প্রাণোদাহ - পর্ব ০৫ - নবনীতা শেখ - ধারাবাহিক গল্প


বসার ঘরে থমথমে মুখে বসে আছে স্মরণ, তার পাশে নক্ষত্র। সামনে নুরনাহার ও তৌহিদ সাহেব। নুরনাহার সহাস্যমুখে জানাতে লাগলেন, এ মাসের দ্বিতীয় শুক্রবারে স্মরণের আকদ। আজ মেয়ে দেখে এসেছেন। মেয়ে মাশাআল্লাহ এত লক্ষ্মী, একদেখায় বিয়ের দিন-ক্ষণ ঠিক করে এসেছেন তিনি। স্মরণের নিশ্চয়ই পছন্দ হবে। এমন লক্ষ্মী মেয়েকে পছন্দ না করলে পাপই হবে।

তৌহিদ সাহেব গম্ভীরমুখে বললেন,
-“পছন্দ হওয়া না-হওয়া ব্যাপার না। একত্রিশ বছরের জীবনে তোমার যেহেতু নিজের কোনো পছন্দ নেই, তার মানে আমরা যাকে বলেছি তাকেই বিয়ে করতে হবে। আমি যখন তোমার বয়সে ছিলাম, তখন তুমি স্কুলে যেতে, তোমার ছোটভাই আমার কোলে পি করে দিত। আর তোমার কপালে নাকি মেয়ে জোটে না!”

স্মরণ হাতের আঙ্গুলগুলো কপালে চালাল। বড়োভাইকে ভীষণ রকমের চিন্তিত দেখে নক্ষত্র খোঁচা মারতে ভুলল না। একটু এগিয়ে এসে ফিসফিসিয়ে বলল,
-“ভাইয়া, দুই সপ্তাহ বেশি হয়ে যায় না? আব্বাকে বলি, নেক্সট উইকেই ডেইট ফেলতে?”

ভস্ম করা চোখে তাকাল স্মরণ, আর তারপর আচমকা শান্ত হয়ে গেল। নক্ষত্রের দিকে তাকিয়ে স্বাভাবিকভাবেই বলল,
-“আব্বাকে বল, তুই বিয়ে করবি।”
-“নো ওয়ে।”

নুরনাহার নিজের ফোন এগিয়ে দিয়ে বলল,
-“মেয়ের ছবি দেখ, নাম তো আরও সুন্দর। প্রীতিলতা। সুন্দর না?”

নক্ষত্র কপাল কুঁচকে ফেলল। তাকাল নুরনাহারের হাতের ফোনের দিকে। ঘটনার ঘুটনির দিকে তাকিয়ে নক্ষত্র বোকার মতো হেসে উঠল। আম্মাজান কি আর মেয়ে পেল না? দুনিয়াতে কি মেয়ের এতই অভাব পড়েছে? কালো/ফরসা, হাই এডুকেটেড, এডাল্ট মেয়ে থেকে শুরু করে গ্রামের চাচাতো বোন, স্কুল পড়ুয়া, বেটে-মোটা কত ধরনেরই তো মেয়ে আছে। সব থুয়ে কেন প্রীতিলতা? কেন? 

নক্ষত্রের উত্তেজিত মস্তিষ্কে প্রশ্নগুলো এলোমেলোভাবে গেঁথে গেল। পরপরই সে হাসি সরিয়ে গম্ভীরমুখে বলল,
-“আম্মু, একটা রিমাইন্ডার দিই। তোমার আরেকটা বিবাহযোগ্য ছেলে আছে।”
-“পাগল ছেলে! দুষ্টুমি ছাড়। ভাবি পছন্দের হয়েছে?”

নক্ষত্র দাঁতে দাঁত চেপে হাসল,
-“ভাবির গুষ্টিকিলাই। ও আমার দূরসম্পর্কের বউ।”

কথাটা শুধুই স্মরণ শুনতে পেল, তারপর জিজ্ঞেস করল,
-“তোর একশত আশি ডিগ্রি এঙ্গেলে বেঁকে যাওয়ার ব্যাখ্যা কী?”
-“তাতে তোর কী?”
-“আমি হ্যাঁ বলে দিই? দুই-সপ্তাহ সত্যিই বেশি হয়ে যায়। আব্বাকে বলি, এক সপ্তাহ...”

নক্ষত্র তাকাল স্মরণের দিকে। চোখে অসহায়ত্ব, ঠোঁটে হাসি। পালটা খেলায় সে-ও বলল,
-“আমি নীহম ভাবিকে প্রপোজ করে দিই? আমার মতো হটচকোলেট বয়য়ের পাশে তোমার মতো কুল চাচাকে কেউ গোণায় ধরবে না।”

স্মরণ কেশে উঠল,
-“আম্মা-আব্বা শোনো, আমি এই বিয়েটা করতে পারব না।”

তৌহিদ গম্ভীরমুখে শুধালেন,
-“কেন?”
-“পছন্দ আছে।”
-“যখন জিজ্ঞেস করেছিলাম গার্লফ্রেন্ড আছে নাকি, তখন মানা করেছিলি কেন, হারামজাদা?”
-“আব্বা, গার্লফ্রেন্ড নাই। পছন্দ আছে। একতরফা প্রেম বোঝো না? অমন।”
-“ওইটাও তো বলা যেত।”
-“তো আমি কি জেনে রেখেছি নাকি যে তুমি গলায় মেয়ে ঝুলানোর প্রিপারেশনে আছো?”
-“তো কী করব? আমার সব বন্ধুরা নাতি-পুতি নিয়ে ফেইসবুকে ছবি ছাড়ে। আর আমার অপদার্থগুলা দুইটাই সিঙ্গেল। আমার কপালে কি দাদা ডাক শোনা নাই?”

নক্ষত্র প্রায় চেঁচিয়েই উঠল,
-“আব্বা, আমিও তোমাকে দাদা বানাতে পারব। আমাকে বিয়ে দাও।”

নুরনাহার অবাক হলেন,
-“তোমার বড়োভাই অবিবাহিত, তাকে রেখে তোমাকে বিয়ে দেবো কেন? লোকে কী ভাববে?”
-“তাহলে বিয়ে ক্যান্সেল করো?”
-“তা কীভাবে সম্ভব? কথা-বার্তা বলে এসেছি।”
-“তাহলে ভাইয়াকে নীহম ভাবির সাথে আগে বিয়ে দাও।”
-“নীহম? কে?”
-“ভাইয়ের একতরফা প্রেম।”
-“তাহলে প্রীতিলতা?”
-“আমি আছি।”
-“তুই এখনো ছোট, বাবু।”
-“বউ পালার মতো যথেষ্ট সামর্থ্য আমার আছে। এ মা, দাদি হতে চাও না?”

নুরনাহার ইতিউতি করে বলল,
-“তা চাই.. কিন্তু এখন কীভাবে বলি...”
-“আম্মু-আব্বা শোনো, ভাইয়ার মতো স্লো না আমি।”

স্মরণ হেসে ফেলল নক্ষত্রের এমন বাচ্চামোতে,
-“আম্মা-আব্বা! নক্ষত্র প্রীতিকে পছন্দ করে। আর আমি নীহমকে। এখন এটুকু অন্তত মানা উচিত তোমাদের।”

তৌহিদ সাহেব আর কিছু বললেন না, মাথা নাড়লেন কেবল, 
-“আচ্ছা, নীহমকে নিয়ে আয় একদিন।”

স্মরণের হাসি চেপে এলো, কেশে উঠল সঙ্গে সঙ্গে। এরপর বলল,
-“দেখা যাক।”

কথা-বার্তা শেষ দিয়ে স্মরণ ঘুমানোর জন্য রুমে প্রবেশ করতেই নক্ষত্র ভেতরে ঢুকে পড়ল। স্মরণ ভ্রু উঁচিয়ে শুধাল,
-“কী?”

নক্ষত্র ভাবলেশহীনভাবে বলল,
-“সিগারেট হবে?”

স্মরণ ড্রয়ার থেকে প্যাকেট ছুঁড়ে মারল নক্ষত্রের দিকে। নক্ষত্র তা নিয়ে বারান্দায় চলে গেল। স্মরণ লাইটার নিয়ে এসে ওখান থেকে একটা সিগারেট ধরাল, এরপর নক্ষত্রও। 

স্মরণ বলা শুরু করল,
-“নিজের স্টুডেন্টকে পছন্দ করা... কেমন একটা ব্যাপার, না?”

নক্ষত্র দেয়ালে হেলান দিয়ে হেসে ফেলল,
-“কোনো ব্যাপারই না। প্রীতিও আমারই স্টুডেন্ট।”
-“তোর গিল্ট হচ্ছে না?” 
-“একদমই না। ইটস টোটালি ফাইন দ্যাট আই অ্যাডমায়ার হার। স্টুডেন্ট বলে কি ও মেয়ে না? টিচার বলে কি আমি পুরুষ মানুষ না?”
-“এক গোয়ালের দুই গোরু টাইপের ফিল পেলাম তোর কথায়। যাই হোক, তোর কাহিনি বল। রিলেশন কতদিনের।”

নক্ষত্র হেসে উঠল,
-“রিলেশনে নেই।”
-“তবে?”
-“পছন্দ করি।”
-“আর ও?”
-“ও-ও পছন্দ করে।”
-“তবে রিলেশন?”

স্মরণ অবাক হচ্ছে, যার দরুণ ভ্রু কুঁচকে আছে। নক্ষত্র বেশ রহস্যময় হাসল,
-“সে আমাকে পছন্দ করে এটা আমি জানলেও, আমিও যে তাকে পছন্দ করি—এটা সে জানে না। সে তো এটাও জানে না যে, আমি কী জানি...”

__________

স্মরণের ফুপাতো বোন রিফা তাকে আর প্রীতিকে ট্যাগ করে ফেইসবুকে ছবি আপলোড করেছে। আসার সময় প্রীতির কাছ থেকে ওর ফেইসবুক একাউন্ট নিয়ে এসেছিল। এরপর এই যা-তা। স্মরণ এখনো দেখেনি। তার আগেই নীহম দেখে ফেলল। ঘাড় কাত করে তাকিয়ে রইল কিছুক্ষণ প্রীতিলতার দিকে। নীহমের চোখ-মুখে নৈরপেক্ষ্য ও চাহনিতে হিংস্রতা লক্ষনীয়। 

সে দ্রুততার সাথে এই প্রীতিলতার প্রোফাইলে ঢুকল। ম্যাসেজ রিকোয়েস্ট পাঠাল একটা, 
-"If you think about marrying my man, I'll cut you into pieces."
 
প্রীতি সঙ্গে সঙ্গে রিপ্লাই লিখল,
-“স্মরণের গার্লফ্রেন্ড?”

নীহম “ইয়েস” লিখে ফোন রেখে দিলো। পাশ থেকে আলফাজ আচমকা ডেকে উঠলেন,
-“আমার মায়ের মেজাজটা ঠিক লাগছে না! কী হয়েছে?”

 নীহম বাবার বাসায় বেড়াতে এসেছে। এমতাবস্থায় এ কী অনর্থ হয়ে গেল তার! লোকটাকে দু'দিন চোখের আড়াল করেছে কি করেনি, ওমনিই বেঁকে গেল? নীহম ভ্রু কুঁচকে সামনে তাকিয়ে রইল। চিন্তিত সুরে বলল,
-“বাবা, আমি যদি তোমাকে বলি—আমি এখন বিয়ে করতে চাই?”

ক্ষণিকের জন্য থমকালেন আলফাজ৷ পরপর হেসে উঠলেন,
-“বিয়ে করতে চাওয়া ভালো কথা। পৃথিবীর সবচেয়ে সুন্দর কাজগুলোর একটা হচ্ছে বিয়ে করা।”
-“কিন্তু বিয়ে করতে ইচ্ছে করে না।”
-“তাহলে কোরো না।”
-“আমি ওকে পছন্দ করি।”
-“তাহলে বিয়ে করো।”
-“যদি বিয়ের পর নিয়মমাফিক ভালোবাসা মরে যায়?”
-“তাহলে কোরো না।”
-“আমার ধারণা, আমার ওয়ান সাইডেড লাভ সম্পর্ক টিকিয়ে রাখতে যথেষ্ট...”
-“তাহলে বিয়ে করো।”
-“যদি ডিভোর্সের প্রসঙ্গ আসে কোনোদিন?”

নীহম তাকাল বাবার দিকে। আলফাজ না হেসে পারলেন না,
-“আমার আফরাহ্‌, শোনো! রিস্ক তো লাইফেও থাকে। তাই বলে কি আমরা দুনিয়াতে আসি না?”
-“মা তোমাকে মিস করে, বাবা।”
-“তাই নাকি?”
-“হ্যাঁ, বাবা।”

আলফাজ চায়ের কাপে চুমুক দিয়ে বললেন,
-“আমিও করি।”
-“একটা বারো বছরের বন্ধুত্ব, সাড়ে চার বছরের প্রেম যখন ইউনিভার্সিটির শুরুতে এসেই বিয়েতে রূপ নেয়। বিয়ের সাড়ে সাত বছর পর তারা কী করে ডিভোর্সে আসে? ভালোবাসা বাদই দিলাম, মায়া কাটানো কি এতই সহজ?”
-“আফরাহ্‌, ইমোশনাল হয়ো না। আমরা যা কখনো ভাবতেও পারি না, লাইফ আমাদের আচমকা অমন এক সিচুয়েশন ফেইস করাবে। অ্যান্ড দ্য ইন্টারেস্টিং ফ্যাক্ট ইজ, আমরা অনায়াসে তা কাটিয়ে উঠব।”

নীহম দীর্ঘশ্বাস ফেলল,
-“এবার আমাকে বলো। বিয়েটা কি করব?”
-“সম্পর্কের কতদিন?”
-“সম্পর্ক? ইয়াক ছি, না!”

অবাক হলেন আলফাজ,
-“তবে কী?”
-“পছন্দ করি।”
-“আর সে?”
-“পছন্দ করে।”
-“মিউচুয়াল না?”
-“না। সে আমাকে পছন্দ করে এটা আমি জানি। কিন্তু আমিও যে তাকে পছন্দ করি, এটা সে জানে না।”

নীহম এখানে এসে চোখে হাসল,
-“সে তো এটাও জানে না যে, আমি জানি—সে আমাকে পছন্দ করে।”
.
.
.
চলবে...........................................................

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন