-“তোমাকে বিয়ে করবে।”
-“আল্লাহ, ও না বিয়াত্যা?”
-“দ্বিতীয় বিয়ে করবে। চার বিয়ের হাদিস গায়।”
-“বাবা, বুকে ব্যথা করছে। মা রাকিব বলতে পাগল, আবার বোলো না সে রাজি....”
-“সে রাজি।”
প্রীতি ঠাস করে সোফায় পড়ে গেল। মাথাটা ভনভন করছে তার। তাকিয়ে আছে স্তব্ধ হয়ে। শব্দ বের করতে এবার কষ্টই হলো,
-“আব্বা, এ কী অনর্থ! কেমনে হলো? কেন হলো? আব্বা গো, এগুলা বলার আগে তুমি কেন আমাকে তেলাপোকা ভেজে বললে না, ‘চাইনিজ রেসিপি ট্রাই করেছি, টেস্ট করো’। আমি খুশি খুশি খেয়ে হজম করে নিতাম। এটা পারছি না।”
শামীম সাহেব দু-ধারে মাথা নেড়ে বললেন,
-“তোমার নাকি তার সাথে সাড়ে তিন বছরের সম্পর্ক। তুমি নাকি তার জন্য হাত কেটেছ, ফাঁস নিতে গিয়েছ? এখন নাকি মরেই যাবা? আসলেই?”
প্রীতি কাঁদো কাঁদো হয়ে বলল,
-“বদলোকে মিথ্যা বলে, বাবা। দেখো ওরে আশিক জিনে ধরছে। তিনরাস্তার মোড়ে গিয়ে ধারানি দেও। শীতকালের সন্ধ্যায় নদীর পানি গায়ে পড়লে, ভূত-পেত্নী সব বেরিয়ে যাবে।”
-“ঠিক আছে। ঘুমাও এখন, অনেক রাত হয়েছে।”
প্রীতি ঘুমাতে গেল না। সেখানেই বসে রইল। শামীম সাহেব বললেন,
-“দুশ্চিন্তা কোরো না। তোমার মায়ের রাজি হওয়ার বিষয়টা আমি রসিকতা করে বলেছি। সে রাজি হলেও আমি হব না। ঘুমাতে যাও।”
-“বাবা?”
-“বলো।”
-“তুমি কি বিশ্বাস করো, ক্লাস সেভেনে থাকতে হাফপ্যান্ট পরাকালীন অবস্থায় আমি ওই কুকুরছানার সাথে প্রেম করেছি? বিশ্বাস করো?”
-“করি না।”
-“তাহলে গুড নাইট। একটা সাউন্ড স্লিপ হবে এখন আমার।”
শামীম হাসলেন,
-“শুভ রাত্রি, শুভ ঘুম, শুভ হোক স্বপ্নগুলো। আমার মেয়ের যত দুঃখ সব আমার হোক, সে আমার সুখসহ সব শান্তি পেয়ে যাক।”
প্রীতি সিঁড়ির সামনে ছিল। তিনসিটের সোফার একপাশে শামীম সাহেব বসে আছেন। হঠাৎ আবেগী হয়ে প্রীতি দৌড়ে বসার ঘরে এসে বাবাকে জড়িয়ে ধরে কেঁদে ফেলল। শামীম সাহেব টিভির ভলিউম কমিয়ে রিমোটটা পাশে রেখে মেয়ের মাথায় হাত রাখলেন। শান্ত গলায় বললেন,
-“কাঁদছ যে?”
-“মন চাইছে, বাবা।”
-“ঠিক আছে, কাঁদো। মনের কথা শুনতে হয়।”
প্রীতি আরাম করে সোফায় উঠে বসল। পাশের কুশনটা এনে শামীম সাহেবের কোলের ওপর রেখে শুয়ে পড়ল। এরপর বলতে লাগল,
-“বাবা, ওসব কথা শুনে তোমার রাগ লাগেনি? একমুহূর্তের জন্যও কি সত্যি মনে হয়নি?”
শামীম সাহেব সামান্য হাসলেন,
-“মা আমার, তোমার বাবা যথেষ্ট অভিজ্ঞ। অন্তত মেয়ে মন-মস্তিষ্কে কখন কী চলে, এটুকু বোঝার মতো জ্ঞান তার আছে।”
প্রীতি কপাল কোঁচকাল,
-“বুঝতে পারছি না।”
-“প্রতিটা মানুষকে নিজের গন্তব্যের পথে একা চলতে হয়। সে হোঁচট খাবে, পড়ে যাবে, এরপর উঠে দাঁড়াবে নিজ থেকেই। আমরা তার পথ পরিচালনা করতে পারি না। আমরা যা পারি, তা হলো তাকে ঠিক ও ভুলের দিক নির্দেশনা দিতে। সে ঠিকটা বেছে নেবে না-কি ভুলটা, ইটস অল আপ টু হিম। তবু মা, আমরা মানুষ, ইশ্বর নই। ভুল আমাদেরও হবে, অজান্তেই। তোমার অতীতটা সেরকমই এক অবুঝপনা ছিল। আমি সেজন্য তোমায় দোষারোপ করতে পারি না।”
প্রীতি চোখ বন্ধ করে নিল,
-“বাবা, তুমি কখন থেকে জানো?”
-“রাকিবের বিয়ের কিছুদিন আগে থেকে।”
-“কিছু বলোনি।”
-“তাতে তুমি নিজের সাথে বোঝাপড়া করতে পারতে না।”
প্রীতি চুপ হয়ে রইল। শামীম সাহেব স্মিত হাসলেন। প্রীতির বিনুনি গাঁথা চুলগুলো আলগা করে, মাথায় হাত বুলিয়ে দিতে লাগলেন। তারপর কেটে গেল অনেকটা সময়, অনেকটা। ঘুম-ভ্রমের মাঝামাঝিতে প্রীতি। পিটপিট করে তাকাল। জড়ানো গলায় বলল,
-“বাবা, আমার খুশিতে কান্না পাচ্ছে। তুমি এত কেন বোঝো আমাকে?”
-“কারণ আমি বুঝি—যখন বোঝার মতো কেউই থাকে না, তখন ঠিক কতটা অসহায় লাগে।”
_______
ইউনিভার্সিটির উদ্দেশ্যে বাসা থেকে বেরোনোর সময় নীপা পিছে থেকে ডেকে উঠল,
-“কী ব্যাপার? আজকাল রাত জাগছ!”
নীহম পিছে তাকাল না,
-“তাতে তোমার কী?”
-“আমার কী? কিছু না। জাস্ট কিউরিয়াস।”
নীহম ঘুরে তাকাল,
-“অফিসে যাওনি কেন, মা?”
-“লিভ নিয়েছি তিনদিনের।”
-“কী উপলক্ষে?”
-“আ লং ট্যুর, ফর রিফ্রেশমেন্ট।”
-“উইথ হুম?”
নীপা চোখে হাসল। দৃষ্টি সরু হয়ে এলো নীহমের,
-“যাব না আমি।”
-“যাবে।”
-“যাব না।”
নীপা নাটকীয়তার সাথে বলল,
-“কিছুদিন আগে এক কলিগ ট্যুর অফার করেছিল আর কী, তুমি সাথে না গেলে ওটা ভেবে দেখা লাগবে...”
নীহম কপাল কোঁচকাল,
-“ছেলে কলিগ?”
-“হুউম। আজকালকার ছেলেরাও না! সিনিয়র দেখলেই লেজ নাড়তে থাকে। অবশ্য আমাকে দেখলে বোঝা যায় না, তোমার বয়সী আমার একটা মেয়ে আছে.. এজ ডিফারেন্স মাত্র আঠারো।”
-“আর তুমি অলমোস্ট ফোর্টি।”
-“শশশ্... কাউকে বোলো না। আ'ম ওনলি থার্টি।”
-“হ্যাঁ, বিগত দশ বছর ধরেই।”
নীপা চোখ মেরে বলল,
-“বয়স না বাড়লে আমার দোষ কোথায়?”
নীহম অতিষ্ঠ ভঙ্গিমায় মাথা নাড়ল,
-“কখন বেরোবে?”
-“সন্ধ্যের বাসে।”
-“বিকেলে চলে আসব।”
নীহম বেরিয়ে পড়ল বাসা থেকে। আজ বাবার বাসায় বেড়াতে যাওয়ার পরিকল্পনা ছিল। কিন্তু যাওয়া হবে না। বাবাকে জানিয়ে দিতে হবে। ব্রোকেন ফ্যামিলির মেয়ে নীহম, মন-মর্জিমাফিক চলে। এতে কেউ কিছু বলে না। সবাই যে যার লাইফ নিয়ে ব্যস্ত। এটা আসলে বাইরের কথা। ভেতরে ভেতরে কে অতীতের কোন সময়ে আটকে আছে, তা কি জানার কথা?
নীহম ইউনিভার্সিটি পৌঁছাল লেইট করে। ক্লাসরুমে স্যার আছে। নীহম ভেতরে ঢুকে পেছনের দিকে জানালা ঘেঁষা একটা সিটে বসে পড়ল। ব্যাগ থেকে বের করল ডায়ারি, পেন্সিল। তাকাল সামনে। তারপর আবার ডায়ারিতে। হাত চলমান তার। পেন্সিল-স্কেচে আঁকতে লাগল এক পুরুষালি অবয়ব। বেশ লম্বা একটা সময় নিয়ে স্কেচটা সম্পূর্ণ করল। চোখে হাসল নীহম। পুরো স্কেচটায় হাতের আঙ্গুল ছুঁইয়ে, নিচের দিকে লিখল, 'The Universe Turns Differently When Fire Loves Water.'
এই লাইনটি গতকাল পড়া বইটাতে লেখা ছিল। আপাতত এই ছবি, সময় ও পরিস্থিতির সাথে এরও অধিক সামঞ্জস্যপূর্ণ কোনো বাক্য নীহমের মাথায় এলো না। সে কপাল কোঁচকাল, হাসল। চোখ সরিয়ে সামনে তাকানোর সাথে সাথেই লেকচারার সাহেবকে ঠিক তার সম্মুখে দেখতে পেল। কোঁচকানো কপাল সদ্য শিথিল হয়েছিল, স্থির রইল দু-সেকেন্ড। এরপর আবার কুঁচকে গেল।
ভদ্রলোক তখন বলল,
-“ক্যান ইউ প্লিজ টেল মি, এখানে কি ফাইন আর্টসের কোনো ক্লাস হচ্ছে?”
নীহম মাথা কাত করল, তাকিয়ে রইল অনিমেষ। সময় নিয়ে বলল,
-“আপনি জানেন না?”
-“আপনার থেকে শুনতে চাইছি।”
নীহম কাঁধ উঁচিয়ে বলল,
-“আজকাল যে কেমন কেমন লোক লেকচার দেয়! নিজের সাবজেক্টের নাম নিজেই জানে না।”
তার মুখাবয়ব দেখে যে কেউ নির্দ্বিধায় বলবে, সে ভীষণ সিরিয়াস কোনো টপিক নিয়ে কথা বলছে। অথচ কথা শুনতে পারলে বোঝা যাবে, সে রসিকতার ঢংয়ে আছে।
ক্লাস আওয়ার শেষ। সে তীক্ষ্ণ দৃষ্টিতে নীহমকে কিছুক্ষণ দেখে বলল,
-“লাস্ট ওয়ার্নিং, আমার ক্লাসে মনোযোগ কেবল আমার দিকেই রাখবেন।”
চলে গেল লেকচারার সাহেব। নীহম চোখ সরিয়ে নিল জানালার বাইরে। দৃষ্টিতে ভ্রম, শব্দে ছল। নীহম সহাস্যে বিরবির করল,
-“ইউনিভার্সিটিতে আসিই কেবল তোমাকে দেখার জন্য, তা তোমার জ্ঞানের পরিসীমার ঊর্ধ্বে।”
______
সকাল সকাল প্রীতি মামার বাড়ি চলে গেল। সে বাড়িতে রঙ্গ হচ্ছে। রাকিবের তিন মাসের সংসারে অশান্তি। রূপে, গুণে, পারিবারিক অর্থ-বিত্তে—সব দিকেই প্রীতির থেকে শতগুণে ভালো ছিল তানিশা। সেই লোভেই তো মেয়েটার সাথে কেবল প্রেম না করে সোজা বিয়ে করে নিল। আর এরপর?
এরপর থেকে প্রতিটা দিন, প্রতিটা মুহূর্তে অনুতপ্ত হচ্ছে। তানিশার প্রতিটা কাজের সাথে সে প্রীতিকে তুলনা করে দেখছে। বার বার ভাবছে, প্রীতি হলে এমন করত না।
বড়োলোক বাপের একমাত্র মেয়ে তানিশার রং-ঢং এমনিতেও বেশি। সে আপোষে আসে না, লোকেদের আসা লাগবে। এটাই তার নিয়ম। রাকিব অতিষ্ঠ। এর চেয়ে প্রীতি ভালো। অন্তত কথা শুনবে। কথা না শুনলে দু-চারটা থাপ্পড়ও মারা যাবে। এ নিয়ে ঝামেলা হবে না। মেয়েটা শান্তিপ্রিয়।
সকালের আরেকদফা আলোচনায় সে সবার সামনে আরেকটা প্রস্তাব রাখল,
-“প্রয়োজনে তানিশাকে তালাক দেবো। তবু আপনারা আমাকে প্রীতি দেন।”
সদ্য বাড়ির আঙিনা দিয়ে গোবর পাড়িয়ে প্রবেশ করা প্রীতি সঙ্গে সঙ্গে পায়ের জুতাটা ছুড়ে মারল রাকিবের দিকে। উড়ন্ত জুতো এসে লাগল সোজা রাকিবের মুখ বরাবর। একটা পড়তে না পড়তে প্রীতি আরেক জুতোও ছুঁড়ে মারল। এটাও মুখে লাগতেই প্রীতি চেঁচিয়ে উঠল,
-“শালা খাইষ্টার খাইষ্টা, গু খা।”
.
.
.
চলবে................................................................