বজ্রমেঘ - পর্ব ০৯ - ২/২ - ফাবিয়াহ্ মমো - ধারাবাহিক গল্প


নির্বাক চাহনিতে চুপ করে আছে শোয়েব। তার চোখের অতলে ঠাণ্ডা ভঙ্গি, ঠাণ্ডা ছাপ লুকোনো। ঠোঁটের ওপর সুনিবিড় কাঠিন্য ধীরে ধীরে প্রগাঢ় হল। দুহাতের মাঝে তুলে আনা মেয়েটিকে মৃদু চাপে তার দেহের কাছটায় চেপে রেখেছে। ঠাণ্ডা কনকনে হাওয়া বইছে এখন। পাহাড়ি শীতালু হাওয়ায় থেকে থেকে শিউরে ওঠছে হুঁশ হারানো মেয়েটি। একপলক কী ভেবে স্থির চোখদুটি নিজের বাহুদূর্গে ফেলল শোয়েব। আগাগোড়া কালো হুডিতে মুড়ে আনায় মেয়েটির নরম মুখখানা স্পষ্ট নয়। হঠাৎ একটি অস্থির কণ্ঠের চিৎকার জায়গাটা তোলপাড় করে তুলল, 

  - এ কী! শোয়েব ভাই, কী হয়েছে তোমার! সর্বনাশ কাণ্ড আল্লাহ! 

বলতে বলতে সেই নারী মূর্তিটি ধপ ধপ করে সিঁড়ি ভেঙে নামলো। তার গলা ফাটানো চিৎকার যেন জায়গামতো পৌঁছে গেছে। সেকেণ্ডের ভেতর সমস্ত বাংলো থেকে কয়েক জোড়া পায়ের হন্তদন্ত ছুটন্ত শব্দ ভেসে আসতে থাকে। শোয়েবের আর বুঝতে রইল না কত বড় ভুলটা সে করেছে। আশু ভাবনায় তার মুখের ছাঁদটা পাথরের মতো শক্ত হয়ে গেল। এভাবে কাজটা করা ঠিক হলো না! একেবারেই না! এরা সব চলে এসেছে! ধ্যাত্! মনে মনে প্রবল আক্রোশে গাঁট হয়ে থাকলে বাইরে থেকে শান্ত রইল শোয়েব। ততক্ষণে শাড়ি পড়ুয়া মানুষটি তার সামনে দাঁড়িয়ে হতভম্ব চোখে জিজ্ঞেস করে উঠল, 

  - কী অঘটন ঘটল? কীভাবে কী হলো এসব? আর এই মেয়েটা কে? এই রাতের বেলা এভাবে . . এরকম . . 

কথাটা বলতে গিয়ে চট করে ওই বাহুবন্ধনে দৃষ্টি ঘুরাল অধরা। যে দৃশ্য দুচোখে দেখতে পেল, তাতে প্রবল আতঙ্কে আঁতকে ওঠল মুখ! তৎক্ষণাৎ শোয়েবের দিকে ভীতিগ্রস্ত চোখ ছুঁড়ে বলল সে,  

  - মেয়েটা আহত? ব্যথা পেয়েছে? 

ওই চোখদুটিতে তীব্র শঙ্কা ফুটে ওঠতে দেখে শোয়েব প্রত্যুত্তর করল, 

  - মেয়েটা বেহুঁশ। পিঠে জখম হয়েছে। 

  - আল্লাহ! কী বলছ তুমি! 

  - হ্যাঁ। 

  - ও নিঃশ্বাস নিচ্ছে? 

প্রশ্নটা করতেই কয়েক মুহুর্ত পুরোপুরি স্থির থাকল শোয়েব। নিজের চোখদুটি বাহুর মধ্যখানে স্থির করে রইল। সে যেন বোঝার চেষ্টায় আছে, তার বুকের মধ্যে কতটুকু শ্বাস ছুঁয়ে ছুঁয়ে যাচ্ছে। চুপ করে সেটা বোঝার চেষ্টা করল সে। পরক্ষণে দৃষ্টিটা অধরার দিকে ঘুরিয়ে হ্যাঁ সুচকে বলল, 

  - নিচ্ছে। বাট, খুব স্লো। 

অধরা যেন ওই কয়েক মুহুর্তের বিরতিতে একদম কাঠ হয়ে দাঁড়িয়ে ছিল। যেন মেয়েটার শেষ অবস্থার খবর পেতে সে মারাত্মক বিচলিত। বিচলিত দৃষ্টিতেই মাথা ঘুরিয়ে পেছনে থাকা দাদী ও রাবেয়ার দিকে তাকাল। আরো তাকাল দাদীর পেছনে ওই সদর দরজায় দাঁড়িয়ে থাকা আরো তিন মূর্তির দিকে। প্রত্যেকেরই চোখে দুর্বোধ্য চিন্তার ছাপ, মনে মনে কৌতুহলের ঢেউ ভাঙছে। কেউ বুঝতে পারছে না হঠাৎ কী ঘটেছে! অধরা মুখ ফিরিয়ে শোয়েবের দিকে তাকালে ত্রস্ত গলাতে বলে উঠল, 

  - ভেতরে এসো! এসো এখুনি। তুমি নিজেও তো চোট পেয়েছ ভাই। কী করেছ তুমি বলো তো? এই গণ্ডগ্রামের জংলা জায়গায় কী হালটা নিজের করলে?  

অধরার পিছু পিছু ঘাসে ছাওয়া পথটা ধরে অগ্রসর হচ্ছিল শোয়েব। সেভাবেই সেজো ভাবীর উদ্দেশ্যে চোখা জবাবটা রাখল, 

  - কী করেছি নিজের? আমি তো দেখছি, আমি আগের মতোই আছি। বরং বলব, এখানে বেশ ভালো আছি। কখন পৌঁছেছেন আপনারা? কটার দিকে এলেন? 

সিঁড়ির প্রথম ধাপে পা রাখতেই সরল উত্তরটা দিল অধরা, 

  - বিকেল সোয়া পাঁচটা। এসে শুনি তুমি নাকি বাড়িতে নেই। বাইরে কী এক জরুরি কাজে দ্রুত বেরিয়ে গেছ। অথচ কাল তোমার ওই হাম্বুস শয়তানটা কী সুন্দর করে মিথ্যে কথাগুলো বলল! আজ সামনে পেলে ওর কানটা আমি মুচড়ে মুচড়ে কোফতা বানাব। ফাজিল! ওই ফাজিলটা জানিয়েছিল তুমি নাকি আজ বাড়িতে থাকবে। অফিস থেকে ছুটি আছে। তোমার ওই বিখ্যাত কক্ষে নাকি সারাক্ষণ সময় কাটাবে। এবার বোঝো অবস্থা কী মিথ্যুক! 

গোপন কক্ষের কথা শুনে প্রচণ্ড অবাক হয় শোয়েব। কিন্তু কেন জানি সেটা ভাবে প্রকাশ করল না। এই জাতীয় তথ্যগুলো কেন রাফান বাইরে বিলি করছে! ও কী জানে না এই জায়গার তথ্য দেওয়া একেবারেই নিষেধ? দিনদিন কী পারিবারিক বাউণ্ডারি গুটাতে চাচ্ছে? দাদীর মতো দুরবীক্ষণ ব্যক্তি, রাবেয়ার মতো কাজের সদারণী, দরজায় দাঁড়ানো চার পুরুষের চার অর্ধাঙ্গী সবাই কেমন চক্ষু বিস্ফোরিত করে তাকিয়ে আছে। হয়তো এখনো বিশ্বাস করতে পারছে না শোয়েব আসলেই দোকা হয়ে ফিরেছে। তার ওই বলপূর্ণ বাহুদ্বয়ে একটি জীবন্ত প্রাণ ঘুমোনো। সবার চক্ষুকে উপেক্ষা করে শোয়েব সোজা সিঁড়ির দিকে পা বাড়াল। এমন সময় পেছন থেকে ডেকে উঠলেন ফাতিমা নাজ মির্জা,  

  - ফারশাদ, দাঁড়াও। 

পা বাড়াতে গিয়ে তৎক্ষণাৎ দাঁড়িয়ে পড়ল শোয়েব। তার ওই নামের সম্বোধনটা শুধু একজন ব্যক্তি উচ্চারণ করে। এখানে আসার পর থেকে কোনোদিন ওই নামকে প্রশ্রয় পেতে দেয়নি। এমনকি ফরেস্ট বিভাগের মধ্যেও না। মাথা পিছু ঘুরাল না শোয়েব। শুধু বাঁ কাঁধ বরাবর মুখের একপাশ এনে স্থির ওভাবে দাঁড়িয়ে রইল। পেছন থেকে বয়স্ক ভারি কণ্ঠটি ভীষণ দৃঢ়তার সঙ্গে বলে উঠল, 

  - বাঁদিকের ঘরে নিয়ে যেয়ো না। উপরের ঘরগুলো তো গোছানো নয়। তালাবন্দী, অপরিষ্কার, ধূলোয় ভরা। রোকেয়ার সেখানে পরিষ্কার করতে সময় লাগবে। সেখানে নিয়ে গেলে মেয়েটার জন্য ভালো হবে না ফারশাদ দাদু। এনেছ যখন, তখন মেয়েটাকে তোমার দখিন ঘরে নিয়ে যাও। আশাকরি তুমি রাগ করবে না। তুমি তো ভালো করেই জানো, বাকি ঘরগুলো ভদ্রস্থ নয়। ওগুলো ধাতস্থ করতে সময় লাগবে। 

ফাতিমা নাজ কথাগুলো উচ্চারণ করলেন খুবই সাবধানে। যেন একটুও এদিক ওদিক কথা পিছলে না যায়। একটার পর একটা বাক্য খুব ঠাণ্ডাভাবে ছুঁড়ে চুপ রইলেন তিনি। নাতীর অভিব্যক্তিহীন কাষ্ঠমুখে উন্মুখ দৃষ্টিতে তাকিয়ে রইলেন। বাকিরা মুখ ভীত করে কেমন তটস্থ চোখে তাকিয়ে আছে। যেন অপেক্ষা করছে পরবর্তী দৃশ্যপট কেমন বিপজ্জনক হতে চলেছে। কিন্তু না, তেমন কিছুই ঘটল না। বরং শোয়েব শান্ত ভঙ্গিতে পা বাড়িয়ে সিঁড়ির দিকে হাঁটা দিয়েছে। সিঁড়ি বেয়ে উপরতলায় পৌঁছে ক'সেকেণ্ড থামল যেন। নীচে থেকে বাকিরা প্রচণ্ড উৎকণ্ঠায় ঢোক গিলে যাচ্ছে। কী হয় তা বোঝা যাচ্ছে না! একজন শাড়ির আঁচলে খুট পাকাতে পাকাতে অস্থিরচিত্তে ঠোঁট কামড়ে ধরল। আরেকজন হাতদুটো মুচলেকা করে ঢোক গিলল। পেছন থেকে রাবেয়া ফিসফিস করে অস্ফুট স্বরে বলল, 

  - বামে গেলে বুঝুম কিচ্ছু না, হুদাহুদি। ডানে গেলে বুঝুম সংকেত আছে! 

রাবেয়ার ওই ছেলেমানুষি বাক্যে এবার বুকের ভেতরটা ধড়ফড় ধড়ফড় করছে। ওরা চারটে মূর্তি পাথরের মূর্তির মতো স্থির হয়ে আছে। কী হয়! কী ঘটায়! কী করবে! এরকম একটা টানটান উত্তেজনার ভেতর হঠাৎ দেখল, শোয়েব ডানেই পা ঘুরিয়েছে! ইশ! প্রচণ্ড উত্তেজনায় বেসামাল হয়ে অধরা চ্যাঁচিয়ে উঠতে যাচ্ছিল, ওমনেই পরিস্থিতি বুঝে তার পায়ে কষে একটা পারা কষাল সেগুফতা। বেচারি অধরা এই ঠাণ্ডার ভেতর পায়ের শেষ আঙুলে ব্যথা পেয়ে আর চুপ থাকতে পারল না। 'মাগো!' বলে তীক্ষ্ম একটা আর্তনাদ ছুঁড়ে চোখমুখ খিঁচিয়ে ফেলল। উপর থেকে শোয়েব তৎক্ষণাৎ নীচে তাকিয়ে সন্দিগ্ধ দৃষ্টিতে কপাল কুঁচকায়। 

  - কী হলো আপনার? পায়ে ব্যথা পেলেন কীভাবে? 

ব্যথার কথা শুনে চোখ মেলে তাকাল অধরা। ব্যথায় চোখমুখ কুঁচকে সেগুফতার দিকে কটমট দৃষ্টিতে তাকাতে চাচ্ছিল। কিন্তু পারল না। এমন সময় সেগুফতা একটুও অধরার দিকে না তাকিয়ে ওর পায়ের দিকে চোখ ফেলে বলল, 

  - ইশ, কী আশ্চর্য দেখো তো! পায়ের চেহারাটা চোখের পলকে কী করে ফেলল! শোনো অধরা, তোমার এই 'ঢুলঢুলুনি' ভঙ্গিটা একটু বন্ধ করো তো। তোমাকে কত করে বলি, তুমি ঢ্যাঙর ঢ্যাঙর করে ঘুরো না, যেখানে সেখানে অন্ধের মতো হেঁটো না, আমার কথা কী একটু কানে ঢোকাতে পারো না? আমি কী তোমাকে পর ভেবে উপদেশ দিই? ইশ, কী অবস্থা করেছে দেখো তো! চোখে দেখা যাচ্ছে না। মিথিলা, অ্যাই মিথিলা! একটা টুল কিছু নিয়ে আসো তো। যাও। 

সেগুফতা তখন এমনভাবে পরিস্থিতিটা সাজিয়ে নিল, যাতে উপরতলায় থাকা ওই লেজারের মতো চক্ষুর কাছে ধরা না পড়ুক। সেগুফতা জানে, এখন উলটাপালটা কিছু ধরা পরলে তাদের আর রক্ষে নেই! এই মহাধূর্ত, অতি চালাক দেবরটা চাপ্টারই পালটে দেবে। না, এটা হওয়া যাবে না। অত্যন্ত সতর্ক থাকা চাই। একমাত্র সেগুফতাই যা একটু বুদ্ধিমত্তার জোরে বেঁচে যেতে পারে। বাকিরা ঘাটের গোঁ! মিথিলা টুল আনতে চলে গেলে শোয়েব উপরতলা থেকে চোখ খাটো করে বলল, 

  - এই এক সেকেণ্ডের ভেতর ব্যথা কীভাবে পেলেন? আমি আপনার আশপাশে এমন কিছু দেখছি না, যেটা দ্বারা পায়ে প্রচণ্ড হোঁচট পাবেন।  

কুঁচকে রাখা চোখ নিমিষে খুলে ফেলল অধরা। ডানদিক থেকে সেগুফতা ধরে রেখেছে। বাঁদিক থেকে সামাল দিচ্ছে তাহিয়া। অধরা মিনমিনে গলায় ব্যথা কুণ্ঠিত করে বলল, 

  - ব্যথাটা আসলে. . শোয়েব ভাই, ব্যথাটা আসলে পেয়েছি . . 

মুখে কোনো উত্তর জুটছে না অধরার। কী বলবে সে? চোখ খিঁচিয়ে এমন ভঙ ধরল যেন ওর পায়ের আঙুলে প্রচণ্ড চিলিক দিয়ে উঠেছে। ওদের পেছনে তখন রাবেয়া ছিল। রাবেয়া পেছন থেকে চোরের মতো কথা এগিয়ে দিল, 

  - কন, গুল্লু সাপ ধরছে। 

অধরা ডায়ে বাঁয়ে না তাকিয়ে ফট করে বলে বসলো,

  - শোয়েব ভাই, গুল্লু সাপ ধরেছে। 

  - গুল্লু সাপ কী? 

ওমন উদ্ভট জাতের নাম শুনে কপাল আরো কুঁচকে ফেলে শোয়েব। জীবনে শত সহস্র বন্য প্রজাতির নাম শুনেছে সে, কর্মক্ষেত্রের দরুন কিছু ভয়ানক প্রাণীর মুখোমুখিও হয়েছে। কিন্তু এই গুল্লু সাপটা কী জিনিস? এই সাপ দেখতে কেমন? গুল্লু নামই তো ইহজনমে শোনেনি! অবস্থা বেগতিক দেখে অধরার দিকে আবার প্রশ্ন করল শোয়েব, 

  - এখানে সাপ থাকার কথা নয়। কোথায় সাপ? ভালো করে বলুন। 

এবার অধরার মনে হচ্ছে সে নিজের পায়ে কষিয়ে একটা কুড়াল মেরেছে। কুড়ালের কোপটা কতদূর গেঁথেছে, তা এখনো স্পষ্ট না। তবে উপরে থাকা ওই ব্যক্তির চক্ষুতে কিছুতেই ধরা দিতে চাইছে না। সেগুফতা, তাহিয়া, রাবেয়া উশখুশ করতে থাকলে দাদীর দিকে তাকাল। সঙ্গে সঙ্গে দাদীর আগুন দৃষ্টি দেখে সবকটা জমে গেল। দাদী ভয়ংকর ভাবে খেপেছে! সর্বনাশ! এমন সময় দরজার বাইরে থেকে কে যেন চ্যাঁচিয়ে বলে উঠল, 

  - স্যার! স্যার, ওদের নিয়ে এসেছি! 

প্রত্যেকের চোখ সঙ্গে সঙ্গে সদর দরজায় ঘুরে গেছে। কণ্ঠ শুনে আর বুঝতে বাকি রইল না কে এসেছে। শোয়েব আর উপরতলায় দাঁড়িয়ে থাকল না। সে দাদীর দিকে সম্মতির ইঙ্গিত ছুঁড়ে পা বাড়িয়েছে। ফাতিমা নাজ নিজে এগিয়ে গিয়ে রাফান ও বাকিদের স্বাগত জানালেন। যদিও তিনি জানেন না রাফানের সঙ্গে এই পাঁচ ছয়জনের দলটা কীসের। তবু দুইয়ে দুইয়ে চার মিলিয়ে ওই আহত মেয়েটা, আর মেয়েটার সঙ্গিদল হিসেবে ভেবে নিলেন। ফাতিমা নাজ চটজলদি রাবেয়াকে দিয়ে ডেকে পাঠালেন রোকেয়াকে। চুলায় গরম পানি চড়াতে বলে তিনি ব্যস্ত ভঙ্গিতে চলে গেলেন উপরে। এখনো বুঝতে পারছেন না কী ঘটছে আসলে। কী হয়েছে ব্যাপারটা? এরা এমন আহত, ক্ষতবীক্ষত, ভীতু অবস্থায় কেন? কেন এদের চেহারা ভয়ে পাংশুবর্ণ? অবস্থা দেখে মনে হচ্ছে এরা যেন মৃত্যুকে কাছ থেকে দেখেছে। কোনো দূর্বিসহ ঘটনার মুখোমুখি হয়েছে। বৃদ্ধা বেশ যত্ন করে সেগুফতাদের কাজ বুঝিয়ে সেই জখম মেয়েটার কাছে চলে গেলেন। চিরচেনা ওই ঘরটার কাছে পৌঁছুতেই কয়েক মুহুর্তের জন্য থমকে যান তিনি। নিজের শূন্য গোছানো বিছানায় মেয়েটিকে শুইয়ে আস্তে আস্তে হাতদুটো বের করছে শোয়েব। যেন মেয়েটার পিঠে কোনো চাপ না লাগে। ফরসা টানটান চাদরটা মেয়েটার পায়ের ধূলোয়, পিঠের রক্তে, হাতের ছিলে যাওয়া তরল থেকে নষ্ট হয়ে যাচ্ছে। তবু সেদিকে দৃকপাত করল না শোয়েব। জানালার কপাট খুলে সে যেন সর্বোচ্চ সেবাটুকু নিশ্চিত করে দিল। দূর থেকে ব্যাপারটা দেখে চুপ হয়ে যান ফাতিমা। চামড়া কোঁচকানো শীর্ণ মুখে প্রসন্ন হাসির রোদ্দুর খেলে গেল। তিনি ধপ করে যেন ফিরে গেলেন কয়েক যুগ পূর্বে। যখন উনার গর্ভের সন্তানটা এভাবেই মানুষের পেছনে ছুটে যেত। এভাবেই চেষ্টা করতো নিজের সামর্থ্যটুকু দিয়ে সাহায্য করতে। কিন্তু আজ সে নেই। সে কোথাও নেই। তবু যেন রয়ে গেছে নিভৃতকোণে। রয়ে গেছে তার পরবর্তী প্রজন্ম এই শোয়েব ফারশাদের মধ্য দিয়ে। বৃদ্ধা মনে মনে উনার মরহুম সন্তানের উদ্দেশ্যে বললেন, " আসাদ, দেখো। যেখানে আজ আছ, সেখান থেকে দেখার সুযোগ পেলে দেখো। তুমি তো চলে গেলে বাবা। সবকিছু নিয়েই চলে গেলে। কিন্তু রেখে গেলে তোমার এই মূলধণকে। এই একজন মানুষ আজ তোমার রক্ত, তোমার শিষ্টাচার, তোমার আদব কায়দা, লেহাজ, শিক্ষা সব বহন করে বেঁচে আছে। আজ তোমার আব্বার কথা খুব মনে পড়ে বাবা। ভদ্রলোক সবসময় বলতেন, পৃথিবীতে সেই মানুষরা মরে গেলেও স্বার্থক, যাদের সন্তানরা মানুষের মতো মানুষ হয়। তুমি কী অনুভব করতে পারো বাবা? আল্লাহর কাছে দুয়া করি জান্নাতবাসী হও।" চোখের দৃষ্টি ঝাপসা করে শাড়ির আঁচল খুঁজলেন ফাতিমা। আজকাল চোখের দৃষ্টি আগের মতো প্রখর না। সুতি কাপড়ের আঁচলটা খুঁজে পেয়ে খুব যত্ন করে চোখের পানিটুকু মুছে নিলেন। বুকের ভেতরে আঁটকে থাকা শ্বাসটুকু ছেড়ে দিয়ে ঠক ঠক করলেন বৃদ্ধা। শব্দ শুনে দরজায় তাকালে শোয়েব মাথা নাড়িয়ে বলল, 

  - এসো। 

বৃদ্ধা ভেতরে ঢুকলেন। নিজের ঘর থেকে আনা ব্যাগটা বিছানা সংলগ্ন টেবিলের ওপর রাখলেন। সেখান বের করে আনলেন কিছু প্রাথমিক চিকিৎসার সরঞ্জাম। তুলো, গজ, কাঁচি, অ্যান্টিসেপটিক সবকিছু বের করতেই শোয়েব ড্রেসিং টেবিল থেকে চাবিটা তুলে নিঃশব্দে বেরিয়ে গেল। দাদীকে বুঝতে দিল না সে আপন কর্মে চলে গেছে। বেহুঁশ মেয়েটির দিকে এবার তাকালেন ফাতিমা। সারামুখ কালো চুলে ঢাকা পরে আছে। গায়ে গোলাপি রঙের জামা। পাজামাটা সাদা। অথচ দুটোরই অবস্থা চোখে দেখার মতো নয়। হয়তো এজন্যই শোয়েব গায়ের হুডিটা দিয়ে ওকে ঢেকেঢুকে এনেছিল। অথচ, তিনি কী কী সব ভেবে যাচ্ছিলেন! ছিঃ! শীর্ণ আঙুলে পরম যত্ন ছুঁয়ে তিনি চুলের পসরাটুকু সরিয়ে দেন। উন্মুক্ত করে ফেলেন মেয়েটির মুখ। এক মুহুর্তের জন্য মনে হলো তিনি যেন ঘুমন্ত কোনো মায়াপুরীতে আবদ্ধ হয়ে গেছেন। যেখানে সবকিছু কেমন ছায়াময়, মায়াময়, অপার সারল্যে মুড়োনো কোমলতা। ঠোঁটে ধীরে ধীরে হাসি ফুটে উঠে বৃদ্ধার। পরম আদরে তিনি আঙুলের ডগায় ছুঁয়ে দেন ওকে। এক তীব্র অনামা উচ্ছ্বাস উনায বুকের ভেতরে উছলে ওঠে, তিনি অনুভব করেন এক অন্যরকম শান্তি। এ শান্তির অর্থ জানেন না ফাতিমা! সত্যিই তিনি জানেন না!


ঘণ্টাখানেক পর কিছুটা ধাতস্থ হয়েছে ওরা। খাওয়া-দাওয়ার পর্বও কিছুক্ষণ আগে চুকেছে। কিন্তু এখনো জানে না শাওলিন কেমন আছে। শুধু এটুকু তথ্য জানতে পেরেছে বনকর্মী লোকটা ওকে উদ্ধার করে এনেছে। কিন্তু আনার পর থেকে একবারের জন্যও ওদের দেখতে দেয়নি। এমনকি অদ্ভুত হলেও সত্যি যে, ওদের প্রত্যেকের থাকার ব্যবস্থাটা নীচতলায় করা হয়েছে। কাউকে উপরে ওঠার অনুমতি পর্যন্ত দেয়নি। একটু আগে ওদের জানানো হয়েছে হলঘরে জরুরি তলব। হলঘরে যেন প্রত্যেকে স্ব স্ব ভূমিকায় হাজির হয়। কিন্তু হঠাৎ এই জরুরি তলব কেন, কী কারণ, সেটা এখনো কেউ জানে না। সোহানা মুখ ভার করে নিস্তেজ গলায় বলল, 

  - মনে হচ্ছে কিছু একটা ঘটবে। উনি আমাদের শুধু শুধু এখানে ডাকেননি। 

কথাটা শুনে ভুল কিছু মনে হল না। বরং মনে হলো সত্যি। নীচের ঠোঁটটা দাঁতে কামড়ে জিদান বলে উঠল, 

  - বাট আমরা কী করেছি? এই তলবটা ডাকতে হবে কেন? আমরা কী খুন টুনের আসামি? কাঠগড়ায় দাঁড়িয়ে ইয়োর অনার, ইয়েস অনার বলতে থাকব? জাস্ট জঘণ্য তো! অসহ্য লাগতেছে এখন। 

জিদানের কথার মাঝে হঠাৎ অদ্ভুত একটা কথা বলল সেলিম। সে কেমন যেন ঘোর ঘোর একটা অবস্থার ভেতর ডুবে আছে। কী যেন গভীরভাবে ভাবছে। ভাবিত গলায় এক অজানা শঙ্কা নিয়ে বলল, 

  - লোকটা কী কিছু জেনে ফেলেছে? জানার তো কথা না। জেনে ফেললে কতটুকু বুঝেছে? ওই হাসপাতাল থেকেই...

কথাটা বলতে বলতে মাঝপথে অদ্ভুত কায়দায় থামল সেলিম। যেন সে অন্য দুনিয়ায় চলে গেছে। মনে মনে কী ভাবছে, তা বোঝা যায় না। কিন্তু যত ভাবছে, ততই যেন মুখের অবস্থা বিবর্ণ হয়ে যাচ্ছে। ফ্যাকাশে, পাণ্ডুবর্ণ দেখাচ্ছে! এমন সময় বজ্রগম্ভীর গলায় কে যেন গম গম করে বাজল, 

  - হাসপাতাল থেকে কী? ওখান থেকে কী বুঝব? 

হঠাৎ ওই কণ্ঠের আর্বিভাবে বুকের রক্ত ছলকে উঠল! সহসা হৃৎকম্পে শিউরে উঠল সেলিম! ধ্বক করে বুকের কাছটা মোচড় দিয়ে ওঠেছে। তার ঠোঁটদুটো কেমন থরথর করে কাঁপছে। সে দৃষ্টি তুলে দেখল শোয়েব ফারশাদ। চোখের ওই চাহনি নীল রশ্নির মাঝে অগ্নিকুণ্ড! কপালের মাঝে ওই ভাঁজটুকু যেন সেই দিনের আভাস! সেলিম ঢোক গিলে অজান্তেই যেন বলে উঠল, 

  - আপনি জার্মানিতে ছিলেন! জার্মানির ফ্রাঙ্কফুটে! আপনার কারণেই সেদিন আলোড়ন উঠেছিল! হ্যাঁ, আপনাকে আমি চিনে ফেলেছি! চিনে ফেলেছি আমি! 
.
.
.
চলবে....................................................

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন