চা নিয়ে এসে থমকে দাঁড়ালাম। জানালা দিয়ে সকালের সূর্যের সোনালী আলো এসে পড়েছে রৈনীলের মুখে। সে হাসছে, কথা বলছে। এমন আলোয় ওকে বড্ড স্নিগ্ধ লাগছিল। কয়েক সেকেণ্ড স্থির হয়ে ওর দিকে তাকিয়ে রইলাম। তার চেহারায় আগের তুলনায় কিছুটা বয়সের ছাপ পড়েছে। তবে এই ছাপ কিছুতেই ওর সৌন্দর্য এতটুকুও কমাতে পারেনি। এই কয়েক বছরে রৈনীল যেন দেখতে আরও দুর্দান্ত হয়ে উঠেছে।
'চা খাওয়াবে না ভাবছো নাকি?'
'না না সেরকম কিছু নয়।'
আমি এগিয়ে এসে চায়ের কাপ তুলে দিলাম তার হাতে। রেজওয়ান ভাই আবারও এসেছিলেন, কথা বলা শেষ না করেই উনি চলে গেলেন আমাদেরকে কথা বলার সুযোগ দিয়ে। চা খাওয়ার ফাঁকে খেয়াল করলাম অনেকেই উঁকিঝুঁকি মারছে আমাদের কথোপকথন দেখা বা শোনার জন্য। তারমানে রেজওয়ান ভাই ইতিমধ্যেই এই তথ্যটা অফিসে প্রচার করে দিয়েছেন!
রৈনীল বললো, 'অসম্ভব মজা হয়েছে চা' টা। থ্যাংকস সরণী।'
'ওয়েলকাম। চা খেয়ে আপনি আপনার কাজে যাবেন। ঠিক আছে?'
'ঠিক আছে। মহারানী যা বলবেন।'
'একটা বিষয় খেয়াল করলাম কি জানেন? আপনার কথা বলার ধরণে আশ্চর্য রকমের পরিবর্তন এসেছে। আপনি আগে এমন দূরন্ত স্বভাবের ছিলেন না। এটা কবে থেকে?'
'গতকাল তোমাকে দেখার পর থেকে। বলতে পারো শুধু তোমার জন্য চার্মিং মুড অন হয়েছে।'
'বাহ, ভালোই তো। আর আমার ক্ষেত্রে উলটো।'
'তোমারও অন হয়ে যাবে। ঘোর কাটলেই।'
চা খাওয়া শেষ করেই রৈনীল উঠে দাঁড়ালো। কাছাকাছি এসে চায়ের কাপটা টেবিলে রাখতে রাখতে আমার চোখের দিকে তাকালো সে। আমি বাকরুদ্ধ হয়ে পড়লাম।
সে বললো, 'অফিস শেষ করে গ্রামের দিকে ঘুরতে যাবো। কেমন?'
'হুম।' ঝোঁকের বশে বলে ফেললাম।
রৈনীল মিষ্টি হেসে সোজা হয়ে দাঁড়ালো। তারপর বললো, তাহলে এখন গুডবাই। সাবধানে থেকো।
বের হয়ে গেলো সে। রেজওয়ান ভাইয়ের গলা শোনা গেলো। হয়তো ওনার রুমে রৈনীল কাজ সারবে এখন। সে আশেপাশে আছে ভেবেই ভালো লাগছে আমার। আবার একইসাথে বেশ অস্থির লাগছে। জানিনা আদৌ কাজে মন বসবে কি না!
মনে পড়ে গেলো চার বছর আগের একটা দিনের কথা। সেদিন প্রচণ্ড ঝড়বৃষ্টি। বিদ্যুৎ নেই। আমি আমার রুমে শুয়ে আছি। অকারণেই ঘুম আসছিলো না। আমি কল্পনায় রৈনীলকে আনার চেষ্টা করলাম। হঠাৎ টের পেলাম সে যেন আমার একদমই কাছে! ঠিক যেন আমার মাথার কাছে বসে ফিসফিস করে গল্প বলছে আর আমার মাথায় হাত বুলিয়ে দিচ্ছে। ওর গল্প শুনতে শুনতে আমার ঘুম লেগে গিয়েছিলো। আমার কল্পনায় সেবারই প্রথম রৈনীলকে অত কাছ থেকে অনুভব করি। ধীরেধীরে সে যেন আমার আরও কাছের মানুষ হয়ে ওঠে। রৈনীলকে সবসময় মিস করতাম আমি। খুব করে চাইতাম একদিন দেখা হোক। কোনো না কোনো ভাবে প্রকৃতি যদি আমাদেরকে এক করে দিতেন!
অথচ ঠিক তার কয়েকদিন পরেই আমার মা কোথ থেকে একজন পাত্র ধরে এনে আমার সঙ্গে দেখা করিয়ে দিলেন! এবারে মা বাবা দুজনেই বিয়ের জন্য সিরিয়াস।
সেবার মায়ের সঙ্গে আমার বড় ধরনের বাক বিতণ্ডা হলো। খুব রাগ হয়েছিলো আমার। নিজের সবকিছু হারিয়ে আমি এমনিতেই নিঃস্ব বোধ করতাম। আমি কোনোভাবেই সেইমুহুর্তে বিয়ের জন্য প্রস্তুত ছিলাম না। তাছাড়া আমার কল্পনা জুড়ে তখন কেবলই রৈনীলের বাস। আমি পড়াশোনা আর রৈনীলের কল্পনা এই দুই নিয়েই সময় কাটাচ্ছিলাম। মায়ের সঙ্গে কথা বলা বন্ধ করে দিলাম সেবার। কয়েকদিন পরে বাবা এসে বোঝালেন, মায়ের সঙ্গে এভাবে রাগ করা উচিৎ হয়নি। আমি যেন মায়ের কথামতো ছেলেটার সঙ্গে দেখা করি।
বাবাকেও তখন খুব অসহ্য লেগেছিল। তাদের অনুরোধে আমি সেই ছেলেটার সঙ্গে দেখা করলাম। ধীরেধীরে আমাদের মধ্যে যোগাযোগ তৈরি হলো। ছেলেটাই বারবার দেখা করতে আসতো, ফোনে কথা বলতে চাইতো। একটু একটু করে রৈনীলের ভাবনা থেকে দূরে সরে আসতে লাগলাম।
একদিন স্বাগতা আপুর কাছে শুনলাম, রৈনীল ইউরোপ চলে গেছে। হঠাৎ করে পুরো পৃথিবীটা আমার দুলে উঠলো। আমাকে একবার জানালো না পর্যন্ত! অবশ্য জানাবেই বা কেন? আমি তো একাই তাকে নিয়ে স্বপ্ন বুনি। সে তো আর আমার ছিলো না তখন।
- এতদূর পর্যন্ত মনে পড়তেই আমি অবাক হলাম। সে তখনও আমার ছিলো। অথচ তা আমার অজ্ঞাত। কোনো এক বিচিত্র কারণে রৈনীল তখন আমাকে কারণটা জানায় নি। কিংবা হতে পারে রৈনীল জানাতে চেয়েছিলো, আমার সঙ্গে যোগাযোগটা হয়ে ওঠেনি তার। বিকেলে দেখা হলে আমি অবশ্যই এই ব্যাপারে জানতে চাইবো।
**
ভাবনা বাদ দিয়ে অফিসের কাজে মন দিলাম। অনেক্ষণ পরে রেজওয়ান ভাইয়ের রুমে রৈনীলের আর কোনো গলার স্বর শুনতে না পেয়ে নিশ্চিত হলাম সে চলে গেছে। এরপর পূর্ণ মনযোগ দিয়ে অফিস সময়টা পার করলাম আমি। বিকেলে দেখা হলে আজ অনেক প্রশ্ন করবো তাকে।
অফিস শেষ করে হেঁটে হেঁটে বাসার দিকে ফিরছিলাম। একজন কলিগ আপুর সঙ্গে দেখা হলো। আপু রিকশায় যাচ্ছিলেন। আমার কাছাকাছি আসতেই রিকশা থামিয়ে বললেন, তোমার বয়ফ্রেন্ড অনেক ড্যাশিং।
আমি মুচকি হেসে বললাম, থ্যাঙ্কিউ।
আপুর রিকশা আবারও দ্রুত পার হয়ে গেলো। রিকশা চোখের আড়াল হতেই আমি আপন মনেই হেসে উঠলাম। শেষ অবধি রৈনীল আমার হলো! এখন থেকে আর তাকে নিয়ে কল্পনা করতে হবেনা আমার। কক্ষনো না! কল্পনার আগেই সে এসে হাজির হবে। ভাবতেই সর্বাঙ্গে শিহরণ বয়ে গেলো। চোখ তুলে দেখলাম রাস্তার পাশে রৈনীল দাঁড়িয়ে! কল্পনার আগেই এসে প্রস্তুত।
আমি মুচকি হেসে বললাম, 'আমাকে না জানিয়ে চলে গিয়েছিলেন কেন?'
'কাজে বিঘ্ন ঘটবে তাই।'
'ইউরোপে চলে গিয়েছিলেন কেন?'
রৈনীল হাঁটা বন্ধ করে দিয়ে আমার দিকে তাকালো। আমি ওর চোখে চোখ রেখে বললাম, উত্তর দিন। এটার জন্য অন্তত ধৈর্য ধরতে বলবেন না। আমাকে যদি তখনও আপনার ভালো লাগতো, তবে আমাকে না জানিয়েই আপনি ইউরোপে কেন গিয়েছিলেন?
রৈনীল গম্ভীর মুখে বললো, 'একদিন ভার্সিটিতে গিয়েছিলাম তোমার সঙ্গে দেখা করতে। ফারাহ'র সঙ্গে অপেক্ষা করছিলাম। তারপর দেখলাম একটা ছেলে তোমাকে ফুল দিয়ে কিছু বলছে আর তুমি হাসছো। ফারাহ জানালো ওর সঙ্গে তোমার বিয়ে ঠিক হয়েছে। তাই আমি আর কথা বলিনি। ফিরে এসেছিলাম।'
খুব আশ্চর্য হয়ে গেলে মানুষ কথা বলতে ভুলে যায়। আমার হলো সেই দশা। তাই বলে ফারাহও আমাকে জানায়নি কিছু! রৈনীল গিয়েছিল সেটা জানার পরে আমি কখনোই ওর থেকে আড়ালে থাকতে পারতাম না। ওইসময়টাতে রৈনীলকে এতটাই আপন করে নিয়েছিলাম যে, সামনে এসে দাঁড়ালে নির্ঘাত জড়িয়ে ধরে কেঁদে ফেলতাম। অথচ সে আমার সামনে থেকেই চলে এসেছে!
আমাকে হতবাক হয়ে থাকতে দেখে রৈনীল বললো, 'ফারাহ বলেছিলো ততদিনে তুমি ভালোই স্ট্রং হয়ে গিয়েছো। ফারাহর সঙ্গে নাকি আমাকে নিয়ে কথাবার্তা পর্যন্ত কখনো বলো না। এরপর যখন হাসিমুখে ছেলেটার সঙ্গে দেখলাম, মনে হলো ভালোই তো আছো। এমনিতেও আমাদের সম্পর্কের কোনো পরিণতি নেই। তারপর আমিও বয়সে তোমার চেয়ে অনেক সিনিয়র..'
আমি ফট করে মুখ খুললাম, 'পরিণতি নেই বলতে?'
রৈনীল হাঁটা শুরু করে বললো, 'আমি তো তখন বিয়ে নিয়ে সিরিয়াস ছিলাম না। মানে প্রস্তুত ছিলাম না আরকি। তোমার ফ্যামিলি বিয়ের কথা বললে আমার পক্ষে তখন বিয়ের মত দেয়া সম্ভব হতো না।'
'আর এখন?'
থমকে দাঁড়ালো রৈনীল। আমার দিকে তাকিয়ে মুচকি হেসে বললো, 'এখন তো নিজেকে পুরোপুরি তোমার কাছে সমর্পণ করে দিয়েছি। তুমি যা বলবে তাই।'
আমার হৃদয়ে ভিন্নরকম এক আনন্দের দোলা এসে লাগলো। অন্যদিকে তাকিয়ে মুচকি হাসলাম। রৈনীল হাঁটা ধরলো। পাশাপাশি হাঁটছি আমিও।
বিকেলের এই অস্তমিত সূর্য, চারদিকে ছড়িয়ে পড়া সোনালী আভা, আর গ্রামের নিজস্ব বাতাসে দোল খেতে খেতে আমরা হাঁটতে লাগলাম। চারপাশে যেদিকেই তাকাই, সবই ভালো লাগে। হয়তো রৈনীল পাশে আছে বলে!
সরু রাস্তা ধরে হাঁটতে হাঁটতে একটা টং দোকান পেয়ে গেলাম। টংয়ের ওপর কেউ নেই। বসলাম দুজনে। সেই প্রথমদিনের কথা মনে পড়ে গেলো। জীবনে প্রথমবার ফুটপাতে চা খেয়েছিলাম রৈনীলের সঙ্গেই। আমি ভেতরে ভেতরে হাসছি অথচ বাইরে তার প্রকাশ ঘটাতে পারছি না। রৈনীলকে পেয়ে আমি কতটা আনন্দিত, তা ওকে দেখাতে চাইনা বলে।
চা খাওয়া শেষে রৈনীল বললো, রাত প্রায় হয়ে আসছে। তুমি বাসায় চলে যাও। নাকি আমিও যাবো?
আমার খুব বলতে ইচ্ছে করলো, আপনিও চলুন। কিন্তু সেটা বললাম না। চুপ করে রইলাম।
রৈনীল বললো, 'আমি আগামীকাল ঢাকায় ফিরে যাবো।'
এবার চমকে উঠলাম। মনেমনে বললাম, এত তারাতাড়ি!
রৈনীল তবুও উত্তর দিলো, আবার খুব দ্রুতই আসবো। আর হারাবো না। কথা দিলাম।
আমি স্মিত হেসে বললাম, কাল তো শুক্রবার। সকালে একসঙ্গে নাস্তা করি? আসবেন?
'হুম। কোথায় আসবো?'
'বাসায়। কোথায় আবার? এখানে রেস্টুরেন্ট কোথায় পাবেন?'
'ঠিক আছে। আসবো।'
বাসায় ফিরতে ফিরতে আমার মনটা উৎফুল্ল হয়ে উঠলো। এই খুশিটুকু এতক্ষণ ওর সম্মুখে প্রকাশ করতে পারছিলাম না। ঘরে ঢুকেই আনন্দে ধেইধেই করে নাচতে লাগলাম। এদিক সেদিক ঘুরে ঘুরে শুধু আনন্দ উল্লাস করতে করতে একসময় ক্লান্ত হয়ে শুয়ে পড়লাম বিছানায়। আহ, রৈনীল আমার হলো, অবশেষে!
.
.
.
চলবে........................................................................