বজ্রমেঘ - পর্ব ০৮ - ২/২ - ফাবিয়াহ্ মমো - ধারাবাহিক গল্প


শ্রেষ্ঠার গলা যেন বাকরুদ্ধ হয়ে গেছে! চিৎকারটা গলা দিয়ে ফুটল না! শেষ দৃশ্যটা দেখার পর থমকে গেছে শ্রেষ্ঠা। রাফানের মুষ্টিবদ্ধ হাত ওর কবজির ওপর কড়াভাবে বসেছে। এক ঝটকায় টান দিয়ে জায়গা থেকে সরিয়ে ফেলেছে সে। শ্রেষ্ঠা নির্বাক, স্তব্ধ, পুরোপুরি হতভম্ব! ঢোক গিলে আতঙ্কিত মুখে সামনে সবকিছু দেখতে পাচ্ছিল। দেখতে পেল ওর বন্ধুরা সবাই রেস্কিউ টিমের দ্বারা নিরাপদ জায়গায় পৌঁছে যাচ্ছে। চারিদিক থেকে ঘিরে ফেলেছে একদল সশস্ত্র বাহিনী। রাতের আঁধার মিলেমিশে কালো ধোঁয়ায় নিমজ্জিত। চোখে কিচ্ছুটি দেখা যাচ্ছে না। বারুদের বিষাক্ত পোড়া গন্ধে চারপাশটা দমবন্ধকর! শ্রেষ্ঠা আর কিছু বুঝে ওঠার পূর্বেই রাফান ওকে টান মেরে রেসোর্টটা থেকে বের হল। ডানহাতে শ্রেষ্ঠার কবজিটা তখনো খামচে ধরে উর্ধ্বশ্বাসে ছুটতে ছুটতে বলল, 

  - তুমি পেছন ফিরে চ্যাঁচাচ্ছিলে কেন? কী দেখে পিছিয়ে যাচ্ছিলে? তোমার সব বন্ধু নাগালের ভেতর পৌঁছে যাচ্ছে, আর তুমি চিৎকার দিয়ে দাঁড়িয়ে যাচ্ছিলে? মাথা কী নষ্ট হয়ে গেছে? 

শ্রেষ্ঠা যেন অনুভূতিহীন রোবটের মতো হয়ে গেছে। মুখে কোনো রা নেই, সাড়া নেই, প্রতিক্রিয়া পর্যন্ত শূন্য। শূন্য চোখে সমস্ত ঘটনা বোঝার জন্য চেষ্টা করছিল। পাদুটো দৌড়ের জন্য ছুটছে ঠিকই, কিন্তু তাতে ওর হুঁশটুকুও নেই। বারবার মনে হচ্ছিল কী হলো? কী হলো ওটা? শেষ মুহুর্তে কী হল ওর সাথে? বুকটা আবারও মোচড়ে উঠল শ্রেষ্ঠার। রাফানের মুঠোর ভেতর কেঁপে উঠল ওর হাত। রাফান যেন সহসা বুঝতে পেরে দৌড়তে দৌড়তে একপলক পিছু ফিরল। ঠিক তখনই শ্রেষ্ঠা দুচোখের পানি ছেড়ে কাঁপা গলায় বলল, 

  - আমার এক ছোটবোন আঁটকা পরে গেছে। ওকে কেউ নিয়ে আসেনি। ওকে উদ্ধার করুন রাফান সাহেব! ওকে পেছন থেকে ছুরি মেরেছে . . ওকে উদ্ধার করুন! 

আচমকা পাদুটো থামিয়ে দাঁড়িয়ে পরল রাফান। হাউমাউ করে কেঁদে ওঠা শ্রেষ্ঠার দিকে চেয়ে রইল সে। এতোটা আশ্চর্য চোখে তাকিয়ে আছে যে, প্রথম ক'মিনিট কিছুই বলতে পারল না। শুধু টের পেল পেছনে একটি মেয়েকে এরা ফেলে এসেছে, যার কপালে ঝুলছে নির্মমতার ঘোর আঁধার! 


টপ টপ করে চোখের পাপড়ি চুয়ে পানি নামছে। মাথার পেছনে অসহন যন্ত্রণা। চুলের প্রতিটি গোড়ায় গোড়ায় দুর্বোধ্য ব্যথা চোখের অশ্রু নিংড়ে আনছে, তবু দুঠোঁট খুলে আর্তস্বরে কোঁকাচ্ছে না। তুলোর মতো নরম কবোষ্ণ ঠোঁটের উপর সর্বোচ্চ শক্তিতে দাঁত চেপে রেখেছে ও। উপরপাটির দাঁতের দংশনে ঠোঁটের শুষ্কতা চিড়ে নোনারক্ত জিভে লাগছে, তবু লোকগুলোর সামনে নতমুখ করল না। কালো কুচকুচে রোমশ হাতটা ওই নরম গাল বরাবর সর্বোচ্চ শক্তিতে ঠাস করে আঘাত করল। এক মুহুর্তের জন্য মনে হল মাথার ভেতরটা ঝিঁ ঝিঁ করে উঠেছে। সবকিছু বোধহয় অসাড়, নিষ্প্রাণ। বন্ধ দুচোখের কোল ঘেঁষে ফোঁটায় ফোঁটায় ঝরছে অশ্রুশিশির, পরছে মেঝেতে গোল গোল বিন্দু হয়ে। দুটো ফর্সা উজ্জ্বল গাল রক্তবর্ণে ফোলা। নরম ত্বকের উপর পাঁচটি আঙুলের ছাপ লালবর্ণে ফুলে ওঠেছে। একমুঠো চুল পেছন থেকে খামচে ধরায় মাথাটা সেই তখন থেকে পেছনে হেলানো। এই যন্ত্রণাটা আর সহ্য করতে পারছে না শাওলিন। শুধু বারবার মনে হচ্ছে আজ পর্যন্ত ওর গায়ে হাত তুলেনি মণি। একটা বাজে ভাষায় কথা অবধি বলেনি। ওর মনেও পড়ে না জীবনে এমন কোনো ভুল করেছে কিনা, যার দরুন আজ এতোটা কষ্ট তাকে পেতে হচ্ছে। চোখ খুলে বহুক্ষণ পর চারপাশটা দেখতে পেল শাওলিন। আধো আঁধার, আধো আলোতে বুঝতে পারল ও কুটিরে বন্দি। লোকগুলো কড়া পাহারায় রেখে বাইরে অপেক্ষা করছে। বোধহয় অপেক্ষা করছে কখন নিরাপত্তা বাহিনীকে ধূলো মেরে এখান থেকে চম্পট দেবে। মুখে নিকাবের মতো গামছা প্যাঁচানো এক লোক ঘরের ডানদিকের মেঝেতে বসে আছে। তার গা সংলগ্ন এলএমজি রাইফেল রাখা। মুখের গামছাটা সামান্য ঢিল করে চ্যাপ্টা একটা কাঁচের বোতল খুলতে খুলতে বলল, 

  - আর কতক্ষণ এইভাবে বইসা থাকা লাগব? আর তো ভাল্লাগতাছে না। তাড়াতাড়ি এই কেচ্ছা ফিনিশ দিয়া এই ছেড়িরে লইয়া চোপাট দেওন দরকার। 

মাথার পেছনে চুল খামচে ধরা লোকটা ফোঁস করে উঠল। গভীর শ্বাস ফেলে গলা খাঁকারি দিয়ে বলল, 

  - সবুর কর। অতো উতলা হইলে চলব ক্যান? এমনেই আর্মি ডাইকা পুরা প্ল্যানডা ভেস্তে ফালায়া দিছে, আর এহন যদি রাস্তা দেইখা না বাইর হই, তাইলে বিরাট ঘাপলা বাঁধব। জুত কইরা বই থাক। কতা কইস না। 

কাঁচের বোতলটা দুঠোঁটের ফাঁকে চেপে ধরল সে। মুখের গামছাটা এবার পুরোপুরি সরিয়ে নিয়েছে। তৃপ্তির একটা ঢেঁকুর তুলে গলা ভিজিয়ে বলল, 

  - আমার মনডায় কয় এই দলটার মইধ্যে বিরাট ঘাপলা আছে। নাইলে সাধারণ একটা জিনিসের পিছে ওস্তাদ ওমনে পরব ক্যা? আমার ক্যান জানি বিরাট সন্দেহ লাগতাছে ভাই। ছোডো মোডো জিনিসের পিছে এমনে কুত্তা পিডা করতো না। তয় এই ছেড়িরে দেইখা আমার পল্টিগিরি মনে হয় নাই। এহনো কমু ছেড়ির হাত দুইটা খুইলা দেন। একটু জুত কইরা এই ছেড়িও বহুক। চাইলে কিন্তু এই ছেড়ি চিল্লায়া বাড়িঘর মাথায় তুলতে পারতো। ওইডা আরো পেরেশানির কারবার। মাগার এই ছেড়ি এক্কেরে ঠাণ্ডা মাইরা পইরা আছে। যেই কয়ডা থাবড়া খাইছে, জুততে সব গিলছে। মিঁউ মিঁউ শুদ্ধা করে নাই। 

কথাগুলো শুনে কেন যেন হাতের মুঠিটা ধীরে ধীরে শিথিল করল। দ্বিতীয় লোকটা বোধহয় বুঝতে পেরেছে এই মেয়ে আর করুক, চিৎকার করে হল্লা হইচই বাঁধাবে না। শান্ত চুপচাপ এককোণে পরে থাকবে। বরং কিছুক্ষণের জন্য ছেড়ে দেওয়াই হয়তো ভালো। চুলটা ছেড়ে দিতেই চালের বস্তার উপর মেয়েটাকে আছড়ে ফেলল। তাতেও কোনোপ্রকার 'উহঃ' শব্দটুকুও বেরুল না। দ্বিতীয় লোকটা মনের সুখে একটা সিগারেট ধরিয়ে গভীর এক টান দিয়ে বলল, 

  - কতা অবশ্য ভুল কস নাই। ছেড়ি এইডা আসলেই চুপচাপ আছিল। দশ মিনিটের এইডারে ছাইড়া দিলাম। একটু আরামে থাউক। ওস্তাদ আইলে আবার হেসালা মুঠঠি খামচায়া ধরুমনে। তয় একটা ব্যাপার আমি বুঝবার পারতাছি না। ওই বন কর্মকর্তার ব্যাডাটায় এইহানে ক্যামনে? কেডায় হেরে খবরটা দিছে? এই দলের লগে কী উনার ভালা সম্পর্ক? 

প্রথমজন আরেক ঢোক তেঁতো পানিটা ঢিলে চোখমুখ কুঁচকে ফেলল। এখনো দেশি জিনিসে জিভ অভ্যস্ত হয়নি। তাই কোঁচকানো চোখ মেলে দ্বিতীয়জনের দিকে বলে উঠল, 

  - আপনে মনে হয় এই লাইনে নতুন। নাইলে এই কতাডা কইতে পারতেন না। আমরা যারা খুঁজ খবর লইয়া এইহানে আইছি, তারা এইডা ভালা কইরাই জানি ওই ব্যাডার লগে এই দলের কুনো সম্পর্ক নাই। সম্পর্ক যে ক্যামনে হইছে খোদা তায়ালা জানে। তয় হাছা কইলে একটা কতা কমু। উনার নাম মনে হয় শোয়েব। পুরা নাম শোয়েব ফারশাদ। এই এলাকার প্রত্যেকটা নামীদামী লোক হেরে এক নামে চিনে। উনি এই এলাকায় জয়েন করার পর আগের যেই অফিসারডায় আছিল, পুরা মাঞ্জা মাইরা গেছে। এহন বিলে ডরে ডরে থাহে। কেউ এই নয়া অফিসাররে ঘাঁটানের সাহস দেহায় না। 

কথাটার ভেতর নতুনত্বের গন্ধ পেয়ে কেমন যেন কৌতুহলী হলো। চোখদুটো প্রশ্নের ছাপে চকচক করে উঠলে দ্বিতীয়জন আস্তে করে মেঝেতে বসে বলল, 

  - আমি লাইনে নতুন এইডা সইত্য। তয় বনের মইধ্যে এমন কড়া শাষণ কইত্থিকা আইলো? আমি কইলাম আসলেও আচ্চায্য হইছি। ওস্তাদে সাজায়া গুছায়া পুরা চার-ছক্কা প্ল্যান বানাইছে, হেইনে দ্যাখতাছি কোনকার কোন বাহিনী আইয়া উদ্ধার কইরা লাইতাছে। যা বুঝলাম, ঢাকা আর চট্টগ্রাম এক না। 

  - ঢাকায় সবকিছু চক্ষে চক্ষে থাহে, চট্টগ্রাম থাহে ভাসা ভাসা। দুই বিভাগের মইধ্যে যেই ডিসটেন্স, হেইডা দিয়াই সবডা বুইজা যাওনের কতা। দেশের পরিস্থিতি এহন যেইদিহি আগ্গাইতাছে, হেইডা কইলাম সুবিধার না। এইলিগাই ওস্তাদ ওমনে উইঠা পইরা লাগছে। তাত্তাড়ি সবকিছু গুছায়া আনতাছে। কহন কী ঘইট্টা যায় কওন যায় না। 

কথার ভেতর এখনো যেন একটা সুক্ষ্ম ফাঁক রয়ে গেছে। যে ফাঁক সাদা চোখে ধরা যায় না। সিগারেট দু টান দিয়ে ভুরভুর করে ধোঁয়া ছেড়ে কপালটা খানিক কোঁচকাল সে। একটু ভেবে পুনরায় প্রশ্ন করে উঠল, 

  - ওস্তাদ কী কোনোভাবে এই অফিসাররে ডরায়? এই কারণেই কী উনার মুখোমুখি পরতে চাইতাছে না? 

প্রথমজন একপলক স্থির দৃষ্টিতে তাকায়। ঠোঁটের উপর স্যাভনলের বোতলের মতো তেমনই একটা কাঁচের বোতল চেপে ধরে। ঢকঢক করে দুঢোক বিশ্রী পানীয়টা গিলে কিছুটা নীচু, কিন্তু গম্ভীর গলায় বলে, 

  - ওই অফিসারের সামনে পরন ঠিক না মোছলেম। বিপদ হয়। এর আগের অফিসারডা সাক্ষাৎ জল্লাদ আছিল, অথচ হের মতো জল্লাদ এনার নাম হুনলেই দশ হাত পিছায়। ওস্তাদ কোন কারণে ডরায় এইটা নির্দিষ্ট কইরা জানোন যায় নাই। কিন্তু মনে হয় বহুত ডরায়। আজকা রাইতে কী ঘটব খোদাই জানে। এই ছেড়িরে আঁটকায়া রাখছে হুনলে ঘটনা ভালা কিছু ঘটব না। 

আচমকা ওই কথার মাঝে কেমন যেন গা শিরশিরে অনুভূতি সঞ্চার করল। দ্বিতীয়জন জানে না অমন অদ্ভুত কথার মানেটা কী। সে এই লাইনে ভালোই নতুন। আগে টুকটাক রংপুরের দিকে হাত টান করেছে, কিন্তু এই প্রথম ভিন জায়গায় এসে ভিন্ন কাজে ঢোকা। হাতের সিগারেটটা শেষ হয়েছে দেখে উঠে দাঁড়াল মোছলেম। জিভে নিকোটিনের পিপাসা জেগেছে। বাইরে কারো কাছ থেকে এক্সট্রা এক প্যাকেট আনার জন্য পা বাড়াল মোছলেম। দরজার চৌকাঠে পা থামিয়ে মুখ ঘুরিয়ে শামীমের দিকে বলল, 

  - আমি বাইরে আছি। প্যাকেট শ্যাষ। প্যাকেট লইয়া আসি। 

শূন্য বোতলটা ঠোঁট থেকে নামিয়ে উত্তর করল শামীম, 

  - ওই জলদি করিস। তুই আইলে আমি বাথরুমে যামু। চাপ আইছে!

বাইরে যেতে যেতে সিঁড়ি থেকে জবাবটা ছুঁড়ে দিল সে,

  - আইচ্ছা ঠিকাছে! আইতাছি আমি! 

বোবা আঁধারে ছেয়ে আছে ঘর। চারিদিকে অখণ্ড নৈঃশব্দ্য। রেসোর্টের একেবারে শেষ সীমানায় গা ঢাকা দিতে আশ্রয় নিয়েছে ওরা। বাকিরা এখনো নিজ নিজ জায়গায় রাইফেল বাগাচ্ছে। কেউ জানে এই রাত্রি প্রহরে নিরাপত্তা বাহিনী কী করে খবর পেয়েছে! কীভাবে জেনেছে তাদের এখানে হত্যাকাণ্ড ঘটানোর কথা! মেয়েটাকে পালাতে গিয়ে একেবারে শেষ মুহুর্তে ধরে ফেলেছে মোছলেম। এরপরই ধরে বেঁধে এই কুটির এনে রেখে দেওয়া। কিন্তু প্রথম দফায় জিজ্ঞাসাবাদ করতে ভালোই নির্যাতন চালিয়েছে ওস্তাদ। কিন্তু পরক্ষণে পালানোর রাস্তা সাফ সুতরো করতে তিনি নিজেই দলেবলে যোগ দিয়ে ছুটে গিয়েছেন। কানে খবর এসেছে, নিরাপত্তা বাহিনীর যে দল সেই দলে স্রেফ ছয় জন সদস্য। এখনো পুরো একটা ব্যাটালিয়ন এখানে পৌঁছুয়নি। তবে খবর পেয়ে আসতে আসতে যতক্ষণ! তিঁতকুটে পানিটা গেলার পর তলপেটে প্রচণ্ড চাপ শুরু হয়েছে। বাথরুমের দর্শনটা করে আসা জরুরি, কিন্তু খালি ঘরে মেয়েটাকে রেখে যাওয়ার ভুল করবে না। লাল পানির জোরেই বোধহয় চোখদুটো ঢুলে ঢুলে আসছিল শামীমের। মেঝেতে বসে পিঠ ও মাথা দেয়ালে হেলান দিয়ে তন্দ্রা মতো ডুবে গিয়েছিল। হঠাৎ চড় চড় করে তীক্ষ্ম কিছুর শব্দে জেগে উঠল সে! মনে হলো এখানে কেউ আছে! কাছেপিঠে কে যেন রয়েছে! দ্রুত বসা থেকে দাঁড়িয়ে যেতেই ঘরের চর্তুদিকে অস্থিরভাবে দৃষ্টি বুলাতে লাগল! একটু দূরে খোলা জানালা, বাঁদিকে চালের বস্তা, সেই বস্তার উপর মাথা রেখে মেয়েটা পরে আছে। না, কিছু তো নেই। তাহলে ওটা কীসের শব্দ হলো? শামীম আধ ভেজানো দরজা থেকে সবে দৃষ্টি ফেরাতে নিচ্ছিল, হঠাৎ চোখের কোণে কীসের একটা নড়াচড়া টের পায়। চোখটা সেদিকে ফেরাতেই শিরদাঁড়া বেয়ে ঠাণ্ডা কনকনে হিম স্রোত বয়ে গেল! চোখদুটো চরম আশ্চর্যে বিহ্বল! নিঃশ্বাস যেন নিতে পারল না! আগাগোড়া কালো হুডিতে ঢাকা। চাঁদের উল্টোদিকে থাকায় চেহারা স্পষ্ট না। অস্পষ্ট আলোতেও বুঝতে পারছে লোকটার ভয়ানক দৃষ্টি তার দিকে বিদ্ধ। বোধহয় তক্কে তক্কে অনুভব করছে সুযোগটুকু। লোকটার ডান মুঠোতে ধারালো রামদা। চাঁদের আলো লেগে ভীষণ চকচক করে জ্বলছে। লোকটা জানালার বাইরে থেকে ভীষণ গাম্ভীর্যের গলায় আজ্ঞা ছুঁড়ল, 

  - কথা বোলো না। চুপ!

শামীম ঢোক গিলে বিস্ফোরিত নেত্রে তাকিয়ে রইল। মুখে আপনা থেকেই বোল ফুটল না। নিঃশব্দ পায়ে ঘরের ভেতরে প্রবেশ করল সে। কেমন যেন অর্থপূর্ণ দৃষ্টিতে চালের বস্তার দিকে তাকিয়ে আছে। শামীম চাইলে ওই কিয়ৎক্ষণের ভেতর জোরে একটা ধাক্কা দিয়ে হুলস্থুল কাণ্ড বাঁধাতে পারতো। কিন্তু কেন যেন সাহসে কুলাল না। লোকটা এক কদম এগিয়ে ঠোঁটের উপর বোধহয় তর্জনী রেখে বলল, 

  - চুপ। সামান্য শব্দ করলে তোমার গলা থেকে শ্বাসনালী কেটে দিব। মৃদু একটা শব্দ হবে, এর বাইরে কোনো শব্দ হবে না। বুঝতে পারছ? 

ভয়ে, আতঙ্কে, তুমুল শঙ্কায় থরথর করে কাঁপছে শামীম। গলা দিয়ে আওয়াজ বের করতে চাইছিল, কিন্তু শেষমুহুর্তে ওই কথা শুনে সামান্যতম দুঃসাহস দেখাল না। লোকটা অন্ধকারে মিলেমিশে জান্তব অবয়ব ফুটিয়ে বজ্র-কঠোর স্বরে বলে উঠল, 

  - মেয়েটাকে কী করেছ? মেরে ফেলেছ তোমরা!

আঁতকে ওঠতে গিয়ে কেঁপে উঠল শামীম। জলদি জলদি দুহাত করজোড় করে আতঙ্কিত সুরে বলল, 

  - না না, বেঁচে আছে তো, মেয়েটা বেঁচে আছে। আপনি ডাকেন, ও উঠবে। ওস্তাদ শুধু সামান্য কয়টা চড় মেরেছে . . উনি আর কিছু করেনি। 

আতঙ্কিত শামীমের দিকে চেয়ে মেঝেতে ঝুঁকে বসলো লোকটা। যেমন বুক কাঁপানো স্বরে শামীমকে কাঁপিয়ে দিয়েছিল, তার চেয়ে কয়েক স্কেল নীচুতে কণ্ঠ নামিয়ে ডাকল, 

  - শুনতে পাচ্ছেন? মিস শুনতে পেলে চোখ খুলুন। চোখ খোলার চেষ্টা করুন! তাকান আপনি!

সারামুখ এলোচুলে ঢেকে আছে মেয়েটার। শামীম দেখল, লোকটা একটু একটু করে মেয়েটার মুখ থেকে সবকটা চুল সরিয়ে দিল। হালকা করে গালটা ধরে কী যেন অপলক দৃষ্টিতে দেখল। বোধহয় গালের ওই ফুলে ওঠা করুণ দুর্দশা লোকটার চোখ এড়ায়নি। কিন্তু শামীম কল্পনাও করতে পারেনি ওইটুকু দৃশ্য দেখে কী তাণ্ডব চালাবে এই লোক! হঠাৎই লোকটা বসা থেকে দাঁড়িয়ে শামীমের খুব কাছে চলে এল। সম্পূর্ণ অন্য মেজাজী সত্তায় একদম হালকা কণ্ঠে শুধাল, 

  - কবার গালটায় আঘাত করা হয়েছে? 

প্রশ্নকর্তার ঠাণ্ডা সুরে শামীম কেমন ভ্যাবাচ্যাকা খেয়ে যায়। বোকা বোকা দৃষ্টিতে একবার মেয়েটার দিকে তাকাল, পরক্ষণে দৃষ্টি ফিরিয়ে চাইল লোকটার দিকে। কী যেন একটা বুঝতে গিয়েও খানিকটা জড়তা নিয়ে বলল, 

  - দু-দু-দুই গালে আটবার। মানে, একনাগাড়ে আটবার। 

  - তক্তা দিয়ে কিছু করা হয়েছে?  

কিছুক্ষণ ভাবনার মধ্যে পরে আস্তে করে বলল, 

  - না না, তক্তা দিয়া মারে নাই। উনারে ধইরা আইনা এই ঘরে বন্দি কইরা রাখছে। বাইরে রাস্তা সাফ হইলে হেরপর নিয়া যাইতো গা। 

কথার টানে আবারও আঞ্চলিক ভাষাটা চলে এসেছে শামীমের। বেচারা বুঝতেই পারেনি, হঠাৎ লোকটার উপস্থিতি দেখে তার মস্তিষ্ক চট করে শুদ্ধ ভাষায় বলে ফেলেছিল। লোকটা হঠাৎ আরো এক কদম এগিয়ে এসে শামীমের নিকটবর্তী হলো। শামীম ভ্রুঁ কোঁচকে কিছু বুঝে ওঠার আগেই লোকটা আচমকা মুখ চেপে ধরে! রন্ধ্রে রন্ধ্রে টের পায় কিছু একটা অনর্থ ঘটবে! আর হলোও তাই! নড়চড় করার নূন্যতম সেকেণ্ডটাও না দিয়ে খচ্ করে আওয়াজটা হল! অভূত বিস্ময় নিয়ে থমকে গেল শামীম। ঘোলাটে চোখ হয়ে গেল স্থির। গলা ফাঁক হয়ে তখনই মৃত। মেঝেতে আস্তে করে নামিয়ে অন্যদিকে ছুটল লোকটা। তড়িৎগতিতে মেয়েটার মাথা ডানহাতে তুলে ডাকতে লাগল সে,  

  - মিস, চোখ খুলুন! আপনি আমার কথা শুনতে পাচ্ছেন? শুনতে পেলে চোখ খুলুন। 

দূর থেকে পায়ের শব্দ ভেসে আসছে। বোধহয় কেউ এখানেই এগিয়ে আসছে। দ্রুত লোকটা মেয়েটার গাল ধরে ঝাঁকাতে লাগল, কণ্ঠস্বর খাদে নামিয়ে ডাকতে লাগল সে। এমন সময় বন্ধ দুচোখের পাতা মেলে নিভু নিভু চাইল শাওলিন। শারীরিক দুর্বলতায় সামান্য অচেতন হয়েছিল সে। মুখের উপর কালো হুডি পরা কাউকে দেখে শিউরে উঠতে যাচ্ছিল, কিন্তু তখনই লোকটা একনিঃশ্বাসে বলে উঠল ওকে, 

  - কথা বলবেন না। উঠে পড়ুন। আমি শোয়েব। আপনাকে উদ্ধার করতে এসেছি। উঠুন। 

মাথা তুলে শোয়া থেকে দাঁড় করাল শোয়েব। চর্তুদিকে একবার নজর বুলিয়ে তৎক্ষণাৎ জানালার পথে এগোল সে। শাওলিন দেখতে পেল জানালা বাইরে একটা মই। মইটা খুব সাবধানে একদম নীচ পর্যন্ত দাঁড় করানো। মাথাটা একবার জানালার বাইরে, পরক্ষণে হুডি পরা লোকটার দিকে ফেরাল। ঢোক গিলে কিছু বলতে উদ্যত হবে, তার আগেই লোকটা তাড়া দিয়ে বলল, 

  - এখন প্রশ্ন নয়। আগে নামুন। এখানে এক সেকেণ্ড দেরি করা সম্ভব নয়। 

মাথাটা 'হ্যাঁ' বোধকে নাড়িয়ে তখুনি মই ধরে নামতে থাকে শাওলিন। মাথাটা টলছে, হাতদুটো খুব কাঁপছে। তবু প্রাণ বাঁচাবার দৈবগুণে শেষপর্যন্ত নীচে নামল সে। উপরে থাকা শোয়েব নিজেও তখন ত্রস্তহাতে নামতে যাচ্ছিল। কিন্তু ঘরের দরজাটা হাঁট করে খুলে যাওয়ায় তাকে দেখে ফেলে মোছলেম। দু সেকেণ্ড সম্পূর্ণ স্থির! অবস্থা বেগতিক বুঝে ঝড়ের গতিতে নামতে লাগল শোয়েব। ধাপ্ ধাপ্ করে কাঠের মইতে শব্দ তুলে ঝাপ দিয়ে মাটিতে পড়ল। অন্যদিকে হই হই করে এক জটলা অস্ত্রধারী ছুটে আসছে। শব্দটা সুলক্ষণ নয়! শোয়েব কোনোমতে শাওলিনের ডান কবজিটা বজ্রমুষ্টিতে আঁকড়ে উর্ধ্বশ্বাসে দৌড় লাগাল। রাতের আঁধার তেড়েফুঁড়ে জঙ্গলের মধ্য দিয়ে শাঁই শাঁই করে ছুটল শোয়েব। ডানহাতের ভেতর মজবুত বলে সরু কবজিটা ধরে রেখেছে। যেন সামান্য একটু ঢিল দিলেই হাতটা ফসকে ছুটে যাবে! বন বাঁদাড় মাড়িয়ে শন শন শব্দে কতক্ষণ ওভাবে দৌড়েছিল তা আর জানা নেই, হঠাৎ বজ্রমুষ্টিতে টান পরায় সতর্ক হলো। দৌড়ের একফাঁকে মাথাটা পিছু ঘুরিয়েছিল শোয়েব। এরপর আচমকাই গতি থামিয়ে মেয়েটার দিকে শুধাল, 

  - ঠিক আছেন আপনি? 

প্রশ্ন শুনে মাথা উপরে তুলল শাওলিন। দম ফুরিয়ে ঠোঁটদুটো গোল হয়ে গেছে। ক্রমাগত অক্সিজেন টানতে ভীষণ পরিশ্রান্ত গলায় বলল, 

  - আর পারব না . . আমি দুঃখিত। 

একটু থেমে আবারও দম নিল শাওলিন। গলাটা ঢোকে ভিজিয়ে ধীরে ধীরে বলল, 

  - নিঃশ্বাস পারছি না। পাদুটো ছিঁড়ে আসছে। আপনার দৌড়ের সঙ্গে তাল মেলাতে অক্ষম। 

বলতে বলতে মাথা নীচু করে দম নিল ও। সমস্ত শরীর থরথর করে কাঁপছে। এতোক্ষণ দেহের শেষ তলানিতে থাকা জোরটুকু দিয়ে দৌড়েছে, তবে আর নয়। আর পারছে না। মনোবল যত দৃঢ়ই হোক, এই শরীরে কুলোচ্ছে না। মাটিতে প্রায় বসে পরতে চাচ্ছিল ও। কিন্তু লোকটার বজ্রমুঠো ওকে ভেজা স্যাতস্যাতে মাটিতে বসতে দিল না। লোকটা ওর হাত তেমনি অধিকারসুলভ ধরে মার্জিত গলায় বলল, 

  - কষ্ট হচ্ছে জানি। কষ্টটা সহ্য করুন। জায়গাটা শিশিরে ভেজা। পাদুটো আরো ক'কদম চালিয়ে ওদিকটায় আসুন।

আধো অন্ধকারে একদিকে তর্জনী দেখাল শোয়েব। পরিশ্রান্ত দৃষ্টিতে ভালো দেখল না শাওলিন। তবু লোকটার প্রতি ভরসা রেখে শেষ চেষ্টাটুকু করল।


ভুবন ভুলানো প্রকৃতি ঠাণ্ডা হয়ে এসেছে। চারিদিকে ছড়িয়েছে রূপোলি ছটা। রাতের আঁধার চিড়ে ফুঁড়ে ফটফট করছে তরল জোৎস্নায়। বাঁশবনে ঝিরঝির পাতার শব্দ, দূরে ঝিঁঝি পোকার ডাক, সমুখে ছলাৎ চলাৎ পানির ঢেউ ভাঙা সুর, দূরে কোথায় যেন ডাকছে নিশি কাক। শুকনো গাছের উপর পা ছড়িয়ে বসে আছে মেয়েটি। ভীষণ হাঁপড়ের মতো শ্বাসটুকু টানছে। অশ্বত্থ বৃক্ষের তলায় শরীর ছেড়ে পিঠ ও মাথা হেলে রেখেছে। মেয়েটার কাছে যক্ষের ধনের মতো একটি টোটব্যাগ আছে। ব্যাগটা বুদ্ধি করে কোমরের একপাশে বেঁধে রেখেছিল। যেমনটা শীতের সময় পরনের সোয়েটারটা খুলে কোমরে বেঁধে রাখে। ওয়াকি-টকি সেটে উদ্ধারের তথ্যটুকু জানিয়ে ফিরে আসে শোয়েব। কাছাকাছি খানিকটা দূরত্বে সেও বসে পড়ে। দুজনের ভেতর কোনো কথা নেই। কেউ কারোর দিকে তাকাচ্ছে না। একজনের চোখ ব্যথায় বোজা, অন্যজন দূর আকাশের পানে স্থির। ব্যথাতুর মানুষটি চোখ মেলে দূরের লোকটাকে খানিক দেখল। একবুক চাপা হতাশা থেকে শূন্য গলায় বলল, 

  - একটা দলে সাতজন মানুষ। তাদের ভেতর পাঁচজন মানুষ সুস্থ। একজন নিখোঁজ, অন্যজন চোখের সামনে জলজ্যান্ত। সেই পাঁচজন জলজ্যান্ত মানুষটাকে ছেড়ে চলে যাচ্ছে। আমি এই দৃশ্যটা হয়তো আমৃত্যু ভুলতে পারব না। 

আকাশ থেকে দৃষ্টি সরিয়ে পিছু তাকাল সে। কালো হুডির কারণে মুখ স্পষ্ট নয়। একপলক নিরুত্তাপ চোখে চেয়ে খানিকটা স্বান্তনার স্বরে বলল, 

  - কিছু দৃশ্য আপনাকে শেখাবে, কিছু দৃশ্য বোঝাবে কষ্ট। আপনার এখানে বুঝে নিতে হবে কোনটা আপনার জন্য যোগ্য। মন খারাপ করবেন না। কিছুক্ষণ শান্ত মনে বসুন। নিজেকে রিল্যাক্স করুন।

লোকটার কথায় কিছুক্ষণ চুপ রইল শাওলিন। গাছের গায়ে মাথা এলিয়ে তাকিয়ে রইল। ওর ওই নির্বাক চাহনি দেখে শোয়েব কিছুই বলতে পারল না। শুধু বুঝতে পারল ওই বড় বড় মায়াবী চোখদুটোতে বিষাদ ছাপা। বিষাদে মাখামাখি হয়ে সরল মুখটা পাণ্ডুর হয়ে গেছে। এখনো ঘন ঘন করে লম্বা দম টানচে, হাঁপানোর টানটা এখনো কমেনি। খুব কী বেশি দৌড়ে ফেলেছে? গতিটা কী বেশি ছিল? ঠিক তখনই শোয়েব দেখতে পেল মেয়েটার পা রক্তাক্ত। পায়ে কোনো জুতা নেই। জঙ্গলের জঘণ্য পথটা ওভাবেই ছুটে এসেছে। অথচ, একবারও বলেনি আপনার পায়ে বুট, আমার পা খালি। চোখ তুলে ওই ব্যথাতুর মুখে তাকাল শোয়েব। হাঁটু গেড়ে এই প্রথম কোনো নারীর সমুখে নিজেকে সমর্পণ করল। পাদুটো নিজের কোলে তুলে নেয় শোয়েব। মাথা থেকে ডানহাতে হুডিটা নামিয়ে শাওলিনের পানে চাইল। পায়ে উষ্ণ হাতের স্পর্শ পেয়ে দৃষ্টি ছুঁড়ে তাকিয়েছে শাওলিন। সহসা বৈদ্যুতিক শক লাগার মতো সমস্ত শরীর ঝিমঝিম করে উঠল! বুকের ভেতর প্রচণ্ড জোরে ধ্বক্ ধ্বক্ করছে ওর। গলার কাছে কাঁটার মতো বিঁধে ঢোক গিলতে পারল না। ঠিক তখনই কানে শুনতে পেল লোকটার ভরাট-স্বর, 

  - ইয়ং লেডি, পাশের টোটব্যাগটা টাচ করতে পারি? একটা ন্যাপকিন প্রয়োজন। এটা এখুনি ক্লিন করা দরকার। 

খট করে কানে 'ইয়ং লেডি' সম্বোধনটা বাজল ওর। সুতীব্র ঝংকারের মতো ঝনঝন করে উঠল! শাওলিন কেমন একটা অবস্থার ভেতর পড়ে গেল, তা নিজেও ঠাহর করতে পারল না। শুধু বুঝতে পারল, হেলিপ্যাড থেকে এই লোকটাকেই দেখেছে। এই লোকটাই তবে সাক্ষাৎ মৃত্যুকূপ থেকে উদ্ধার করেছে! কী অদ্ভুত, কী ভয়ংকর অদ্ভুত . . ! 
.
.
.
চলবে.....................................................

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন