প্রাণোদাহ - পর্ব ০৪ - নবনীতা শেখ - ধারাবাহিক গল্প


-“প্রয়োজনে তানিশাকে তালাক দেবো। তবু আপনারা আমাকে প্রীতি দেন।”

সদ্য বাড়ির আঙিনায় গোবর পাড়িয়ে প্রবেশ করা প্রীতি সঙ্গে সঙ্গে পায়ের জুতাটা ছুড়ে মারল রাকিবের দিকে। উড়ন্ত জুতো এসে লাগল রাকিবের মুখ বরাবর। একটা পড়তে না পড়তে প্রীতি আরেক জুতোও ছুঁড়ে মারল। এটাও মুখে লাগতেই প্রীতি চেঁচিয়ে উঠল, 
-“শালা খাইষ্টার খাইষ্টা, গু খা।”

গোবরের গন্ধে রাকিবের বমি চলে এলেও, প্রীতিকে দেখে তার অবাক হওয়া আর জুতোকর্মের বিস্ময় সেই বমিটাকে উলটো রাস্তা দিয়ে পেটের ভেতরে চালান করে দিলো। রাকিবের মা পৌমি এসে দ্রুত গামছা দিয়ে ওর মুখ মুছে দিয়ে বলল, 
-“এটা কী করলি, প্রীতি? ওকে এভাবেও তো বোঝানো যায়। ভেতরে এসে বোস, মা।”
-“তোমার ছেলে বোঝানোর জাত? এমন বদের বদ কীভাবে বানিয়েছ, খালা? কী খেয়ে বানিয়েছ? অমাবস্যার রাতে একশত একটা ব্যাং চিবিয়েছিলে?”

পৌলি প্রীতিকে ধরে ভেতরে আনলেন। ওর নানা সোরহাব উদ্দীন বললেন, 
-“হারামজাদার কথাগুলা গোবরজুতাই চাইতেসিলো। ঠিক হইছে। বু, এনে বয়। আমার লগে।”

প্রীতি গিয়ে নানার পাশে বসল। আর একটা কথাও বলল না। কটমটে চোখে তাকিয়ে রইল রাকিবের দিকে। চাহনি এমন যেন, “এ রাকিব্যা, তোর ওই কুকুরছাওয়ের মতো মুখখানা দিয়ে যদি আমার অপছন্দের একটা কথাও বের হয়, নেক্সটে গোবর সোজা পেটে চালান করে দেবো।”

রাকিবও প্রীতির দিকে তাকিয়ে আর কিছু বলার সাহস পেল না। তাকে বুঝিয়ে-শুনিয়ে তানিশার সাথেই সংসার করতে বলা হলো। এমনিতে মানিয়ে নিলে তানিশা খুব একটা খারাপ মেয়ে না।

প্রীতি দুপুরের খাওয়া শেষে মায়ের সাথে বাড়ি ফিরল। পথিমধ্যে লক্ষ করল, পৌলি তার সাথে কথা বলছেন না। কেমন যেন নিষ্ক্রিয়তা দেখাচ্ছেন। প্রীতি দু-বার ডাকল তাকে। কোনো সাড়া এলো না। প্রীতি আবারও ডাকল,
-“মা? রেগে আছো?”

পৌলি বললেন, 
-“এত বাড় বেড়েছ ভাবতেই মাথায় আগুন জ্বলছে আমার। কথা বোলো না।”

প্রীতি মলিন গলায় বলল,
-“মা, আমি সত্যি কিছু করিনি।”

বাড়ির ভেতরে এসেই পৌলি ধমকে উঠলেন,
-“চুপ করো। কিছু করোনি? দুই আঙ্গুলের মেয়ে নও, নাগর জোটাও। প্রেম করার বয়স হয়েছে তোমার? আশ্চর্য!”

প্রীতির চোখ ছলছলই করে উঠল। এদিক-ওদিক তাকাল না আর। সিঁড়ি বেয়ে সোজা নিজের রুমে চলে গেল। তারপর বালিশে মুখ গুঁজে অনেকটা সময় নিয়ে কাঁদল, কাঁদতে কাঁদতে ঘুমিয়ে পড়ল। 

সোয়া চারটার দিকে নক্ষত্র এলো। আমেনার মা এসে প্রীতিকে বলল,
-“স্যের আইসছে, আম্মা। উঠি পড়ো।”

প্রীতি ঘুম জড়ানো গলায় বলল,
-“ওহ, উঠি। তুমি যাও, খালা।”

আমেনার মা চলে যেতেই, প্রীতি লাফিয়ে উঠে আয়নার সামনে দাঁড়াল। দু'চোখ ডলে নিজেকে ভালো করে দেখল। গায়ের সাদা রঙের জামাটা এলোমেলো হয়ে ভাঁজ পড়ে আছে, চুলগুলোয় জট পড়েছে, মুখ ফুলে তো তাকে চেনাই যাচ্ছে না! প্রীতি জলদি চিরুনি করল চুলে, জট যেন ছিঁড়েও শান্ত হলো না, জট ছাড়ল না। উপায়ন্তর না পেয়ে প্রীতি চুলগুলো খোঁপা করে মাথার ওপরে বেঁধে ফেলল।

সিঁড়িতে খটখটে শব্দ পেতেই বিছানায় পড়ে থাকা ওড়নাটা গায়ে নিয়ে চেয়ার টেনে বসল। দরজায় নক পড়ল। প্রীতি বলল,
-“আসুন।”

নক্ষত্র ভেতরে এসে চেয়ার টানতেই প্রীতি সালাম দিলো। নক্ষত্র সালামের উত্তর দিয়ে নিজের ব্যাগ থেকে কিছু শিট বের করল। পড়ানো শুরু করল। প্রীতি ঘুমে ঢুলছে। সদ্য ঘুম থেকে উঠে আধ ঘন্টা তো এটা ভাবতেই লেগে যায় যে, আমি কে? কোত্থেকে টপকেছি? কোথায় এসে টপকেছি? সেখানে বিছানা থেকে উঠিয়ে এনে বইখাতার সামনে বসিয়ে পড়ানোটা রীতিমতো জুলুম। সেই জুলুমটা প্রীতির সাথে হচ্ছে। বয়স সতেরো তার। আন্ডার এইজড, তার মানে শিশু। অর্থাৎ শিশু নির্যাতন হচ্ছে।

-“দুটো মানুষের প্রথম বাচ্চা গোরু হয়, দ্বিতীয় বাচ্চা হয় ভেড়া, তৃতীয় বাচ্চা টিকটিকি আর একমাত্র বাচ্চা হয় ছাগল। যেমন তুমি। ঠিক না?”
 
অন্যমনস্ক প্রীতি নক্ষত্রের প্রত্যুত্তরে মাথা নাড়ল, ঠিক। পরমুহূর্তেই মাথা ঝাঁকাল। বড়ো বড়ো চোখে তাকাল নক্ষত্রের দিকে। প্রশ্ন করল আনমনে,
-“ঠিক বুঝতে পারিনি, স্যার। আবার বলবেন, প্লিজ?”
-“মনোযোগ কোনদিকে?”
-“অন্যদিকে ছিল।”
-“কেন?”

প্রীতি আচমকা ঠোঁট চেপে হাসল,
-“আপনি আবারও পড়ানো শুরু করুন, স্যার। এবার সব মনোযোগ আপনার দিকে রাখব, আই প্রমিস।”

নক্ষত্র পড়াতে লাগল আর প্রীতি তার চোখ, চোখের মণির বিক্ষিপ্তভাবে দিক পরিবর্তন, ঠোঁটের আকৃতির সংকীর্ণতা, প্রসারিত শব্দগুচ্ছ সব সব সবকিছু গভীরভাবে লক্ষ করতে লাগল। প্রীতির সব ভালো লাগছে এখন। 

পড়ানো শেষে নক্ষত্র জিজ্ঞেস করল,
-“ঘুমোচ্ছিলে?”

প্রীতি মাথা নাড়ল,
-“হ্যাঁ, স্যার। ঘুমাচ্ছিলাম।”
-“অবেলায়?”
-“আমার এমন টাইমে ঘুম পায়।”
-“তাহলে পড়ানোর টাইম চেইঞ্জ করি?”
-“উম্ম.. আপনার সুবিধামতো পড়াতে আসুন। আমার সমস্যা নেই।”
-“সন্ধ্যায় ফ্রি?”
-“হ্যাঁ, মোটামুটি ফ্রি।”
-“সাড়ে ছয়টায় আসব। হু?”
-“আচ্ছা।”

নক্ষত্র চলে গেল। প্রীতি সেদিক থেকে চোখ সরিয়ে আজকের পড়াগুলো দেখতে লাগল। নক্ষত্র যেই নোটবুকে পড়া বোঝায়, সেটা উলটিয়ে-পালটিয়ে দেখতে লাগল, কী কী ফর্মুলা কীভাবে করিয়েছে।

তন্মধ্যে এক কোণায় দুটো শব্দ লেখা,
-“চন্দ্রচোক্ষে অমানিশা!”

______  

“লাগ যা গালে, কে ফির ইয়ে
হাসিন রাত হো না হো।
শায়েদ ফির ইস জনম মে
মুলাকাত হো না হো...
লাগ যা গালে...”

প্রীতি গান গাইতে গাইতে হাঁটুতে মাথা এলিয়ে দিলো। আজ পূর্ণচন্দ্রের রাত। আশকোনার জলে ঢেউ খেলে যাচ্ছে চাঁদের আকৃতি। সেদিকে তাকিয়ে প্রীতি গান গাইতে লাগল। আচমকা বাঁশির ধ্বনি থেমে যেতেই প্রীতি ফিক করে হেসে ফেলল। লোকটার সিগারেটের সময় হয়ে গেছে। দোকানি আবদুল কাকা চা নিয়ে এসে প্রীতিকে বললেন, 
-“এই যে আম্মু, তোমার চা!”

প্রীতি মুচকি হেসে কাপটা নিয়ে বলল, 
-“আজকাল না বলতেই সব পেয়ে যাচ্ছি! ভাগ্য পরিবর্তনের মৌসুম চলছে নাকি, কাকা?”
 
আবদুল কাকা হাসলেন,
-“প্রতিটা মুহূর্তেই কারো না কারো ভাগ্য পরিবর্তন হয়। ধরে নাও এই সময়টা তোমার।”

তিনি চলে যেতেই বাঁশিওয়ালা বেশ জোরে শোরেই বলে উঠল,
-“সময়ের কাটা ফের ঘুরে যায়।”

প্রীতি কপাল কুঁচকে হাসল,
-“নেভার মাইন্ড। আমি অপেক্ষা করব। যা কিছু পাইনি, যা-ই বা হারিয়েছি, তাতে আমার আফসোস নেই। কেননা আমি জানি, পরেরবার যা পাব—তা আমার ব্যথা ভুলিয়ে দেবে গোড়া থেকে।”

বাঁশিওয়ালা সিগারেটের শেষটান দিলো। সম্মুখে ধোঁয়া নিয়ে হাসল, চোখ বন্ধ করে ফিসফিসিয়ে বলে উঠল,
-“পরবর্তী কদমমাত্র মৃত্যু থাকতে পারে জেনেও, কী করে যে বান্দাগুলো এত এক্সপেকটেশন রাখে!”

প্রীতি আজও বাড়ি ফিরল পোনে দশটায়। সে কখনো বাঁশিওয়ালাকে দেখার ইচ্ছে রাখে না, কখনো এটা-সেটা নিয়ে আলোচনায় আসতে চায় না। ব্যাপারটা এমন, ভীষণ রকমের স্নিগ্ধ রাত, শুভ্র ফুলের সুবাস, চাঁদের সঙ্গ, বাঁশরীর সুর, আর মনের আনন্দে গান গাওয়াটা প্রীতি এত বেশি উপভোগ করে যে—যদি দেখে ছাপরি ধরনের লোক লাগে, তো? যদি কথা বলে মতের অমিলে মেজাজ বিগড়ে যায়, তো? এখন যেমন এত এত সুখ সবেতে, ঐশ্বরিক আনন্দ মনে, কৌতূহল ও আগ্রহের বোঝাপড়া, চোখে বিভ্রম, গানে অন্যভুবন... এগুলো প্রীতি নষ্ট করতে নারাজ। যা পাচ্ছে, যেটুকু পাচ্ছে, তাই যথেষ্ট। লোভে না এগোনোর চেয়ে, সামান্যতেই সর্বোচ্চ সুখ।

বাড়ি ফিরতেই পৌলি এসে মুখোমুখি দাঁড়াল প্রীতির। শক্ত গলায় জিজ্ঞেস করল, 
-“কই ছিলে?”

প্রীতির গলা সামান্যও কাঁপল না, দৃষ্টি দৃঢ় ভীষণ। চোখে চোখ রেখে শান্ত গলায় বলল,
-“আশকোনায়।”
-“কেন?”
-“চা খেতে।”
-“সাথে কে ছিল?”
-“একা বসে ছিলাম।”
-“মিথ্যে বলবে না।”
-“আমি মিথ্যে বলি না।”

প্রীতির অনঢ় ও দৃঢ় আওয়াজে পৌলি আর তর্ক করতে পারল না, কিছু বলতেও পারল না। যেতে দিলো তাকে নিজের রুমে। আপাতদৃষ্টিতে দেখলে লাগবে, প্রীতি মিথ্যে বলেছে। অথচ সে কোনো মিথ্যে বলেনি, অর্ধেক সত্য বলেছে কেবল।

ঘটনা ঘটল তার ক'দিন পর, কোনো এক সন্ধ্যায় আচমকা প্রীতিকে দেখতে হাজির হলো পাত্রপক্ষ। শুদ্ধভাবে বলতে গেলে হবে, পাত্র ছাড়া তার পক্ষ। সে পক্ষেরও লোক মাত্র চারজন। পাত্রের বাপ, পাত্রের মা, ফুপি আর ফুপাতো বোন। 

ছেলেরা দুইভাই। বড়োভাই লেকচারার, ছোটটা গ্র‍্যাজুয়েশন করছে। পাত্রের ফুপি আর প্রীতির আম্মাজান ছোটবেলায় সই পাতিয়েছিল, সেই সখ্য এখনো আছে। কিছুদিন আগে যখন মেয়ের অমন বাড়াবাড়িরকমের অকাজে ভীষণভাবে ব্যাকুল হয়েছিলেন পৌলি, তখনই প্রিয় সখীকে সেসব বলেছিলেন। ফলাফল আজকের বসারঘর ভর্তি লোক।

পাত্রের মা নুরনাহার বললেন,
-“আমার বড়োছেলে স্মরণের জন্য একটা বাচ্চাপুতুলের শখ ছিল। ওর বয়স তো কম, আকদ করিয়ে রাখি। পরে রিসেপশন করলেই হবে।”

পৌলি মুচকি হেসে বললেন,
-“আপা, তা-ই ভালো হয়।”

তারিখ ঠিক করা হলো তখনই, এ মাসের দ্বিতীয় শুক্রবার। প্রীতি পাথরের মতো বসে ছিল পুরোটা সময়। এরপর উঠে চলে গেল নিজের রুমে। 

সিঁড়ি দিয়ে উঠতে উঠতে প্রীতি যখন রুমের চৌকাঠে পৌঁছাল, ঠিক তখন আচমকা এই ভদ্রমহিলার চেনা চেনা মুখটা প্রীতি পুরোদমে চিনতে পারল। কার সাথে যেন মিলছিল? 
নক্ষত্র নামের যেই স্যারটা তাকে পড়ায়, হুবহু তারই মতো দেখতে না? প্রীতি সোজা রুমে ঢুকে পড়ল। দ্রুতহাতে ফোন বের করে ফেইসবুকে ওপেন করল।
কী সাংঘাতিক! আসলেই তাই। আরেকটু ঘাটাঘাটি করতেই দেখা গেল, এই টিউটরের বড়ো ভাইয়ের নাম স্মরণ। পুরোপুরি বোকা বনে গেল প্রীতি। ক্রাশের মুখে ভাবি ডাক কেমন শোনাবে? মধুর নিশ্চয়ই?
.
.
.
চলবে.........................................................

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন