অতিথি নিবাস - পর্ব ২৭ - তানজিল মীম - ধারাবাহিক গল্প


পরন্ত এক বিকেল বেলা। জানালার কার্ণিশ ছুঁইয়ে হুড়মুড়িয়ে ঢুকছে বাতাস। বাতাসের শীতল ধাক্কায় অরিনের গাঁ শিউরে উঠছে। সে বসে আছে বিছানার মধ্যিখানে। চোখের সামনে ল্যাপটপের স্কিনে ভাসছে এক মহিলার কথোপকথনের ভিডিও। ভিডিওটা মূলত কিভাবে একজন বাকশক্তিহীন মানুষের সাথে হাতের ইশারায় বা ইশারার ভাষায় কথা বলা যায় তার কলাকৌশল শেখানো হচ্ছে। অরিন খুব আগ্রহ নিয়ে সেই ভিডিও দেখছে। এই ভিডিও দেখার একমাত্র কারণ হলো শান্ত। অরিন চাচ্ছে নেক্সট টাইম যখন শান্তর সাথে তার কথোপকথন হবে তখন যেন সে মোবাইল মেসেজ নয় হাত ইশারার ভাষায় কথা বলতে পারে। অরিনের সাথে প্রায় সময়ই শান্তর কথা হয়। মানুষটা চমৎকার একজন মানুষ। একটু সাহিত্যক সাহিত্যক ব্যাপার আছে। কথা বলার সময় এমন সুন্দর আর সাবলীল ভাষায় বলে যে পড়তে বেশ লাগে। অরিনের তো মাঝে মাঝে বড্ড ইচ্ছে হয় শান্তর কণ্ঠখানা শোনার। না জানি শান্ত কথা বলতে জানলে কতটা সুন্দর শোনাত সেই কণ্ঠ।

অরিন নিরাশ মনে বসে রইল। ভিডিও অফ করে মোবাইলটা হাতে নিল। অরিনের ফেসবুক একাউন্টের নাম আরিহা সিকদার। অরিনের স্কুল কলেজের নাম ওইটাই তবে ডাকনাম অরিন। অরিন ভীষণ আগ্রহ নিয়ে মেসেঞ্জারে ঢুকল। প্রতিদিনের মতো আজও চেক করল হাসান মাহবুবের আইডিটা। সেই বিয়ের আসরে লোকটা একটা আকস্মিক রিপ্লাই দিয়েছিল, 
 “লেখককে খুঁজতে হলে, জানতে হবে। পেতে হলে বুঝতে হবে।”

ব্যস এরপর আর খবর নেই। অরিনের মেসেজের রিপ্লাইটাও সে করেনি। অরিনের প্রথম ক'দিন বড্ড মন খারাপ হয়েছিল কিন্তু এখন আর ভাবে না। হাসান মাহবুবকে অরিন পছন্দ করে। লেখক হিসেবে পছন্দ করে, তাকে দেখতে চায়, খুঁজতে চায়, জানতে চায়, কথা বলতে চায়। পেতে চায় কি? শেষটার উত্তরটা জানা গেল না। অরিন বেশক্ষণ ভাবল সে কি লেখককে চায়, না অরিন লেখককে চায় না। অন্য কাউকে চায়। অরিনের হঠাৎ মনে হলো সেই অন্যকেউটা বোধহয় শান্ত! সঙ্গে সঙ্গে বিষম খেল সে। এ কি আকস্মিক ভাবনা!

•••••••••••

দিনগুলো সব কেমন যেন চলে যায়। আরহানের অসুস্থতার পর দেখতে দেখতে কেটে গেল একটি মাস। আরহান তার আর.জে শোতে যাচ্ছে না প্রায় দশদিন। কারণ আরহান ঢাকাতে নেই। সে গেছে তাদের দেশের বাড়ি বা নিজের বাড়ি চাঁদপুরে। আরহান গ্রাম বাংলার সন্তান। সে শহরে থাকছে বেশ কয়েক বছর ধরে। তার সাথে তৌহিদের পরিচয় হয়েছিল ম্যাচে বসে। তৌহিদ আর্থিক দিক থেকে শুরু থেকেই বেশ সচল। শান্তর সাথেও পরিচয় হয় ম্যাচে বসে। শান্ত তাদের ভার্সিটিতে ছিল না। সে ছিল অন্য ইউনিভার্সিটির স্টুডেন্ট। তারা তিনজনই অত্যন্ত মেধাবী ছাত্র। শান্তর ছিল বাংলা সাহিত্যের ওপর ভীষণ দূর্বলতা। তার জন্যই তো আজ সে এতবড় লেখক। তৌহিদের বাবার নাম আবদুল আজিজ। তার ইচ্ছে ছিল ছেলে পড়াশোনা শেষ করে তার ব্যবসায় হাত দিবে। কিন্তু তৌহিদ সে ছোট বেলা থেকেই সাদামাটা জীবন-যাপন করতে পছন্দ করে। তার বাবা কখনোই চায়নি ছেলে শিক্ষকতা করুক। এ নিয়ে বাপ-ছেলের মাঝে দ্বন্দ্বও চলছে। এই দ্বন্দ্বের জন্যই ঢাকায় তৌহিদদের বিশাল বাড়ি থাকতেও সে অতিথি নিবাসে ভাড়ায় থাকছে। ম্যাচে থাকাটা ছিল শখ। কিন্তু এই শখ এখন অভ্যাসে পরিণত হয়ে গেছে। যেদিন থেকে তিন বন্ধুর ব্যাচেলার জীবন শুরু হয় সেদিন থেকেই জীবনটা কেমন যেন একটি প্রাণে আটকে নেই। জীবন আটকেছে তিনটি প্রাণের মাঝে। কতগুলো বছর পেরিয়ে গেল শান্ত, তৌহিদ আর আরহান একসাথে আছে। হাসি, দুঃখ, আনন্দ সব একসাথে কাটিয়েছে। কিন্তু এ জীবন আর কতকাল। সময় তো বড় দূর্লভ। এ ব্যাথা দিবেই। তাদের নিজ নিজ সংসার গড়ার সময় হয়ে গেছে। ব্যাচেলার জীবন থেকেও ইতি টানার সময় ঘনিয়ে এসেছে। তৌহিদের মা নেই। আরহান মধ্যবিত্ত পরিবারের সন্তান। গ্রামে তার বাবার ছোট্ট একটা দোকান ছিল। কিন্তু এখন তারাও বেশ উচ্চবিত্ত পরিবারের একজন হয়েছে। আরহান আরজে শো করছে প্রায় দুবছর। তার কণ্ঠের জন্যই আর মানুষের সাথে মিশতে পারার বিশেষ গুনটাই তাকে আরজে বানিয়েছে।

শান্ত সে তো নিরিবিলি মানুষ। তার জীবনে আছে মা। বাবা তার জন্মের দু'মাস আগেই মারা গেছেন। তার জীবন জুড়ে ছিল শুধু মা। কিন্তু হঠাৎ ভূমিকম্পের মতো তার জীবনে হাজির হলো তৌহিদ আর শান্ত। তাকে বুঝতে শিখল, মানিয়ে নিতে জানল। শান্ত ছোট থেকে তার খামতির জন্য কম মানুষের কথা শোনে নি। তাদের কথা হয়তো বুঝত না কিন্তু মায়ের অশ্রু। আচ্ছা, মানুষ কি নিজে নিজে নিজের খামতি তৈরি করতে পারে। কোন মানুষ চাইবে তার মধ্যে খামতি থাকুক। সে কালো হোক, তার চোখ না থাকুক, হাত না থাকুক, কথা বলতে না পারুক, কানে না শুনুক। এমনটা কি কেউ চায়! চায় না তো। কিন্তু মানুষ তো বুঝতে চায় না। শান্ত আর আজকাল এসব ভাবে না। তার বিশাল পাঠকমহল আছে, সমালোচক আছে, মা আছে আর আছে দুই প্রাণপ্রিয় বন্ধু। আর কি লাগে? জীবনসঙ্গী! ওসব নিয়ে শান্ত কখনোই ভাবে না। কারণ সে জানে, “সব জোনাকি পোঁকারা আঁধার সরাতে পারে না।”

  শান্তদের গ্রামের বাড়ি ময়মনসিংহ। তাদের নিজস্ব বাড়ি আছে। সেই বাড়িতে তার মা থাকে। সঙ্গে আছে তার দাদি। দাদি শান্তকে ভালোবাসলেও তাকে বোঝে না। কথা বুঝতে পারে না বলতেও পারে না। প্রথম প্রথম দুঃখ লাগত এখন আর লাগে না।

•••••••••••••••

দিনটি বুধবার। প্রকৃতি ছুয়ে খানিকটা শীত শীত ভাব। ফাবিহা নীরবে বসে আছে মায়াকুঞ্জের দরজার মুখে। তার অস্থির মন, চোখ জোড়ায় কাউকে দেখতে পাবার তীব্র আকুলতা। আরহানের সাথে ফাবিহার কোনোরূপ সাক্ষাৎ নেই আজকের দিন নিয়ে এগারোদিনের শুরু। ফাবিহা বুঝতেও পারেনি কবে এত বেশি ভালোবেসে ফেলল আরহানকে। ফাবিহা রোজ রাতে কাঁদে। কাঁদার অর্থ সে জানে না। আরহানের অসুস্থতার জন্য প্রথম দশদিন সে ঘর থেকেই বের হয়নি। এর মাঝে মাসুদ 
উদ্দিনও এসে যান। সবশুনে কতবার দেখতে যান আরহানকে। রিনা বেগমও চিন্তিত হন দারুণ। ছেলেটার আচমকা এমন দূর্ঘটনা ঘটে গেল। এরপরের দশদিন আরহান আরজে শো করে। খানিকটা সুস্থ হয় তখন। এরপরই সে গ্রামে চলে যায়। গ্রাম থেকে তার চাচা আসেন তাকে নিতে আরহানও যেতে বাধ্য হয়। আর সেই থেকে আরহানের শূন্যতা ফাবিহাকে কাঁদায়। অদ্ভুতভাবে সে বুঝতে পারে আরহান ছাড়া ফাবিহা থাকতে পারে না। তাই ফাবিহা সিদ্ধান্ত নিয়েছে আরহান ফিরলেই তার মনের কথা আরহানকে বলবে। 'ফাবিহার দিনরাত দুশ্চিন্তায় কাটে আরহান কি তাকে ভালোবাসবে? তাকে বুঝবে। যদি না মানে তখন কি হবে?'

 “আপা এত কি ভাবেন?”
আচমকাই রাহেলার কণ্ঠটা কানে আসতেই চমকে উঠল ফাবিহা। বলল,
 “কই কিছু না তো।”

রাহেলা আয়েশ করে বসল ফাবিহার পাশ দিয়ে। নরম গলায় বলল, “আপা আমি গ্রাম দিয়া আইছি আইজ পাঁচদিন। আপনারে দেহি আপনে হারাদিন মনমরা হইয়া এহানে ওহানে বইয়া থাকেন। ভার্সিটিও যান না। কি হইছে আপা?”

ফাবিহা কিছু সময় চুপ থেকে বলে,
 “তেমন কিছু হয়নি।”

রাহেলা কিছু বলল না। চুপ করে রইল।

হঠাৎই সামনের কালো গেটটা কে যেন খুলল। ফাবিহা অধিম আগ্রহে চেয়ে রইল। কাঙ্ক্ষিত মানুষটা এলো না তো!

•••••••••••••

 নিজের ক্লাস শেষ করে ক্লাসরুম থেকে বেরিয়ে আসলো তৌহিদ। তখনই পিছন থেকে ডাক দিল মোহনা, “স্যার।”

তৌহিদ দাঁড়িয়ে পড়ল। বেশ বিরক্তবোধও করল। কারণ বিগত কয়েকদিন যাবৎ তৌহিদ ক্লাসরুম থেকে বের হলেই মোহনা ডাক দেয়। কিন্তু কাছে এসে কিছু বলে না। কিছু সময় চুপ থেকে জানায়, স্যার কিছু না।' অদ্ভুত না। ইচ্ছে না থাকা সত্ত্বেও তৌহিদ দাঁড়াল। ধাতস্থ কণ্ঠে শুধাল,
 “কি হয়েছে?”
  
মোহনা হেঁটে এগিয়ে আসলো। বলল,
 “কিছু বলার ছিল স্যার।”
 “সে তো রোজই থাকে— বলা তো আর হয়না।”
 “স্যার কথাটা সিরিয়াস।”
 “তো বলছো না কেন?”
 “আপনি যদি রাগ করেন।”

তৌহিদ জোরে শ্বাস ফেলে বলল,
 “আমাকে কি অবুঝ মনে হয় মোহনা?”

মোহনা থমকে গেল। বিস্মিত হলো। তৌহিদ স্যার বুঝে ফেলল না তো তার মনের কথা।

••••••••••••••

 শহরের পাবলিক লাইব্রেরিটা তখন বেশ থমথমে। নীরব। ভীড়হীন। হাতে গোনা মাত্র চারজন বসে। সেই চারজনের ভীড়ে লাইব্রেরির একদম শেষ প্রান্তে চুপচাপ বসে আছে শান্ত। চোখের সামনে 'দূরবীন' নামে একটা বই ঘুরছে। শান্ত চুপচাপ নিঃশব্দে বইটা পড়ছে। এসবের ভিড়ে পাবলিক লাইব্রেরির দরজা খুলে গেল। মেরুন রঙের সেলোয়ার-কামিজ পড়ে সেখানে উপস্থিত হলো অরিন। খানিকটা বিঘ্ন ঘটল। শান্ত বাদে বাকি তিনজনই ঘুরে তাকাল তার দিকে। এরপরই দৃষ্টি সরিয়ে মনোযোগ দিল নিজস্ব কাজে।
.
.
.
চলবে.....................................................................

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন

WhatsApp