক। বিরক্তিভাব তার মুখমণ্ডলকে শক্ত করে তুলেছে। মুখের মাংসপেশী রাগে টনটন করছে, দাঁতের পাটি গজগজ শব্দে কড়মড় করছে। সবচেয়ে বড় চিন্তার বিষয় হচ্ছে বিয়ে! কালকের বিয়েটা কী করে হলো? ওই সময় কী এমন ঘটেছিল যে নিজের উপর থেকে সম্পূর্ণ নিয়ন্ত্রণ হারিয়ে ফেলেছিল সে? এই অস্বস্তিকর চিন্তা ইশতেহারের মাথাকে দম বন্ধ করা বিশাল বোঝার মতো ভারী করে তুলছে। নিশ্চয়ই মেয়েটার মধ্যে কোনো ঘাপলা আছে! এই বিষয়টা বোঝার জন্যই এখানে নিয়ে এসেছে তাকে। কিন্তু আসল রহস্যটা কী? কী এমন আছে এই অনন্যা শিকদারের মধ্যে, যা তাকে এভাবে নাড়িয়ে দিয়েছে?

কৌশিকের স্যুপের বাটি নিয়ে যেতে লারা আসলো। তাকে দেখে কৌশিক গলার স্বর নরম করে বলল,
"আচ্ছা! যারা খুব বেশি ঝগড়াঝাঁটি করে, তাদের বাংলায় কী বলা হয়?"

লারার চোখে কিছুটা দ্বিধা ফুটে উঠল। খানিকটা ভেবে স্থির হয়ে বলল,
"ঝগড়াঝাঁটি? আমম... ঝগড়ুটে! হ্যাঁ, ঝগড়ুটেই তো বলা হয়।"

কৌশিক মাথা নেড়ে বলল,
"ওই মেয়েটা,অনন্যা শিকদার,খুব বেশি ঝগড়ুটে। সবকিছুর উত্তর দিতে হবে না। বলবে চুপচাপ শান্তভাবে থাকতে। এভাবে ঝামেলা পাকানোর মানুষ আমার একদম পছন্দ নয়। তুমি তো জানো নিশ্চয়ই?"

লারার ঠোঁটের কোণে সামান্য হাসি ফুটে উঠল, কিন্তু সেটা দ্রুতই চেপে রাখল। মাথা নত করে সম্মতি জানিয়ে বলল,
"জ্বি সাব। বলে দেবো।"

লারা আবার টেবিল পরিষ্কার করতে ব্যস্ত হয়ে পড়লো। পরিষ্কার করে চলেও গেলো। কিছুক্ষণ পর অনন্যা খাবারের ঘর পেরিয়ে বসার ঘরে আসলো। কৌশিক স্যারকে দেখে দ্রুত পা ফেলে সোফায় এসে স্যারের পাশে বসলো। গলা পরিষ্কার করে বললো,
"স্যার,কাল থেকে নতুন সেমিস্টারের ক্লাস শুরু হবে। "

কৌশিক মাথা নাড়িয়ে গম্ভীর মুখে বললো,
"ভালো কথা।"

"এতো দূর থেকে ভার্সিটিতে কীভাবে যাবো?"

"আমি কী জানি?"

অনন্যা বিস্ময়ে হতবাক হয়ে বললো,
"এসব কী বলছেন?"

"কালকেরটা কালকে দেখা যাবে।"

কৌশিক কথাটা বলে পকেট থেকে অনন্যার ফোনটা বের করে টেবিলে রাখল।

ফোনটা দেখে অনন্যার মুখমণ্ডলে খুশির ঝলক ছড়িয়ে পড়ল, যেন একটা হারানো জিনিস ফিরে পেয়েছে সে। দ্রুত ফোনটা হাতে তুলে নিল অনন্যা। কৌশিকের দিকে তাকিয়ে হালকা হাসি দিয়ে বলল,
"ধন্যবাদ!"

এরপর কোনো দেরি না করে সিঁড়ির দিকে দৌড়ে গেল। কৌশিক স্থির হয়ে সেদিকে তাকিয়ে রইল।

অনন্যা নিজের রুমে ফিরে দরজাটা বন্ধ করে ফোনটা অন করল। স্ক্রিনে ভেসে উঠল ঈরা, আরণ্যক আর নোহারার একের পর এক মিসড কল। নোহারা গ্রামের বাড়ি ঘুরতে যাওয়ায়, তার সাথে বিয়ের কথাটা শেয়ার করা হয়নি। তাছাড়া জোর করে বিয়ে হয়েছে, সেটা বলেই বা কী লাভ হতো?

ফোনটা হাতে নিয়ে কিছুক্ষণ ভাবল অনন্যা। তারপর নোহারাকে কল করল।

ফোনের ওপাশ থেকে নোহারা চিরচেনা উচ্ছল কণ্ঠে কথা বলতে শুরু করল। অনেক কথা হলো তাদের মাঝে। গ্রামের পরিবেশ, আত্মীয়-স্বজন, মাঠঘাট, পশুপাখি, সবকিছু নিয়ে গল্প করতে লাগল নোহারা। একপর্যায়ে থেমে বলল,
"তোর খবর কী? তুই কিছু বলছিস না কেনো?"

অনন্যা একটু ইতস্তত করে হেসে বলল,
"আমার সাথে অনেক কিছু ঘটে গেছে, দোস্ত। কাল দেখা হলেই তোকে সব বলব।"

নোহারা কথাটা শুনে কিছুক্ষণ চুপ করে রইল। হয়তো কিছু একটা আন্দাজ করার চেষ্টা করছিল। তারপর ঠান্ডা গলায় বলল,
"আচ্ছা! তাহলে কাল সব শুনব।"

কথাটা বলে সে আর বাড়াল না। ফোনের ওপাশে একটা কৌতূহল জমে রইল।

অনন্যা ঈরার সাথেও কথা বলল। ঈরার কণ্ঠে একটা চাপা রাগ আর অভিমান ঝরে পড়ছিল। মামা-মামী ঠিকই তাকে বকাঝকা করেছে, আর সেটা ঈরা অনন্যাকে জানাতেও ভুলল না। অনন্যা বারবার মাফ চাইতে লাগল,
"প্লিজ রাগ করিস না! আমি জানি, আমার জন্য তুই সমস্যায় পড়েছিস। আর কখনো এমন হবে না।"

"না, ঠিক আছে। এসব তো নিত্যদিনের ঘটনা।"

কথা ঘোরাতে ঈরা হঠাৎ জিজ্ঞেস করল,
"তোর সব ঠিক আছে তো? পরিবেশ কেমন? সবাই কেমন?"

অনন্যা হেসে উত্তর দিল,
"হ্যাঁ, সব ঠিক। কোনো সমস্যা নেই।"

অনন্যা হেসে হেসে সব বললো, কিন্তু এই হাসির মধ্যে একটা অদৃশ্য চাপা ব্যথা ধরা পড়ে গেল। ঈরা সেটা টের পেলো কি পেলো না কে জানে!


সূর্যের প্রথম আলো ধীরে ধীরে পূর্ব দিগন্তে রঙ ছড়াচ্ছে। আকাশের নীলচে ধূসর রংটা এখন লাল-গোলাপির মিশেলে সেজে উঠেছে। শিশির ভেজা ঘাসে সূর্যের কিরণ পড়তেই যেন মুক্তোর মতো ঝলমল করছে। দূর পাহাড়ের চূড়াগুলো আলোয় স্নান করে সোনালি রং ধারণ করেছে।
গাছের ডালে ডালে পাখিদের কলকাকলিতে এক অদ্ভুত সুর বাজছে। কোকিলের মধুর সুর, চড়ুইয়ের কিচিরমিচির আর ঝোপের ভেতর থেকে ভেসে আসা নাম না জানা পাখির ডাক - সকালের প্রকৃতি যেন সঙ্গীতের এক মহোৎসব উদযাপন করছে। 

দুই তলা বিলাসবহুল বাড়ির পাশে দমবন্ধ করা নিরবতা ভেঙে উঠছে অদ্ভুত আওয়াজে। কোথাও তলোয়ার চালানোর শব্দ শোনা যাচ্ছে। তলোয়ারের তীক্ষ্ণ শান মারার শব্দ বাতাসে মিশে যাচ্ছে, সেগুলো কেমন যেন মাটির ওপর পড়ে শিস দিতে শিস দিতে দূরে চলে যাচ্ছে। ধপাধপ শব্দ করে কাঠের চতুর্মাত্রিক ব্লগ ভেঙ্গে দিচ্ছে আকস্মিক তলোয়ারের শান। এতো তীক্ষ্ণ আওয়াজ শুনে অনন্যার ঘুমের বারোটা ইতিমধ্যেই বেজে গেছে। সে চোখ কচলে উঠে বসলো, এখনো কানে বাজছে তলোয়ারের শব্দ আর কাঠের বস্তু ভেঙে যাওয়ার শব্দ।

বিছানা থেকে ধীর পায়ে নেমে কাঁচের তৈরি জানালার সামনে এগিয়ে গিয়ে নিচে তাকানোর সাথে সাথে সে দেখতে পায়, মাত্র দুই দিন আগে তার বিয়ে করা বরকে। স্যারের হাতে তলোয়ারটি যেন একটা রহস্যময় অস্ত্র, যা থেকে রশ্মি নির্গত হচ্ছে। তলোয়ারের তরজা কেটে যখন রশ্মিগুলো কাঠের ওপর পড়ছে, তখন প্রতিটি রশ্মি সেই কাঠের তৈরি বস্তুকে বিশাল শব্দের সাথে ভেঙে ফেলছে। বিভিন্ন কায়দায় তলোয়ার ঘোরানোর কৌশল অনন্যা কে মুগ্ধ করতে লাগলো। 

অনন্যা কতক্ষন তাকিয়ে থাকলো সে নিজেও বলতে পারবে না। কৌশিক স্যারের শরীরে এখনো ভারী পোশাক। ভারী পোশাক পড়েই সে তলোয়ার চালাতে মগ্ন। চিন্তিত হয়ে পড়লো অনন্যা। তলোয়ার চালানো পর্যন্ত ঠিক ছিল, কিন্তু এটা কোন ধরনের কৌশল যেখানে তলোয়ার থেকে রশ্মি নির্গত হয়? 

অনন্যা কাঁচের জানালার শীতলতায় হাত রাখলো। তার পাঁচ আঙুলের স্পষ্ট অবয়ব বসে গেলো জানালার ঝকঝকে পৃষ্ঠে। বাতাস ধীরে ধীরে ভারী হয়ে উঠলো তার শ্বাসের সাথে। অনন্যা নিজেই বুঝতে পারলো না, কখন যে মৃদুস্বরে ফিসফিসিয়ে উচ্চারণ করে ফেলেছে,
"প্রিন্স…!"

নিচের উঠানে হঠাৎ থেমে গেলো তলোয়ারের ছন্দময় ঝংকার। এক মুহূর্তের জন্য যেন সবকিছু স্তব্ধ হয়ে পড়লো। ইশতেহার কৌশিক, যার প্রতিটি গতিবিধি বজ্রপাতের মতো শক্তিশালী আর অপ্রতিরোধ্য ছিল তা থেমে গিয়ে, লোকটার ঈগলের মতো চক্ষু যুগল তলোয়ার নামিয়ে সরাসরি দুই তলার জানালার দিকে পড়লো। তার তীক্ষ্ণ দৃষ্টি কাঁচ ভেদ করে অনন্যার চোখে গিয়ে স্থির হলো। চোখ বড় বড় হয়ে গেলো অনন্যার।

কৌশিক স্যারের দৃষ্টি শুধু একটি দৃষ্টি ছিল না, বরং ছিল এক গভীর রহস্যময় সংকেত, যা বাতাসের প্রতিধ্বনির মতো অনন্যার চারপাশে ছড়িয়ে পড়লো। অনন্যা মুহূর্তের জন্য নিশ্বাস নিতে ভুলে গেলো। তার হৃদস্পন্দন বেড়ে উঠলো, যেন কৌশিকের সেই প্রখর দৃষ্টির স্রোত তার ভেতরের সমস্ত অনিশ্চয়তাকে গিলে ফেলছে। অসম্ভব জোরে বাতাস বইতে লাগলো, কৌশিকের আকাশি দৃষ্টির তীক্ষ্ণতা সমস্ত গাছপালাকে কয়েক মুহুর্তের মধ্যে নাড়া দিয়ে গেলো। অনন্যা ভীত হয়ে দ্রুত পর্দা টেনে পিছমুখী হয়ে দাঁড়ালো। জোরে জোরে ক্রমাগত শ্বাস নেওয়া শুরু করলো। 

শ্বাস নেওয়ার তীব্রতা বৃদ্ধি পাচ্ছে ধীরে ধীরে, সাথে সাথে অনন্যার ভাবনায় ভেসে উঠছে সেই তীক্ষ্ণ চক্ষু যুগল। লোকটা হঠাৎ উপরে তাকালো কেনো? আর এমনভাবে তাকালো মনে হলো সবকিছু তোলপাড় করে ফেলছে।
.
.
.
চলবে...................................................

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন

WhatsApp