তুমি রবে নীরবে - পর্ব ৩৫ - নাদিয়া সাউদ - ধারাবাহিক গল্প


সারাদিনে আজ কাজের ধকল কম যায়নি। শরীর যেন চলতেই চাইছে না কুহুর। তবুও মাথায় একটা চিন্তা ঘুরপাক খাচ্ছে। আদনানকে খুব একটা মন্দ লাগেনি। চোখের ত্রুটি টা তো জন্মগত নয়। এইটুকু খুত অতটা চোখে লাগবার মতো নয়। রিশাকে তারা পছন্দ করলেই হয়। মেয়েটা নতুন ভাবে সবকিছু শুরু করলে আগের চিন্তা নেমে যাবে মাথা থেকে। কথাগুলো ভাবতে ভাবতেই ড্রয়ার থেকে সেলোয়ার-কামিজ বের করলো কুহু। এই শাড়ি পরে আর কতক্ষণ থাকবে? হাতের উপর কারো স্পর্শ পেতেই ভাবনার জাল ছিন্ন হলো। হাত থেকে কাপড়গুলো টেনে নিয়ে বলল রওনক,

"এই শাড়িটা এখন সম্পূর্ণ এলোমেলো করে দেওয়ার অধিকার রাখি আমি। কার অনুমতি নিয়ে চেইন্জ করতে যাচ্ছ শুনি?

রওনকের কথা বুঝতে কয়েক সেকেন্ড লাগলো না কুহুর। অপ্রতিভ হয়ে বার কয়েক চোখের পাতা ঝাপটালো। রওনককে এড়িয়ে যেতে যেতে বলল,

" আপনার অসভ্য কথা শুনতে ইচ্ছে করছে না এখন।

ফের কুহুর সামনে এসে দাঁড়াল রওনক। দীর্ঘশ্বাস ফেলে বলল,

"কিন্তু আমার যে অসভ্য হতে ইচ্ছে হচ্ছে খুউব!

বেলকনির দিকে দৃষ্টি পরতেই চট করে বলল কুহু,

" আচ্ছা রওনক ভাই! ওই যে বারান্দায় দেখুন গোলাপ গাছে দু'টো ফুল ফুটেছে। লাল আর সাদা। আপনার মতে এটা কিসের ইঙ্গিত দিচ্ছে? 

কুহুর কথা শুনে একপলক বারান্দায় তাকাল রওনক। সত্যিই দুইটা ফুল ফুটে আছে। তপ্ত শ্বাস ফেলে কুহুর শাড়ির কুচিগুলো টেনে খুলে নিল। ভয়ানক চমকে উঠলো কুহু। প্রশ্নের প্রতিত্তোরে এমন কিছু করবে রওনক ভাই কল্পনাতীত ছিল। আপনাআপনি কাঁধ থেকে আঁচল খসে পড়লো। কুহু জমে রইল বরফের মতো। রওনকের দৃষ্টি আঁটকে রইল কুহুর চোখে। কুহুকে টেনে নিজের সাথে জড়িয়ে নিয়ে কানের কাছে মুখ নামিয়ে বলল,

"সাদা গোলাপটা তোমার স্বচ্ছ মনেরই ইঙ্গিত দিচ্ছে মেয়ে। যেখানে আগে আমার জন্য কেবল রাগ আর জেদ ছিল! আর লাল গোলাপটা ভালবাসার আগমনী বার্তা নিয়ে এসেছে। এই যে আমাকে তুমি ভালবাসো এখন!

রওনকের কথায় ভারী অবাক হলো কুহু। ভীষণ গোছানো কথা। মুচকি হাসি ফুটে উঠলো ওষ্ঠকোণে। সেটুকু দৃষ্টিগোচর হয়ে রইল রওনকের। কুহুর শুভ্র রঙা স্কন্দে দৃষ্টি আঁটকে গেল রওনকের। পেলব অধরোষ্ঠ মিলিয়ে নিল। খোঁচা খোঁচা দাঁড়ির স্পর্শ পেতেই সর্বাঙ্গ শিউরে উঠলো কুহুর। তাৎক্ষণিক জড়িয়ে নিল রওনককে। শক্তপোক্ত বুকে মাথা ঠেকাতেই স্পন্দন শুনতে পেল সুস্পষ্ট! কর্ণ লতিকায় ঈষৎ দন্তাঘাত করে ফিসফিস করে বলল রওনক,

" আমি জামা চেইন্জ করিয়ে দেই কুহু?

কথাটা কর্ণপাত হতেই ছিটকে সরে আসলো কুহু। একদৌড়ে ওয়াশরুমের দিকে ছুটলো। শব্দ করে হাসলো রওনক। পরক্ষণে গিয়ে পরীক্ষার খাতা নিয়ে বসলো। কুহুর ক্লান্তি মাখা চোখেমুখে লাজুক হাসি ভীষণ সুন্দর লাগছে। ভীষণ ভাবে আকৃষ্ট করছে। মাথা চুলকে খাতায় মনোনিবেশ করলো রওনক। মেয়েটাকে অযথা জ্বালানো উচিত হবে না। সারাদিন বড্ড খাটাখাটুনি করেছে। অত্যল্পকালে কুহুর চিন্তা রেখে স্বীয় কাজে মনোযোগ দিল।

◼️

মাস পেরিয়েছে অনেকদিন। আদনানদের বাড়ি থেকে সেদিনের পর আর কোনো খবর আসেনি। রিশার জন্য ভালোই হয়েছে৷ ছেলেটার চোখের ব্যাপারটা নিয়ে কিছু বলতে হয়নি তাকে। রাশেদ জামালের মনটা খুব খারাপ হয়ে গিয়েছিল। এমন ভালো ছেলে সচরাচর মেলে আজকাল? নম্র, ভদ্র, শিক্ষাদীক্ষা সবদিকেই স্বয়ংসম্পূর্ণ! সামান্য ত্রুটি দিয়ে ছেলেটাকে বিচার করেননি। শারমিন বেগমের খানিক আপত্তিই ছিল আদনানের চোখের সমস্যা নিয়ে। তবে ছেলেটার ব্যবহার আর কথাবার্তার ধরণ তাকে মুগ্ধ করেছে। রিশাকে অপছন্দ করার কোনো কারণ দেখতে পাচ্ছেন না তিনি। অবশ্য সবার রূচি তো এক নয়। এখনো পথ চেয়ে আছেন রাশেদ জামাল। যদিওবা ফিরে আসেন তারা। ভীষণ খুঁতখুঁতে স্বভাবের তিনি। অভদ্র ধাঁচের ছেলে একদমই পছন্দ নয়। শিক্ষক বলেই হয়তো। কোন ছেলেটার স্বভাব, চরিত্র ভালো সেটা তার জহুরি চোখ দিয়ে ঠিকই অনুধাবন করতে পারেন। কতশত ছেলেপেলেকে শিক্ষায় গড়ে তুলেছেন। ঘড়িতে চোখ বুলালেন রাশেদ জামাল। আজকে তার অবসরপ্রাপ্তের দিন। ছোটখাটো একটা আয়োজন হয়েছে স্কুলে। মনটা ভীষণ খারাপ হয়ে আছে কেন জানি। অর্ধাংশ চা রেখেই চলে গেলেন তিনি। পাল্টা আর কিছু বললেন না শারমিন বেগম৷ স্বামীর মনের অবস্থা ঠিক বুঝতে পারছেন। কিছুক্ষণের মাঝে রওনক আর কুহু তৈরি হয়ে আসলো। ভার্সিটিতে যেতে হবে। সময় বেশি নেই। ডাইনিং রুমে রিশাকে না দেখে খুব অবাক হলো কুহু। আজকে ইনকোর্স পরীক্ষা। অন্যসময় হলে সবার আগে তৈরি হয়ে চলে আসতো সে। মাস খানেক ধরে রিশাকে চিনতে কষ্ট হয় কুহুর। এমন ছন্নছাড়া স্বভাবের তো ছিল না মেয়েটা! ভালবাসার মানুষ কি জীবন এতটাও বদলে দিতে পারে? মাথায় একরাশ চিন্তা নিয়ে রিশার রুমের কাছে আসতেই দেখলো এখনো বিছানা ছাড়েনি। বেঘোরে ঘুমাচ্ছে। তড়িঘড়ি করে এসে ডাকলো কুুহু। ভীষণ ভরকে গেল রিশা। উঠে বসলো। চোখ ডলে কিছুক্ষণ তাকিয়ে রইল কুহুর দিকে। ভার্সিটিতে যাওয়ার জন্য তাড়া দিল কুহু। ছোট্ট একটা শ্বাস ফেলে রিশা জানালো সে একাই চলে যাবে। কুহুকে বলল চলে যেতে। কুহু নাছোরবান্দা। সে আজ রিশাকে নিয়েই যাবে। কয়েক সেকেন্ড কুহুর দিকে তাকিয়ে ভয়ানক রেগে গেল রিশা। চোখমুখ শক্ত করে বলল,

"আমি যখন বলছি চলে যাব তাহলে তোর বসে থাকতে হবে কেন? এত আধিখ্যেতা আমার ভালো লাগে না কুহু। কি ভেবেছিস এখন আমার ভাবী হয়েছিস বলে তোর দায়িত্ব বেড়ে গেছে? এসব ন্যাকামো আমার পছন্দ নয় জাস্ট! চলে যা তুই।

কথাগুলো বলেই উঠে ওয়াশরুমে চলে গেল রিশা। হতভম্ব হয়ে দাঁড়িয়ে রইল কুহু। আদৌ এটা রিশা তো? সর্বপ্রথম তাদের সম্পর্ক হচ্ছে খুব ভালো বন্ধুত্বের! অথচ অনায়াসে মুখের উপর কত কথা শুনিয়ে দিল। ননদ ভাবী সম্পর্কের কথা তো মনেও নেই কুহুর। অজান্তে চোখ গড়িয়ে জল পরলো। কন্ঠনালী শক্ত হয়ে এলো। শুকনো ঢোক গিলে চলে গেল।


কুহুর অপেক্ষায় আছে সবাই। আজকে বেশ কড়াকড়ি একটা প্ল্যান কষেছে সবাই। বুদ্ধিটা আরিয়ানের। কুহুর মুখ থেকে আজ সত্য বের করেই ছাড়বে সবাই। সকলের কথোপকথনের মাঝে কুহুকে এগিয়ে আসতে দেখা গেল। তার অনেকটা পেছনে রওনককে দেখা গেল অন্য দিকে তাকিয়ে হেঁটে যাচ্ছে অফিসকক্ষের দিকে। পরনে কালো রঙা শার্ট আর ফর্মাল প্যান্ট। রূপসা সেদিকে তাকিয়ে বলল,

" দ্যাখ, দ্যাখ এমন ভাব করে হাঁটছে যেন বউকে চেনেই না! কি অভিনয়রে! রওনক স্যারের উচিত ছিল টিচার না হয়ে অভিনেতা হওয়ার।

নয়ন বলল,

"তুই আসলেই মাথামোটা একটা। ভার্সিটিতে কি স্যার কুহুর হাত ধরে নিয়ে আসবে?

আরিয়ান বলল,

" তোরা চুপ থাক কুহু এসে গেছে।

কুহুকে অন্যদিনের তুলনায় আজ বেশ অন্যমনস্ক লাগলো। চেহারা জুড়ে মলিনতার ছাপ। সোহা সোজা প্রশ্ন করেই বসলো মন খারাপ কিনা কুহুর? মাথা ঝাঁকিয়ে না বলল কুহু। কৃত্রিম হাসলো একটু। আরিয়ান জিগ্যেস করলো রিশা এসেছে কিনা। কুহু কথার প্রসঙ্গ টা এড়িয়ে গেল। আজকের পরীক্ষা নিয়ে কথা আরম্ভ করলো। কথামতো সবাই অভিনয় করার জন্য প্রস্তুত হয়ে গেল। প্রথমে সোহা বলল,

"ভাগ্যিস রিশা এখনো আসনি। রূপসা তো বিশাল প্ল্যান করে এসেছে আজ। সাকসেস হলেই হয়। আর আমরা আছি না। 

সোহার কথা শুনে রূপসার দিকে তাকাল কুহু। আজকে একটু বেশিই সুন্দর লাগছে যেন মেয়েটাকে। মুখে লাজুক হাসি। হাতে ছোট্ট একটা খাম। সেটা সামনে ধরে নিয়ে বলল,

" জীবনের প্রথম কোনো পুরুষের জন্য লাভ লোটার লিখেছি দোস্ত! আমার তো হাতপা কাঁপছে রীতিমতো। রওনক স্যার আমাকে ফিরিয়ে দেবে না তো? কিন্তু চিঠিতে প্রেম নিবেদনটা অন্যরকম এক অনুভূতি দিচ্ছে।

কুহু বাকরুদ্ধ হয়ে গেল। মাস খানেক ধরেই রূপসা এটাসেটা উল্টাপাল্টা বলে যাচ্ছে রওনক ভাইকে নিয়ে। ভীষণ খারাপ লাগলেও মুখে কিছুই বলতে পারেনি কুহু। দিনদিন সবাই যদি এভাবে তার স্বামীর দিকে কুদৃষ্টি দেয় তাহলে তো ধৈর্যের বাঁধ ভেঙ্গে যাবে। কুহুর রিয়াকশন দেখে মনে মনে পৈচাশিক আনন্দ পেল সবাই। নয়ন বলল,

"এই এক রওনক স্যারকে নিয়ে কি পেয়েছিস তোরা? জানিস না শাহিনূর মাহি ম্যাম আগেই দৃষ্টি দিয়ে রেখেছে।

মুখ বাঁকিয়ে বলল রূপসা,

" যার ইচ্ছে হয় নজর দিক। রওনক শুধু আমার হিরো! তাছাড়া ওই মাহির থেকে সবদিকেই সুন্দর আমি। ভার্সিটিতে কত ছেলে আমার পেছনে ঘুরে সেটা তো জানিসই! আমি এও সিউর রওনক স্যার আমাকে ফেরাবে না।

কুহুর দিকে তাকিয়ে রূপসার উদ্দেশ্যে বলল আরিয়ান,

"তোর সাহস আছে বলতেই হয়। স্যারকে দেখলেই তো ভয় লাগে। কি জানি হয় আজ কে জানে। তবে আমরা মনেপ্রাণে চাই তোদের মিল হোক। কি বলিস কুহু?

কুহু কোনোরকম উত্তর দিল না। মস্তিষ্ক বিক্ষিপ্ত হয়ে আছে তার। সকালে রিশার সঙ্গে কথা বলার পর মনটা প্রচন্ড খারাপ হয়ে আছে। তারউপর রূপসার এসব কথা শুনে কষ্ট দ্বিগুণ হলো। এলোমেলো পা ফেলে পাঁচ তলা ভবনের দিকে ছুঁটলো। কুহুর এরুপ আচরণে সবাই চমকে গেল। শব্দ করে হেসে ফেলল সবাই। এতদিনে কাজ হয়েছে বলে মনে হলো। তৎক্ষনাৎ সবাই কুহুর পেছনে ছুটলো। দরকার হয় আরো রাগিয়ে দেবে। তবুও মুখ থেকে আজ কথা বের করে ছাড়বে। খানিক্ষনের মাঝেই পরীক্ষা শুরু হয়ে যাবে। হুড়োহুড়ি করে যে যার ডিপার্টমেন্টে চলে গেল। কুহু উপরে উঠছে ধুপধাপ সিড়ি ভেঙ্গে। পেছনে রূপসা'রা অনুসরণ করছে। তাদের পরীক্ষা হবে অন্য ভবনে। তবে কুহু কোথায় যাচ্ছে? সুইসাইড করতে নয় তো? চারতলায় উঠতেই রওনককে দেখতে পেল কুহু। হাত ভর্তি খাতা নিয়ে তাতে দৃষ্টি বুলিয়ে যাচ্ছিল। দূর থেকেই জোড়ালো স্বরে ডাকলো,

" রওনক ভাই? 

চেনা কন্ঠস্বর পেয়েই দৃষ্টি তুলে তাকাল রওনক। ততক্ষণে কুহু এগিয়ে গিয়ে জাপ্টে ধরলো রওনককে। আশেপাশে কিছুই খেয়ালে নেই তার। এরুপ কিছুর জন্য প্রস্তুত ছিল না রওনক। পেছনে দৃষ্টি আটঁকে রইল তার। কারণ ঠিক পেছনেই আট জোড়া চোখ অবাক দৃষ্টি নিয়ে দেখছে তাদের। কুহু হুহু করে কেঁদে ফেলল। শরীর মৃদু কাঁপছে কান্নার দাপটে। সকাল থেকেই মন তীব্র খারাপ হয়ে আছে তার। রওনক অপ্রস্তুত হলো। কিরুপ প্রতিক্রিয়া জানাবে বুঝতে পারলো না। পেছনে ছাত্রছাত্রীদের চোখে তাকাতে পারছিল না। পেছনে খালি ক্লাসরুম দেখতেই রওনককে টেনে নিয়ে গেল কুহু। রওনক হতভম্ব! রূপসা অবাক কন্ঠে বলল,

"ওরা ফাঁকা ক্লাসরুমে কেন গেল?

নয়ন উত্তর দিল,

" হয়তো ব্যাক্তিগত কোনো কথা বলতে। বাদ দে। চল আমরা ক্লাসে চলে যাই। পরীক্ষা শুরু হয়ে যাবে।

রূপসা পাশ থেকে সোহার হাত টেনে নিয়ে উপরে যেতে যেতে বলল,

"এ অবধি যখন এসেছি তখন দেখে যাব তারা দুইজন ফাঁকা ক্লাসরুমে কি করছে।

নয়ন পা বাড়াতে গেলে আরিয়ান থামিয়ে দিয়ে বলল,

" এমনি স্যার আমাদের দেখে নিয়েছে। যদি এখন ধরা খাই না তাহলে বিচ্ছিরি অবস্থা হয়ে যাবে। চল আমরা ক্লাসে চলে যাই। কুহুকে পরে আঁটসাঁট বেঁধে ধরবো। অগত্যা আরিয়ানের সঙ্গে চলে গেল নয়ন।


রওনকের শার্টের কলারে দু'হাত চেপে নিয়ে কান্নারত স্বরে বলল কুহু,

"শাহিনূর মাহি ম্যাম তো কবে থেকেই নজর দিচ্ছে আপনার দিকে। এখন রূপসাও, কতশত ছাত্রী আড়ালে কত কিছু বলে আপনাকে নিয়ে। আমার কষ্ট হয়। খারাপ লাগে। আমাদের বিয়ের সম্পর্ক টা কেন লুকিয়ে যাচ্ছেন আপনি? আমি আর এসব শুনতে পারছি না। ধৈর্য্যে কুলচ্ছে না আমার। আমি আপনাকে ভালবাসি রওনক ভাই। বুঝেন সেটা আপনি?

প্রচন্ড মন খারাপ থেকে অনর্গল কথাগুলো বলে গেল কুহু। রওনক নিষ্পলক তাকিয়ে দেখছিল কুহুর কান্না। এই কান্নামাখা মুখ তাকে কষ্ট দিচ্ছে না। বরং অন্যরকম এক প্রশান্তি দিচ্ছে বক্ষস্থলে। এত রাগ দেখিয়েও ভালবাসা বলা যায় সেটা এই মাথামোটা মেয়েকে না দেখলে বোধহয় জানতোই না! রওনককে চুপ থাকতে দেখে খানিক উঁচু হয়ে রওনকের কানের পাশে ভাঙ্গা স্বরে বলল কুহু,

" আপনি শুধু আমার। শুধুই আমার। 

কথাটুকু বলেই এক অপ্রত্যাশিত কাজ করে বসলো। রওনকের ওষ্ঠযুগলে নিজের ঠোঁট জোড়া মিলিয়ে নিল। তৎক্ষনাৎ কুহুর কোমড়ে হাত রেখে খানিক উঁচু করে ধরলো রওনক। সাড়া দিল নিজেও। রূপসা আর সোহার চোখ ছানাবড়া! মুখ আপনাআপনি হা হয়ে গেল দু'জনের। চোখের চশমা ঠিক করে নিয়ে ফিসফিস করে বলল সোহা,

"আমি কি ঠিক দেখছি রে রূপসা? মানে আমাদের লাজুক আর ভদ্র কুহু নিজ থেকে চুমু খাচ্ছে রওনক স্যারকে? তাও ঠোঁট চুমু? 

" তাই তো দেখছি! এখানে না আসলে তো বিশাল কিছু মিস করে ফেলতাম। এতদিন সিনেমাতেই দেখেছি। আজ বাস্তবে দেখছি। রওনককে স্যারকে দ্যাখ কি সুন্দর করে কুহুকে জড়িয়ে ধরে আছে! 

রূপসার চোখের সামনে হাত রেখে বলল সোহা,

"অনেক দেখেছিস। চল এবার। পরীক্ষা শুরু হয়ে গেছে। কখন না ধরা পড়ে যাই!


বেশ অনেকটা সময় নিয়ে ছাড়লো কুহু। আবারো কান্না পাচ্ছে তার। আজকের দিনটাই তার জন্য খারাপ মনে হচ্ছে। সকালের ঘটনাটা রওনককে বলল না। কুহুর দিকে কয়েক সেকেন্ড তাকিয়ে থেকে বলল রওনক,

" আমাদের বিয়ের বিষয়টা আর বোধহয় লুকানো থাকবে না কুহু। তখন যেভাবে জড়িয়ে ধরেছ আমাকে পেছনে তোমার বন্ধুরা ছিল। কি ভাবছে তারা কে জানে! হয়তো ভাবছে স্যারের আর স্যারের ছাত্রী দু'টোর একটারও চরিত্রের ঠিক নেই! এমন বোকামো কেউ করে?

হঠাৎ যেন হুঁশ ফিরলো কুহুর। খারাপ লাগার সঙ্গে ঈষৎ লজ্জাও লাগলো। কোনো প্রতিউত্তর করলো না সে। দ্রুত চলে গেল।

◼️

রিকশায় আমনা হয়ে বসে আছে রিশা। সময় বলছে পরীক্ষা শুরু হয়ে গেছে। অথচ বইটাও ছুঁয়ে দেখেনি। সবকিছুতে বিতৃষ্ণা এসে যাচ্ছে। কুহুর সঙ্গে আজকে খুব বাজে ব্যবহার করে ফেলেছে। সেটা মনে হতেই অপরাধবোধ হচ্ছে। রিকশা সিগন্যালে পরতেই ভাবনার ঘোর কাটলো রিশার। আচমকা দূরে দৃষ্টি পরতেই দেখলো ফুটপাত ধরে হেঁটে যাচ্ছে রাতিম। বক্ষস্থল ধ্বক করে উঠলো রিশার। ব্যাগ থেকে টাকা বের করে কোনোরকম রিকশাওয়ালার হাতে ধরিয়ে দিয়ে সেদিকে ছুটলো। পেছন থেকেই জোড়ালো স্বরে ডাকলো। চলন্ত পা দু'টো থেমে গেল রাতিমের।ঘাড় ঘুরিয়ে তাকাল সে। ছুঁটতে ছুঁটতে আসলো রিশা। রাতিমের সামনে দাঁড়িয়ে ঘনঘন শ্বাস ফেলল। হাসিমুখেই জিগ্যেস করলো রাতিম,

"কেমন আছ আইরিশ? পড়াশোনা কেমন চলছে?

রাতিমের এমন প্রশ্নে ভীষণ অবাক হলো রিশা। কেমন স্বাভাবিক লাগছে লোকটাকে। রিশাকে কষ্ট দিয়ে কি একটুও খারাপ বা অনুশোচনা হয়নি তার? সরাসরি প্রশ্ন ছুড়লো,

" গত একমাস যাবৎ আপনার ফোন বন্ধ কেন?

কয়েক সেকেন্ড চুপ থেকে বলল রাতিম,

"আমার আগের ফোনটা হারিয়ে গেছে। সিম আর উঠাইনি। নতুন সিম কিনেছি। তাই হয়তো যোগাযোগ হয়নি তোমার সাথে। 

" আমি আপনার ফ্ল্যাটে অনেকবার গিয়েছি। পাইনি।

"আমার চাকরি টা চলে গেছে। গ্রামে চলে গিয়েছিলাম।

রাতিমের কথায় স্তব্ধ হয়ে গেল রিশা। চাকরি হারানোর কারণেই কি রিশার মুখোমুখি হয়নি সে? রিশার পাঠানো বার্তাটা কি তবে পায়নি? শক্ত চোখেমুখে বলল,

" শেষবার আমাকে কেন ডেকেছিলেন? কি বলতে চেয়েছিলেন আমায়? আশা করি নির্দ্বিধায় বলবেন। কোনো সংকোচ রাখবেন না।
·
·
·
চলবে...........................................

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন