শাহজাহান তন্ময় - পর্ব ৭৩ - নাবিলা ইষ্ক - ধারাবাহিক গল্প


মোস্তফা সাহেবের হাতে বড়ো-বড়ো চারটে বোয়ালমাছ।
জ্যান্ত বোয়ালমাছ চারটা নড়চড় করছে এখনো। জীবন্ত মাছগুলোর দিকে ক্ষণে ক্ষণে তাকাচ্ছেন ভদ্রলোক। যত দেখছেন তত তার মুখের হাসির রেখা দীর্ঘ হয়ে চলেছে। এমন বড়ো চারটা মাছ কীভাবে আনল ছেলে-মেয়ে গুলো কে জানে! মোস্তফা সাহেব উৎসাহিত কদমে এগুচ্ছেন রান্নাঘরের দিকে। লিভিংরুমে তার কাছের কিছু বন্ধুবান্ধব বসেছে। আনোয়ার সাহেব সিঁড়ি ধরে নামছিলেন। হাতে কদমফুলের টব। অরু কিছুক্ষণ আগেই আদেশ ছুঁড়ে গিয়েছে বাবার উদ্দেশ্যে—অতি দ্রুত যেন টবটা তাকে এনে দেয়া হয়। আনোয়ার সাহেব মেয়ের বাধ্য বাবা বলে কথা। টব আনতে গিয়েছিলেন ছাঁদে। এবেলায় বড়ো ভাইয়ের হাতটা কাছাকাছিভাবে লক্ষ্য করে আশ্চর্য হলেন। অবাক স্বরে শুধিয়ে বসলেন,

‘ভাইয়া, মাছ কোথা থেকে আনলেন?’

এই প্রশ্ন শোনার জন্যই অপেক্ষায় ছিলেন মোস্তফা সাহেব। বাগান পেরিয়ে যখন ফিরছিলেন মাছ নিয়ে বারংবার মাছগুলো সবার নজরে আনার চেষ্টা করেছিলেন। কিন্তু আশ্চর্যজনক ভাবে একটা কেউ জিজ্ঞাসাবাদ চালাল না। জিজ্ঞেস করলেই তো তিনি বলতেন মাছগুলো কে এনেছে, কেন এনেছে! কাঙ্ক্ষিত প্রশ্নের সম্মুখে পড়ে আপ্লুত তিনি বোয়ালমাছ চারটে ঝটপট নাড়িয়ে-চাড়িয়ে ছোটো ভাইকে ভালোভাবে দেখালেন। যেন হাতে মাছ নয়, আন্তর্জাতিক ডায়মন্ড ধরে রেখেছেন।

‘দেখ কেমন টাটকা বোয়ালমাছ! মাছের রঙটাই বলে দিচ্ছে একদম পরিষ্কার মাছ। এতে ভ্যাজাল নেই।’

আনোয়ার সাহেব বড়ো ভাইয়ের উজ্জ্বল মুখ খানা দেখে হাসলেন। মাছগুলো ভালোভাবে দেখে পণ্ডিতের মতন জেনেবুঝেই জানতে চাইলেন আগ্রহী কণ্ঠে,

‘তন্ময় এনেছে নিশ্চয়ই?’

মোস্তফা সাহেব গর্বিত স্বরে জানালেন,

‘তন্ময় ওর বন্ধুদের বলেছে আমার পছন্দের মাছের কথা। ওর বন্ধুরাও কী লক্ষ্মী দেখ! নিয়ে এসেছে কেমন।’

তন্ময় এসে দাঁড়িয়েছে দোরগোড়াতেই। ইতোমধ্যে মোস্তফা সাহেবের কিছু সংখ্যক বন্ধুবান্ধব এসে মাছ চারটে আহ্লাদী দৃষ্টিতে পর্যবেক্ষণ করছেন। মোস্তফা সাহেবও ধরে ধরে দেখাচ্ছেন। তন্ময় হতবিহ্বল না হয়ে পারল না। দীর্ঘশ্বাস ফেলল। এতো ছোটো বিষয়ে এতোটা ডেস্পারেট হলে হয়? বাবার হাস্যোজ্জ্বল মুখ দেখে তন্ময় আর ঢুকল না ভেতরে। কিচ্ছুটি বললও না। বাগানের দিকেই ফিরে এলো। এমন নয় যে মোস্তফা সাহেব এমন বড়ো জ্যান্ত বোয়ালমাছ আশেপাশে পাবেন না! বা নিজে গিয়ে কিনতে পারছেন না খেতে পারছেন না! গতকালও ছোটো বোয়ালমাছ রাঁধা হয়েছিল। কিন্তু ছেলে তার খুব করে বন্ধুদের দিয়ে বলে-কয়ে আনিয়েছে মাছ চারটা —এটাই যেন ভদ্রলোকের গর্বের কারণ। আনন্দের উৎস। তন্ময় একটা সাধারণ চাদর এনে দিলেও তার গর্বের ত্রুটি রয় না। বন্ধুর সাধারণ মজার ছলাকলামূলক অসদাচরণ কাণ্ডে যে তার বাবা এতোটা খুশি হবে তন্ময় বুঝতে পারেনি। উত্তরদিকের এক কোণেতে তার বন্ধুরা বসেছে। ওরা সবসময় আলাদা থাকতে পছন্দ করে। অন্যদের হট্টগোল শুনতে পছন্দ না করলেও—নিজেদের চ্যাঁচামেচি শোনাতে বেশ ভালোবাসে। তবে তাদের বাড়িতে এলে এরা একটু ভদ্রসভ্য হয়ে থাকে। চাপাস্বরে ভাঁওতাবাজি ছাড়া তেমন কিছুই করে না। মাহিন কিছু একটা নিয়ে অন্যমনস্ক বোধহয়। আনমনা বসে আছে। বন্ধুদের কথায় মাথা নাড়াচ্ছে বা দোলাচ্ছে। কোথাও একটা বারবার তাকাচ্ছে। লুকিয়ে একটা সিগারেটও ধরিয়েছে। সিগারেট ধরা হাতটা চেয়ারের পেছনে লুকোনো। তন্ময় লক্ষ্য করে মাহিনের পাশের চেয়ারটাতেই এসে বসল। পায়ের ওপর পা তুলতে নিয়ে চাইল সামনে। অরু শাবিহার গালে হলুদ মাখাতে ব্যস্ত। দুলে দুলে কেমন হাসছে মেয়েটা। ওর নিজের দু'গালেও আচ্ছারকমের হলুদ লাগানো। মাহিন তন্ময়ের দিকে আড়চোখে চেয়ে সিগারেট এগিয়ে দেয়ার ভাণ ধরল,

‘নে টান দে একটা।’

মাহিন ভালো করেই জানে তন্ময় আপাতত সিগারেট খাবে না। ধরবেও না। চতুর্দিক চেনাপরিচিত মানুষ। সামনেই ওর প্রাণপ্রেয়সী দাঁড়িয়ে। অর্থাৎ প্রশ্নই ওঠে না খাওয়ার। তবে তাকে অবাক করে দিয়ে তন্ময় অলস ভঙ্গিতে সিগারেটটা নিলো। ডান হাতের আঙুলের ভাঁজে চেপে একটু ঘুরে বসল। মাথাটা ডান দিকে ঘুরিয়ে টান দিলো দুটো। নাক-মুখ দিয়ে বেরুল কালো নিকোটিনের ধোঁয়া। রিয়ানের ভ্রু দুটো কপালে উঠে এসেছে। মাহিন কিছুটা বিচলিত হলো,

‘কীরে…মামা! কী হইছে? এখানেই টানতেছস যে! আমিতো ফান পারপোসে সাধলাম।’

তন্ময় হেসে ফেলল। মাহিনে দিকে চেয়ে ঠাট্টার সুরে শুধাল, 

‘তুই যেভাবে বলতেছিস যেমন আমি খাই না।’

রিয়ান দু ভ্রু নাচাল, ‘খাস তো। চৌদ্দবার সাধার পর। তাও বাইরে। আজ বাসাতেই খাচ্ছিস। তাও এক সাধাতেই। আশ্চর্যজনক না? কীরে…ইব্রাহিম তুইই বল।’

ইব্রাহিম তন্ময়ের দিক চেয়ে। তন্ময় দেখছে স্টেজের দিকটা। শুহানিকেও দেখা যাচ্ছে। শাবিহার পাশে বসে আছে। নখে নেইলপলিশ দিয়ে দিচ্ছে বেশ মনোযোগ সহকারে। তন্ময় পাশ ফিরে সিগারেট আরেকবার ঠোঁটের ভাঁজে গুঁজল। সময় নিয়ে মাহিনের দিক তাকিয়ে জানাল,

‘বাবা খুব খুশি। এমন সামান্য ব্যাপারে এতো খুশির কী আছে কে জানে! তোর কী লাগবে বল! আই'ল ট্রায় টু গিভ ইউ দ্যাট!’

রিয়ান শব্দ করে হেসে ফেলল। হাসল ইব্রাহিম, সৈয়দও। ওদের অট্টোহাসি শুনে শুহানিও ছুটে এসেছে ব্যাকুল হয়ে। সামনের চেয়ারে অগোছালো ভাবে বসে জানতে উতলা হলো,

‘কী ব্যাপারে হাসছিস তোরা?’

সৈয়দ মাহিনকে ইশারায় নির্দিষ্ট করে বলল, 

‘মাহিন মজার ছলে চারটা বোয়ালমাছ আনল না? সেই চারটা বোয়ালমাছ তো এক ইমোশনাল ব্যাপারস্যাপার ঘটিয়ে ফেলছে। আংকেল তো খুউব খুশি। তার ছেলে বন্ধুদের বলিয়ে তার পছন্দের মাছ আনিয়েছে বলে কথা!’ 

বলতে বলতে আরেকদফায় হাসল। মাহিন ইতস্ততভাবে ঘাড় চুলকালাল। সে তো এতোটা ভেবেচিন্তে আনেনি। তার মন চাচ্ছিল তন্ময়কে একটু জব্দ করতে। তাই আরকি! উচ্চ আওয়াজে হলুদের গান বাজছে। গান ব্যতীত কিচ্ছুটি শোনা যাচ্ছে না। কথাবার্তা জোরসে বলতে হচ্ছে। মাহিনের হাবভাব খুব একটা সুবিধের ঠেকছে না। বারবার স্টেজের দিকটায় তাকাচ্ছে। ওর ঘনঘন চাহনি খেয়াল করেছে তন্ময় অনেক আগ থেকেই। এবারে সুনিশ্চিত হলো—এই ছেলেটা ডাগরডাগর চোখে অরুর বান্ধবীকেই পর্যবেক্ষণ করছে। অনেকক্ষণ ধরে। মেয়েটার নাম সম্ভবত মারজি। পছন্দ করেছে নাকি? মাহিনের তো অতিরিক্ত বয়সের ব্যবধান পছন্দ ছিলো না। প্রতিনিয়ত নাক সিটকে বেড়াতো। তাহলে? অবশ্য মনের ওপর কখনো মানসিক চিন্তাভাবনা চাপানো সম্ভব হয়ে ওঠে না। মাহিনের ক্ষেত্রে বুঝি তেমনি ঘটতে যাচ্ছে।
মরিচ বাতির আলো এসে পড়েছে তন্ময়ের মুখে। চাপদাড়িটা দারুণভাবে ট্রিম করা। হলদেটে আলোতে স্পষ্ট দেখা গেল তার সন্দিহান প্রশ্নবোধক ডান ভ্রু তোলার ভঙ্গিমা। মাহিন আড়চোখে বন্ধুর মুখে একটিবার তাকিয়ে আর তাকানোর সাহস দেখাল না। তন্ময় নাক-মুখ দিয়ে প্রশ্নাত্মক ধ্বনি তুলল,

‘হুম?’ 

মাহিনের হাপুস নয়নজোড়ার দৃষ্টি দিকভ্রান্ত। তন্ময় প্রত্যুত্তর না পেয়ে ফের একই ধ্বনি তুলল,

‘হুম?’

এযাত্রায় মাহিন থতমত খেয়ে মুখ খুলল, ‘কী?’

তন্ময় ম্লান গলায় বলল, 

‘আমি জিজ্ঞেস করছি তোকে।’
‘তুই না বললি যা ইচ্ছে চাইতে? যা চামু দিবি?’

তন্ময় চোখজোড়া ছোটো ছোটো করে ফেলল,

‘অরুর বান্ধবী কী দেবার জিনিস?’

মাহিন ভোঁতা মুখে বলল, ‘পারমিট? এটা তো দিবি? তোর বউয়ের বান্ধবীকে পটাতে যাচ্ছি বলে কথা!’

তন্ময় আশ্চর্য হলো এমন অযথার্থ লজিক শুনে, ‘মেয়ে তোকে পছন্দ করলে আমার মাথা ব্যথা নেই।’

শুহানি তন্ময়ের কাঁধে গুঁতো দিলো, ‘ওই মেয়েটাও মাহিনকে পছন্দ করে। আম শিয়র! কতবার করে তাকাল।’

রিয়ান আগ্রহপূর্ণ গলায় শুধাল, ‘তুই কীভাবে শিয়র মাহিনকে দেখছে? হতে পারে আমায় দেখছে।’

শুহানি ফুঁসে উঠল। নাক সিটকাল। মুখ ভেঙিয়ে বলল,

‘নিজের চেহারা আয়নায় দেখছিস?’
‘আয়না লাগবে কেনো? তোর চোখেই তো চব্বিশঘণ্টা দেখি। এখনো দেখতে পারতেছি। আনডাউটলি ওয়ার্ল্ড ওয়াইড হ্যান্ডসাম।’

তন্ময় বন্ধুদের ঝগড়া থেকে দৃষ্টি সরাল। সামনেই তাকাল। স্টেজের সামনে অরু নেই। দৃষ্টি ঘোরাল চতুর্দিক ভালো করে। তার বলদিটাকে এখন কোথাও দেখা যাচ্ছে না। মিনিটপাঁচেক আগেও তো দেখেছিল এখানটাতেই। মারজির পাশে বসে উচ্চকণ্ঠে গান গাইছিল। তন্ময় বন্ধুদের রেখে উঠে এলো। মেয়েটা কোথায় গেল! ভেতরে নাকি? ও এতো অবাধ্য! তন্ময়ের একটা কথা যদি ভালোভাবে শোনে। বাড়িতে বেশ অপ্রয়োজনীয় অতিথির আগমন ঘটেছে। চতুর্দিকে অচেনা-অজানা অহরহ মুখ। এসময়ে এই মেয়েটাকে সে একা-একা ছুটতে নিষেধ করেছে। তন্ময় অস্থির অনুভব করে ও চোখের আড়াল হলেই। এতো করে ধমকের সুরে বোঝাল চোখের আড়াল হতে না! কথা শুনল? স্টেজের সামনের ফাঁকা চেয়ারে উঁচু জুতো পেলো। অরুর হিলস! খুলেই গিয়েছে বোধহয়। জুতোজোড়া হাতে নিয়ে বাগানটা একটিবার চক্কর মেরে বাড়ির ভেতরে ঢুকল। মোস্তফা সাহেব একদল লোকজন নিয়ে বৈঠকে বসেছেন লিভিংরুমে। ডিভানে বসে আছেন প্রতিবেশী আজমল সাহেব। তন্ময়কে দেখতে পেয়েই গাল ভরে হাসলেন। ডান হাতের ইশারায় কাছে ডাকলেন। ভদ্রলোকের এই এক বদভ্যাস। আওয়াজ তুলে নয় হাতের ইশারায় ডাকতে পছন্দ করেন। ইশারায় ডাকাটা তার অন্যতম পছন্দের কাজ যেন। তন্ময় ভদ্রলোকের আহ্বানে ভদ্রতাসূচক হাসল। এগুতে নিয়ে চারিপাশে তাকাল নিবিড়ভাবে। অরুকে দেখা গেল না। রান্নাঘরেও না। আনোয়ার সাহেবও কাছাকাছি বসেছেন। তন্ময় সালাম জানিয়ে শুধাল,

‘ভালো আছেন, চাচা?’

ভদ্রলোক আলতোভাবে ধরলেন তন্ময়ের হাত দুটো। আজমল সাহেব তন্ময়কে খুব ভালো পান। স্নেহ করেন। ছোটো থেকে বড়ো হতে দেখেছেন বলেই হয়তোবা। তার চোখদুটোর উজ্জ্বলতাই পরিষ্কার জানায় মনের অব্যক্ত কথাগুলো। গত বছর অবশ্য প্রিয় নাতনির জন্যে সম্বন্ধের আলাপ তুলতে চেয়েছিলেন। তবে মোস্তফা সাহেবের মতিগতি বুঝে পরে চুপও মেরে গিয়েছিলেন। এতে কী আর স্নেহ কমে? ভদ্রলোক বিনয়ী স্বরে বলেন, 

‘ভালোই আছি, বাবা। তোমার বিয়েতে থাকতে পারলে আরও ভালো থাকতাম বলে মনে করছি। তুমি দাওয়াত না দিয়ে বিয়ে করতে পারলা?’

মোস্তফা সাহেব হেসে জবাব দিলেন ছেলের হয়ে, ‘বাচ্চাদের বিয়ে। নিজেরাই করেছে। আনুষ্ঠানিক বিয়েতে তো দাওয়াত পাবি। তোরা না এলে কারা আসবে?’

ভদ্রলোক হাসলেন, ‘ছেলেকে জিজ্ঞেস করেছি। তোকে বলছি জবাব দিতে?’
‘জেনেশুনে জিজ্ঞেস করবি কেনো?’

আজমল সাহেব রাগ করার ভাণ ধরে তন্ময়ের উদ্দেশ্যে বলেন, ‘দ্যাখো বাবা দ্যাখো! তোমার বাবা কীভাবে লাগতেছে আমার সাথে। আমি কী একটু মজা করতে পারি না?’

তন্ময় জবাব দেয় না। তবে মুচকি হাসছে। তাদের ঠুনকো দুষ্টুমি দেখতে ভালোই লাগছে। মোস্তফা সাহেব হালকা কেশে ছেলের দিকে তাকালেন। শুধালেন,

‘কাকে খুঁজছিস?’
‘অরুকে। ওকে ওপরে যেতে দেখেছো? বাগানে তো নেই।’

আনোয়ার সাহেব অসহায় গলায় তখুনি জবাব দিলেন, ‘হ্যাঁ, ওপরে গেল হলুদের ডালা নিয়ে। আমি জিজ্ঞেস করেছিলাম কেন যাচ্ছে এই রাতের বেলাতে ছাদে। বলল ওর নাকি ইম্পরট্যান্ট কাজ আছে। আমাকেও যেতে নিষেধ করে গেল।’

তন্ময়ের ভ্রু'দ্বয়ের মধ্যিখানে কয়েক ভাঁজ পড়ল। সিঁড়ি ধরল ত্বরান্বিত। সে ইতোমধ্যে বুঝতে পেরেছে কেন ও ওপরে গিয়েছে। অন্যদের প্রেমজনিত ব্যাপারস্যাপারে ও এগুবেই। নিশ্চয়ই কথাবার্তা আদানপ্রদান করতে ব্যস্ত বেআক্কেলটা।

———— 

জ্যোৎস্নাময় রাত্রির পূর্ণ চাঁদটা মাথার ঠিক ওপরেই। চাঁদের চতুর্দিক নক্ষত্রের আধিপত্যতা বিরাজমান। ছাদের দরজাটা আধখোলা। ছাদ দুয়ারে দাঁড়াতেই কনকনে ঠান্ডা হাওয়া ছুঁয়ে গেল। সজাগ হয়ে উঠল গায়ের একেকটি পশম। এইমাসে হাওয়ার স্পর্শ হয়ে থাকে দুর্দান্ত শীতল। শীতের তোপ প্রকৃতির হাওয়াই যেন বাড়িয়ে তুলছে কয়েকগুণে। চাঁদের জ্যোৎস্না এসে লুটিয়েছে ছাদের কোণায়-কোণায়। আশেপাশে ঘনঘটা কুয়াশার বেড়াজাল। মোহাচ্ছন্ন এক পরিবেশে—অরু হলুদের ডালা হাতে দাঁড়িয়ে। ঠিক পশ্চিম দিকের প্রাচীর ঘেঁষে। শাড়িটা নড়বড়ে হয়েছে সামান্য। অয়নের অবয়ব অনুধাবন করা যাচ্ছে। ওদের ছাদেই দাঁড়িয়ে ছেলেটা। গুমোট অথচ অসন্তোষ কণ্ঠে শুধিয়েছে,

‘শাবিহা আসেনি, অরু?’

অরুর কণ্ঠে ঝরে পড়ছে বেদনার রস। যেন এহেন কথা বলতে ওর কণ্ঠ রোধ হয়ে আসছে,

‘লিভিংরুমে চাচ্চু, বাবা সহ আরও অনেকেই বসে আছেন। তাই আপু আসতে পারছে না। খুউব লজ্জা পাচ্ছে। তবে আমি হলুদের বাটি নিয়ে এসেছি ভাইয়া। এটা থেকেই আপু হলুদ ব্যবহার করেছে।’

অয়ন মিনমিনে স্বরে আওড়ায়, ‘হলুদ তো ছুতো মাত্র! যাকে আসতে বললাম তার তো কোনো খবর নেই।’

অরু বুঝি শুনল। মাথাটা আরও কয়েকধাপে নত করল। অয়নের পীড়িত হৃদয় উপলব্ধি করছে যেন। তন্ময় ছাদের দরজায় হেলান দিয়ে দাঁড়িয়ে আছে। বুকে দু'হাত বেঁধেছে আমোদেই। ঠোঁট বেঁকিয়ে —ভ্রু তুলে দেখছে দু'জনের নিপুণ কাণ্ডকারখানা। অরু তখনো চোখ বুজে মিথ্যে বলেকয়ে অয়নকে আশ্বস্ত করতে ব্যস্ত,

‘ভাইয়া, আপুও খুব করে আসতে চাচ্ছিল। খুব করে বিশ্বাস করো। বারবার করে বলছিল— পরিস্থিতির জন্য যেতে পারছি না। নাইলে আমি এক্ষণ যেতাম। সত্যি। তুমি কষ্ট পেয়ো না।’

অয়নের মুখের রঙ পাল্টাল। ভোঁতা মুখ কুঁচকে এলো। এমন কথা বলবে শাবিহা? তার শাবিহা? যে চব্বিশ ঘণ্টা তেইশ ঘণ্টাই তার থেকে পালিয়ে বেড়াতে ব্যস্ত! অরুকে বাঁকা চোখে দেখে অয়ন বলল,

‘এই কথা না বললেই বুঝি ভালো ছিল!’

বলতে-বলতে অয়ন আনমনা চোখ তুলে চাইল অরুর ঠিক পেছনে। তন্ময়কে আবছায়া—আগন্তুক হিসেবে দেখেও সে চিনে ফেলল এক পলকে। নিঃশব্দে ফাঁকা হাসল কোনোরকমে। ধড়ফড়িয়ে ওঠা বুকেরপাটা ছুঁয়ে এক দৌড়ে নেমে গেল। সালাম দেবার প্রয়োজনবোধটুকুও করল না। ধমক খাওয়ার ইচ্ছে আপাতত তার নেই। ডালা হাতে অরু আতঙ্কিত নয়নে অয়নের চলে যাওয়ার দিকে চেয়ে আছে। ভূতের ভয়ে তার মেরুদণ্ড বেয়ে ভয়ের স্রোত বয়ে গেল। গলা ধরে আসলো। ভয়ে আঁটসাঁট হলো সর্বাঙ্গ। ভীত সে চমকে পেছনে তাকাল বড়ো বড়ো চোখে। এই বুঝি উচ্চস্বরে চিৎকার দিয়েই উঠবে। কিন্তু না, সবশেষে তন্ময়কে দেখতে পেয়ে— ততক্ষণাৎ খোলা মুখ বন্ধ করে নিলো। ডান হাতে ধড়ফড়ানো বুক চেপে বলল,

‘এভাবে কেউ দাঁড়িয়ে থাকে? আমি ভয় পেয়ে গেছি।’

অরুর এলোকেশী চুল কপাল ছুঁয়ে আছে। ফরসা দু'গালে মিষ্টি করে হলুদ লাগানো। চাঁদের আলোয় সুন্দর দেখতে লাগছে। তন্ময় এগুতে এগুতে গম্ভীরমুখে শুধাল, ‘একাই উঠে এসছিস তখন ভয় করেনি?’

গম্ভীর কণ্ঠ শুনে অরু সতর্ক হলো খানিক। ভালো করে তন্ময়কে দেখে নিলো। মিনমিন স্বরে সাফাই গাইতে বলল, 

‘ভয়ের কী আছে? ভূত বলতে কিছুই নেই তো। আমি ভাইয়াকে হলুদ দিতে এসেছি জাস্ট।’

অরুর খুব কাছাকাছি এসে থামল তন্ময়। ওর কপালে আঙুল দিয়ে গুঁতো মেরে প্রশ্ন করল,

‘দেয়া শেষ?’

অরু প্রথমে মাথা দোলাল। ওপর-নিচ। পরপর মাথা নাড়াল। ডানে-বায়ে। নিচ থেকে তখন গানের আওয়াজ ভেসে আসছে। টুনের মতন, মৃদু। মরিচ বাতির উজ্জ্বলতা ছাদেও এসেও ভিড়েছে যেন। সকলের হৈ-হুল্লোড় কর্ণগোচর হচ্ছে একটু-একটু করে। দীপ্ত কিছু একটা নিয়ে আলোড়ন সৃষ্টি করছে। খুব উচ্চ স্বরেই। তার সাথে মোস্তফা সাহেবের প্রাণোচ্ছল হাসির ধ্বনিও মিশে আছে। আশ্চর্য! অরু ওপরে এলেই কেনো তাদের আনন্দ, উল্লাসে মত্ত হতে হবে? ওদের এমন রঙ্গতামাশা দেখে অরু নিচে যেতে ব্যাকুল হয়ে ওঠে। দ্রুত গলায় বলে,

 ‘না। ভাইয়া তো নিলো না। চলুন নিচে যাই।’

অরু দুরন্ত কদমে তন্ময়কে পাশ কাটিয়ে চলে যেতে ব্যাকুল রয়। ওর মনমস্তিষ্ক সব আপাতত নিচে ঘটিত নাচগানের ওপর। তন্ময় অবলীলায় ওর চঞ্চল ডান হাতটা টেনে ধরে। এক ফিচেল টানে দাঁড় করায় ছাদের প্রাচীর ঘেঁষিয়ে। কণ্ঠ নামিয়ে প্রশ্ন করে,

‘দু’গালে ঘন করে হলুদ লাগিয়ে দিয়েছে কে?’

অরু গাল ফোলায়। আড়চোখে নিচে চায়। কলি আর মারজি নাচ শুরু করেছে, ‘ঢোল বাজে’ গানটিতে। সবাই জড়সড়ভাবে গোল হয়ে দাঁড়িয়ে আছে। কড়োতালি দিয়ে নাচ দেখছে। অরু ব্যগ্র গতিতে জানায়,

‘মারজি দিয়েছে। ওরা নাচছে। দেখব। আমি নিচে যাই। আপনি আসুন।’

অরু ফের যেতে উতলা হয়। তন্ময় বিরক্ত হয়। বাঁধ সাধতে সামনে এসে দাঁড়ায়। গভীরভাবে। অরুর মাথাটা এসে ছুঁয়েছে তার বুক। ডান হাতে অরুর গাল দুটো চেপে বলে,

‘এমনভাবে হলুদ মাখিয়ে দিয়েছে যেন গায়ে হলুদ তোর হচ্ছে।’

অরু মাথা তুলে চাইল। খেয়াল করল তন্ময়ের পরিষ্কার মুখখানা। আশ্চর্য হলো সে,

‘আপনাকে মাখেনি হলুদ? সবাইকেই তো জোরপূর্বক মাখানো হলো। আপনি কোথায় ছিলেন?’

তন্ময় হাসি চাপিয়ে বলে, ‘কার সাহস আমাকে মাখানোর?’

অরু ভেংচি কাটে, ‘সাহসের কি আছে এখানে?’ 

বলেই ডান হাত ভরে হলুদ নিলো বাটি থেকে। তন্ময়ের গালে লাগাতে দ্রুত হাত বাড়াল। তবে শেষমেশ গাল ছুঁতে পারল না। তন্ময় চঞ্চল নরম হাতটা নিজের হাতের মুঠোয় ভরে নিলো নিমিষেই। চ্যাটচ্যাটে হলুদে মেখে গেল নিজ হাতেও। অরু চোখ ছোটো করে চেয়ে আছে। মুখ ভোঁতা। কণ্ঠ গম্ভীর… 

‘লাগাতে হবে না। সরুন —আমি নিচে যাব।’

তন্ময় অসন্তোষ হলো বড্ড, ‘এমনিতে তো বেশ আরোপ লাগিয়ে বেড়াস—আমি কাছে থাকি না, কথা বলি না। আর এখন যে পালাতে উতলা হয়ে আছিস।’

গান পরিবর্তন হয়েছে। বর্তমানের সুবিখ্যাত একটি আইটেম গান চলছে। ওটায় হয়তোবা কেউ নাচছে। মজলিশ আরও গরম। চেঁচামেচি বৃদ্ধি পেয়েছে। অরুর বুকের পাখিটা উত্তেজনায় তখন দিশেহারা। সে এক্ষণ নিচে যাবেই যাবে,

‘উফ! সরুন রে বা….’

তন্ময়ের হলুদে মাখোমাখো শীতল হাতটা অরুর উষ্ণ কোমর ছুঁয়ে দিতেই মেয়েটা চুপসে গেল কেমন। চঞ্চল চোখজোড়া থমকাল। বাক্যের পূর্ণতাও মিলল না। গড়গড় করে চলতে থাকা মুখটা আচমকাই বন্ধ হয়ে গেল। অনুভব করল তন্ময়ের শীতল পুরুষালি রুক্ষ হাতটা পেটে বিচরণ চালাচ্ছে। হলুদে মাখামাখি কাণ্ড। অরু শক্ত করে চোখ বুঝে নিয়েছে। থরথর করে কাঁপুনি ধরেছে ওষ্ঠজোড়ায়। তন্ময় নিগূঢ় দৃষ্টিতেই দেখল হলদে মুখখানা। আরেকটু গভীর হয়ে ধীর গলায় বলল,

‘সরব না। কী করবি? হুম?’

বলতে বলতে তন্ময় নিজের খোঁচাখোঁচা গাল ঘষে দিলো অরুর তুলতুলে নরম ডান গালে। সেই স্পর্শে কেঁপে ওঠে সরে যেতে চাওয়া মেয়েটাকে সে দু'হাতে জাপ্টে ধরে। বিন্দুমাত্র নড়তে দেয় না, সরতে দেয় না। একেএকে ওর বাম গালেও গাল ঘষে দেয় গাঢ় স্পর্শে। খোঁচা দাড়ির দৃঢ় স্পর্শে অরুর শরীর শিথিল হয়। গাঢ় হলুদ তন্ময়ের দু’গালেও স্থান পেয়েছে। অরুর হাত দুটো তন্ময়ের পাঞ্জাবির বুকপকেট মুষড়ে ধরা ছিল। সেখানে গাঢ় করে দাগ ভেসেছে হলুদের। একরঙা পাঞ্জাবি একপ্রকার কুঁচকে গিয়েছে মুষড়ে ধরায়। ঘনঘন গরম শ্বাস ফেলা অরু নড়েচড়ে ওঠে। ভুলে বসে নিচের উদ্যম আয়োজন। চোখ মেলে চায়। তন্ময়ের দু’গালের হলুদ এক অদ্ভুত সৌন্দর্য এসে জমিয়েছে তার সুদর্শন মুখটিতে। বেশ সুন্দর দেখাচ্ছে তো। অরু দু'পা তুলে আচমকাই তন্ময়ের ডান গালে চুমু বসায়। তন্ময় মুহূর্তেই তেড়ে গিয়ে মিশে যায় অরুতে। ঠোঁটে ঠোঁট ছোঁয়ায় উদ্বিগ্ন রূপে। ডুবে যায় অতলে। অরুর হাতের ডালাটা জমিনে পড়ে গিয়েছে। একেকটি জিনিসপত্র কর্কশ শব্দ তুলছে নিস্তব্ধতার মধ্যে। শীতল রাতের কুয়াশাচ্ছন্নতা বাড়ছে বলে মনে হচ্ছে। বাতাসের তীব্রতা কী বৃদ্ধি পেলো? কেমন শাঁ শাঁ ধ্বনি ভাসছে। অরু একপর্যায়ে ধড়ফড়িয়ে ছাড়া পেতে ব্যাকুল হয়। অনুভব করে আরও গভীর স্পর্শ, উন্মাদ চুমু। এই অস্থিরতা যেন এই ঠান্ডা রজনিও নেভাতে ব্যর্থ। 
.
.
.
চলবে......................................................

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন